রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৩| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

3
794

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিভীষিকাময় অহোরাত্র কাটিয়ে নব দিবস সূচনা। প্রকৃতি যেন মেতে উঠেছে নব দিবসের মহিমায়। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ ঝলমলে। কানায় কানায় রোদ্দুরে মোহাবিষ্ট। সকাল সকাল মৃত্তিকাকে খুবই চনমনে লাগছে। কালই তো কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করে ফেলেছিল আর আজই স্বাভাবিক। এ যেন এক নতুন মৃত্তিকা। এই তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুজনের জন্য নাস্তা তৈরি করল। এরপর মা মেয়েতে মিলে তা খেলও। এরপর সারাটাদিন তনুজার সঙ্গেই কাটিয়েছে মৃত্তিকা। খুব আড্ডা দিয়েছে দুজনে মিলে। যেন অনেক কথা জমে ছিল৷ একে অপরের সুখ দুঃখ আজ নিঃসারণ হয়েছে। সময় যে কীভাবে অতিবাহিত হয়ে গেল টেরই পাওয়া গেল না। চোখের পলকেই সকাল থেকে সন্ধ্যে নেমে এসেছে৷ আজ অর্পণ ইরার রিসেপশন। আয়নার সামমে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে মৃত্তিকা৷ কালো রঙা শাড়ি পড়েছে৷ ঘন দীঘল কেশগুছকে উঁচু করে খোঁপা করেছে৷ হালকা সেজেছে আজ। মৃত্তিকা খুবই খোশমেজাজে রয়েছে আজ৷ আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে আর গুনগুন করছে। তার এহেন কাজে কিছুটা অবাক হলেন তনুজা৷ তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন মৃত্তিকার ঠিক পেছন দিকটায়৷ তনুজা শুধালেন‚

“অর্পণের রিসেপশনে যাবি তুই?”

“যেতে তো আমাকে হবেই মামনি। কাঙ্ক্ষিত দিনটা যে চলেই এসেছে।”

তনুজা বুঝলেন না মৃত্তিকা ঠিক কোন দিনটার কথা বলছে। তাই তিনি পুনশ্চ শুধালেন‚ “কোন দিনটার কথা বলছিস তুই?”

আয়নার কে তাকিয়ে ক্ষীণ হেসে মৃত্তিকা বলল‚ “যেই দিনে আমি আমার আম্মাকে হারিয়েছিলাম— সেই দিনটা।”

“তুই কিছু ভাবছিস তাইনা?”

মৃত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তনুজাকে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়৷ মৃত্তিকা ঠিক কী করতে চাইছে বুঝলেন না তিনি৷ অবাক চোখে তাকিয়েই দেখতে লাগলেন। তনুজার হাতখানা নিজের হাতের মাঝে রেখে মৃত্তিকা ধরা গলায় বলল‚

“আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তুমি দিদিভাইয়ের কাছে চলে যেও।”

অস্থির হয়ে উঠলেন তনুজা৷ মৃত্তিকার কিছু হয়ে যাবে এটা শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার নেমে এলো৷ ত্রস্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি শুধালেন‚ “কেন— তোর কী হবে?”

“এই একটা দিনের জন্যই আমি এতগুলো দিন ধরে অপেক্ষা করছি। ওই লোককে নিজের হাতে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমার আম্মার আত্মা শান্তি পাবে না৷ জীবদ্দশায় আমার আম্মাকে কম কষ্ট পেতে হয়নি। সবকিছুর জন্য দায়ী ওই মেহরাব শিকদার। ওই লোককে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না৷”

কিছুটা শান্ত হয়ে তনুজা বললেন‚ “শাস্তি দেবার পদ্ধতিটা কী অন্যভাবে করা যায় না? আমি তোকে হারাতে পারব না মা৷”

তনুজার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল মৃত্তিকা৷ মনে হচ্ছে যেন তার আম্মার কোলই এটা৷ শুয়ে থেকেই তনুজার হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল‚ “আমি যে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

