প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৩৭+৩৮#প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৩৮

0
406

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৭+৩৮#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮

একই সাথে দুটো বড় বড় খবর এবার যেন আরহামে’র সত্তা পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’র দিকে তাকানোর মুখটা পর্যন্ত ওর নেই। শেখ বাড়ীতো রীতিমতো কান্নার রোল পরে গেলো। তোঁষাকে নিয়ে আরহাম সোজা ওর ফ্লাটে চলে এসেছে তখন। পিছুপিছু তুষার ও এলো। তবে তোঁষার সামনে যায় নি। রুমের থেকে প্রায় ঘন্টা খানিক পর বেরুলো আরহাম। তুষার ড্রয়িং রুমে মাথা নিচু করে বসে আছে। আরহাম এগিয়ে এসে ধপ করে তুষারের পাশে বসে পরলো। মাথা নিচু করে বললো,

— আমি আমার ওয়াদা রাখতে পারলাম না ভাই। তুঁষ’কে ঐ অবস্থায়….

তুষার সহসা থামিয়ে দিলো আরহাম’কে। নিজের হাতের রিপোর্টগুলো দিলো আরহামে’র হাতে। ভ্রু কুঁচকে তা হাতে নিলো আরহাম। পাতা গুলো উল্টে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো “পজেটিফ” লিখা জায়গাটায়। শূন্য চোখে মাথা তুলে তাকালো তুষারের দিকে অতঃপর আবার সেই লিখাটার দিকে। তুষার আরহামে’র পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলো ও। চোখে ওকে তুষার চাইলো ভরসা দিতে কিন্তু পারলো না। উঠে দৌড়ে রুমে চলে গেলো এদিকে আরেকটা রিপোর্ট পরে রইলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে ঐ রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে রইলো তুষার। তোঁষাকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যার্থ এক ভাই ঠাই বসে রইলো। নড়লো না। শক্তি পেলো না।

আরহাম তোঁষা’র উপর এক প্রাকার ঝাপিয়ে পরলো। সারা মুখে চুমু খেতে খেতে আবেগী গলায় ডাকলো,

— এই প্রাণ? আমার প্রাণের টুকরো। আমার তুঁষ। জানিস কি হলো? আমি আবার বাবা হব। উঠ। আর কত ঘুমাবি? এই তুঁষ? উঠ না।

ঢুলুমুলু তোঁষা নড়েচড়ে শুয়ে পরলো আবার। আরহাম ওর পেটটা উন্মুক্ত করে নজর দিলো সেখানে। উঁচু হওয়া একটা থলথলে পেট। তুঁষটা অনেকটাই গুলুমুলু হয়েছে আগের থেকে। আগে যতটা ছিলো তার থেকেও অনেকটা বেশি মোটা হয়েছে। তাই বোধহয় বুঝা যায় নি। আরহাম নাক, মুখ ডুবিয়ে দিলো তলপেটে। একে একে দিতে শুরু করলো ওর ভালোবাসা। বুনে ফেললো এক ঝুড়ি স্বপ্ন। ভুলে গেলো বাস্তবতা।
আদৌ তার বুনন কতটা ভুল। তার তুঁষ কি স্বাভাবিক যে স্বপ্নগুলো স্বাভাবিক হবে?
.
আরহামে’র সেই স্বপ্ন স্বপ্ন ই রয়ে গেলো বোঁধহয়। ডক্টর সোজা বলে দিলো তোঁষার বর্তমান শরীর বেবি ক্যারী করার ক্ষমতা রাখে না। এটা আরহাম জানে। তাই তো পাগল হয়ে ছুটে এসেছে তোঁষাকে নিয়ে। নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে আরহাম বলে উঠলো,

— এবোর্শন। এবোর্শন করব আমরা। ও..ওকে আজই এবোর্শন করুন। আমার শুধু তুঁষ’কে চাই আর কিছু না।

ডক্টর আদিত্য’র মায়া হলো খুব। আরহামের আগাগোড়া তার জানা। কোন এক সময় কাছের বন্ধু ছিলো তারা। আজ আরহামকে দেখলেই তার দীর্ঘশ্বাস বেরুয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আরহামে’র পাশে বসলো ডক্টর আদিত্য। ওর হাতে হাত রেখে বললো,

— এবোর্শন সম্ভব না আরহাম। তুই নিজেও ডক্টর। বুঝিস এসব। চার মাসের বেবিটাকে কিভাবে মা’রব? আর তোঁষার বডি এখন এসব নিতে পারবে না। এটা সম্ভব না।

আরহাম অসহায় চোখে তাকালো। তুষারের দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,

— ভাই আমার পাপ কি এতই বেশি? এর প্রায়শ্চিত্ত আমি আর কতদিন করব?

