#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_২১
“তোমাদের দুজনকে একসাথে খুব মানিয়েছে, তোয়া আপু।”
ইয়াদের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো তোয়া। সাগ্রহে শুধালো,“কীসে মানিয়েছে রে? আবির ভাইয়ের সাথে আমাকে আবার মানাবে কেন?”
ইয়াদ মৃদু হেসে জবাব দিল,“তোমাদের কাপল হিসেবে কিন্তু মন্দ লাগবে না।”
“খুব পাকা পাকা কথা শিখে গেছ বিয়ের কনে হয়েছ বলে তাই না? এদিকটা তোমার বুঝতে হবে না। নিজের আর নিজের বরের কথা ভাবো, বুঝলে?”
“ভাবছি তো। তোমাদের জন্যও একটু ভেবে নিলাম।”
আবির এগিয়ে আসতেই দুজনের আলাপচারিতা বন্ধ হয়ে গেল। আবিরকে দেখে ইয়াদ বলে উঠল,
“আমার পর কিন্তু আপনার পালা, ভাইয়া। বিয়ে করে নেন তাড়াতাড়ি নইলে সব মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে আর আপনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন।”
আবির একগাল হেসে বলল,“আপাতত তোর বিয়েতে মন দেই পরে আমারটা দেখব।”
আবির-তোয়ার পরপরই ফালাক আর নিশো এসে উপস্থিত হলো। চারজনে মিলে আনন্দ করে ইয়াদের সাথে কিছু স্মৃতি রেখে দিল। এত আনন্দের মাঝে আবিরের চোখ যখন তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাওয়া চোখের দিকে নজর দিল তখনই সেই চোখজোড়া আড়াল হওয়ার পরিবর্তে যেন আরেকটু উচ্ছ্বসিত হলো। বিপদ বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
আবিরের মুখ ভাড় দেখে তোয়া শুধালো,“কী হয়েছে রে তোর? মন খারাপ? মাঝেমাঝে এত জোরে শ্বাস ফেলছিস কেন?”
আবির দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,“ভুল না করলে, বিয়ে বাড়িতে আসলেই অন্য মেয়েদের বিয়ের কথা ওঠে না? এবার হয়তো তার ব্যতিক্রম কিছু হবে। আমার হয়তো প্রেমের প্রোপোজাল আসবে।”
আবিরের কথায় হো হো করে হেসে উঠল তোয়া। এদিকে ওদিকে দেখে জানতে চাইলো,“কোথায়? কে প্রোপোজাল দেবে তোর মতো ইঞ্জিনিয়ারকে?”
সন্ধ্যা থেকে ফলো করে যাওয়া মেয়েটাকে ইশারায় দেখিয়ে বলল,“ওই যে ওটা।”
তোয়া সেদিকে তাকাতেই সুন্দর একটা মেয়েকে দেখতে পেল। প্রশংসার স্বরে বলল,
“মেয়েটা সুন্দর আছে। একদম কচি।”
“লা*ত্থি খাবি, তোয়া। ”
“তোর থেকে এটা ছাড়া আর কী-বা আশা করতে পারি।”
আবির বেশ অন্যগলায় তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “করেছিস কখনো?”
“কী?”
“অন্যকিছু আমার থেকে আশা করেছিস কখনো, যে পাবি?”
তোয়া কিছু বলল না। আস্তে করে আবিরের সামনে থেকে প্রস্থান করল৷ আবির তোয়ার কান্ড বুঝে উঠতে না পেরে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবতে থাকল- ও এভাবে চলে গেল কেন? কিছু বুঝে গেল!
