মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৭)

0
210

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৭)

মুক্ত সমীরণ এসে পূর্ণ হলো কক্ষটি। সায়রা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। সেই গাছে দুটো পাখি বাসা বেঁধেছে। তারা ঘর করছে ভেবেই ওর মন নেচে ওঠল। ইচ্ছে করল দু চোখ ভরে এদের সংসার দেখে নিতে। অথচ নিজের ঘরের খবর নেই। ঊনত্রিশ বছর বয়সী সে এখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারে না। কি এক ব্যথা ছেয়ে যায় সমস্ত শরীর জুড়ে।

জাফরিন এসে দরজায় নক করল। তার মন মস্তিষ্ক ইদানীং চলছে না। খুব কান্না পাচ্ছে। সায়রা ওকে দেখে বলল,”কী ব্যাপার জাফরিন? মুখ ওমন শুকনো কেন দেখায়?”

মেয়েটির মুখ দেখেই সায়রার মায়া হলো। ও এগিয়ে এসে বাহুতে হাত রাখল।

“কিছু হয়েছে?”

জাফরিনের সরল দৃষ্টি। চোখ দুটো বোধহয় ইষৎ ছলছল করছে। সায়রা ওকে নিয়ে বসল। তারপর কিছু সময় চেয়ে রইল।

“জাফরিন, তুমি বলো কী হয়েছে। এমন হয়ে আছে কেন মুখখানি?”

জাফরিনের কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। ও জ্বিভের অগ্রভাগ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। দৃষ্টিতে লজ্জা মিশে আছে। যা সায়রা স্পষ্ট অনুভব করতে পারল।

“আমার কিছু ঠিক লাগছে আপু।”

“সেটির কারণ?”

“আসলে…..

বলে থেমে গেল জাফরিন। ঘটনাটা কেমন করে বলবে সে? এটা বলার মতন তো নয়।

“বলো, জাফরিন। কী হয়েছে? এমন চুপ করে থেকো না প্লিজ।”

“মাহিমের বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।”

সায়রা ইষৎ থমকাল। জাফরিন হুট করে মাহিমের বিষয়ে কেন বলতে চাইছে? ও ভালো মতন কয়েক দিনের ঘটনা স্মরণ করল। দুজনের মাঝে খুব বেশি কথা বার্তা হতে দেখে নি সে। তবে, তবে কী হতে পারে?
এদিকে জাফরিন মাথা নামিয়ে রেখেছে। ও দ্বিধা হচ্ছে। কিছুতেই কিছু বলতে পারছে না। সায়রা তখনো চেয়ে আছে। ও জানতে চাইছে। দ্বিধা কাটিয়ে জাফরিন কিছু বলতেই চাইছিল। সে সময়েই ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল মাহিম। এসেই জাফরিনের হাত স্পর্শ করল।

“আমার সাথে আসো জাফরিন। কথা আছে।”

“ছাড়ো হাত। তোমাকে নিষেধ করেছি।”

“তর্ক করার মতন সময় নয় এখন। প্লিজ আসো।”

তারপর মেয়েটিকে প্রায় টেনেই নিয়ে গেল মাহিম। পুরো ঘটনায় বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল সায়রা। ওর শরীর শিউরে ওঠল।

জাফরিন কেঁদে ফেলল। মাহিম ওর মুখখানি হাতের মাঝে আটকে নিল। আবেগ মিশিয়ে বলল,”ভালোবাসো তুমি। বলো ভালোবাসো।”

জাফরিন মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। কদিনে ছেলেটার প্রতি ওর মায়া হয়ে গেছে। আর এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জাফরিন আহত।

“কথা বলো জাফরিন। কথা বলো প্লিজ।”

“তুমি আমায় মে রে ফেললে মাহিম। মে রে ফেললে আমায়।”

মেয়েটির আরেকটু কাছে এল মাহিম। ওর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে।

“এমনটা বোলো না প্লিজ। আমি তোমায় যথেষ্ট ভালোবাসি জাফরিন। অনেক বেশি পছন্দ করি তোমায়। আর তুমিও আমায় ভালোবাসো।”

জাফরিনের কান্নার বেগ বাড়তে লাগল। মেয়েটিকে আলিঙ্গন করল মাহিম। যার ফলে জাফরিনের মাথা ঠেকল বুকে।

“জাফরিন,শুধু বলো ভালোবাসো। বিশ্বাস করো,তোমায় কখনো ছাড়ব না। কখনোই না।”

সায়রা ঘটনাটি বেশ বুঝতে পারছিল। তবে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওর কাজ পড়ে গেল। তাই বের হতে হলো তাকে। আর সবথেকে বিস্মিত হলো মিটিং এ অনুভব কে দেখে। তার থেকে বেশি অবাক করল ছেলেটির ভাব এমন যে ওকে চেনে না অবধি!

সুনেরাহ আর অনুভব খুব দ্রুতই একটি ব্র্যান্ড লঞ্চ করতে যাচ্ছে। সায়রা এখানে আসার পর একটি কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেই কোম্পানির সাথে অনুভব নতুন কিছু করতে চলেছে। মিটিং শুরু হলো। অনুভবের কথা বার্তা দেখে সায়রা অবাক হয়। এই সেই অলস অনুভব! ওর মনে হয় না। কিছুতেই ছেলেটাকে মেলাতে পারে না ও। সায়রা বোধহয় প্রথম বারের মতন নিজের কাজের প্রতি আগ্রহ হারাল। কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না। ব্রেক টাইমে কফি আনতে গেল। কফি তৈরি। কাপটি তুলবে সেই সময়েই খপ করে কাপটি নিয়ে নিল অনুভব। চুমুক দিয়ে বলল,”এত মিষ্টি খাও তুমি!”

