রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪২| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
511

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

চিন্তিত ভঙ্গিতে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মাধুরী। প্রলয় এখনো বাড়ির ফেরেনি। তাকে খুঁজতেই বের হয়েছেন মোর্শেদ শিকদার আর মেহরাব শিকদার। কিছুক্ষণ আগেই অর্পণ আর ইরাকে বরণ করে বাড়িতে আনা হয়েছে। অর্পণ যেতে চেয়েছিল।কিন্তু বাড়ির অন্যরা কিছুতেই তাকে বের হতে দিলেন না। প্রলয়ের জন্য বাড়ির প্রত্যেকেই খুব চিন্তা করছেন৷ চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক নয় কী? এই তো কিছুদিন আগে এত বড়ো একটা ফাড়ার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে৷ দুদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছে। তখন কমিউনিটি সেন্টার থেকে ছেলেকে একা পাঠানোটাই বোকামি করেছেন মাধুরী৷ ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন তিনি৷ বাড়ি ভরতি মেহমান৷ অন্যদিকে লেকের ধারে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়। তখনকার বলা মৃত্তিকার প্রত্যেকটা কথা কানে এখনো বাজছে। সে কিছুতেই মানতে পারছে না— তাদের অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই চলে গিয়েছে। মৃত্তিকাকে সেদিন এই লেকের ধারেই পেয়েছিল প্রলয়। আজও সে এই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মৃত্তিকার এই জীবনের জন্য একমাত্র দায়ী সে নিজেই৷ প্রলয় খুব করে ভাবছে‚ মহুয়াকে কে খুন করেছে? ভূমিকে মে’রে ফেলার চেষ্টার পেছনে কার হাত ছিল? সব সত্যির উন্মোচন তাকেই করতে হবে। প্রলয় বুঝল এর পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। কেউ একজন খুব ঠান্ডা মাথায় প্রত্যেকটা পরিকল্পনা করেছে। তার ভুমি কন্যাকে কষ্ট দেওয়ার পেছনে যারই হাত থাকুক না কেন‚ সে তাকে চরম শাস্তি দেবে। অপরাধীর শরীরের প্রত্যেকটা অংশ কুমিরকে খাওয়াবে। এর পেছনে যদি বিরোধীদলীয় নাজিম চৌধুরীর হাত থেকে থাকে তাহলে তাকেও শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না সে। এর জন্য যদি তাকে জেলেও যেতে হয় তবুও সে পিছুপা হবে না। এক একটাকে দেখে ছাড়বে।

রাত তখন সাড়ে এগারোটা৷ বারান্দায় বসে রয়েছে মৃত্তিকা৷ তনুজার কথাগুলো তাকে গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে৷ একটা কথা তো ঠিক— সেদিন প্রলয়ের কোনো কথা না শুনেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ নিজের পক্ষে কথা বলবে সেই সুযোগটা পর্যন্ত সে প্রলয়কে দেয়নি৷ তবুও প্রলয়ের প্রতি চাপা অভিমানের পাহাড় আকাশসম৷ সহজে ভাঙবে না৷ প্রলয়কে তার শাস্তি পেতে হবে৷ তার ভালোবাসা যদি নিঃস্বার্থই থাকত তাহলে অবিশ্বাস শব্দটা জায়গা পেত না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ কিছু একটা ভেবে ঘরের ভেতরে চলে গেল৷ তনুজা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ সে তার মামনির পাশেই শুয়ে ছিল৷ ঘুম আসছিল না বিধায় বারান্দায় গিয়েছিল৷ কিছুক্ষণ সময় কাটাল৷ প্রলয়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে আজ৷ কেমন একটা অদ্ভুত গুমোট অনুভূতি হচ্ছে! মৃত্তিকা বুঝতে পারছে না। কোনো কিছুতেই যেন শান্তি নেই৷ ঘরে এসে চার্জিং এ বসিয়ে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করল৷ এই নাম্বারটা আর কারোর না‚ মেহরাব শিকদারের৷ নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী আর মাত্র তিনদিন সময় আছে মেহরাব শিকদারের কাছে। সময় ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে৷ মুখোশ উন্মোচন করার সময় হয়ে আসছে যে!

