#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-২৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সময় গড়িয়ে গেলো নিজের মতো। তটিনী, রুপান্তর ও মজনু এইচএসসি পাশ করে আলাদা হয়ে গেলো। তারপর এলো এডমিশন। মজনু সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে গেলো। রুপান্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো। তটিনী পাবলিকে চান্স পেলো না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে চান্স হলো তার। কিন্তু তা নিয়ে তার কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ নেই তার পরিবারেরও।
রুদ্র বিদেশে যাওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেছে। ঈদ ঘুরে ঈদ এসেছে বাংলাদেশে। এইবার ঈদের ছুটিতে তটিনী ও রুপান্তর মজনুর গ্রামের বাড়ি সিলেটে ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করেছে। তাদের সব ব্যবস্থা করা শেষ। এবার রওনা হওয়ার পালা।
সিলেটের একটি ছোট্ট গ্রামে মজিদ চৌধুরীর বাড়ি। তার দুই ছেলে মিনহাজ ও মিলাদ। মজনুর ভালো নাম মিনহাজ চৌধুরী। তারা ইতিমধ্যে খবর পেয়েছে গ্রামে পৌঁছে কাউকে যদি চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তো যে কেউ বলে দিতে পারবে। অর্থাৎ গ্রামে অনেক নাম-ডাক চৌধুরী বংশের।
মজনু বাবার টাকায় চলাফেরা করতে চায়নি। নিজের যোগ্যতায় চলতে পছন্দ করে বলে কখনো কাউকে নিজের বাবার বাড়ি-গাড়ি ধন-সম্পদের কথা বলেনি। সে যে চৌধুরী বংশের ছেলে সেটাও না। সবসময়ই সাধারণ ভাবে চলাফেরা করেছে। কারো দেখে বুঝার উপায় নেই যে সে চৌধুরী বংশের বড় ছেলে।
তটিনী ও রুপান্তর বাসে চড়ে বসেছে। বাড়ি থেকে তাদের ছাড়তে রাজি হয়নি প্রথম। কিন্তু তারা অনেক চেষ্টার পর রাজি করাতে পেরেছে। রোবা নাহার ও ঈশানীকে রাজি করাতে কম বেগ পেতে হয়নি তটিণী-কে। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে রুদ্রের দিক সামলাতে। বেচারা টেনশনে বার-বার তটিণী-র ফোনে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম তটিনী অভিভাবক ছাড়া কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। সেজন্য রুদ্রের প্রেশার হাই।
তটিনীর ফোনে রুদ্রের ফোন এলো। ইয়ারফোন কানে গুঁজে সে রিসিভ করলো। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ঠিকঠাক ভাবে বসেছো? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
তটিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
‘হ্যাঁ বাবা বসেছি। বাস ইতিমধ্যে ছেড়েও দিয়েছে।
‘তোমাদের কতো করে বললাম বাড়ির গাড়ি নিয়ে যাও।
‘আরে বাস ছাড়া জার্নিতে মজা আছে নাকি? আপনি রাখুন তো। এতো চিন্তা করে কি হবে? কেউ তো তুলে নিয়ে যাবে না। সারাজীবন তো আর আপনাদের উপর ডিপেন্ড করে চলবো না। প্রয়োজনে একাও চলতে হবে।’
রুদ্রের কন্ঠে হতাশা,
‘আমি চিন্তা করা বাদ দিলে থাকতে পারবে তো? নাকি নতুন কেউ জুটিয়ে নিয়েছো?’
তটিনী রেগে গেলো,
‘বিদেশে যাওয়ার পর থেকে সবসময়ই এমন কথা বলেন আপনি। এসবের মানে কি? আমাকে এতোই যখন সন্দেহ তো বিয়ে করেছেন কেন?’
রুদ্র হাসলো,
‘সন্দেহ করলে কি যাওয়ার অনুমতি পেতে? আর বিয়ে তোমাকে করবো না তো কি তোমার বান্ধবীকে করবো?’
রুপান্তর কান পেতে রেখেছিল। চোখ বড়বড় করে বলল,
‘এসব কি জিজু, আপনি আমাকে নিয়ে বললেন?’
রুদ্র জিহ্ব কাটলো,
‘আরে শালিকা মজা করছিলাম।’
তটিনী ফোন কেটে দিলো। রুপান্তর তটিণী-কে শাসালো।
‘বেচারা কতোদূরে থাকে। তোর জন্য চিন্তা হবে স্বাভাবিক। তাই বলে এমন করে কথা শুনাবি?’
তটিনী ফুসফুস করে উঠলো,
‘সবসময় এক কথা ভালো লাগে?’
‘কোনো বাঁধা ছাড়া সোনা পেয়ে গেছিস, সেজন্য মর্ম বুজচ্ছিস না। আমার মতো সংগ্রাম করে যদি পাইতি তো মর্ম বুঝতি। আমাকে দেখ এখনো কিছু করতে পারিনি। নিজের পরিবারকে ও জানাতে পারিনি।’
তটিনী মাথা চেপে বসে রইলো। কিছুমুহুর্ত পর মোবাইল হাতে নিয়ে রুদ্রকে বার্তা পাঠালো।
*
সুইজারল্যান্ডে তুষারপাত হচ্ছে। রুদ্র জানালা দিয়ে তুষারপাত দেখতে ব্যস্ত। তখনই তার ফোনে টুং করে শব্দ হলো। স্কিনে তটিণী-র নাম। লক খুলে মেসেজ অন করলো।
‘আর ভালো লাগে না, এতো দূরত্ব কেন? চলে আসুন না তাড়াতাড়ি। আপনাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। আপনাকে জড়িয়ে ধরতে না পারলে আমার মেজাজ ঠান্ডা হয় না। সেজন্য রেগে যা-ই। দয়া করে জলদি ফিরুন। এমন গরম মেজাজ ভালো লাগে না আর।’
রুদ্র পড়ে হাসলো। তটিণী-কে ভিডিও কল করলো। তৎক্ষনাৎ সেটা রিসিভ হলো। তটিণী হাতের ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। রুদ্র ক্যামেরা ঘুরিয়ে জানালার দিকে দিলো। স্কিনে তটিণী-র মুখে হাত। সে চোখ বড়বড় করে তুষারপাত দেখতে ব্যস্ত। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘কতো সুন্দর! সুন্দর জায়গা ছেড়ে কে-ই বা আসবে শুনি? আপনি গেছেন ওখানেই থাকুন। পারলে আমাকেও নিয়ে যান।’
রুদ্র ক্যামেরা নিজের দিকে ঘুরালো।
‘আসবে?’