কাল রাতের ঘটনা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। প্রলয়ও বেশ শান্ত। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে কাল রাতে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছে৷ মনে হচ্ছে যেন কোনো বড়ো ঝড়ের পূর্বাভাস। মাধুরী নিজের কর্মফলে অনুতপ্ত। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে তিনি ভূমির কাছে মন থেকে ক্ষমা চাইতেন। কম অন্যায় তো তিনি করেননি মেয়েটার উপর৷ তিনি এখনো জানেন না যেন মৃত্তিকাই আসলে ভূমি। আর না গুলবাহার উনাকে কিছু জানতে দিয়েছেন৷ সবকিছু জেনেও তিনি স্বাভাবিক আচরণই করছেন৷ এদিকে শিকদার বাড়ির সকলেই এখন কমিউনিটি সেন্টারে৷ ইরার পরিবারের সকলে আগে থেকেই উপস্থিত৷ কালই উনারা গ্রামে ফিরে যাবেন। কাজিনমহলের সবগুলো এখন অর্পণ ইরার সঙ্গে স্টেজে ফটোশুট করছে৷ এদিকে মৃত্তিকা এখনো আসেনি৷ প্রলয় ভেবেই নিয়েছে আজ হয়তো মৃত্তিকা আসবে না৷ মনকাননে অনেক প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে। মেহরাব শিকদারকে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়৷ বারবার মনে হয় সবকিছুর পেছনে হয়তো ওই লোকটার কোনভাবে হাত রয়েছে। আবার মনে হচ্ছে এসব নিয়ে অর্পণ হয়তো কিছু জানে৷ তা নাহলে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট কী করে পরিবর্তন হয়? ভূমির সত্যিটা হয়তো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্পণ সবটাই জানে। প্রলয় ভেবে নিল‚ যে করেই হোক আজই অর্পণের সাথে তার কথা বলতে হবে৷ কোনো কিছু না ভেবেই প্রলয় চলে গেল তৃপ্তির সামনে৷ কারণ ওরা সবাই এখন অর্পণ আর ইরার কাছেই রয়েছে৷ তৃপ্তি কিছুটা দূরে থাকায় তাকে দিয়েই কাজটা করাতে হবে। অর্পণের সঙ্গে একা কথা বলবে প্রলয়৷ তাই তৃপ্তিকে পেছন থেকে ডেকে উঠল‚

“তৃপ্তি!”

অকস্মাৎ প্রলয়কে দেখে যারপরনাই অবাক হলো তৃপ্তি৷ কারণ সচরাচর প্রলয় তার সঙ্গে কথা বলে না৷ এক কথায় তাকে সহ্যই করতে পারে না৷ তৃপ্তি জিজ্ঞেস করল‚ “জি! কিছু বলবেন?”

সঙ্গে সঙ্গেই প্রলয় বলে উঠল‚ “পূর্ণ পুষ্প‚ ইরা আর বাকিদেরকে নিয়ে একটু এখান থেকে যাও৷ অর্পণের সঙ্গে আমার আলাদাভাবে কিছু কথা বলার রয়েছে৷”

“ওরা জিজ্ঞেস করলে— কী বলব?”

“আমার কথা বললেই হবে।”

তৃপ্তি ঘাড় বাকিয়ে সায় জানাল৷ কিছুক্ষণের মাঝেই পূর্ণ পুষ্প‚ ইরা আর বাকিদেরকে নিয়ে ফটোগ্রাফার যেখানে ছবি তুলছে সেখানেই চলে গেল৷ এখন আপাতত এই দিকটায় কেউ নেই। অতিথিদের খাওয়াদাওয়া পর্ব চলছে৷ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রলয় সোজা চলে গেল অর্পণের কাছে৷ আজ সারাদিনে দুই ভাইয়ের মাঝে কোনোপ্রকার কথাবার্তা হয়নি। অর্পণ আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি প্রলয়কে৷ কিছু একটা আন্দাজ ঠিকই করছে সে৷ তারউপর সকালে ভূমির সঙ্গে কথা হয়েছিল তার৷ অর্পণ চিন্তিত! না জানি প্রলয় তাকে কখন কী জিজ্ঞেস করে বসে৷ তার কাছে যে‚ সত্যিটা বলার হিম্মত খুবই কম৷ অর্পণের ভাবনার মাঝে প্রলয় চলেই এলো তার সামনে৷ মনে হচ্ছে‚ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির আগমন। অর্পণ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে‚ চরম বিস্ময়ে অভিভূত। প্রলয় হয়তো বুঝল তার অবস্থাটা৷ অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে সোজাসুজি বলে ফেলল‚

“তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা বলার রয়েছে।”

যেটার ভয় ছিল সেটাই হচ্ছে৷ গলা শুকিয়ে আসছে অর্পণের। প্রলয় তার সঙ্গে কী কথা বলবে সেটা হয়তো জানা নেই কিন্তু ভূমির বিষয়ে কথা বলবে সেটা নিশ্চিত! অর্পণ ঠিক করে নিয়েছে আজ সমস্ত সত্যিটা প্রলয়কে জানিয়ে দেবে। আর কোনো লুকোচুরি নয়। অর্পণ কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য উদ্যত হবে তার আগেই প্রলয় বলে ফেলল‚

“তুই যদি আমার ভালোই চেয়ে থাকিস তাহলে আমাকে একটা কথা বল!”

পাল্টা জবাবে অর্পণ শুধাল‚ “কী কথা ভাই?”

“ভূমির সঙ্গে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পেছনে কী চাচ্চুর কোনো ভাবে হাত রয়েছে?”

প্রলয়ের কথায় ঠিক কী উত্তর দেওয়ার আছে অর্পণ জানে না৷ সকালে মৃত্তিকা জানিয়েছিল কাল রাতে সে প্রলয়কে তার বেঁচে থাকার সত্যিটা জানিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু বাকি কথাটা সে কী করে বলবে? কী করে বলবে— সবকিছুর পেছনে একমাত্র তার বাবা নামক পশুর হাত রয়েছে! যাকে এতকাল যাবৎ নিজের আইডল মনে করে এসেছে। একটা মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে তা মেহরাব শিকদারকে দেখলেই বোঝা যায়৷ দিনকে দিন উন্মাদ হয়ে উঠছে৷ কথাটা বলতে গিয়েও অর্পণ কিছুটা আমতা আমতা করছে। প্রলয় বুঝতে পেরে বলল‚

“আমি কোনো মিথ্যে শুনতে চাইছি না।”

মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে সঙ্গে সঙ্গে অর্পণ বলল‚ “কোন সত্যিটা তুমি জানতে চাও ভাই? একটা সত্যির থেকে মুখোশ উন্মোচন করতে গেলে আরও অনেকগুলো সত্যি সামমে চলে আসবে।”

অর্পণের কথায় মোটেও অবাক হলো না। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হবে এটা সে ভেবেই নিয়েছিল৷ সে পুনশ্চ জিজ্ঞেস করল‚

“কী এমন সত্যি রয়েছে? আমি সব জানতে চাই৷”

শুকনো ঢোক গিলল অর্পণ। এরপর গলা ঝেড়ে বলল‚ “তাহলে সবার আগে জেনে রাখ— ভূমি শুধু শিকদার বংশের বউ নয়। সে মেহরাব শিকদারের ঔরসজাত সন্তান। শিকদার বংশের র’ক্ত তার শরীরেও বইছে। অথচ সারাজীবন তাকে জা’রজ সন্তানের তকমা পেতে হয়েছে৷”

অর্পণের কথায় চরম স্তম্ভিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রলয়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে৷ কাল থেকে একের পর এক সত্যি সামনে আসছে। কিন্তু এমন একটা সত্যি তার সামনে আসবে এটা কল্পনাতীত ছিল৷ প্রলয়ের অবস্থা বুঝতে পারল অর্পণ। সে পুনরায় বলল‚

“ভূমির আম্মা অর্থাৎ মহুয়া আন্টির খু’নি হচ্ছে মেহরাব শিকদার। ভূমিকে গণিকালয়ে কে পাঠিয়েছিল শুনতে চাইবে না?”

কম্পিত স্বরে প্রলয় শুধাল‚ “কে?”