তুষার কথা বললো না। ডক্টর আদিত্য আরহামে’র কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

— ওর চিকিৎসা চালিয়ে যা। দেখ কি হয় সামনে। সবটা ছেড়ে দে উপর ওয়ালার কাছে। আমি দোয়া করি আরহাম। তুই সুখী হ।

আরহাম কথা বললো না। মানুষের মন ম’রে গেলে যেমন হয় আরহাম’কে তেমনই দেখালো। ছেলেটা আস্তে ধীরে হেটে তোঁষার কেবিনে চলে গেল। ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তোঁষার মাথার কাছে গিয়ে বসলো।
ইলেকট্রিক শক দেয়ার ফলে কিছুটা প্রভাব পরেছে বেবির উপর। আরহামে’র নিজেকে অসহায় লাগলো। বড্ড অসহায়। আজ তার মনে হচ্ছে সে ম’রে যাক শুধু তার তুঁষ আর ছোট্ট প্রাণটা সুখে থাকুক।

____________________

রজনীর পর রজনী একা কাটিয়ে তথ্য এখন একাকীত্ব’কে ভয় পায় না৷ ঢাকা এসেছে আজ দুই দিন। ছুটিতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। বাবা’র জোরাজোরিতে বাধ্য হলো আসতে। খেতে বসেছে এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তথ্য’র মা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই কেউ একজন ওনাকে সালাম দিলো। তথ্য’র হৃদপিণ্ড থেমে গেলো মুহুর্তের জন্য। কার কণ্ঠ শুনলো এটা? ভাবলো একবার হয়তো এটা ওর ভ্রম কিন্তু না। ভ্রম না এটা। ওর মা তুষারের হাতটা ধরে তুষারকে খাবারের টেবিলে বসিয়ে দিলো। তুষার ওর বাবা’কেও সালাম দিলো। তিনজন এতটাই হেসেখেলে কথা বলছে যেন তারা অতি পরিচিত। তথ্য সবে খেয়লা করলো টেবিলে জামাই আদরের খাবার সাজানো। ঢোক গিললো তথ্য। তুষারের চেহারাটা এমন কেন? এমন ভাঙা চাপা ওর তুষারের না। এই বিষন্ন মুখ ওর তুষারের না। একটা শক্তপোক্ত মানুষের হঠাৎ এহেন দশা কেন?
আজ কতটা মাস পর দেখছে তুষারকে? তুষার ওর দিকে তাকালো না। তথ্য’র মা ওকেও খেতে তাগাদা দিলো। খেয়ে দেয়ে তথ্য নিজের রুমে চলে আসলো। তুষার শশুর শাশুড়ী’কে সময় দিচ্ছে।

রাত একটা নাগাদ তুষার তথ্য’র রুমে ঢুকলো। না অনুমতি, না নক। সোজা ঢুকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তথ্য’কে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। কেঁপে উঠলো তথ্য। আজ কত মাস পর ছোঁয়াটা পেলো? আপন পুরুষটার আরো তীব্রকর ছোঁয়া পেতে চাইলো তথ্য। ঘুরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জানান দিলো নিজের আবদার।
তুষার এতমাস পর অন্তত তথ্য’র মন ভাঙতে চাইলো না। মেনে নিলো সবটুকু আবদার। দিয়ে দিলো নিজের দেহ, মনে জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা। সুখের সাগরে ভাসলো দুটি দেহ৷ একটি প্রাণ। দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘ রজনী পার হলো। প্রেমময়। ভালোবাসাময় এক রজনী।
তথ্য’র জীবনের অপেক্ষা শেষ হলো। শেষ রাতে তথ্য মাথা রাখলো তুষারের উন্মুক্ত বুকে। বিরবির করে বললো,

— অপেক্ষা যদি এত সুখ বয়ে নিয়ে আসে তাহলে আমি রাজি অপেক্ষা করতে। আজ সকল অপেক্ষা সার্থক তুষার। সব সার্থক।

তুষার তথ্য’র কপালে চুমু খেলো। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— বেকার জামাই’কে পেয়ে নিজেকে স্বার্থক বলছো?

তথ্য আলতো কিল মা’রলো তুষারের বাহুতে।

— ভুলেও আমার জামাই’কে বেকার বলবেন না।

— অফিশিয়ালি ছেড়ে দিয়েছি।

— আমিও দিব।

— মে’রে ফেলব বোকামি করলে।

— আমি সংসার করতে চাই তুষার। আপনার ছানাপোনার মা হতে চাই। হোক না ছোট্ট একটা সংসার। শুধু সুখ থাকলেই হলো। আপনি ছোট্ট একটা কাজ করবেন আর আমি কোমড়ে শাড়ী গুজে সংসার করব।

— তোমার মতো স্বাধীনচেতা মেয়ের মুখে এসব মানায়?