“কারণ আমি তোমার তেঁতো নই।”

“আমি তেঁতো?”

“অবশ্যই।”

“কীভাবে?”

“সব ভাবে।”

সায়রা ফের আরেক কাপ কফি বানাতে দিল। অনুভব মেয়েটিকে ভালো মতন দেখে নিয়ে বলল,”তোমার মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে সায়রা।”

ছেলেটার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল সায়রা। অনুভব আরেকটু মজা নিতে বলল,”দেখো, তোমার কপালে ভাঁজ পড়েছে। একটা নয়, পুরো দুটো ভাজ। একটু মুটিয়েও গেছ। চোখে মুখে ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে। তোমার সত্যিই বয়স হয়েছে সায়রা।”

সায়রার এত রাগ হচ্ছে। এদিকে অনুভব কথা বলত‍ে বলতে ওর মুখের কাছাকাছি চলে এল। দুজনের দৃষ্টি একত্র হলো। অনুভবের চোখে খুশি খেলা করছে। সায়রা দৃষ্টি নামিয়ে বলল,”আমাকে রাগানো চেষ্টা করছ?”

“কেন, রাগ হচ্ছে না তোমার?”

“হচ্ছিল, তবে এখন হচ্ছে না।”

“কেন?”

“তোমার দৃষ্টিতে আমি আমার সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি অনুভব। মুখে এসব বললেও চোখের দৃষ্টি কেমন করে বদলাবে অনুভব?”

“তুমি চোখের দৃষ্টি পড়তে পারো সায়রা?”

সায়রা জবাব দিল না। অনুভব আর তার মাঝে খুব হলে এক ইঞ্চির মতন দূরত্ব।

“কী হলো? উত্তর দিলে না যে।”

“সব কথার উত্তর হয় না।”

অনুভব হাসল। তারপর মেয়েটির মুখশ্রীর দিকে চাইল। এক সেকেন্ডের জন্য কোমল ঠোঁটটা নজরে এল। ও চোখ ঘুরিয়ে নিল।

“তুমি চোখের দৃষ্টি পড়তে পারো না সায়রা। একদমই পারো না।”

সায়রা হয়তো কিছু বলত। তবে সে সময়ই সুনেরাহ’র আগমন হলো। ও এসে বলল,”কফি খাচ্ছ, আমায় কেন ডাকলে না?”

“তুমি ব্যস্ত ছিলে।”

“ও আচ্ছা। আমি কফি বানাতে দেই।”

সুইচ প্রেস করে অনুভবের হাতটি ধরল সুনেরাহ। সায়রার দৃষ্টিতে এল সেটা। ও চোখ ঘুরিয়ে নিল। অনুভব কিন্তু সায়রার দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েটার ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটা ওর দেখা পৃথিবীর সব থেকে অদ্ভুত প্রাণীর মধ্যে পড়ে।

বের হওয়ার সময় অনুভব আর সায়রার দেখা হলেও কোনো কথা হলো না। দুজন দুদিকে চলে গেল। আজ সারাটা দিন বড়ো বিরক্তিতে কেটেছে সায়রার। ওর ভালো লাগছে না কিছু। নানান চিন্তায় মাথা জ্যাম হয়ে আছে। বাসায় ফিরেই মাহিমের সাথে দেখা হয়ে গেল। মাহিম যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইল। তবে সায়রা আটকে দিয়ে বলল,”কথা আছে। সাথে চল।”

মাহিমকে যেতে হলো। সায়রা নিজের কক্ষে এসে আরাম করে বসল। এত ধকল গেল তার। এদিকে মাহিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওর মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর কাঁপছে। সায়রা আর তার সম্পর্কে বন্ধুত্বের ছোঁয়া আছে। তবু সম্পর্কে অনেকটা বড়ো হয় সায়রা। শ্রদ্ধার জায়গাটা বিশাল।

“কিছু কথা বলব, শুধু হ্যাঁ অথবা না বলবি। ঠিক আছে?”

মাহিম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল। সায়রা শুরুতেই শুধাল,”জাফরিনকে পছন্দ করিস? প্রথম দিন থেকেই?”

মাহিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলতে পারবে না সে। জাফরিনের প্রতি তার অনুভূতি অস্বীকার করার মতন না।

“কী হলো?”

“পছন্দ করি।”

“জাফরিন?”

“জানি না।”

“কেন?”

“কিছু বলে নি।”

মাহিম চুপ। সায়রা ও তাই। ছেলেটার মুখশ্রী ভালো মতন দেখে নিয়ে সায়রা বলল,”বাসায় বলার মতন সাহস আছে?”

“আছে।”

“যদি না মানে?”

এবার মাহিমের হৃদয় ধক করে ওঠে। ও কিছু সময় চুপ করে থাকে। সায়রা এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারে না। তবে ওঠে এসে মাহিমের বাহুতে স্পর্শ করে। সম্পর্কে সন্তানের মতন হলেও, বয়সে আহামরি পার্থক্য নেই। তাই বন্ধুত্বের ভাব আছে বেশ।

“মাহিম, সম্পর্ক তৈরি যতটা কঠিন, ভাঙা ততটাই সহজ। তাই সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিবি। সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে এমন কোনো আচরণ যেন না হয় যার ফলে অপর পাশের ব্যক্তিটির অসম্মান হয়।”

সায়রার কথাটা বুঝতে পারল মাহিম। মাথা দুলিয়ে বলল‍,”আমি এমন কিছু করব না পিপি। জাফরিনের স্বাধীনতা আছে পুরো।”

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

পর্ব (৩৮)
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/454604247100475/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here