______
বেশ ধুমধাম করে ইয়াদের বিয়েটা হয়ে গেল। বরযাত্রী, বর, কনে, বাড়ির মানুষ, আত্মীয় মিলিত হয়ে বিয়ের কাজটা শেষ করল সবাই। বাড়িতে ইয়াদের চাচাতো বোনগুলো তার থেকে বড়। তার এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কারণ তার বাবা এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চাননি। বরযাত্রী আসার আগ মুহূর্তেও আবির ভেবেছিল বরের হয়তো বয়স বেশি হবে কিন্তু সে যখন বরকে দেখল তখন পুরো ভাবনাটাই বদলে গেল। সকালে যখন ইয়াদকে বউ-সাজের জন্য পার্লারে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়েছিল তখন সে আর অনিচ্ছা প্রকাশ করেনি। ইয়াদের সাথে একটু ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা জরুরিও ছিল। যদিও সে ভীষণ ছেলেমানুষি করে কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে এটা করলে পরে খুব পস্তাবে। আবির যা ভেবেছিল ঘটল তার বিপরীত। গাড়িতে উঠতেই একটা কল এলো ইয়াদের। ব্যাস শুরু হলো প্রেমালাপ। কথার মাঝেমাঝে আবিরের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসছিল ইয়াদ। কারো সামনে গোপনীয় কথা বলতে গেলে যেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ইয়াদ যেন সেরকমই পরিস্থিতিতে পড়েছিল। পার্লার পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কল কাটলো ইয়াদ। আবিরের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত গলায় বলল,
“স্যরি ভাইয়া।”
“সমস্যা নেই। তুই হ্যাপি তো?”
ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,“খুব। আমি যেমন চেয়েছিলাম উনি ঠিক তেমন, আলহামদুলিল্লাহ। ”
“বুঝে বলছিস তো?”
ইয়াদ গাল ফুলিয়ে বলল,“না বুঝে বলব কেন?”
“কিছুদিন আগ পর্যন্তও কিন্তু আমার জন্য….”
আবিরকে কথা শেষ করতে দিল না ইয়াদ। নিজের ছেলে-মানুষিগুলো সে মনে রেখেছে কিন্তু কারো সামনে স্বীকার করতে চায় না। আগে যা করেছে সেটা অতীত হয়ে গেছে। এখন বর্তমান। অতীত ভেবে বর্তমান নষ্ট করা খাঁটি বোকামি।
ইয়াদ বিরসমুখে বলল,“ভাইয়া প্লিজ, ওসব বলবেন না আর। ওসব ভাবলেই এখন হাসি পায় আমার। এখন বুঝতে পারি আপনি দেখতে সুন্দর বলেই আমি আপনাকে নিয়ে ভেবেছিলাম। আমার হবু বরও কম সুন্দর না। তবে আমি তাকে দেখার পর তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করিনি। কেন জানি না উনার সাথে প্রথম কথা বলাতেই অনেক পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন উনি। কত খেয়াল রাখেন এখনই। বিয়ের পর তো ভালোবাসা এমনিতেও বেড়ে যায়। আমি ভবিষ্যত ভেবে পুলকিত হই, না জানি আল্লাহ চাইলে আমি উনার সাথে কত ভালো থাকব! উনি আমাকে সঙ্গ দেন। ব্যস্ততায়ও আমার খোঁজ নেন। এই যে গতরাতেই উনি বলে রাখলেন রাস্তায় বেরিয়ে যেন কল দিই৷ কল দেওয়ার পর উনি কথা বলেই যাচ্ছিলেন। জানি না কীভাবে যেন পারফেক্ট একটা মানুষকে পেয়ে গেলাম আমি। এতবার প্রেমে পড়ে পাগলামি করতে করতে অজানা, অপরিচিত লোকটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। ভাবনার সবটুকু জুড়ে এখন শুধু তার বিচরণ। আমি তাকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারি না।।”
ইয়াদের কথার পর আবির আর কোন কথা বলার সাহস পায়নি। মনে মনে শুধু দোয়া করেছে-মেয়েটা সুখী হোক।
বিয়ে শেষে বউ নিয়ে বরযাত্রী অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। বাড়ির সামনেটায় নিশো আর আবির দাঁড়িয়ে আছে। জাভেদ সাহেব এবং জাফর সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ে একসাথেই বাড়ি ফিরছিলেন ইয়াদের বাবার সাথে। দুজনকে একসাথে দেখে আবির বেশ হলো। নিশোর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,
“দুজন একসাথে! ব্যাপার কী রে?”