অন্যদিকে মেহরাব শিকদার আর মোর্শেদ শিকদার একটা লেকের ধারে এসেছেন৷ প্রলয়ের গাড়িটা শেষ বার এখানেই দেখা গিয়েছে। লেকের ধারে গাড়ি পড়ে আছে কিন্তু প্রলয় কোথাও নেই! ওকেই মূলত খুঁজছেন উনারা৷ এমন সময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো মেহরাব শিকদারের ফোনে৷ প্রথমত তিনি রিসিভ করলেন না৷ একমাত্র ভাইপোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আপাতত তাকেই খুঁজে বের করা উচিত। কিন্তু পরপর কয়েকবার রিং হওয়ায় খুবই বিরক্ত হলেন তিনি৷ কল রিসিভ করে রাগান্বিত স্বরে বললেন‚

“দেখছেন কল রিসিভ করছি না তার মানে‚ ‘ব্যস্ত অথবা বিরক্ত’ দুটোর একটা তো হবেই। এতটুকু কমন সেন্স নেই? বারবার কল করে বিরক্ত করছেন কেন?”

মৃত্তিকা শান্ত মোলায়েম কণ্ঠস্বরে বলল‚ “আস্তে ডক্টর মেহরাব শিকদার!”

মেয়েলি কণ্ঠ কিছুটা চেনা মনে হলো। কোথাও একটা শুনেছেন বোধহয়! মেহরাব শিকদার শুধালেন‚ “কে বলছেন?”

আফসোসের সুরে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “এ কী এত সহজে ভুলে গিয়েছেন? আমি আপনার পরিচিত একজন বলছি।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি৷ কিন্তু কে আপনি?”

“গেস করুন তো— কে আমি!”

যারপরনাই বিরক্ত হলেন মেহরাব শিকদার। এত হেয়ালি সহ্য হচ্ছে না উনার৷ তাই তিনি বললেন‚ “আশ্চর্য! আপনি পরিচয় না দিলে আমি বুঝব কী করে?”

“যাকে মে’রে ফেলার জন্য খু’নি মেহরাব শিকদার নরপিশাচে পরিনত হয়েছে‚ সে তার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারছে না? লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেলে হবে?”

কেঁপে উঠল মেহরাব শিকদারের কণ্ঠনালি। কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন‚ “ভ..ভূমি!”

অপাশ থেকে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। মেয়েটা বলল‚ “উঁহু! আমি মৃত্তিকা।”

মোর্শেদ শিকদারের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এলেন মেহরাব শিকদার। না জানি কথা বলার সময় ভাইয়ের সামনে বেফাঁস কথাবার্তা বেরিয়ে যায়৷ কিছুটা চিন্তা তো অবশ্যই হচ্ছে উনার। মোর্শেদ শিকদারকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে মেহরাব শিকদার একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। ফোনটা আবারও কানের কাছে নিয়ে বললেন‚

“তুমি বেঁচে আছ?”

“ম’রে যাওয়া উচিত ছিল তাইনা?”

মেহরাব শিকদার ক্রমশ ঘামছে৷ মৃত্তিকাই যে ভূমি হবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন৷ দুদিন ধরে মৃত্তিকাকে গভীর ভাবে অবলোকন করছিলেন তিনি। মেহরাব শিকদারকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে মৃত্তিকা বলল‚

“কী হলো মেহরাব শিকদার— ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?”

ভাবনার ঘোর কাটল যেন! শুকনো ঢোক গিলে গলা পরিষ্কার করলেন মেহরাব শিকদার। প্রত্যুত্তরে বললেন‚ “মেহরাব শিকদার এত সহজে ভয় পায় না৷ সে হচ্ছে গভীর সমুদ্রের মাছ। তাকে দাবিয়ে রাখা অত সহজ না৷ তুমি এখনো মানুষ চেননি মেয়ে!”

“আপনিও এখনো আমাকে চিনলেন না। সমস্যা নেই খুব শীগ্রই চিনে যাবেন৷ আপনার প্রাণ ভোমরা তো এখন আমার হাতেই৷”

কিছুটা ঘাবড়ালেন মেহরাব শিকদার। কিন্তু বিপরীত পক্ষের কাছে প্রকাশ করলেন না৷ তাহলে যে লড়াইয়ে হেরে যেতে হবে। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বললেন‚

“এখন আমার‚ তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই৷ তোমার প্রাণ ভোমরা এখন বিপদে আছে৷ তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না— এই খবরটা হয়তো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে৷”

“আপনি ভুল ভাবছেন। এ জীবনে আমার কোনো প্রাণ ভোমরা নেই৷ তাই আমাকে ভয় দেখালেও কাজে দেবে না৷”

“বেচারা প্রলয়! আজ একটা সত্যি কথা বলি। প্রলয় তোমাকে কেন ভুল বুঝেছিল— সেটা শুনবে না?”

