যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_৪৫ জাওয়াদ জামী জামী

1
627

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী জামী

স্বম্বিৎ ফিরে পেতেই রিশাদ তেড়ে আসল আরমানের দিকে। আরমানের এক ঘুষিতেই ও কিছুক্ষণ মেঝেতে লুটোপুটি খায়। নাক বেয়ে গলগল করে নামছে র’ক্তে’র ধারা। ওকে তেড়ে আসতে দেখেও আরমান মোটেও বিচলিত হলোনা। ও অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। যেন কোন কিছুতেই ওর কোনও তাড়া নেই।

রিশাদ আরমানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ও রাগে ফুঁসছে।

” ইউ ব্লাডি ফুল। তোমার সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার? আগেরবার তোমাকে কিছু বলিনি বলে আজও যে তোমাকে ছেড়ে দেব, এটা ভেবোনা। আজ আমার হাত থেকে তোমাকে কোন বাপের ব্যাটাই বাঁচাতে পারবেনা। ”

কথা বলেই রিশাদ আরমানকে মারার জন্য হাত উঠায়। ওর হাত মাঝপথে থাকতেই আরমানের হাতের দশাসই থাপ্পড় খেয়ে ও দুই হাত দূরে ছিটকে যায়। সেখানে উপস্থিত সবাই থাপ্পড়ের বিকট শব্দে চমকে উঠল। কিন্তু কেউই আরমানের সামনে আসার সাহস পেলোনা। এখানের সবাই জানে আরমানের সম্পর্কে। আরমান এগিয়ে যায় রিশাদের কাছে।

” রাস্কেল, সেদিনও তোর কিছু করার ক্ষমতা ছিলনা, আর আজও নেই। আমি তোকে এখানেই মে রে পুঁতে রেখে দিলেও তুই কিছুই করতে পারবিনা। এতদিন অনেক বিরক্ত করেছিস মাশিয়াকে। নেহাৎই বাঘিনী বিড়াল হয়েছিল তাই তোর চাপার জোড় এখনো আছে। নয়তো ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয় মাশিয়া। আমাকে কি করবি কর। দেখি তোর হিম্মত। ” আরমান কথা বলছে আর রিশাদকে এলোপাথাড়ি মা’র’ছে।

রিশাদ এতক্ষণ গলার জোড় দেখালেও আরমানের মা র সহ্য করতে পারছেনা কিংবা নিজেকে রক্ষা করতেও পারছেনা।

আরমান এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। এক কোনায় একটা রড দেখে দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে রড হাতে নেয়।

” আমার সন্তানদের নিয়ে তুই কি বলেছিলি মনে আছে? ওরা তোর সন্তান? পৃথিবীতে আসার আগেই আমার সন্তানদের কলুষিত করতে চেয়েছিলি তুই। আমি মনে মনে তোকেই খুঁজেছি কয়েকটা দিন। কিন্তু তোকে পাইনি। আজ দেখ, তোর দুর্ভাগ্য তোকে আমার কাছে টেনে এনেছে। ” আরমান রড দিয়ে মারছে রিশাদকে। রিশাদের চিৎকারে হসপিটালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

আরমানের এমন আগ্রাসী রূপ দেখে রিসিপশন থেকে একজন মিরাজ মোর্তাজাকে ফোন দেয়।

মিতুল হসপিটালে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। আরমান রিশাদকে বেদম প্রহার করছে। আরমানের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে ভয় ঢুকে যায়। তবে ও এটা ঠিকই বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে আরমানকে না থামালে আজ রিশাদ বাঁচবেনা। ও এগিয়ে গেল লিফ্টের দিকে।

” সুধা, শশী তোমরা নিচে গিয়ে স্যারকে আটকাও। স্যার আজ রিশাদকে মে রে ই ফেলবে। তারাতারি যাও। ” মিতুল প্রায় ঠেলে ওদের দু বোনকে রুম থেকে বের করে দেয়।

