#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-২৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
রাত একটার পর সিলেটে এসে বাস থামলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তটিনী ও রুপান্তরের গা ছমছম করতে লাগলো। রুপান্তর ঘাবড়ে দিয়ে তটিণী-র হাত শক্ত করে ধরলো। দুজনের মনে স্বস্তি দিতে ভেসে এলো মজনুর গলার স্বর।
‘তোরা এসে গেছিস?’
তটিনী ও রুপান্তর গলার স্বর অনুসরণ করে তাকালো। অন্ধকারে মুখাবয়ব তেমন স্পষ্ট না। মজনু সাথে কেউ নিয়ে এসেছে। দুজন এগিয়ে এসে দাড়ালো আরও।
মজনুর সাথের লোকটি তটিনী ও রুপান্তরের ব্যাগ দুটো নিজের হাতে নিয়ে নিলো। মজনু দুজনের দিকে তাকালো,
‘আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
রুপান্তর ঢুক গিলে বলল,
‘সমস্যা হয়নি, তবে বাস থেকে নেমে গা কেমন ছমছম করছিল।’ ভাগ্যিস তুই এলি নাহলে তো হার্ট-অ্যাটার্ক করে ফেললাম।’
মজনু হাসলো,
‘বেশি কথা না বলে আয়। গাড়িতে উঠে বস।’
তটিনী ও রুপান্তর মজনুদের গাড়িতে চেপে বসলো। মজনু বসলো সাথে আসা ড্রাইভারের পাশে। গাড়ি চলা শুরু করলো গ্রামের উদ্দেশ্যে।’
ইতিমধ্যে রুদ্রের কল এসেছে দু’বার। তিনবারের সময় তটিনী রিসিই করলো। কানে ধরতেই রুদ্রের গলা ভেসে এলো,
‘সব ঠিকঠাক?’
‘হ্যাঁ আমরা এখন মজনুদের নিজস্ব গাড়িতে করে গ্রামের দিকে যাচ্ছি।’
রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,
‘ঠিক আছে পৌঁছে একটা মেসেজ করে দিও। খেয়ে ঘুমাবে। দ্যান সকালে কথা হবে। রাখছি।’
মোবাইল ব্যাগে রেখে তটিনী গ্লাসের ফাঁক দিয়ে আশপাশ দেখতে লাগলো। গাড়ি গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করলো একটু পরই। এসে থামলো বড়বড় অক্ষরে চৌধুরী বাড়ি লেখা গেইটের সামনে। তটিনী ও রুপান্তর নেমে দাঁড়ালো। গেইট খুলে দিলো দারোয়ান। দুজন মজনুর পিছে পিছে ভেতরে প্রবেশ করলো। জমিদার বাড়ির মতো সব কারুকার্য। সদরদরজা অনেক বড়। সেখানে শাড়ি পরিহিতা এক মহিলার দুপাশে আরও চারজন মেয়ে দাড়িয়ে আছে। তটিণী-র ভাবনা অনুযায়ী সেগুলো কাজের লোক হবে।
তটিণী-রা সদরদরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। শাড়ি পরিহিতা রমনী দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। স্বাগতম জানালেন চৌধুরী বাড়িতে। দু’পাশের মেয়েগুলোর হাত থেকে শরবত এগিয়ে দিলেন।
ভারী মিষ্টি কন্ঠে বললেন,
‘প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছো, তোমাদের স্বাগতম এই গরিবের বাড়িতে মা। এসো ভেতরে এসো।’
তটিনী ও রুপান্তর এহেন সম্মান পেয়ে মুগ্ধ। মজনু পেছেন দাড়িয়ে মাথা চুলকাছে। রুপান্তর আড়চোখে তাকাতেই ঠিকঠাক হয়ে দাড়িয়ে হাসলো। দুজন ভেতরে প্রবেশ করলো তারপরই।’
তটিনী ও রুপান্তরকে একটি রুম দেওয়া হলো থাকার জন্য। বাড়িটা সকালে তারা ঘুরেফিরে দেখবে। দুইতলার দক্ষিণ দিকেই তাদের রুম। ফ্রেশ হয়ে দুজন খাবার টেবিলে গেলো। সেখানে তেমন কেউ ছিলেন না। মজনুর মা দুঃখীত হয়ে বললেন,
‘ক্ষমা করো মা, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
মজনু বসেছে রুপান্তরের পাশে। প্লেটে খাবার দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে বলছে,
‘খা খা, দেখ এটা আমাদের সিলেটের ঐতিহাসিক সাতকড়া। খেয়েছিস কখনো?’
