#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৬
নিশো তোয়ার ফোন পাওয়া মাত্র থানায় এসেছে। জাফর ইকবাল সাহেবকে থানার মধ্যে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি পিছনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।
রাত নয়টা বেজে গিয়েছে। অন্যান্য দিনে রাস্তায় কোন প্রকার জ্যাম থাকে না কিন্তু আজ অনেকদূর পর্যন্ত গাড়ির লাইন। কোনভাবেই, কিছুতেই এগুচ্ছে না। গাড়িতে বসিয়ে এক সেকেন্ড কাটানোও যেন সম্ভব হচ্ছে না নিশোর পক্ষে৷ সে যখন বুঝলো এই জ্যাম ছাড়তে অনেকক্ষণ সময় লাগবে তখন সে গাড়িওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে ছুঁটতে শুরু করল।
বাবার এমন অবস্থায় কোন ছেলে স্থির থাকতে পারে? নিজের ইচ্ছেতে বা অন্যের ইচ্ছেতে সময় ব্যয় করতে পারে? বাবা-ছেলের কথা নেই, অভিমানে কেটেছে বেশ কয়েকটা মাস তাই বলে কী এতগুলো বছরের ভালোবাসা উধাও হয়েছে না-কি?
নিশো ছুঁটলো। তাকে ভীষণ ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। মিনিট পনেরো দ্রুত গতিতে হেঁটে থানার গেইটে পৌঁছে শ্বাস টানলো সে। এতখানি পথ এভাবে হেঁটে আসায় হাঁপাচ্ছে সে। থানার গেইটের দারোয়ান নিশোকে দেখে এগিয়ে এলো। নিশো হাটুতে দুই হাতে ভর দিয়ে উঁবু হয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল। দারোয়ান এগিয়ে এসে নিশোর পিঠে হাত রাখলো।
“আব্বা, আপনে!”
নিশো মাথা বাঁকিয়ে একপাশে উঁচু করে দারোয়ানকে দেখে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল,“চাচা, একটু পানি হবে?”
লোকটা নিজের জায়গায় ফিরে গেল। সেখানে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে আবার নিশোর কাছে ফিরে এসে বোতলটা নিশোকে ধরিয়ে দিল। নিশো একটা জায়গা খুঁজে সামান্য সময়ের জন্য বসে কিছুটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিল। বোতলটা দারোয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ, চাচা। ভালো আছেন তো?”
লোকটা মৃদু হেসে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছে৷ তা তুমি এখানে কেন? দৌঁড়ে এসেছ? হাঁপাচ্ছিলে যে!”
নিশো থানার দিকে ইশারা করে বলল,“আমার বাবাকে নিয়ে এসেছে। কারণটা এখনো জানি না। আমার ভেতরে যেতে হবে, চাচা। পরে সব বলব ইন শা আল্লাহ। ”
নিশো আর এক মুহূর্ত সময় ব্যয় করল না। থানার ভেতরের দিকে আবার ছুটে গেল। দারোয়ান নিশোর যাওয়া দেখে কষ্টের হাসি হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমারে এমন একটা ব্যাটা কেন দিলা না, আল্লাহ?”
নিশো ভেতরে ঢুকতেই সামনের দিকে একটা বেঞ্চিতে বাবা জাফর সাহেবকে দেখতে পেল। অনাথের মতো চোখ বন্ধ করে দুটো হাত একসাথে করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। বাবাদের অসহায় দেখতে সন্তানদের ভালো লাগে না। নিশো দরজায় দাঁড়িয়েই থমথমে গলায় বলে উঠল,
“বাবা!”
জাফর সাহেব পরিচিত কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে দরজার দিকে তাকালেন। নিশোকে দেখে বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পুরুষ মানুষ তো কষ্ট খুব সহজে প্রকাশ করতে পারে না। জাফর সাহেবও পারলেন না। শুধু মলিন মুখে, নির্জীব ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
নিশো দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বাবার পায়ের কাছে বসলো। মৃদু গলায় শুধালো,
“কী হয়েছে, বাবা?”
জাফর সাহেব মায়ামাখা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিশোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওরা আমাকে ধরে এনেছে। আমি নাকি ডেট এক্সপায়ার্ড পণ্য বিক্রি করি।”
নিশো পিছনের দিকে তাকিয়ে কয়েকজনকে দেখে আবার বাবার দিকে তাকালো। নিচুস্বরে বলল,
“পেয়েছে কিছু?”