তটিণী মাথা নাড়ালো।
‘পড়াশোনা?’
‘ওখানে কোথাও ভর্তি করে দিবেন।’
‘সত্যিই আসবা?’
তটিনী এবার ফুসফুস করতে লাগলো,
‘আসবো না তো কি এমনি এমনি বলেছি?’
রুদ্র শব্দ করে হাসলো।
‘নিয়ে আসবো শীগ্রই তাহলে। মিস ইউ।’
তটিণী-র এবার কান্না পেলো,
‘আপনি এমন আবেগি কথা বললে আমার কান্না পায়। এসব বলবেন না।’
রুদ্র সবসময়ের মতো হাসলো,
‘এতো ভালোবাসো?’
তটিনী মুখ বাকালো,
‘কোন দুঃখে আপনাকে ভালোবাসতে যাবো? হু আর ইউ?’
রুদ্র আঙুল দেখিয়ে ইশারা করলো,
‘আমি তোমার ওইখানে থাকি।’
তটিনী নিজের বক্ষের বাম পাশে হাত রাখলো। ধুকপুক করছে সেখানে। রুদ্র মুচকি হাসলো।
‘দেখলে তো?’ সিগনাল পেয়ে গেলে।’
রুপান্তর উঁকি দিলো স্কিনে,
‘বাসে এতো কিসের প্রেম জিজু?’ বউ হীন থাকতে পারছেন না? হায় রে।’
রুদ্র পুনরায় ক্যামেরা ঘুরালো। রুপান্তর তুষারপাত দেখে মুখে হাত দিলো।
‘ওয়াও, সো’বিউটিফুল জিজু। এতো সুন্দর!
রুদ্র ঠোঁট চেপে বলল,
‘এইরকম ওয়েদারে বউকে মিস করবো না তার কোনো মানে হয়?’
তটিনী জবাব দিলো,
‘আপনার পড়াশোনা নেই? যান পড়তে বসুন।’
রুদ্র শব্দ করে হাসলো,
‘একটা তুমি’র অভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না।’
রুপান্তর বুকে হাত দিয়ে পড়ে যাওয়ার ভান করলো,
‘হাউ রোমান্টিক।’
পেছনে বসেছেন এক বৃদ্ধ। তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে তটিনীদের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। রুদ্র সেটা দেখে ফোন কেটে দিলো। বার্তা পাঠালো,
‘রাতে ফোন দিবো।’
ঢাকা থেকে সিলেটে যেতে দশ থেকে এগারো ঘন্টা লাগে। এখন দুপুর। তটিনীরা মধ্যরাতে পৌঁছাবে সিলেটে। চিন্তার বিষয় সেটা রুদ্রের জন্য।
রুদ্র কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো। পাশে তটিনী থাকলে মন্দ হতো না। কোনো ভাবে যদি তটিনীকে এখানে নিয়ে আসা যেতো তো মন্দ হতো না। রুদ্র পকেট থেকে মুঠোফোন বের করলো। ডায়াল করলো তার বাবার নাম্বারে। দীর্ঘক্ষণ আলাপ সেরে রুদ্রের মুখে হাসি ফুটলো। পকেটে ফোন রেখে দিয়ে সে কফির মগ শক্ত করে ধরলো। ঠোঁট চেপে বলল,
‘তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তটিনী। সেটার হয়তো খুব বেশ দেরি নেই। ভাবনাটা সত্যি হতে পারে ভাবিনি কখনো। প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো জান। এই ফ্লাট, এই জানালা, এই তুষারপাত, এই দূরে দেখতে পাওয়া চেরিব্লসম আমার মতো একটা তুমি’র অভাবে ভুগছে। প্লিজ কাম ফাস্ট।’
*
রাতে মা বাবার সাথে কথা বললো রুদ্র। রোবা নাহার রাজি হলেন। তটিনী যদি একবার কয়েকদিনের জন্য যায় তাতে তাদের আপত্তি নেই কোনো। ঈশানী বা তাহের কোনো দ্বিমত করলেন না। বরং তারা খুশি হলেন। নিজের মেয়ের বিষন্ন মুখ কোনো মা বাবাই সহ্য করতে পারেন না। এবার যদি মেয়েটা মন খুলে হাসে তো তারা বাঁধা দিবে কেন।’
তটিণী-র পাসপোর্ট আগে থেকে তৈরি করা। ভিসা পেতে টাইম লাগবে হয়তো। তাহসিন ইরফান নিজের পরিচিত লোকদের বলে রেখেছেন। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তটিণী-র ভিসা রেডি হয়ে যাবে।’
রাত বারোটার দিকে রুদ্র তটিণী-র ফোনে বার্তা পাঠালো,
‘সারপ্রাইজ আছে সর্বনাশিনী। বন্ধুর বাড়ি ঘুরে ফিরে এসো। দেরি করো না যেনো।’
(চলবে)