— এতসব জানি না আমি। প্লিজ তুষার। আমি আপনার কাছে আর কিছুই চাইলাম না শুধু এতটুকু চাই। দিবেন না?

তুষার শব্দ করে তথ্য’ট ঠোঁটে চুমু খেলো। জানান দিলো তার সম্মতি। একে একে জানালো এতমাসের ঘটনা। তথ্য দেখা করতে চাইলো তোঁষার সাথে। তুষার ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— নিব। নিব ওর কাছে।

#চলবে…

খাটের কোণে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে রোদ। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো ওর বাবা। ফ্লোরেই মেয়ের পাশে বসলেন। চোখ দুটো তার টলমলে। ছয়টা মাস তার মেয়েটা স্বাভাবিক নেই। আদর মিশিয়ে ডাকলেন,

— আম্মা?

রোদ তাকালো না। আজকাল কারো ডাকে সাড়া দেয় না ও। নিজের মতো পরে থাকে। না লেখাপড়া, না কোন কথা, না কোন সখ, না কোন স্বাদ।
মেয়ের মাথায় হাত বুলান মি.রহমান। রোদ ফিরেও তাকালো না। উনি যেতেই রোদ ফ্লোরে শুয়ে পরলো। এবার নজর বারান্দায়। শুভ্র আকাশ দেখা যাচ্ছে। পাখি উড়ছে। রোদ ভাবলো, এই পাখিদের পায়ে কি চিঠি পাঠানো যায়? রোদ পাঠাবে। আদ্রিয়ান’কে। কোথায় যে থাকে লোকটা? ঠোঁট উল্টে তাকালো রোদ……

ই-বুক “চিনি” এর অংশ বিশেষ। সম্পূর্ণ ই-বুক পড়ার লিংক কমেন্টে। আপনাদের রোদ আদ্রিয়ানকে পাবেন এখানে।

যারা পড়েছেন বা পড়বেন অবশ্যই বইটই অ্যাপে রিভিউ দিবেন 💜

“সুখ” জিনিসটা কারো সহ্য হয় তো কারো হয় না। ভাগ্যে আরহাম তোঁষার সুখ জিনিসটা বোধহয় একদমই সইলো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তারা আলাদা। আরহামের শিয়রের কাছে বসা ওর মা। ভদ্র মহিলা বারবার চোখ মুছে যাচ্ছেন। একটু দূরে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তুরাগ। উপরে উপরে নিজেকে যতটা ই কঠর দেখাক না কেন ভেতরে ভেতরে তার করা হাহাকার কেবলমাত্র সেই টের পায়। তার প্রথম সন্তান আরহাম। তার প্রথম বাবা অনুভূতির জন্ম দিয়েছে এই আরহাম। এই ছেলেটাকে সে ভালোবাসে। শুধু মাত্র পরিবারের যাতে ভাঙন না ধরে তাই কোনদিন সে তোঁষা আরহামে’র বিয়ের পক্ষে ছিলো না। তুহিন কোনদিন চায় নি আরহামে’র সাথে তার ছোট পুতুলকে বিয়ে দিতে। আরহামে’র হুটহাট রাগ উঠা। নিজের জিনিস একদম নিজের করে রাখা এসব কে ই বা পছন্দ করবে? কোন বাবা ই চাইবে না আরহামে’র মতো ছেলের সাথে নিজের সন্তানের বিয়ে হোক। তুহিন ও চায় নি। তুরাগ পরিবার ভাঙার ভয়ে ছেলেকে কত অপমান করে দূর দূর করে দিয়েছিলো। তার সেই বুকের ধন আজ বিছানায় পরে আছে। ছেলের খোলা বুকে তাকিয়ে তার বুকটা ছেঁত করে উঠে। অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন তাতে। কামড়ের দাগগুলো যেন একদম তাজা। তুরাগের বুকে চাপ অনুভব হলো। মন চায় ছেলেকে বুকে চেপে ধরে রাখতে অথচ সে অপারগ। কোন এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে বাবা ছেলের মাঝে।
আজ তিনদিন ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি। ডক্টর এখনও বললো না কি হয়েছে। তুষারের কাছে শুধু শুনলো আরহাম সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে।
কোন বাবা মায়ের কাছে ছেলের সুইসাইডের কথাটা মানুষ যতটা সহজে বলে জিনিসটা কি আসলেই এত সহজ?