সাতকড়া’কে তটিনী প্রথম আলু ভেবেছিল। খেয়ে মন্দ লাগলো না তার। রুপান্তর পেট ভরে তৃপ্তি করে খেলো। খেয়ে দেয়ে বলল, ‘আপনার রান্নার হাতের জবাব নেই আন্টি। অনেকদিন পর ভিন্ন স্বাদের খাবার খেলাম তৃপ্তি করে।’
মজনুর মা হাসলেন। দুজনকে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। তটিনী ও রুপান্তর নিজেদের রুমের দিকে চলে গেলো। মজনু চোরের মতো মুখ লুকাতে চেষ্টা করলো। মজনুর মা ছেলের কান টেনে ধরলেন।
‘আমার বউমাকে কবে ঘরে তুলছিস?’
মজনু মাথা চুলকালো,
‘ছেলে বউয়ের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত হোক। ঘরে এসে যাবে যথাসময়ে। ছেলের বউকে কেমন দেখলে?’
‘রুপান্তরের রুপ নামের মতোই মাশাআল্লাহ। আমার পছন্দ হয়েছে। গুন গুলো নাহয় এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর দেখে নিবো।’
মজনু হাসলো,
‘ঠিক আছে দেখে নিও।’
*
ভোরের দিকে বৃষ্টি নামলো সিলেটে। ঝিরিঝিরি বর্ষণে ঠান্ডা ফিল হলো সবার। গরমের মধ্যে এ যেনো সিলেটবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত। তটিনী ও রুপান্তর বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজলো অনেকক্ষণ। দুজনে একে অপরের বৃষ্টিতে ভেজার পিক তুলে নিলো। সাথে তুললো একত্রে কিছু সেলফি। রুপান্তর বারান্দা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালো। বারান্দা থেকে বাগানের গাছ ও সুইমিংপুল টা দেখা যাচ্ছে। তটিনীকে গুঁতো মে রে বলল,
‘কি ভাই? আর কতো অবাক হবো? দেখ বাগানে কি সুন্দর সুইমিংপুল। গ্রামের হয়েও এতো উন্নত রুচি। ভাবা যায়?’
তটিনী ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো।
‘চল বাগানে যাই।’
রুপান্তর সায় দিলো। দুজন চুপিচুপি বাগানে চলে গেলো। সুইমিংপুলে নেমে সাঁতার কাটলো কিছুক্ষণ। গতকালের ড্রাইভার তখন দূর থেকে বললেন,
‘হায় আল্লাহ মা জি, এ কি করছেন। এবেলা তো বড়ো সাহেব পুকর মে ডুব দিতে হে।’
তটিনী মুখ তুলে তাকালো,
‘কে বড়ো সাহেব?’
‘আজ্ঞে মিনহাজ বড় সাহেব জি।’
‘আপনি ইন্ডিয়ান?’
‘নেহি জি, হাম খাঁটি বাংলাদেশি হে। লেকিন হাম হিন্দিমে বাত কারনে পাছান্দ কারতি হে।’
রুপান্তর কোমড়ে হাত রেখে বলল,
‘ও আচ্ছা, কোথা থেকে শিখলেন?’
‘ও তো আম্মা জি হিন্দি সিরিয়াল দেখতি হে, সেসময় হাম থুরিথুরি দেখতি হে, তো হামারি হিন্দি থুরাথুরা আতি হে।’
তটিনী ও রুপান্তরের মাথা ঘুরতে লাগলো,
‘হিন্দি ভাষার মান ইজ্জত মে রে দিলো ভাই।’
তখনই আসতে দেখা গেলো মিনহাজকে। হাতে টাওয়াল নিয়ে বেচারা গোসল করতে এসেছে সুইমিংপুলের কাছে।’
তটিনী ও রুপান্তরকে ভেজা অবস্থায় দেখে থমকে গেলো,
‘তোরা এখানে কি করছিস?’