“যাকে নিজের বাবা বলতে কুণ্ঠাবোধ হয়। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়৷ সেই মেহরাব শিকদার হচ্ছে সকল কিছুর মূলে৷ এত সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড হচ্ছে মেহরাব শিকদার।”

প্রলয় এখন নিশ্চুপ। কোনো উত্তর নেই তার কাছে৷ তাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে অর্পণ বলতে শুরু করল‚

“একজন ভালো নৃত্যশিল্পী হবার আশায় শহরে এসেছিলেন মহুয়া আন্টি৷ তখনই দেখা হয় মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। মহুয়ার আন্টি জানতেন না— মেহরাব শিকদার বিবাহিত। নানান কৌশল অবলম্বন করে একুশ বছর আগে মেহরাব শিকদার বিয়ে করেছিলেন মহুয়া আন্টিকে। এরপর কেটে যায় আরও একটি বছর। যখন আন্টি প্রেগন্যান্ট হয় তখনই মেহরাব শিকদার নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়। নিজেরই অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করেন। বাচ্চাটাকে অ্যাবর্শন করিয়ে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন মেহরাব শিকদার। কিন্তু মহুয়া আন্টি এমনটা করতে নারাজ ছিলেন৷ তিনি শহর থেকে গ্রামে চলে যান৷ এরপর সময় গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়৷ শহর থেকে দূরে অনিন্দ্যনগরে মেয়েকে নিয়ে দিব্যি ছিলেন মহুয়া আন্টি৷ হঠাৎ করে আবারও সব এলোমেলো হয়ে গেল৷ হয়তো ভাগ্যটাই এমন ছিল। যে বাবা নিজের অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করেছিলেন— ভূমিকে সেই লোকটার কাছে আসতে হলো। শিকদার বংশের মেয়ে হয়েও স্বীকৃতি না পাওয়া মেয়েটা‚ ভাগ্যের পরিহাসে শিকদার বংশেরই পুত্রবধূ হিসেবে এলো৷ এসমস্ত সত্যি জানার পর— মেহরাব শিকদার নতুন করে উন্মাদ হয়ে ওঠেন। কী করে নিজের পথের কাটা দূর করবেন সেটারই পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। হঠাৎ একদিন মহুয়া আন্টি ভূমিকে সমস্ত সত্যিটা জানিয়ে দেন। মাস তিনেক সময় পর খবর এলো মহুয়া আন্টি আর বেঁচে নেই। ভূমির দুনিয়া যেন ওলট-পালট হয়ে গেল৷ মেহরাব শিকদার লোক লাগিয়ে খু’ন করিয়েছেন মহুয়া আন্টিকে৷ তার পরপরই ভূমিকে অপহরণ করিয়ে গণিকালয়ে পাঠানো হয়৷ ভূমি তখন আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল৷ মেহরাব শিকদার সবটাই জানতেন৷ তিনিই সেখানকার সর্দারনি পিংকিকে নির্দেশ দেওয়া হয় ভূমির অনাগত বাচ্চাটাকে অ্যাবর্শন করানোর। বহু কষ্টে ভূমি সেখান থেকে পালিয়ে আসে৷ এরপর কিছুদিন যেতেই আরেক কাহিনি। মেহরাব শিকদার তোমাকে উষ্কাল যাতে ভূমিকে তুমি অবিশ্বাস কর৷ হলোও তাই। মেহরাব শিকদার নিজের পরিকল্পনায় সফলও হয়ে যায়৷ কিন্তু সেদিন রাতে ভূমির উপর কে বার কার লোক হা’মলা করিয়েছিল সেটা শুধু ভূমি জানে। খুব শীগ্রই মেহরাব শিকদারের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে৷ তার সত্যিটা সবাই জানবে৷ ভূমি নিজের অপূর্ণ কাজে সফল হবেই৷ আমি জানি না এই সত্যিটা জানার পর মায়ের মানসিক অবস্থা ঠিক কেমন হবে? মাকে আমি সামলাব কী করে? মায়ের চিন্তা আজকাল আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমার হাসিখুশি সহজসরল মাকে কষ্ট পাওয়া থেকে হয়তো আটকাতে পারব না কিন্তু মাকে সবকিছু থেকে আমাকেই আগলে রাখতে হবে।”