“আপনার থেকে আমার সেসব জানতে হবে না।”

“আরে একটু শুনেই দেখ! আমি যে আমার ভাইপো-র কষ্টগুলো সহ্য করতে পারি না৷ ছেলেটার কষ্ট চোখে দেখা যায় না৷ তবে কী করব বল— পৃথিবীতে কী মেয়ের অকাল পড়েছিল? সেই তোমাকেই বিয়ে করতে হলো? আমি আমার ভাইপো-কে ভীষণ ভালোবাসি কিন্তু তোমাকে আমার সহ্য হয় না৷ তুমি আমার জন্য একপ্রকার এলার্জির মতোই। তাই তো তোমাদের দুজনকে আলাদা করে দিলাম৷ তোমার মতো দূর্বল নারীকে হারাতে আমার একটা ইশারাই যথেষ্ট।”

“আপনার অহেতুক কথা শুনতে আমি কল করিনি৷ আসল কথায় আসি! আপনার কী ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছে না?”

“তোমাকে আমার মোটেও ভয় করছে না৷ বরঞ্চ করুণা জন্মাচ্ছে৷”

“আমার কিন্তু আপনার প্রতি কোনো করুণা নেই। এত দয়ালু আমি নই। একটা সিক্রেট কথা বলি আপনাকে।”

মেহরাব শিকদার চরম বিরক্ত মৃত্তিকার উপর। সেটা উনার কথার ধরনেই বোঝা যাচ্ছে৷ সুযোগ পেলে নিজের হাতে পথের কাটা উপড়ে ফেলবেন তিনি।

মৃত্তিকা কিছুটা ফিসফিস করে বলল‚ “আপনার হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই৷ হুট করেই আপনার মুখোশ খুলে পড়ে যাবে। নিজের বউ আর পরিবারকে মুখ দেখাতে পারবেন তো? আমার মায়ের খু’নিকে কিন্তু আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব। আর আমার অনাগত বাচ্চাকে মে’রে ফেলার শাস্তিও তাকে পেতে হবে৷ সে যত বড়ো মানুষটাই হোক না কেন!”

এবার মেহরাব শিকদার বললেন‚ “সেটা কে?”

অতি সহজ করে মৃত্তিকা বলল‚ “কে আবার! আপনার বিজনেস পার্টনার।”

এবার কণ্ঠনালি কিছুটা কেঁপে উঠল৷ কম্পিত স্বরে মেহরাব শিকদার আবারও জিজ্ঞেস করলেন‚ “ক..কার কথা বলছ?”

“প্লিজ আমার সামনে অন্তত নাটক করবেন না৷ সমস্ত সত্যিটার একমাত্র সাক্ষী আমি নিজে৷”

“আর সেই সাক্ষীটাই যদি আর না থাকে?”

“মৃত্তিকাকে ভয় দেখাচ্ছেন? ভুলে যাবেন না— পুরোনো অবলা ভূমি নিজের খোলস ছেড়ে মৃত্তিকা সত্তা ধারণ করেছে৷ তাকে দাবিয়ে রাখা মোটেও সহজ কাজ নয়। যা আপনার দ্বারা হবে না৷ আমার যা যা বলার ছিল আমি বলেছি৷ আমাদের আবারও দিন তিনেক পর দেখা হবে৷ ততদিনের জন্য আপনাকে ভালো থাকতেই হবে৷ সময় মতো খাবার আর ঔষধ খাবেন৷ আপনি যদি নিজের খেয়াল না রাখেন তাহলে আমি আমার প্রতিশোধ নেব কী করে? আমার জন্য হলেও আপনাকে ভালো থাকতে হবে।”

এতগুলো কথার মাঝে চুপ করে রইলেন মেহরাব শিকদার। মাথায় অনেক চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ওদিকে মোর্শেদ শিকদার উনাকে ডাকছেন। সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। মেহরাব শিকদারকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে মৃত্তিকা আবারও বলল‚

“আল্লাহ হাফেজ খু’নি মেহরাব শিকদার।”

