#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-৩০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সুইজারল্যান্ড আনুষ্ঠানিক ভাবে সুইস কনফেডারেশন, পশ্চিম-মধ্য ইউরোপ একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। তবে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। এর মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাংক এবং বাৎসরিক স্থূল দেশজ উপাদানের পরিমাণ ৫১২.১ বিলিয়ন সুইস ফ্রাংক (২০০৭) খ্রিস্টাব্দ।
তটিনী ও রুদ্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিয়েছে। রুদ্র আজ থেকে তটিনীকে পুরো সুইজারল্যান্ড যতোটুকু পারে ঘুরে দেখাবে। সেইরকমই প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
স্নিগ্ধ সুইজারল্যান্ডের প্রতিটি বাড়ির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো কাঠের দোতলা আর চারপাশে নাম না-জানা অসংখ্য ফুলে ভরা বাগানে ঘেরা। মনে হবে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি, সৃষ্টিকর্তা যেন ঢেলে সাজিয়ে রেখেছেন।
তটিনী মুগ্ধ হয়ে মুখে হাত রেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। সৃষ্টিকর্তার কি অপরুপ সৃষ্টি!
ট্রেনভ্রমণ সুইজারল্যান্ডে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। তবে আরামদায়ক আর নিরাপদ। দু-চোখ ভরে দেখার জন্য ও ট্রেন জার্নি অতুলনীয়।
পাহাড়, লেক, প্রকৃতির শোভা পরিবেষ্টিত সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ট্রেনের বিকল্প নেই। কারণ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ট্রেন এবং কেবল কারে চড়ে বাইরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী উপভোগ করা, সে শিহরিত হওয়ার মতো ব্যাপার। আপনার কাছে তখন মনে হবে এ কোন বিস্ময়কর দুনিয়ায় এসে পড়লাম।
রুদ্ররা লুজার্ন থেকে বিষাল প্রমোদতরিতে লেকের এক মাথা হতে অন্য মাথায় চক্কর দিয়ে দ্রুতগামী প্যানারমিক ট্রেন চেপে লাঙ্গার্ন শহরে এসে নামলো।
লাঙ্গার্ন থেকে ইন্টারলেকেন – এই পথটুকু হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের প্রধান কয়েকটি পর্যটন স্থানের মধ্যে অন্যতম। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’সহ অসংখ্য হিন্দি সিনেমার শুটিং এই ক্যান্টিনে হয়েছিল। বলিউড এরিয়া নামেই এই ক্যান্টিন সুপরিচিত।
তটিনী মুখে হাত দিয়ে সব দেখছে। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। সাথে ঠিকরে পড়ছে বিস্ময়কর সব ভাবনারা। রুদ্রের হাত ধরে সে সব ঘুরে দেখতে লাগলো। সাথে নিজের সাথে ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলো বিস্ময়কর এই জায়গা গুলো।
তারা একটি পাহাড়ে উঠলো। তটিনী পাহাড়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। রুদ্র পাশে শুয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো৷ প্রকৃতির এই বিস্ময়কর রুপে মুগ্ধ হয়ে দু’জন তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। রুদ্র কপালে গভীর চুম্বন করেলো।
‘প্রকৃতির কাছে এসে তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে ঐশি। চেহারায় ন্যাচারাল গ্লু করছে। তোমাকে আমার কাছে প্রকৃতি কন্যা মনে হচ্ছে।’
