#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৫
“ভাইয়া, ইয়াদের বিয়ের কথা চলছে। ও তোকে পছন্দ করে জানিস তো তাই না? এরপরও কেন চুপ করে বসে আছিস? ফুপাকে তুই চিনিস না? বিয়ের কথা যেহেতু ভেবেছে সেহেতু বিয়ে দিয়েই দেবে।”
ফালাক তোয়াদের বাড়ি থেকে ফেরার দুদিন পরই জানতে পারল ইয়াদের বিয়ের কথা চলছে। ইয়াদ ফোন করে জানিয়েছে। আবিরের কথা ইয়াদের কাছে জানতে চাইলে সে শুধু বলেছে- জীবনে কতজনকেই তো ভালো লাগে, সেই ভালো লাগার মানুষগুলো কি আমাদের ভালোবাসে?
ফালাক বেশ বুঝতে পেরেছে আবিরের সাথে ইয়াদের কিছু একটা হয়েছে যার জন্য ইয়াদ এমন কথা বলেছে। আবির কর্মব্যস্ততায় থাকে। ফালাক তার সাথে একা একটু কথা বলার সময়ই পায় না। আজ আবির তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরায় ভাইকে ফ্রি পেয়েছে ফালাক।
আবির শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছিল এমন সময় ফালাক রুমে প্রবেশ করে উক্ত প্রশ্নটা করে বসলো। আবির কিছুক্ষণ ফালাকের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল,
”ওর বিয়ে হলে আমি কী করব? বড় যেহেতু হয়েছে বিয়ে তো করতেই হবে।”
ফালাক এগিয়ে এসে আবিরের পায়ের দিকটায় পা ঝুলিয়ে বসলো৷ দরজার দিকে উঁকি দিয়ে দেখে বলল,
“ইয়াদ তোকে ভালোবাসে, ভাইয়া।”
“আমি ভালোবাসি না।” আবিরের সোজাসাপ্টা জবাব।
“একজন মেয়ে তোকে ভালোবাসে, তুই জানিস, বুঝিস তারপরও পছন্দ না করে বা ভালো না বেসে আছিস? তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ? ইয়াদ তো অপছন্দ করার মতো মেয়ে না।”
আবির নিঃসংকোচে বলল,“হ্যাঁ। ”
ফালাক ভ্রু কুঁচকে শুধালো, “কী হ্যাঁ? কাউকে পছন্দ করিস?”
আবির তেজে উঠে বলল,“হ্যাঁ, বললাম তো।”
ফালাক বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। মৃদু গলায় বলল, “কাকে?”
আবির ফোনস্ক্রিনে নজর নিবদ্ধ রেখেই বলল,“সময় হোক জানতে পারবি। তাছাড়া ইয়াদের বয়স কম। এই সময়ে যাকে তাকে ভালো লাগবে। আমাকে ওর কতদিন ধরে ভালো লাগে? চার মাস। এর আগে একটা ছেলের জন্য হাত কেটে, স্লিপিং পিল খেয়ে সাতদিন হসপিটালে এডমিট ছিল ভুলে গেছিস? এরকম নিব্বি টাইপ মেয়েকে বিয়ে করব আমি? সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল। জোর করে ধরে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে ছিল বিধায় যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেখানেই বসে ওকে ক্লিয়ারলি সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছি। কথা মেনেও নিয়েছিল৷ ওর সাথে আমার যায়? পিচ্চি একটা মেয়ে৷”
সব শুনে ফালাক হতভম্ব চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল,“তাহলে ও যে বলল….”
“কী বলল?” প্রশ্ন আবিরের।
“বলল, তুই ওকে কষ্ট দিয়েছিস তাই বাবার কথায় বিয়ে করে নিচ্ছে।”
“ভাইইইই! তুই গিয়ে দেখ বিয়েটা ঠিকই নাঁচতে নাঁচতে করছে মাঝখান দিয়ে তোকে বোকা বানাচ্ছে।”
আবির রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ফালাক পায়ের দিক থেকে উঠে মাথার দিকে থাকা পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল। আবিরের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পিছনে টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে বলল,
“তাহলে বল না প্লিজ, তুই কাকে পছন্দ করিস? আচ্ছা ইয়াদকে বাদ দিলাম। ও আসলেই বাচ্চা মানুষের মতো বিহেভ করে। তুই তোর কথা বল।”
আবির পরিমিত হেসে বলল,“তোয়াকে তোর কেমন লাগে?”