নিশো মুচকি হেসে বলল,“মীরাক্কেল তো ঘটে গেছে।”
“আমার অজান্তে?”
“হ্যাঁ। তুই ইয়াদের সাথে পার্লারে গেছিলি তখন।”
আবির বেশ আগ্রহের সাথে জানতে চাইলো,“কী হয়েছে রে? কই সারাদিনে আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি!”
“বলবে কীভাবে? সবাই তো সারাদিন ব্যস্ত ছিল আর তুই তো এসেছিস ব্যস্ততার সময়েই।”
“ঘটনা কী বল তো?”
“ সকালে সবাই রঙ খেলা শুরু করেছিল। গ্রামে এরকম আনন্দ করতে দেখা যায়৷ এখানেও এমন হয়েছিল। ফুপার এক ভাই আছেন। তিনি খুব মিশুকে প্লাস মজার মানুষ। বাবা তো ফুপার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ঠিক তখনই ফুপার ভাই এসে টকটকে গাঢ় লালরঙ বাবাকে মাখিয়ে দিল। পাশেই তোর বাবা দাঁড়িয়ে মেসওয়াক করছিল। চাচা তো আরেক কাঠি ওপরে। বাড়ির ভেতরে যেয়ে কার থেকে যেন রঙ এনে বাবাকে সোজাসাপ্টা বলে বসল ‘ভাই, তুই বেয়াইকে ধর আজ রঙ খেলব।’ ব্যাস বাবাও রাজি হয়ে গেল। আঙ্কেলকে ধরে দুই ভাই মিলে একদম রঙে চুবিয়ে ছাড়ল। বাড়ির মানুষ এগিয়ে এলো। প্রচুর হাসি, আনন্দ হলো৷ একসাথে ফটোসেশান হলো। তারপর থেকেই দুই ভাই অনেকটা ফ্রি হয়ে গেছে।”
আবির কপালে চাপড়ে আফসোসের স্বরে বলল,“ইশ কতকিছু মিস করে গেলাম!”
নিশো পুনরায় হেসে বলল,“জীবনে অনেক কিছু মিস করে যাচ্ছিস।”
“বিয়ে দিয়ে দে, বউকেও মিস করছি।”
“তুই নির্লজ্জ কবে থেকে হয়ে গেলি?”
“তোর হাওয়া গায়ে লাগছে।”
“বাপেক গিয়ে বল, বউ লাগবে।”
“লাগবে তো তোর বোনকে। আমার বাপেক কইলে সে একপায়ে খাঁড়া হয়ে যাবে। বোন দিতে তুই রাজি?”
“প্রতিশোধ নিলি, ভাই?”
“তুই আমার বোনকে বিয়ে করবি আর তোর বোনকে আমি। মিলমিশের ব্যাপার, প্রতিশোধ কেন বলছিস?”
নিশো কিছু না বলে বাড়ির ভেতরের দিকে রওয়ানা দিল। আবির নিশোর পিছন পিছন আসতে আসতে বলল,“আমিও বোন দিতে রাজি হয়ে গেছি তুই হচ্ছিস না কেন? মনে রাখিস আমি না চাইলে কিন্তু ক্যাডার ফ্যাডার হয়ে লাভ নাই।”
নিশো দাঁড়িয়ে গেল। রাগী দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,“ব্ল্যাকমেইল!”