মাশিয়া মিতুলের কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। ওর বুঝে আসছেনা আরমান কেন রিশাদকে মা র ছে? চিন্তায় ওর মাথা খারাপ হবার জোগাড়।

সুধা লিফ্ট থেকে বেরিয়েই দেখল প্রায় অচেতন রিশাদকে মে রে ই যাচ্ছে আরমান
রিশাদের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। ও জড়বস্তুর ন্যায় মেঝেতে লুটাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর পুরো শরীর। সুধা দৌড়ে যায় আরমানের কাছে।

” ভাইয়া, কি করছ! ছেড়ে দাও। লোকটা ম রে যাবে তো। ” ওরা দু বোন জোড় করে আরমানের কাছ থেকে রড কেড়ে নেয়।

শশী আরমানকে জড়িয়ে ধরে আছে। আরমান রাগে কাঁপছে।

” ভাইয়া, তুমি কি পাগল হয়েছ! এভাবে কেউ কাউকে মা রে? তুমি নিজেকে এই লোকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছ নাকি! এটা নাহয় বেয়াদব। কিন্তু তুমি তো নও? ” শশী আরমানকে ঠেলে লিফ্টের কাছে।

” ও এভাবে একঘন্টা এখানে থাকবে। এক ঘন্টা পর ওর চিকিৎসা করবেন আপনারা। এর আগে যদি কেউ ওকে টাচ করে, তবে তারও এর মতই অবস্থা হবে। ” লিফ্টে ওঠার আগে হসপিটালের কর্মীদের হুমকি দিল আরমান।

কেবিনে এসে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে মেয়েদের কাছে যায়। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে। তাই ওদের কোলে নিতে পারলনা। মাশিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। কিন্তু আরমান একটাবারও ওর দিকে ফিরে তাকায়না।

মিরাজ মোর্তাজা একঘন্টা পর এসে জানালেন রিশাদের দুই হাত আর এক পা ভেঙে গেছে। বুকের দুইটা হাড়ও ভেঙেছে। মাথায় সেলাই পড়েছে সাতটা। এছাড়াও ওর পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। তিনি আরমানের দিকে তাকালেন। কিন্তু আরমানের ভেতরে কোনও হেলদোল দেখলেননা।

মাশিয়া অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। ওকে বাসায় নিতে হবে। কল্পনা মোর্তাজা চাইলেন মাশিয়াকে তাদের বাসায় নিতে। কিন্তু আরমান চায়না মাশিয়া সেখানে যাক। ও মাশিয়াকে সুধার ফ্ল্যাটে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরমানের সিদ্ধান্তে কল্পনা মোর্তাজা মোটেও অখুশি হননি। অবশেষে তার মেয়ে নিজের সংসারে ফিরবে, এটাই তার জন্য স্বস্তির।

সুধা বাচ্চাদের তৈরী করছে। শশী ওদের কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। গোছগাছ শেষ হলেই ওরা নিজেদের ফ্ল্যাটে যাবে। মাশিয়াকে ওরা কিছুই করতে দিচ্ছেনা। ও ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আরমান কোথাও গেছে। তাই মেয়েটা বিছানায় শুয়ে হাত-পা নাড়াচ্ছে।

” সুধা, তোদের গোছগাছ হয়েছে? গাড়ি এসে গেছে। তারাতারি কর। ” আরমান কেবিনে প্রবেশ করে সুধাকে বলল।

” হুম। তুমি ব্যাগগুলো নিচে নিয়ে যাও। গাড়িতে রেখে এস। ভাবিকে ধরে নিতে হবে। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আমরা ভাবিকে নিতে পারবনা। খালাম্মাতো এখনও আসলোনা। তিনি সকালেই আসতে চেয়েছিলেন। ”

আরমান কিছু না বলে একজনকে সাথে নিয়ে ব্যাগগুলো গাড়িতে রেখে আসল।

ওরা বেরোনোর আগ মুহূর্তে কল্পনা মোর্তাজা কেবিনে ঢুকলেন।

” আমার দেরি হয়ে গেল, মা। হঠাৎই প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। একটু আরামবোধ করতেই চলে আসলাম। ” কল্পনা মোর্তাজা তার বড় নাতনিকে কোলে নিলেন।