ফালাক সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল। ফালাকের হাসি শুনে রাবেয়া বেগম রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এসে আবিরের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে রে? দুই ভাইবোন কী বলে হাসাহাসি করছিস?”
ফালাক হাসতে হাসতে মায়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল,“মা, বাসায় আমার ভাবি আনার ব্যবস্থা করে দাও।”
____
আগামীকাল ফালাকের পরিক্ষা শেষ। এই কয়েকদিনে সে মোটামুটি ভালোভাবেই সিলেবাস শেষ করেছে। নিশো পড়াতে আসায় তাকে দেখামাত্র ফালাক নিশোকে রুমে বসিয়ে রেখে চা করতে গিয়েছিল। চা বানিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই ফালাককে দেখে নিশো বলল,
“আপনার আগামীকাল পরিক্ষা আর আপনি সেজেগুজে, চা বানিয়ে সময় কেন নষ্ট করছেন?”
ফালাক চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ওরনাটা মাথায় ভালোভাবে টেনে কপাল অবধি নিয়ে বলল,
“দেখুন তো, এভাবে আমাকে কেউ দেখলে পছন্দ করবে?”
“পছন্দ কেন করতে হবে?”
“বাবার হাত কা*টার পর যে ডক্টর বাবাকে দেখেছিল তিনি আমাকে পছন্দ করেছেন। সন্ধ্যার আগে মাকে নিয়ে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই চলে গেল।”
নিশো ভ্রু কুঁচকে ফালাকের দিকে তাকালো।
“পছন্দ করেছে মানে? কেন পছন্দ করেছে?”
“একটা অবিবাহিত পুরুষ, একটা অবিবাহিত নারীকে কেন পছন্দ করতে পারে?”
“কে কেন?”
“বুঝতে পারছেন না? আমি বলছি শুনুন। ডাক্তার সাহেব আমাকে পছন্দ করেছেন নিজের জন্য। আজ তার মাকে নিয়ে বাসায় এসেছিলেন বিয়ের কথা বলতে। বাড়িতে তো সবাই খুব খুশি।”
নিশো ফালাকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বলল,“তুমিও?”
ফালাক চেয়ারে বসলো৷ চায়ের কাপটা নিশোর দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিও কী?”
“খুশি?”
“আপনিই বলুন আমার কী করা উচিৎ? ”
নিশো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেকি হাসলো। কিছু বলতে যাবে তখনই ফালাকের ফোন বেজে উঠল। ফালাকের আগেই নিশোর চোখ গেল সামনে থাকা ফালাকের ফোনস্ক্রিনে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘ডাক্তার সাহেব’। ফালাক নিশোর দিকে তাকিয়েই খপ করে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। নিশোকে ইশারায় বোঝালো- সে একটু কথা বলেই আসছে।
ফালাক বসা থেকে উঠে বাহিরে না গিয়ে দরজা আর নিশোর মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলতেই সে বলে উঠল,
“ওহ আচ্ছা। বাড়িতে ঠিকমতো পৌঁছেছেন? কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
ওপাশ থেকে আবারও কিছু বলল। ফালাক কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে বলল,“কালকে তো আমার পরিক্ষা আছে, আপনি পরশু বের হন। আমিও বাবাকে বলে বের হতে পারব। কোথায় দেখা করবেন বলুন?”
ফালাক কথা শেষ করল। দ্রুত এসে আবার আগের মতো চেয়ারে বসলো। সামনে চায়ের কাপ ওভাবেই পড়ে আছে দেখে বলল,
“এ বাবা, আপনি চা এখনো খাননি? চা তো এখন ঠান্ডা শরবত হয়ে গেছে।”
“চা খেতে ইচ্ছে করছে না।” বলেই ফালাকের বইটা বের করল নিশো।
ফালাক ফিক করে হাসতে গিয়েও হাসি আটকে রাখলো। সে বেশ বুঝতে পারছে ডাক্তার সাহেবকে সে ভালোভাবে নিতে পারেনি। তার ঈর্ষা হচ্ছে। ফালাক বিষয়টি আরেকটু ঘাটাতে বলল,
“ডাক্তার সাহেব দেখতে সুন্দর, দেখেছেনই তো! আমার সাথে মানাবে?”