ড্রাইভার হিন্দিতে বললেন,
‘দেখইয়ে না জি হাম খাবিসে উন দুনো ক আপকি পুকুরসে আগমন কা মেসেজ বেজতাহে লেকিন উন দোন শুনতাহি নেহি।’
রুপান্তর মিনমিন করে বলল,
‘আমরা সুইমিংপুলে গোসল করতে এসেছি। যাই হোক চলে যাচ্ছি।’
রুপান্তর তটিণী-র হাত ধরে দৌড় দিলো। মিনহাজ হেসে সুইমিংপুলে নামলো গোসল করতে।
ড্রাইভারের নাম হাসিবুল। তিনি দাঁত বের করে হাসলেন,
‘মেডাম দুনো বহুত দুষ্টু হে জি, লেকিন দুনো কি দিল খুব সুরত হে।’
মিনহাজ হাসলো,
‘মেডামরা তোমার হিন্দি শুনেই তো পালাবে চাচা।’
*
হাঁচি দিতে দিতে তটিণী-র অবস্থা খারাপ। রুদ্র ফোনের অপর পাশ থেকে শাসাচ্ছে।
‘বলেছিলাম নিজের খেয়াল রাখতে। কে বলেছে সুইমিংপুলে গোসল করতে? বৃষ্টিতে ভেজার এতো শখ। বান্দর কোথাকার। নিজের বাড়িতে অসুস্থ হলে মা বাবা ছিল চিন্তা থাকতো না। এখানে অসুস্থ হলে কে দেখবে?’
তটিনী মিনমিন করে বলল,
‘অসুস্থ হইনি তো, শুধু হাঁচি দিচ্ছি।’
রুদ্র হতভম্ব,
‘সেটা কি অসুস্থতা না?’
‘একদমই না, এটা একটু পর থেমে যাবে। শরীর গরম করলেই।’
‘কিভাবে শরীর গরম করবে?’
‘এইযে কাঁথার তলে ঢুকে গেলাম। একটু পর গরম লাগবে।’
রুদ্র কিছু বলার ভাষা পেলো না। তটিনী নাক টেনে বলল,
‘গতকাল মেসেজে বললেন সারপ্রাইজ আছে, সেটা কি?’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল,
‘বলবো না, সারপ্রাইজ তো সারপ্রাইজ’ই। বাড়িতে ফিরেই জানতে পারবে। কিন্তু দোহাই লাগে ঠান্ডা লাগিও না। নাহলে সব ক্যান্সেল হয়ে যাবে।’
তটিনী কথা দিলো সে ঠান্ডা লাগাবে না। রুদ্র হেসে বলল,
‘তোমার ঠান্ডা কপালে উষ্ণ চুমু।’ রেস্ট নাও।’
তটিনী ফোন রেখে দিলো। সর্দি মুছতে মুছতে রুপান্তর চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলল,
‘আজ কেউ নেই বলে ফোনে উষ্ণ চুমু নিতে পারছি না। জীবনে কি করলাম?’ এতো লস নিয়ে বাঁচা যাচ্ছে না রে তটিনী। আমাকে তুই মে রে ফেল।’
তটিনী দাঁত বের করে হাসলো,
‘বেঁচে আছিস কেন? বারান্দায় গিয়ে লাফ নিচে। সোজা তোর জামাইর শখের সুইমিংপুলে। আদালতে প্রমাণ হবে ফোনের ভিতর থেকে জামাই উষ্ণ চুমু দেয়নি বলে একমাত্র জামাইয়ের শখের সুইমিংপুলে লাফ দিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করলেন রোকেয়া বিনতে রুপান্তর নামক সুন্দরী যুবতী।’
তটিনীর কটাক্ষে রুপান্তর আফসোস করলো,
‘হাহ্, জামাই না ছাই। জামাইয়ের সুইমিংপুলে গোসল করার শখ হয়। শুধু রুদ্র ভাইয়ের মতো মোবাইলে উষ্ণ চুমু দেওয়ার শখ হয় না। কপাল!
তটিনী মুখ বাকালো,
রুদ্র ভাইকে টানবি না, সে বেচারা দূরে। তোর জামাই তো তোর কোলের কাছে বসেও কিছু করবে না। ভদ্র সভ্য কি না।’
রুপান্তর আফসোসে ভেসে গেলো,
‘এমন ভদ্র সভ্য জামাই দিয়ে কি করমু, যে বেটা বউকেই একটা চুমু খেতে পারে না।
রুপান্তরের আফসোসে ভরা মুখশ্রী দেখে তটিনী মুখ চেপে হাসলো। তখনই দ্রুতগতিতে এক রুপান্তরের গালে চুমু খেয়ে আবার ঝড়ের গতিতে চলে গেলো। তটিনী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে দেখলো শুধু। রুপান্তরের মাথায় হাত,
‘এমন বর আমি চাইনি গো। মিনহাজের বাচ্চা!
(চলবে)