তটিনী সবুজ রঙের পোশাকে নিজেকে আবরিত করেছে। হাত কাটা সবুজ গাউন সাথে পাথরের অসম্ভব সুন্দর কাজ করা অর্নামেন্টস। তটিণী-র মাথায় রুদ্রের পড়িয়ে দেওয়া সবুজ পাথরের মুকুট। এ যেন সত্যিই এক প্রকৃতি কন্যার রুপ। রুদ্র মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে নিজের নিজস্ব প্রকৃতি কন্যাকে দেখতে লাগলো। চোখে আলো পড়ার কারণে চ্যুত হলো। রুদ্র উঁকি দিয়ে দেখলো একজন ক্যামেরা হাতে বিদেশিয়ান তাদেে ফটো তুলেছে। লোকটি এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে দিলো,
‘হাই আ’ম লুসা।
রুদ্র নিজেদের পরিচয় দিলো। লুসা অবাক হয়ে বলল, ‘ও মাই গড বেঙলাডেষি।’
লুসা রুদ্র ও তটিণী-র পাহাড়ে শুয়ে থাকার ছবি দেখালো। রুদ্র নিজের ফোনে সেগুলো নিয়ে নিলো। লুসা বললো সে তার পেইজে এগুলো পোস্ট করবে। রুদ্র অনুমতি দিলো।’
রুদ্রের হাত ধরে তটিনী প্রকৃতির আরও গভীরে যেতে লাগলো। যেখানে শুধু রয়েছে বিস্ময়কর মুগ্ধতা।
খঁস-মন্তানা শহরের প্রায় ১৫০০ ফিট ওপরে উঠে তারা দেখলো বাঁকা বাঁকা কাঠের দোতলা বাড়ি, ভয়ংকর লাগছে তাদের কাছে। ওরা পাহাড় কেটে ঘরগুলো সোজা করমে পারত কিন্তু প্রকৃতির নষ্ট করেনি, বরং পাহাড়ের আদল অনুযায়ী নিজেদের পছন্দের কাজগুলো করে থাকে। চারপাশে গরু, ভেড়ার ফার্ম হাউজ, চিজ, গরুর দুধের ফ্যাক্টরি, অবাধে মুরোগ, গরু ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন একেবারেই গ্রামীন দৃশ্যপট। একদম সাদামাটা যাপন, অথচ এসব বাড়ির মালিকেরা সুইজারল্যান্ডের একেকজন ধনকুবের।
শহরের বাড়ি, ফ্লাট ভাড়া দিয়ে দূরদূরান্তের বন-জঙ্গলে চলে যান। কৃষিকাজ করেন, বাগান করেন। এমনও বাড়ি আছে যেগুলোতে ইলেক্ট্রিসিটি আছে কিন্তু ওরা ব্যবহার করে না। সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে পুরো বাড়ি মোমের আলোয় আলোকিত করে রাখে। মাটির চুলোয় রান্না করে, আর অবশ্যই তা উন্নত পর্যায়ের। অনেক পুরোনো গাছে ঘেরা, সবুজ আর সবুজ। আমাদের দেশে হলে কেটেকুটে লাকড়ি বানিয়ে ব্যবহৃত হতো। নিরাভরণ, নিস্তব্ধ, শান্ত প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতোই ব্যবহার করে সুইসরা। সামারে বাগান থেকেই জুকিনি, সালাদপাতা, টমেটো, শালগম, গাজর উঠিয়ে বাগানেই রান্না করে খেয়ে থাকে।
আমরা পাহাড় কেটে, নদী ভরাট করে, প্রকৃতি নষ্ট করে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করি, অথচ সুইজারল্যান্ডে ঠিক তার উল্টো। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা কতটা নৈসর্গিক আর নিরিবিলি জীবন যাপন করে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। গভীর অরণ্যের ভেতর ডুপ্লেক্স বাড়ি, তার চারপাশে আঙুর, আপেল কিউইসহ বিভিন্ন পাম ফলের বাগান। পাহাড়ের ঢাল বা আদল অনুযায়ী নিজেদের আবাসস্থল ও জমি চাষ করেন। কিন্তু প্রকৃতির বিন্দুমাত্র ক্ষতিসাধন এরা করে না।
তটিনী ঠোঁট চেপে মুখে হাত দিচ্ছে শুধু। এতো এতো সৌন্দর্য সুইজারল্যান্ডে পা না রাখলে বুঝি অ-দেখা থেকে যেতো। সে রুদ্রের হাত চেপে ধরলো। রুদ্র হেসে আলতো করে ধরে বলল, ‘আরও অনেক কিছু দেখবে। তোমাকে দেশবিদেশ ঘুরানোর দায়িত্ব টা না-হয় আমিই নিলাম।’
তটিনী মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
‘আমি বার-বার প্রকৃতির প্রেমে পড়ি। কিন্তু যে আমাকে এসব দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে তার প্রেমে আরও গভীর ভাবে পড়েছি। আপনি এতো প্রেমময় কেন রুদ্র?’