“আগামীকালের পরিক্ষাটা ভালোভাবে শেষ করো। বাহিরের মানুষের চিন্তায় শেষ পরিক্ষাটা খারাপ কোরো না। আমার খুব পরিশ্রম মরতে হয়েছে এই কয়েকটা মাস। নিজেও তো কম পরিশ্রম করোনি। শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ভালোয় ভালোয় সব পরিক্ষা হয়ে যাক তারপর যাকে ইচ্ছে তাকে নিয়ে ভেবো।”
ফালাক এবার নরম গলায় বলে উঠল,“আমার পড়া কমপ্লিট।”
নিশো ফালাকের দিকে তাকিয়ে বলল,”বিয়েটা কি সত্যিই হচ্ছে? হওয়ার সম্ভাবনা আছে?”
“হ্যাঁ, কেন থাকবে না?”
নিশো কিছুক্ষণ চুপ রইল। ভাবলো পুরোনো জনের কথা। চুপ থাকলেই তো মানুষকে হারিয়ে ফেলতে হয়। মানুষ একবার হারিয়ে গেলে তার ছায়াও ফিরে আসে না। নিশো কিছু একটা ভেবেই ফালাককে বলল,
“আর তিনটা মাস অপেক্ষা করা যায় না? আমি আমার মেধায় কিছু করে উঠতে না পারলে তোমার বিজনেসটা না হয় বড় করব?”
ফালাক যেন এবার কেঁদেই ফেলল। নিশো যে পরোক্ষভাবে তাকে ভালোবাসার আভাস দিল। ফালাকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। নিশো আসলেই এই কথাটা বলল! ফালাকের চোখ দুটো টলমল করছে অথচ মুখে হাসি। আঙুল দিয়ে চোখের নিচটা মুছতে মুছতে বলল,
“আমি এই কথাটা শোনার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না বিশ্বাস করুন। প্রতিদিন আপনাকে দেখছি, কেমন প্রফেশনাল সম্পর্ক। গম্ভীরভাব, আমাকে না দেখা আমি নিতে পারছিলাম না। এখন আমি দুই, তিনমাস কেন? আমি আপনার জন্য আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে দুই যুগও অপেক্ষা করতে পারব। আপনি শুধু সফল হয়ে ফিরে আসুন। আমি অপেক্ষা করব।”
নিশোর যেন এবার এই মেয়েটাকে নিজের নিজের লাগছে। সে চুপচাপ ফালাককে দেখে যাচ্ছে। ফালাক দুই হাতের উল্টোপাশ দিয়ে দুই চোখ মুছে নিয়ে বলল,
“আপনি তাহলে আমার কাছে হার মানলেন। আমি আপনাকে জিতে নিলাম শেষ পর্যন্ত।” বলেই হেসে ফেলল ফালাক।
নিশো কিছু বলবে তখন ফালাকের ফোন আবার বেজে উঠল। ফালাক ফোনস্ক্রিনে ‘তোয়া আপু’ নাম দেখে নিশোর দিকে তাকালো।
“আপু কল দিয়েছে। ”
নিশো নিজের ফোন বের করতে করতে বলল,“রিসিভ করো তো। আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল, হয়তো কল দিয়ে আমাকে পায়নি তাই তোমাকে কল দিয়েছে।”
ফালাক কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তোয়া বলে উঠল,“হ্যালো ফালাক, ভাইয়া কি তোর ওখানে আছে?”
ফালাক নিশোর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,“হ্যাঁ আছে তো। কিছু কি হয়েছে, আপু? বাসায় সব ঠিকঠাক?”
তোয়া কান্নাজড়ানো গলায় বলল,“ভাইয়াকে ফোনটা একটু দে। ভাইয়ার সাথে কথা বলব।”
ফালাক আর দেরি না করে নিজের ফোনটা নিশোর হাতে ধরিয়ে দিল। নিশো ফোনটা কানে নিয়ে বলে উঠল,
“কী হয়েছে, তোয়া? বল আমি শুনছি।”
তোয়া এবার শব্দ করে কেঁদে উঁঠল। বলল,“ভাইয়া, বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। বাবা এখন থানায়।”
#চলবে…..
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link