” শুধু আম্মুই আসেনি, আমিও এসেছি। মাশিয়াকে আর বাচ্চাদের আমাদের বাসায় নিয়ে যাব। তই দেখি, বাচ্চাদের আমার কাছে দাও। ” দোলন কেবিনে ঢুকে হাসিমুখে বলল।

দোলনকে দেখে সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

” সরি, আপনার চাওয়া পূরণ করতে পারছিনা। বাচ্চাদেরও আপনার কোলে দেয়া যাবেনা। আর আমার মেয়েরা আমাদের বাসাতেই যাবে। তা হুট করে আজকে কি মনে করে উদয় হলেন? এই কয়দিন আপনার টিকিটির দেখাও পাইনি। আমার স্ত্রী যখন আইসিউতে মৃ’ত্যু’র প্রহর গুনছিল, তখন কোথায় ছিলেন? আজ হঠাৎ করেই কেনইবা এত দ্বায়িত্ব দেখাতে এসেছেন? কয়েকটা মাস যখন ওর পাশে আমি ছিলামনা, তখন কোথায় ছিল আপনার দ্বায়িত্ববোধ? আপনি যেতে পারেন। আপনাকে দেখেই আমার রাগ উঠছে। যখন দেখলেন একটা মেয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে, তখন তাকে না বুঝিয়ে তার পাশে না থেকে, তার বাড়ি ছাড়ার কারণ হয়েছেন। ভেবেছিলেন আমার স্ত্রী তার বাবার বাসায় থাকলে আপনার কর্তৃত্ব থাকবেনা। তাইতো? তাই ওর সাথে দুর্ব্যবহার করলেন। ওকে আঘাত দিলেন। কিন্তু আজ যখন দেখলেন, আমার স্ত্রী ওর সংসার, স্বামী ফিরে পেয়েছে, তখনই চলে আসলেন তাঁবেদারি করতে? ভালোমানুষি দেখাতে? তার প্রয়োজন নেই। আমার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”

আরমানের কথায় দোলন চরম অপমানিত হয়। ও ভাবতেই পারেনি আরমান ওকে এভাবে অপমান করতে পারে। তবে ও আরও আশ্চর্য হয়েছে আরমান কিভাবে ওর দুরভিসন্ধি ধরে ফেলেছে! ও হাসার চেষ্টা করল।

” সংসারে থাকলে এমন অনেক কিছুই হয়। আবার সব ঠিকও হয়ে যায়। সবকিছু মনে রাখলে চলেনা। ”

” সবকিছু আপনি ভুলে যেতে পারেন, অন্যেরা ভুলতে পারে, কিন্তু আমি ভুলতে পারিনা। বিশেষ করে সবকিছু যখন আমার আপনজনদের ঘিরেই ঘটে। একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আপনি বাসা ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, এটাতো কোনদিনই ভুলবনা। আর আপনি আমার আপন কেউই নন যে আপনাকে তোষামোদ করে চলতে হবে আমাকে। আপনি আসতে পারেন। আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

আরমানের করা তীব্র অপমানে দোলনের মুখ কালো হয়ে গেছে। ও সুড়সুড় করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

মাশিয়া মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে আরমানের দিকে। যে মানুষটাকে ও একদিন আঘাত দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, সেই মানুষটাই আজ ওর অপমানের উচিত জবাব দিল! রিশাদকে সেদিন আঘাত করেছে ওরই জন্য। আজ আপন পরের ফারাক মাশিয়া বুঝতে পারছে। সেইসাথে বুঝতে পারছে, হাজারবার জন্ম নিলেও মাশিয়া আরমানের হয়েই জন্মাতে চায়। এই মানুষটাই ওর সুখ-দুঃখের সাথী। এই মানুষটার বুকেই ওর সুখ।

চলবে…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here