তোঁষাকে দেখে সোজা হসপিটালে ফিরলো তুষার। ওর লাল হওয়া চোখ দেখেই ওর মা দৌড়ে এসে ছেলের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুষার তোঁষা, তোঁষা ঠিক আছে?

তুষার দুই হাতে মা’কে জড়িয়ে রাখলো। একটু সময় নিয়ে ধুকপুক করা বুকে বললো,

— মা পুতুল….

— হ্যাঁ বল। পুতুল কি?

— ও ও ভালো নেই মা। ও ভালো নেই। শুধু কাঁদে। ওর মুখে ওর প্রাণ বাদে কোন শব্দ নেই। আরহাম ছাড়া ও বাঁচবে না মা৷ ও ম’রে যাবে। ওখানে সত্যি ই ম’রে যাবে। বাঁচবে না। আজ আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরলো। বিশ্বাস করো মা, মনে হলো আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। এতদিন আমাকে ও কত আঘাত করলো সেই আঘাতে আমি এত কষ্ট পাই নি যত কষ্ট আজ ওর এই দশাতে পেলাম। ওখানে রাখব না মা৷ ওখানে আমার পুতুল ম’রে যাবে।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো তুষার। ওর মায়ের মনটা ও কেমন আনচান করে উঠলো। তুষার মাকে নিয়েই আরহামে’র কাছে গেলো। তখনই আদনান এলো। পরিবারের সকলেই উপস্থিত এখানে। অপেক্ষা আরহামে’র জ্ঞান ফিরার।
আদনান তুষারকে দেখেই বললো,

— ভাই ডক্টর আসছে। কথা বলে এসেছি।

তুষার শুধু মাথা নাড়লো। কথা বলার শক্তি পেলো না আর।

রাত আটটা নাগাদ চোখ মেলে আরহাম৷ বুঝতে সময় লাগলো নিজের অবস্থান৷ আশেপাশে একে একে সকলকে দেখলেও দেখলো না ওর প্রাণকে। কিছু একটা মনে পরতেই ফট করে উঠে বসলো ওমনিই আদনান ধরলো ভাইকে। ওর মা আরহামকে সজাগ দেখেই ছেলের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অঝোরে কেঁদে উঠলেন। আরহাম একহাতে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে বললো,

— তুঁষ? ভাই তুঁষ?

তুষার এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই আরহাম বললো,

— আমাকে নিয়ে চলো ওর কাছে। শুধু দেখব। একবার দেখব। কথা দিচ্ছি। দূর থেকে দেখব। আমার মন কেমন লাগছে। ও ও ভালো নেই ভাই।

ছেলের পাগলামি দেখে তুরাগ এগিয়ে এসে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো আরহামকে। মুহুর্তে থমকে গেলো আরহাম৷ আজ ঠিক কতটা বছর পর এক ভরসার বুক পেলো সে। দুই হাতে সেই বাবা নামক মানুষটার পিঠ ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো আরহাম।
পরিবেশটা মুহুর্তে ই ভারী হলো। তুরাগের চোখ গলিয়ে পানি পরলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু ধরা গলায় বললো,

— তোর তুঁষ তোরই থাকবে বাবা। নিয়ে যাবে ওর কাছে।

আরহাম কান্নার চোটে কথা বলতে পারলো না৷ আজ ঠিক কত বছর পর সে বাবা নামক ভালোবাসা পেয়েছে তা জানা নেই তার।

_____________

গায়ে কোনমতে এক শার্ট জড়িয়ে তুষার আর আদনানে’র সাহায্য গাড়িতে উঠলো আরহাম। অস্থির হয়ে একবার নিজেই বললো,

— আমি চালাই গাড়ি।

তুষার ওকে শান্ত স্বরে মানা করলো। আরহামে’র হাসফাস লাগছে। একদমই সহ্য হচ্ছে না এই পথঘাট যা পেরুতে এত সময় লাগে।

হাটু পর্যন্ত এক ফ্যাকাশে আকাশী রঙের ঢোলা জামা পরা তোঁষার। তিনজন তাকে চেপে ধরে আছে বেডের সাথে। শরীর মুচড়ে মুচড়ে উঠতে চাইছে তোঁষা। চিৎকার করে কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। ওর কণ্ঠনালী ভেদ করে শুধু এক শব্দ ই বেরুচ্ছে “প্রাণ”। ভালোবাসা জিনিসটা বড় অদ্ভুত। এটা যেমন তোমাকে সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখবে তেমনই ছুঁড়ে মা’রবে অতলে যেখানে হারালেও তুলার কেউ নেই।