জাফর ইকবাল সাহেব ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,“ কীভাবে এলো বুঝতে পারলাম না। আমি তো প্রতিমাসে ডেট চেইক দেই। দোকানের ছেলেটাকে দিয়েও চেক দেওয়াই কিন্তু ডালের প্যাকেটগুলো কীভাবে এরকম হলো বুঝতে পারলাম না।”
“শুধু ডালের প্যাকেট?”
“না।”
“আর কী কী?”
জাফর সাহেব মাথা চুলকালেন তারপর বললেন,“ডাল, সসের কৌটো, কয়েকটা কোম্পানির বিস্কিটের প্যাকেট ওহ হ্যাঁ তেলও। দুই একটা করে প্যাকেট, বোতল করে আছে।”
“ওগুলো কি নিয়ে এসেছে নাকি ওখানেই আছে?”
“ওখানেই আছে। দোকান তালা দিয়ে চাবি নিজেদের কাছে রেখেছে। আমাকে তুলে এনেছে। আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।” বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরালেন জাফর সাহেব।
নিশো উঁঠে দাঁড়ালো। বাবাকে ধরে তুলে দাঁড় করালো আর তারপর বাবাকে নিয়ে বসে থাকা অফিসারের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ার পিছিয়ে দিয়ে বাবাকে বসতে বলল। জাফর সাহেব অফিসারের দিকে তাকালেন। তার সম্মতির অপেক্ষায় রইলেন। অফিসার ভদ্রতার সাথেই বললেন,
“বসুন।”
জাফর সাহেব বসতেই নিশো বলে উঠল,“দোকানে কয় পদের ডেট এক্সপায়ার্ড পণ্য পেয়েছেন?”
অফিসার নিশোর দিকে তাকিয়ে শুধালো,“আপনি উনার কে হন?”
নিশো অফিসারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। দুই হাত দিয়ে বাবার দুই কাঁধ স্পর্শ করে বলল,
“উনি আমার বাবা।”
অফিসার মৃদু গলায় বলল,“ওহ আচ্ছা। প্রায় সাত রকমের পণ্য হয়তো পাওয়া গিয়েছে।”
“বাবা বলছেন, দোকানে এরকম পণ্য থাকার কথা নয়।”
“আমরা পেয়েছি ইভেন ওগুলো দোকানেই আছে।”
“আশেপাশের কোন দোকান চেক দিয়েছেন নাকি সরাসরি আমাদের দোকানে গিয়েছেন?”
“একটা আননৌন নম্বর থেকে কল এসেছিল। তারপর আমরা গিয়েছি।”
“আমার মনে হয় এটা চক্রান্ত।”
“কেন মনে হলো?”
“হয়তো কেউ বাবাকে পছন্দ করেন না তাই এরকম করে বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”
অফিসার একটা কাগজ খুঁজে বের করে নিশোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,“ ফাঁসানোর মতো কিছু দেখিনি। এটা নিন। জরিমানা দিয়ে বাবাকে নিয়ে যাবেন।”
নিশো কাগজ হাতে নিয়ে দেখল। দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশো। জাফর সাহেব নিশোর দিকে তাকালে শুকনো হাসি হেসে বাবাকে বলল,“বাবা, চিন্তা করবে না। আল্লাহ আছেন। তিনি ঠিক কিছু না কিছু করবেন।”
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় নিশো চমকে উঠল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল জাভেদ সাহেব কল করেছেন৷ বাবার সামনে কল রিসিভ করবে কি না ভাবতে থাকলো সে। অতঃপর ভাবনার ইতি টেনে কলটা রিসিভ করে ফেলল। জাভেদ সাহেব ওপাশ থেকে থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
“কী হয়েছে রে, আব্বা?”
নিশো বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,“চাচা, বাবাকে পুলিশ থানায় এনেছে। দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ কয়েকটা জিনিসপত্র ছিল।”
“কী বলছে অফিসার?”
“দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেছে।”
“ভাই ঠিক আছে তো?”
“ঠিক থাকার তো কথা না।”
“ওখানে কোন অফিসার বসে আছে? নাম শুনে জানা তো, বাপ”
নিশো ফোনটা হোল্ড করে অফিসারের দিকে তাকালো। বলল,“স্যার, আপনার নামটা?”
অফিসার নিশোর দিকে তাকিয়ে বিরসমুখে বলল,“ আনাস, আনাস রহমান।”
নিশো এবার ফোন কানে নিল। বলল,“উনার নাম আনাস রহমান।”
জাভেদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,“ওহ আচ্ছা উনি! ফোনটা দে তো, বাবা। উনার কাছে দে। আর আমি আবিরকে থানায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নিশো ফোনটা অফিসারের দিকে এগিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিল। অফিসার ফোনটা নিয়ে মিনিট দুয়েক কথা বললেন। হেসে হেসে কথা বলা দেখে নিশো একটু আলোর দেখা পাচ্ছে। হঠাৎ দোকানের সিসিটিভির কথা মনে পড়তেই নিশো বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাবা, ক্যামেরার কথা তুমি ছাড়া আর কি কেউ জানে?”
