#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৪
ফালাক দ্রুতপায়ে নিশোর পাশের চেয়ারে এসে বসলো। হাসি হাসি মুখ করে বলল,“আপনাকে মিস করছিলাম।”
নিশো ফালাকের দিকে তাকালো। মৃদু গলায় বলল,
“এতগুলো দিন পর আবার এ ধরণের কথা কেন? তুমি বলেছিলে এটা নিয়ে আর কোন কথা কখনো বলবে না। ”
ফালাক প্রশ্নপত্র টেবিলের ওপর রেখে বলল,
“আপনি যেন আমাদের বাড়িতে থাকেন তাই ওটা বলেছিলাম৷ আপনি ওখানে থাকলে আমার কথা রাখতাম। ইভেন কয়েকটা মাস হয়ে গেল আপনি আমাকে পড়াচ্ছেন৷ আমি কি একদিনও আর বলেছি? বলিনি তো৷ আপনি আমাকের পড়ানোর সময় একদিনও বলিনি। আচ্ছা, বিরক্ত করলাম না তো সেটা আগে বলুন।”
“ পড়াশোনা একঘেয়েমি লাগছিল। তুমি আশায় যেন প্রাণ ফিরে পেলাম, ক্লান্তি দূর হলো।” বলতে গিয়েও বলতে পারলো না নিশো।
খাতার ওপর হাতের কলমটা রেখে ফালাকের প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল,
“না।”
“তাহলে ঠিক আছে। আরেকটা কথা, আমি যদি আজ আপনাদের বাসায় থাকি আপনার সমস্যা হবে না তো?”
নিশো ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুমি এখানে কেন থাকবে?”
“পরিক্ষার আগে এবার এক সপ্তাহ ছুটি। রুটিন চেঞ্জ হয়েছে তাই ভাবলাম কাজ একটু এগিয়ে রাখি।”
“কী কাজ?”
“ওসব আপনাকে জানতে হবে না। আপনার কোন সমস্যা থাকলে বলুন।”
“প্রশ্ন কেমন হয়েছে? সহজ নাকি কঠিন?”
“আমি কী জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে আর আপনি কী বলছেন?”
“বাড়ি আমার না। এটা জাফর ইকবালের বাড়ি। তার থেকে অনুমতি নেওয়ার হলে নাও। আমার কোন সমস্যা নেই।”
“প্রশ্ন সহজ হয়েছে। আমি আসছি তাহলে।”
“প্রশ্নের কী কী আন্সার করেছ? মিলিয়ে নাও।”
“দাগানো আছে দেখুন। পরিক্ষা ভালো হয়েছে।”
ফালাক নিশোর চায়ের কাপ থেকে এক চুমুক চা খেয়ে দৌঁড়ে বাহিরে চলে গেল। নিশো তাকিয়ে তাকিয়ে ফালাকের চলে যাওয়া দেখল। ফালাক পাশের রুমে ঢুকতেই নিশো চায়ের কাপের দিকে তাকালো৷ চা এঁটো করে রেখে গেল মেয়েটা! চায়ের কাপটা হাতে নিলো নিশো। কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসলো অতঃপর ফালাকের খাওয়া চায়ের কাপে সে নিজেও ঠোঁট ডুবালো।
_____
ফালাক আর তোয়া আজ রান্নাঘর দখল করেছে। রূম্পা বেগমকে কোনমতেই রান্নাঘরের আশেপাশে আসতে দিচ্ছে না তারা। রান্নাঘরে যেতে না পেরে তিনি ড্রয়িংরুমে বসে বসে ফেলে রাখা বইটা শেষ করছিলেন। জাফর সাহেব বাসায় প্রবেশ করলেন। তাকে দেখেই রূম্পা বেগম শুকনো ঢোক গিললেন। ফালাক এসেছে অনেক দিন পর। জাফর সাহেব আবিরকেই এ বাড়িতে আসতে দেখা পছন্দ করেন না। আজ ফালাক এসেছে। মেয়েটাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে না বসে- এই ভয়টা পাচ্ছেন তিনি।
জাফর সাহেব বাহিরের জুতো খুলে ভেতরেরটা পরে নিলেন। রূম্পা বেগম হাতের বইখানা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। জাফর সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্তস্বরে বললেন,
“এখন বাড়ি এলে যে?”
জাফর সাহেব পাশের সোফায় বসতে বসতে বললেন,“দোকানে সোহানকে বসিয়ে রেখে এসেছি। আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না।”
রূম্পা বেগম তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন। পাশে বসে কপালে, বুকে হাত দিয়ে বললেন,“কী হয়েছে? জ্বরও তো আসেনি।”
“জানি না৷ ভালো লাগছিল না। এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?”
“হ্যাঁ, আমি এনে দিচ্ছি, তুমি বোসো এখানে।”
রূম্পা বেগম একগ্লাস পানি এনে জাফর সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের ঝাঁঝ ড্রয়িংরুম অবধি চলে আসায় বারবার হাঁচি হচ্ছে জাফর সাহেবের। ভ্রু কুঁচকে রূম্পা বেগমকে বললেন,
“রান্নাঘরে কোন মাতব্বর? রান্না করছে ওপরের ছোট ফ্যান চালিয়ে দিতে পারছে না?”
রূম্পা বেগম জাফর সাহেবের হাতের গ্লাসটা নিয়ে সরিয়ে রেখে পাশে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন,
“শোনো না, ফালাক এসেছে অনেকদিন পর। তোয়ার সাথে রান্নাঘরে কী যেন করছে।”
“ফালাক!”