একসময় তোঁষার চিৎকার বন্ধ করে দেয়া হলো। তার মুখের ভেতর গুজে দেয়া হলো রুমাল। হাত পা ছটফটিয়ে উঠলো আরহামে’র প্রাণে’র। যাকে আরহাম তুলা তুলা করে বুকে পুরে রাখলো সেই তোঁষাকে যখন ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হলো তখন তার সারা শরীর কাঁপিয়ে হাত পা ছুড়লো মেয়েটা। লাভ হলো না। কেউ দয়া দেখালো না তোঁষাকে। চোখ গড়িয়ে পানি পরলো। বড় বড় চোখ করে তোঁষা খুঁজলো। পেলো না কাঙ্খিত ব্যাক্তিকে। নেই তোঁষার প্রাণ। কোথাও নেই।

এসাইলেমে ঢুকা মাত্র আরহাম যেন আরো অস্থির হলো। ভুলে গেলো তুষারকে দেয়া ওয়াদা।
তুষার ওকে নিয়ে ডক্টরের ওখানে যাওয়া মাত্র জানা গেলো তোঁষাকে শক দেয়া হচ্ছে। আরহাম নেতানো শরীরটা যেন এটা শোনামাত্র শিউড়ে উঠে। সেলের দিকে দৌড়ে যেতেই হা করে তাকিয়ে রইলো আরহাম৷
চিৎকার করে ঢুকতে নিলো ভেতরে। তুষার চেয়েও আটকাতে পারলো না। সোজা ভেতরে ঢুকে একেএকে সব তোঁষা থেকে খুলে দিলো। তোঁষা শরীর ছেড়ে দিলো। আরহাম গর্জে উঠে তোঁষার নামে মুখে অজস্র চুমু খেতে খেতে ডাকলো,

— প্রাণ। আমার প্রাণ। এই যে আমি। কলিজা আমার তাকা না। একটু তাকা। আমাকে মাফ কর তোঁষা৷ আমাকে মাফ কর।

জ্ঞানহীন তোঁষা হয়তো জ্ঞানে থাকলে অবাক হতো আরহামে’র মুখে ” তোঁষা” ডাক শুনলে। আরহাম সোজা কোলে তুলে নিলো ওকে।
কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। শুধু এক পলক লাল চোখে তাকালো উপস্থিত ডক্টরের দিকে। ওর নজরে কেঁপে উঠলেন তিনি।
এদিকে তোঁষার সদ্য রিপোর্ট হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। মাত্র ই ওর হাতে দেয়া হয়েছে এটা। জানা নেই তুষারের। কি বয়ে আনবে এই রিপোর্ট তোঁষা আরহামে’র জীবনে।

#চলবে…
[যারা ভাবছেন এখন বুঝি সুখের সুখের পর্ব পাবেন তাদের জন্য 🥹]

গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদ। আদ্রিয়ানের শক্ত হাতের এক থাপ্পড় খেতেই কুপোতকাত অবস্থা। অথচ আদ্রিয়ান থেমে নেই পুণরায় এক জোড়ালো থাপ্পড় মারলো রোদের গালে। এবার ছিটকে গিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো রোদ। ঠোঁট কেটে চিকন ধারায় রক্ত গড়িয়ে পরেছে তার। রিশান আদ্রিয়ানকে টেনে ধরে বললো,

— কি করছিস? পাগল হয়েছিস? কেন মারছিস?

— ছাড় আমাকে। ও পাগল পেয়েছে আমাকে। হাত কেটে হুমকি দেয় আমাকে। সাহস দেখ ওর।

বলেই তেড়ে আসে রোদের দিকে। ভয়ে ইয়াজকে চেপে ধরে জোরে কেঁদে ফেলে রোদ। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

— মারো মারো সবাই মারো। রোদকে মেরে ফেলো।

আদ্রিয়ান থেমে গেলো। চোখ বুজে শ্বাস টানলো। নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালেও কতটুকু কাজ হলো জানা নেই। এগিয়ে এসে রোদকে টেনে নিলো ইয়াজ থেকে। রোদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই আদ্রিয়ান ওকে বুকে চেপে ধরলো। এই প্রথম। হ্যাঁ এই প্রথম এতটা কাছাকাছি দুইজন। রোদের কান্না থেমে গেলো নিমিষেই। আদ্রিয়ান থেকে অদ্ভুত সুন্দর এক ঘ্রাণ আসে। রোদ তা শুঁকতে ব্যাস্ত। আদ্রিয়ানের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here