ঠান্ডা মাথার ষড়যন্ত্রের কথা ভাবতেই রাগে গা কেঁপে উঠল প্রলয়ের৷ এতটা ঠান্ডা মাথার গভীর পরিকল্পনা ছিল যে সে ধরতেই পারল না। ইচ্ছে করছে মেহরাব শিকদারকে নিজের হাতে খু’ন করে দিতে৷ শুধুমাত্র ওই লোকটার জন্য তার আর ভূমির জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। মহুয়াকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে৷ কিছুতেই নিজের রাগকে সংবরণ করতে পারছে না সে৷ অন্যদিকে….মৃত্তিকা অনেকক্ষণ ধরেই মেহরাব শিকদারকে চোখে চোখে রাখছে৷ এখানে এসেছে অনেকটা সময়ই অতিবাহিত হয়েছে৷ আজই সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বারবার মনে সাহস জোগাচ্ছে মৃত্তিকা৷ বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট আর টিমটিম করছে৷ মেহরাব শিকদারের সঙ্গে শেষ বার তার কিছু কথা বলার খুবই প্রয়োজন। ভুলিয়ে ভালিয়ে লোকটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে সফল হতে হবে। যেই কারণে সে উনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে৷ ব্যাপারটা বেশ নজর কেড়েছে মেহরাব শিকদারের৷ স্টেজ থেকে অর্পণও বিষয়টা খেয়াল করেছে৷ এদিকে মেহরাব শিকদার মৃত্তিকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন‚

“এভাবে আমার আগে পিছে ঘুরঘুর করছ কেন? মতলব কী তোমার?”

কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই মৃত্তিকা বলে উঠল‚ “আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার ছিল৷”

মৃত্তিকার সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠ কিছুটা অবাক করলেন মেহরাব শিকদারকে৷ সেই সাথে সন্দেহ হলো উনার৷ না জানি এখন এই মেয়ে কী করবে! ভূমি অনেকটা পাল্টে গিয়েছে এটা তিনি খুব করে মানেন৷ মেহরাব শিকদার অত্যন্ত রুক্ষস্বরে বললেন‚ “তোমার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।

মৃত্তিকা তার পার্স থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করল৷ মেহরাব শিকদারকে দেখিয়ে বলতে লাগল‚ “আপনার কাছে দুটো অপশন রয়েছে৷ হয় আপনি আমার সঙ্গে চলুন আর নয়তো এই পেনড্রাইভ এখানেই লাইভ টেলিকাস্ট হবে৷ তারপর আপনার মুখোশটা খসে পড়বে সকলের সামনে৷ নিজের স্ত্রী আর পরিবারকে তখন সামলাতে পারবেন তো?”

“তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? কিন্তু আমি যে ভয় পাচ্ছি না৷”

“কে বলল আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি? আমি তো আপনাকে একটা চান্স দিচ্ছি৷ আমি আবার সবাইকে দ্বিতীয় চান্স দিই না৷ আপনার পার্টনার নাজিম চৌধুরীকে তো মোটেও দেব না৷ আপনাকে কেন চান্স দিচ্ছি জানতে চাইবেন না?”

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মেহরাব শিকদার বললেন‚ “রক্তের টান আছে তাই হয়তো!”

অস্ফুটে ‘চ’ উচ্চারিত হলো৷ চোখ ছোটো ছোটো করে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন মেহরাব শিকদার। এবার মৃত্তিকাও অত্যন্ত তেজি স্বরে বলল‚ “সেই কথাটা কী ভুলে গেলেন— ডক্টর অমানুষ শিকদার?”

ক্ষিপ্ত হলেন মেহরাব শিকদার। মৃত্তিকার দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করলেন। ভেবেছেন আজও হয়তো সবকিছু দাবিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু হলো তার উল্টোটা৷ মৃত্তিকা মোটেও ঘাবড়াল না। নিজের অধরে তর্জনী ছুঁয়ে বলল‚ “হুশ! আমার ভাইয়ার রিসেপশনে কোনো সিনক্রিয়েট চাইছি না৷ চুপচাপ আমি যেটা করতে বলছি সেটাই করুন৷”

“কোথায় যেতে হবে আমাকে?”