কল কে’টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাগে বি’স্ফো’রিত হলেন মেহরাব শিকদার। ভূমির কাছে কিছুতেই হেরে যেতে পারেন না তিনি৷ মেয়েটার এমন গা জ্বালানো কথাবার্তা মোটেও সহ্য হচ্ছে না উনার। ফোনটাকে পকেটে রেখে মোর্শেদ শিকদারের কাছে গেলেন। প্রলয়কে আবারও খুঁজতে শুরু করলেন৷

রাত হচ্ছে। এবার একটু ঘুমের প্রয়োজন। মৃত্তিকা বারান্দা থেকে প্রস্থান নিল। অর্পণ মেসেজ দিয়েছিল তাকে। প্রলয়কে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকটা কোথায় গিয়েছে সেই নিয়েও চিন্তা হচ্ছে৷ প্রলয়ের প্রতি জমা অভিমান দুজনের দূরত্ব বাড়িয়েছে। তার মানে তো এই নয় প্রলয়ের প্রতি চিন্তা‚ ভালোবাসা একচুল অবধি কমেছে। লোকটার জন্য তার চিন্তা হয়। সেদিনের এক্সিডেন্টের পর থেকে প্রলয়কে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে সে৷ নাজিম চৌধুরী উন্মাদ হয়ে উঠেছে৷ যখন তিনি জানতে পেরেছে উনার কালোবাজারি গোডাউন প্রলয়ের কথায় সরকারি লোকেরা সীল করে দিয়েছে৷ কাজটা চুপিসারে হয়েছিল বিধায় কারোরই জানা নেই। নাজিম চৌধুরীর অনেক টাকা লস হয়েছিল৷ তখন থেকেই প্রলয় উনার চক্ষুশূল। আরও বিরাট ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। যেগুলো প্রলয়েরও জানার কথা না৷ জানলে এতদিনে সবার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যেত। মৃত্তিকার নজর সবার উপরেই রয়েছে৷ সবাইকেই সে চোখে চোখে রাখছে৷ বিশেষ করে মেহরাব শিকদার। সমস্ত ভাবনাকে আলাদা করে মৃত্তিকা বিছানায় গিয়ে তনুজার পাশে শুয়ে পড়ল৷ হুট করে ঘুম ভেঙে গেলে‚ তাকে না পেলেই অস্থির হয়ে পড়বেন তিনি। মেয়েকে নিয়ে ভারী চিন্তা হয় উনার।

রাত তখন দেড়টা…

প্রলয়কে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন মোর্শেদ শিকদার এবং মেহরাব শিকদার। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ তার চিন্তায়‚ এতটা সময় ধরে জেগে ছিলেন। লেকের ধারে শানবাঁধানো সিঁড়িতে বসে ছিল। সকল ঝঞ্ঝাট থেকে পালাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তা আর হলো কোথায়? বাড়ির সকলেই খুব কথা শোনাচ্ছে প্রলয়কে৷ তার মতো দায়িত্বশীল একজন কী করে এমনটা করতে পারে! অর্পণ আর ইরাও বৈঠকখানায় রয়েছে। অর্পণ অপলক নেত্রে তার ভাইকে দেখছে৷ প্রলয়কে মোটেও ঠিক লাগছে না। তার চোখমুখ জানান দিচ্ছে— কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে৷ যে কাউকে বলতে চাইছে না প্রলয়৷ অর্পণ এগিয়ে তার ভাইকে ধরল৷ জিজ্ঞেস করল‚

“তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে ভাই?”

সব সত্যিটা জেনে অর্পণ তার কাছ থেকে লুকিয়ে গিয়েছে৷ ভেবেছে হয়তো প্রলয় এর কিছুই জানবে না৷ অর্পণের প্রতি রাগ হলো৷ সত্যি মিথ্যার দারুণ যবনিকা তৈরি করেছে এরা। অর্পণের হাতটা ঝেড়ে সরিয়ে দিয়ে প্রলয় বলল‚ “সকলের এত এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”

মোর্শেদ শিকদার এবার চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রলয়কে বললেন‚ “খুব লায়েক হয়ে গিয়েছ তাই না? যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করবে৷ মনে রেখ— এটা যৌথ পরিবার। কোথাও গেলে তোমাকে বলেই যেতে হবে! সবাই যে এতক্ষণ তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল তার মূল্য কী তোমার কাছে আছে?”