“হ্যাঁ ফালাক।”
“দুই ভাইবোন এ বাড়িতে এত পাক দেয়া শুরু করেছে কেন? নিষেধ করতে পারো না তুমি?”
“কী নিষেধ করব?”
“ওরা যেন এ বাড়িতে না আসে।”
“বেশি বুঝো না তো! ভুল করেছে তোমার বাপ। ফালাকের বাপ না। তোমার বাপ দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল, মায়ের কথায় ছোটবেলা থেকে জাভেদ ভাইকে দেখতে পারো না। ভাইয়ের কী দোষ এখানে? আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছে। কয়দিনই বা বেঁচে থাকবে? সব ঠিকঠাক করে নাও। তুমি ডাক দিলেই জাভেদ ভাই তোমার জন্য দৌঁড় দেবে। মনে রাইখো, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য কঠিন শা*স্তি আছে।”
কথাগুলো বলে এক প্রকার ভয়েই মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন রূম্পা বেগম। তিনি অনুভব করলেন জাফর সাহেব ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি সাহস করে আবার বললেন,
“আমাদের দুই পরিবারে সবার সাথে সবার সম্পর্ক আছে। যাতায়াত হয়, বাহিরে যাওয়াও হয় মাঝখান দিয়ে তুমিই শুধু এসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছো।”
জাফর সাহেব রূম্পা বেগমের দিকে নজর স্থির রেখেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছু না বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে রুমে চলে যান।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসেছে শুধু নিশো আসেনি। কিছুক্ষণ আগেই সে বাহিরে গিয়েছে। মূলত সবাই একসাথে খেতে বসলে তাকেও ডাকবে আর সে বাবার সামনে বসে সে খেতে পারবে না। ফালাকের সামনে বাবাকে আর অপ্রস্তুত করতে চাইছে না সে। বাড়ির সামনেই ছোট একটা ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বসে সিগারেট টানছিল।
রাত এগারোটার দিকে নিশো বাসায় ফিরে। এতরাতে কলিংবেল না চেপে তোয়াকে টেক্সট করে দরজা খুলে দিতে বলে। তোয়া উঠবে তখনই ফালাক তাকে থামিয়ে দিয়ে তাকে রেস্ট নিতে বলে নিজেই উঠে যায়। রূম্পা বেগম জেগে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনাকেও ফালাক নিশোর জন্য অপেক্ষা করতে দেয়নি।
ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বা*লিয়ে দরজাটা খুলে দিল ফালাক। নিশো ভেবেছিল তোয়া নিজেই এসে দরজা খুলবে। সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে সেটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে আ*গুন নিভিয়ে দরজার দিকে ঘুরতেই ফালাককে দেখামাত্র হয়ে হাতের ডানদিকে ফিরে হাত এদিকে ওদিক নাড়িয়ে মুখের ধোয়া বিলীন করল। ফালাক কেশে উঁঠল। একবার, দু’বার পরপর তিনবার কেশে উঁঠল সে।
নিশো অসহায় ভঙ্গিতে ফালাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ফালাক কাশতে কাশতে বলে উঠল,
“আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমি যেখানে যখন থাকব আপনি সেখানে তখন সিগারেট খাবেন না। আমি সিগারেটের ধোঁয়া তো দূরের কথা গন্ধও সহ্য হয় না। এসব গু-গোবর খান কীভাবে ছি। রুচিতে বাঁধে না?”
নিশোর এখানে শেষের দুই বাক্যে রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও সে রাগলো না। ভুলটা তার নিজেরই। কেন যে বাড়ি অবধি সিগারেট খেয়ে আসতে গেল! নিজের বোন আর চাচাতো বোন কি আর এক হলো নাকি তাও আবার ফালাকের মতো মেয়ে!
নিশো মলিনমুখে বলে উঠল,“স্যরি।”
“ভেতরে আসুন৷ খেতে বসার আগে শুধু ফ্রেশ না একদম দাঁত ব্রাশ করে কুলকুচি করে আসবেন নইলে আমি খাবার সার্ভ করব না।”
নিশো ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,“তুমি সার্ভ করবে মানে? মা কোথায়?”
“রাত এগারো পার হয়েছে। একঘণ্টাও নেই অন্যদিন শুরু হতে। এতরাত অবধি বাহিরে থেকে এখন বাসায় ফিরছেন আর আশা করছে বড়মা জেগে থাকবে। সালাম আপনাকে। এরকম আশা আর করবেন না।”
“বড্ড বেশি কথা বলা শুরু করেছ।”
“বোবাবউ পছন্দ।”
নিশো ফালাকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,“তোমার মতো এত শাসনের স্বরে কথা বলা বউ অন্তত অপছন্দ হবে। সুর কোমল করো। আমি তোমার সিনিয়র।”
ফালাক এক পলকে নিশোর দিকে তাকিয়ে রইল। নজর স্থির রেখে বলল,”ভাইয়া, ভাইয়া, খেতে আসুন প্লিজ। আমি আপনার জন্য অনেক কষ্ট করে রান্না করেছি। আপনার বাবাও খেয়েছেন। আপনি খেলেই আমার রান্না এবার স্বার্থক হবে।”
নিশো কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। ফালাক পিছন থেকে ডেকে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসবেন, আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়ায়া।”
#চলবে……
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link