দুজন একসাথেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। নিজেদের বাড়ির সবাই একসাথেই বসে আছে বড় উঠোনটায়। চারদিকে অন্ধকার নেমেছে অনেক আগেই৷ অন্ধকার দূর করতে উঠোনের দুইপাশে দুইটা বাল্ব জ্বা*লানো হয়েছে। বিয়ে বাড়ির মানুষজন যেহেতু বরযাত্রী চলে যাওয়ার পরপরই নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছে তাই উঠোনে বাহিরের কেউ নেই। খুব কাছের মানুষ যাদের বাড়ি দূরে তারা ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে।
নিশো ভেতরে এসে আড্ডায় সবাইকেই দেখতে পেল শুধু ফালাক ছাড়া। আবির আর নিশো গিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক ভালো করে খুঁজেও ফালাককে না পেয়ে তোয়াকে ডাকলো নিশো। তোয়া এগিয়ে আসতেই সে বলল,
“সবাই এখানে। ফালাক কোথায়?”
“সারাদিন এত লোকজনের মধ্যে থেকে ওর মাথা ব্যথা করছে। চারজন একসাথেই নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম। ফালাক শুধু ফরজ পড়েই জায়নামাজে শুয়ে পরেছিল পরে ছোটমা ওর মাথায় তেল দিয়ে শুইয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণই হলো ঘুমিয়েছে।”
নিশো অসহায় চোখে তোয়ার দিকে তাকিয়ে আফসোসের সাথে বলল,“ইশ! খুব মাথাব্যথা করছিল হয়তো। কোনরুমে আছে ও?”
তোয়া ইশারায় ইয়াদের রুম দেখিয়ে বলল,“ওই যে ওখানে। ইয়াদের রুমে।”
“আচ্ছা। তুই এখানে থাক, আমি আসছি।”
তোয়া হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,“তাড়াতাড়ি আয়, ভাইয়া। একটা বিয়ে শেষ হতেই আরেকটা বিয়ের খবর পেয়ে গেছি। এবার শুধু বিয়ে আর বিয়ে, নো থামাথামি।”
নিশো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,“কার বিয়ে?”
“তুই তাড়াতাড়ি ঘুরে আয় পরে বলছি।”
নিশো আর আগ্রহ দেখালো না। ধীরপায়ে ফালাকের খোঁজে এগিয়ে চলল।
নিশো যখন তোয়ার সাথে কথা বলছিল তখন আবির পাশেই দাঁড়িয়ে। আবছা আবছা দুজনের কথা শুনেছে সে। তোয়া তার দিকে বেশ আগ্রহে এগিয়ে এলো। পাশে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলল,
“আবির ভাইয়া! খুশির খবর আছে।”
বেশ সন্দেহজনক লাগছে তোয়াকে। আবির মূলত নিজেই জানতে চাইতে চাচ্ছিল বিষয়টা। তোয়া আগ্রহ দেখানোয় তার বেশ সুবিধা হলো। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? আজ সব খবর আমার আড়ালেই ঘটে যাচ্ছে। দুই ভাইয়ের মিল হয়ে গেল সেটাও জানি না আবার এখন কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না।”
তোয়া ইশারায় ইভাকে দেখিয়ে বলল,“ওটা ইয়াদের চাচাতো বোন।”
“আমি কী করব?”
“ও তো আমাদের হবু ভাবি হতে চলেছে।”
“মানে? কার বিয়ে? নিশোর?”
“উহু। আমার ভাইয়া তো ফালাককে ভালোবাসে। দেখলি না ফালাকের মাথাব্যথা শুনে সেদিকে ছুটলো।”
আবিরের কেমন যেন মনে হলো। দমবন্ধ করেই কিছু একটা সন্দেহ করে প্রশ্ন করল,“তাহলে কার সাথে বিয়ে? ”
তোয়া হেসে বলল,“তোর সাথে, আবার কার সাথে!”
আবির যেন আঁতকে উঠল। চোখ বড় বড় করে তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “কীহহহ!”
#চলবে……..
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link