“না নেই— এখানে কারোর মূল্য নেই আমার কাছে৷”

মেহরাব শিকদার এগিয়ে এসে বললেন‚ “এ তো কেমন পরিবর্তন হয়েছে? বাবার মুখে মুখে তো কখনো কথা বলিসনি!”

টি টেবিলের উপর থাকা ফুলদানিটা সজোরে মেঝেতে আছাড় মারল প্রলয়৷ রাগ এখন তড়তড় করে বাড়ছে৷ মেহরাব শিকদারের একটা টু পরিমাণ শব্দও সহ্য হলো না। প্রলয়ের এহেন রাগ দেখে থরথর করে কাঁপছে পূর্ণ পুষ্প৷ প্রলয় একবার তার বোনদের দিকে তাকাল। যত যা-ই হয়ে যাক বোনদের মেয়ে দুটো ভয় পেয়েছে তাই সে তৃপ্তিকে বলল‚ ওদের দুজনকে ঘরে পৌঁছে দিতে৷ প্রলয়ের কথানুযায়ী ওরা চলে গেল। প্রলয় এবার মেহরাব শিকদারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল‚

“সেদিন তুমি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলে চাচ্চু? কেন সেদিন বলেছিলে— ভূমি দুই সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট? অথচ ও আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল! এত বড়ো মিথ্যে কথাটা তুমি কেন বলেছিল? তোমরা তো জানো কাজের প্রেসার আমি একটু বেশি হাইপার হয়ে যাই। সেদিন যখন আমি ভুল করছিলাম তখন আমাকে কেন আটকাওনি?”

প্রলয়ের কথার সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই কণ্ঠে মাধুরী বললেন‚ “আমাদের উপর যে চেঁচাচ্ছিস— ওই মেয়ে যে বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছিল! তোকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেছিল? ওই ঘটনার জন্য ভূমিই দায়ী ছিল। ও কেন সবকিছু খোলাসা করল না? কেন চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল? এতই যদি নির্দোষ থাকত তাহলে মুখে উপর কেন সত্যিটা বলল না? এই মেয়ে ম’রেও শান্তি দিচ্ছে না।”

ভূমির বিরুদ্ধে এ কথা শুনে প্রলয় আরও রেগে গেল৷ রেগে গেলে তার মাথার ঠিক থাকে না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে৷ আরেকটা ফুলদানি নিয়ে গ্লাসের টি-টেবিলটার উপর সজোরে আঘাত করল। মুহূর্তেই টি-টেবিলের কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইরা তার কান চেপে রেখেছে৷ অর্পণ দ্রুত গিয়ে প্রলয়কে ধরল৷ এখন তাকে না আটকাকে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলা কেউ আটকাতে পারবে না৷ প্রলয়কে জাপ্টে ধরে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“তুমি একটু শান্ত হও৷ হুট করে তোমার কী হলো? এমন রিয়েক্ট করছ কেন?”

প্রলয় আবারও অর্পণকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল‚ “একদম আমাকে ছুঁবি না৷ তোকে আমার ভাই মানতেও কষ্ট হচ্ছে৷ তুই আমাকে ঠকিয়েছিস। এতই যদি আমার ভালো চাইতি তাহলে সত্যিটা এভাবে লুকিয়ে যেতে পারতি না৷”

উপস্থিত কেউই বুঝল না প্রলয় কোন সত্যির কথা বলছে৷ প্রলয়ের এমন ব্যবহারের মেহরাব শিকদার সহ সকলেই হতভম্ব। প্রলয় তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল‚

“ভূমির উপর দোষ চাপানোর চেষ্টাও করবে না মা। সব দোষ আমি করেছি। আমিই অপরাধী। ওকে অবিশ্বাস করা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো পাপ। আর আমার পাপের শাস্তি জীবদ্দশা বয়ে বেড়াতে হবে৷ মাঝে মাঝে আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে৷ আমি তো সেই একবছর আগেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। এ দহন আর নেয়া যাচ্ছে না৷”