জাফর সাহেব নাবোধক মাথা ঝাঁকালেন। যার অর্থ কেউ জানে না। নিশোর মুখে হাসি ফুঁটলো। সে নিশ্চিত কেউ জেনে-বুঝে এমন কাজ করে তার বাবাকে ফাঁসিয়েছে। হতে পারে তাদেরই পাশের দোকানী। কারণ তারা চায় না জাফর সাহেব দোকান নিয়ে ওখানেই থাকেন। ভেতরে ভেতরে কিছুটা শত্রুতা সে খেয়াল করেছে।
অফিসার কথা শেষ করে নিশোকে ফোন এগিয়ে দিতেই নিশো বলে উঠল,“ স্যার আমার সন্দেহ হচ্ছে, একজন আমার বাবাকে ঠকাচ্ছে। দোকানে ক্যামেরা লুকোনো। আমি আর বাবা ছাড়া কেউ জানে না। ক্যামেরা দেখলে সবাই সতর্কতার সাথে হায় সাফাই করে বলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওটা চেক করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। আপনি যদি অনুমতি দিতেন আমি ওটা দেখে আপনাকে জানাতাম।”
আনাস রহমান উঠে দাঁড়ালেন। টুপিটা মাথায় দিয়ে বললেন,“চলুন তবে। আর আপনার বাবাকে বাসায় নামিয়ে দিই চলুন।”
নিশো মৃদু হেসে বাবার দিকে তাকালো। সে জানে জাভেদ সাহেব সবটা সামলে নেবেন। আল্লাহর রহমতে উনি কথা বললে সব কিছুটা সহজ হতে পারে এটা নিশো জানতো। যার ধনসম্পদ, প্রতিপত্তি বেশি তার কথার জোরও বেশি।
নিশো বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,“বাবা, তোমার ভাই এবারেও তোমার ভাই হিসেবেই পাশে দাঁড়ালো। তুমিই মানুষ চিনলে না।”
নিশোর কথার পর জাফর সাহেবকে চুপচাপ এবং অন্যমনস্ক দেখালো। তবে কি ভাইকে নিয়ে ভাবা শুরু করলেন? নিজের করা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলেন!
নিশোর বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা পার হলো। বাবাকে সে অনেক আগেই বাড়িতে পাঠিয়েছিল। সে নিজেই আবিরকে সাথে নিয়ে অফিসারের সাথে সবটা সামলেছে। সিসিটিভিতে মুখ্য আসামী ধরা পড়েছে। দোকানে থাকা ছেলেটাই মনিবের সাথে এমন নিমক হারামীটা করেছে। দোকান থেকে প্রমাণ-সমেত ছেলেটার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল। সে বাড়িতে নেই। পালিয়েছে। কোনভাবে হয়তো খবর পেয়েছে তার সম্পর্কে সবাই সবটা জেনে গিয়েছে তাই সে ধরা পড়ার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। যদিও অফিসার ছেলেকে না পেয়ে বাবাকে ধরে আনতে চেয়েছিল কিন্তু নিশো বাধা দিয়েছে। তার মতে, ছেলের কৃতকর্মের শা*স্তি বাবার পাওনা নয়।
নিশো কলিং বেল চাপলেই সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। ওপাশে বাবাকে দেখে একটু অবাক হলো নিশো। জোরপূর্বক হেসে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল সে। জাফর সাহেব নিশোকে একা দেখে বললেন,
“আবির কই?”
নিশো বাবার কথায় এবার অবাক হলো। এর আগে কখনো ওদের বাড়ির কারো কথা জানতে চায়নি মুখ ফুঁটে। সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও বাসায় চলে গেছে। তোমার দোকানে থাকা ছেলেটা এই অকাজ করেছে। সে হয়তো মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। পুলিশকে সে নিজেই খবর দিয়েছে। তোমার ওপর রাগ ছিল?”
জাফর সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। একটু ভেবে বললেন,”জিনিস চুরি করতো মাঝেমাঝেই। সেদিন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তিন চারজনের সামনে চড় দিয়েছিলাম তাই বলে এত বড় ক্ষতি করবে!”
#চলবে…….
(এখনই দিয়ে দিলাম। সময় করে পড়ে ছোট করে হলেও মন্তব্য করবেন। রিচেক দেওয়া হয়নি। পর্ব খুব বেশি ছোট হয়নি।🌸)
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link