“আগে তো এই কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হন। তারপর বলছি কোথায় যেতে হবে!”

মৃত্তিকার কথা মতো মেহরাব শিকদার বেরিয়ে পড়লেন। এই মুহূর্তটার অপেক্ষাই তো এতদিন ধরে করছে মৃত্তিকা৷ সুযোগ বুঝে নিজের পার্স থেকে ইঞ্জেকশনটা বের করে মেহরাব শিকদারের ঘাড়ে পুস করে দিল সে৷ আজ হয়তো ভাগ্যও তার সঙ্গ দিচ্ছে। তা না হলে এত সহজে লোকটাকে ফুসলানো যেত না৷ সে তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল৷ ভেবে ছিল কাজটা খুব একটা সহজ হবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল বলে সহজ হয়ে গেল। মেহরাব শিকদারের দিন ঘনিয়ে এসেছে৷ পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে৷ এবার শাস্তির পালা৷ যেটা মৃত্তিকা নিজ হাতে দেবে৷ যখনই মেহরাব শিকদার অচৈতন্য হয়ে পড়বে তখনই মৃত্তিকা উনাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিল৷ এতটা রাস্তা তো এই লোককে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ এরপর গাড়িতে বসে পড়ল৷ অর্ণব ড্রাইভ করছে৷ এই ঝামেলার মাঝে তনুজা আর সুদর্শিনীকে জড়াতে চায়নি মৃত্তিকা৷ সবকিছু একাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্ণব সুদর্শিনী তাকে একা ছাড়েনি। এতক্ষণ ধরে প্রলয়ও মৃত্তিকাকে নজরে নজরে রাখছিল৷ যখনই শুনেছে সবকিছুর পেছনে মেহরাব শিকদারের হাত রয়েছে তখন থেকেই তার মনে মৃত্তিকাকে আবারও হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছে। কমিউনিটি সেন্টারে মৃত্তিকা বা মেহরাব শিকদারকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚

“ভূমি কোথায়?”

“যেখানে থাকার সেখানেই রয়েছে৷”

প্রলয় বুঝল অর্পণ মৃত্তিকার পরিকল্পনার ব্যাপারে সবকিছুই জানে। তাই সে পুনরায় শুধাল‚ “তুই কী আমাকে কিছু লুকচ্ছিস?”

অর্পণও সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলল‚ “হ্যাঁ।”

“লুকিয়ে লাভ হবে না তাড়াতাড়ি বলে দে৷ আমি চাই না দ্বিতীয়বার ভূমির কোনো বিপদ হোক৷”

অর্পণ নিজের ফোনটা বের করে প্রলয়কে বলল‚ “তোমাকে একটা লোকেশন শেয়ার করছি। ওখানে গেলেই ভূমিকে পাবে৷” এটুকু বলে থামল। পরপরই অর্পণ আবারও বলল‚ “আমার বোনের যেন কোনো বিপদ না হয়!”

প্রলয় যেতে যেতে বলল‚ “আমার জীবন থাকতে ওর আর কোনো বিপদ হবে না।”

এরপর কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হবার আগে প্রলয় চলে গেল কম্পিউটার রুমে৷ বাহিরে অনেক সিসি ক্যামেরা রয়েছে৷ মৃত্তিকা যে মেহরাব শিকদারকে নিয়ে গিয়েছে সেটা ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স রয়েছে। তাই আপাতত কিছু ভিডিও নিজ দায়িত্বে ডিলিট করে দেবে প্রলয়। সেই সঙ্গে ক্যামেরা গুলোও বন্ধ করে দেবে। সে চায় না এসবে মৃত্তিকা কোনোভাবে ফেঁসে যাক। অর্পণ এতক্ষণে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে৷ রিসেপশনের অনুষ্ঠান ছেড়ে কোথাও গেলে সবাই সন্দেহ করতে পারে৷

চলবে?…..

3 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here