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে কেঁদে দিলেন মাধুরী। কী থেকে কী হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না৷ শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছেন৷ এবার তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কতবড়ো ভুল তিনি করেছেন! ছেলের এমন অবস্থা কোনো মা-ই সহ্য করতে পারবে না। অর্পণের খালা‚ মামী আর গুলবাহার সহ সকলেই এখন উপস্থিত। প্রিয় নাতির এমন অবস্থা দেখে খুবই খারাপ লাগল উনার। তিনি গিয়ে প্রলয়কে সামলে নিলেন। গুলবাহারকে পেয়ে কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলো স্বাক্ষর। উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল৷ প্রলয়কে ছোটো বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখে স্কলেরই খুব খারাপ লাগছে৷ আজ প্রলয় নিজের মাঝে নেই। অর্পণ দূরে সরে দাঁড়াল। এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে৷ মনে।মনে ভাবছে‚ এই ভয়টাই তো সে এতদিন ধরে পেয়ে আসছে৷ ইরা দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণের পাশেই। ফোন বের করে মৃত্তিকাকে ভিডিও কল দিল অর্পণ৷ তার জানা নেই মৃত্তিকা এখনো জেগে রয়েছে কি-না! কয়েকবার রিং হলো কিন্তু কল রিসিভ হলো না। হতাশ হলো অর্পণ। একটা সুযোগ হাত থেকে ফসকে গেল৷ ভেবেছিল এই একটা সুযোগ রয়েছে দুজনের ভুল বোঝাবুঝি দূর করার৷ প্রলয়ের হুট করে কী হয়ে এটা সবারই অজানা। তবে প্রলয়ের কষ্টটা ঠিক কীসে সেটা সবাই জানেন। প্রলয় একবার গুলবাহারের দিকে তাকিয়ে বলল‚

“নানুমণি! আমার জীবন থেকে সব সুখ চলে গিয়েছে।”

প্রলয়কে শান্ত করার জন্য গুলবাহার বললেন‚ “তুই আমার সঙ্গে ঘরে আয়। আর বাকিরা সবাই নিজেদের ঘরে যাও। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। এবার সকলের ঘুমের প্রয়োজন।”

এবার যে যার ঘরে চলে যাচ্ছে। মাধুরীকে জোর করে মোর্শেদ শিকদার ঘরে নিয়ে গিয়েছেন। গুলবাহার উনার নাতিকে নিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত কামরায় চলে এলেন। নিজে বিছানায় আগে বসে‚ প্রলয়কে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললেন। ছোটো বাচ্চাদের মতো প্রলয়ও তেমনটাই করল। গুলবাহার আলতো হাতে নাতির চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছুটা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন‚

“তোর কী হয়েছে নানুভাই? আমাকে সবটা খুলে বল৷ কমিউনিটি সেন্টারে শেষ বার তোকে আমি মৃত্তিকা নামক মেয়েটার সঙ্গে দেখেছি। ও কী তোকে কিছু বলেছে?”

“ও মৃত্তিকা নয়। ও-ই আমার ভূমি কন্যা। ওকে চিনতে আমি মোটেও ভুল করিনি। যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে আমার কাছে। জানো নানুমণি— ভূমির বাচ্চাটা আর নেই। সেদিন রাতে বাচ্চাটা…!”

আর কিছু বলতে পারল না প্রলয়। গলা ধরে আসছে তার৷ বেশ অনেকটা সময় চুপ করে রইল প্রলয়৷ গুলবাহার তাকে সময় দিলেন‚ মনের সকল কষ্ট উগলে দেওয়ার জন্য। প্রলয় পুনরায় বলল‚

“আমার সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। আমি আর আগের আমিটা নেই। আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। আসলে প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। ভূমির প্রতি অন্যায় তো আমিও করেছি। নিজের অজান্তেই সন্দেহের বশে নিজের স্ত্রীকে অবিশ্বাস করেছি আমি। এর শাস্তি তো আমাকে সারাজীবন ভর পেয়ে যেতে হবে। আমি এই মুখটা ভূমিকে আর দেখাতে চাই না। ও ঠিকই বলেছে— আমি ক্ষমারও অযোগ্য।”

“এভাবে বলে না নানুভাই। আমার নানুভাই সবথেকে ভালো। হয়তো এখন সময়টা খারাপ যাচ্ছে তার মানে এই নয় ভালো দিন আসবে না! ভালো দিন অবশ্যই আসবে৷ তোর ভূমি তোর কাছেই ফিরে আসবে। সম্পর্কের সুতো কী এত সহজে ছিড়ে ফেলা যায়?”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here