রুদ্র চমৎকার করে হাসলো। চুলের ভাজে ঠোঁট ভুলিয়ে নিলো। তটিণী-র চোখে সুখের অশ্রু টলমল। রুদ্র চোখের ইশারায় বুক পেতে দিলো।
‘তোমাকে এক সাগর কাঁদাবো। তুমি সুখে ডুবে কান্না করবে। তোমাকে এক পাহাড় সমান অপেক্ষা করাবো। কিন্তু অপেক্ষার শেষটা অবশ্যই সুখকর হবে। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়, কাঠের বাড়ি, স্নোবল, লতাপাতা, চেরি-ব্লসম, শহর জানুক আমি তোমাকে আকাশের মতো ভালোবাসি আমার ঐশি!’
*
সুইজারল্যান্ডের তাপমাত্রা জানান দিলো তুষারপাতের। রুদ্র ও তটিনী ট্রেনে চেপে নিজেদের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো৷ট্রেন ছেড়ে গাড়িতে করে ফ্লাটে পৌছানোর আগেই ছোট ছোট স্নোবল গড়িয়ে পড়তে লাগলো পাহাড়ের বুক ঘেষে। তটিনী সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে দেখলো। রুদ্র পেছন থেকে ধরে তটিণী-র দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালো। তখনই ক্লিক করলো লুসা। সে রুদ্র ও তটিণী-র পিছু ছাড়েনি। কারণ তার মন বলছিল আরও সুন্দর সুন্দর পিক ক্লিক করতে পারবে সে। রুদ্রকে পিক দিয়ে সে চলে গেল। রুদ্র তটিনীকে টেনে গাড়িতে উঠলো।
স্নো বৃষ্টি মুগ্ধ চোখে দেখছে তটিনী। রুদ্র নিজের জ্যাকেট খুলে পড়িয়ে দিয়েছে তাকে। ফলে রুদ্রের জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাঝে মধ্যে সে তটিণী-র দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে। বিনিময়ে তটিনী হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে। রুদ্র সেই সুন্দর হাসি দেখে রাগ দেখাতে পারে না। শুধু নিজের সাথে জড়িয়ে উষ্ণতা নিয়ে বললো, ‘আমি যদি জ্যাকেট না আনতাম তো তুমি তো জমে যেতে এতোক্ষণে।
গাড়ির স্প্রিড তুলে ছুটছে। ফ্লাটের সামনে থামতেই রুদ্র ও তটিনী দৌড়ে বাড়ির গেইটের দিকে দৌড় দিলো। তারপর লিফটে করে তাদের ফ্লাটে। উষ্ণতা নিতে রুদ্র যখন কাছে এলো তটিনী তখন আবেশে নিজের সাথে জড়ালো।
*
বাংলাদেশ থেকে একের পর এক কল দিচ্ছে রুপান্তর। ইতিমধ্যে লুসা পোস্ট করেছে তার পেইজে। সাথে ট্যাগ করেছে রুদ্র ও তটিনীকে। রুপান্তরের রীতিমতো হা হুতাশ হচ্ছে। তার বান্ধবী এতো স্বার্থপর। শেষ পর্যন্ত তাকে রেখে সুইজারল্যান্ডে মধুচন্দ্রিমা সেরে নিলো। নিজের সাথে এমন অন্যায়ের জন্য সে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বসাবে। তটিনী একবার শুধু বাংলাদেশে ফিরুক। সে ছাড়বে না একদম। তাকে রেখে ঘুরাঘুরি! পরক্ষণেই রুপান্তরের মনে হলো তটিনী বিবাহিত। হাসবেন্ডের সাথে ঘুরতেই পারে। সবখানে তো আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরা সম্ভব না, কিন্তু হাসবেন্ড নিয়ে ঘুরা সম্ভব। মনে মনে সে ভেবে নিলো অনেক কিছু।
(চলবে)