একটি_সাঁঝরঙা_গল্প #তানিয়া_মাহি #পর্ব_২৪

0
97

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_২৪

ফালাক আর নিশো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। লিয়াকত সাহেবের কথায় আঁতকে উঠল দুজন। নিজেদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে একসাথে, একইসময়ে বলে উঠল,

“এদিকে একদমই তাকাবেন না। ফালাকের জন্য নিশো আছে।”

উঠোনের সবার চোখ এবার নিশো আর ফালাককে ঘিরে ধরল। জাফর সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত গলায় বলে উঠলেন,

“তামাশা হচ্ছে এখানে? কোথায় কী বলতে হয় জানো না তোমরা? বিয়ের কথা হওয়া মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়। এসব পছন্দের কথা তোমরা বাড়িতে বলোনি কেন আগে? তাছাড়া বাড়ি ফিরেও তো বলতে পারতে।”

জাভেদ সাহেব শান্তস্বরে জাফর সাহেবকে চুপ করতে বললেন। বললেন,

“ভাই, ওরা ছোট মানুষ। তাছাড়া আমি নিশোকে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছি ফালাকের জন্য। এতদিন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক থাকায় এসব নিয়ে কথা বলা হয়নি।”

লিয়াকত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। পাংশুমুখ করে বললেন,“দুই ভাই তাহলে বেয়াই হয়ে যাচ্ছেন। আমিই না জেনে না বুঝে পরিস্থিতি ভারি করলাম। স্যরি ভাই, দুজনকেই স্যরি।”

জাভেদ সাহেব নিশো আর ফালাকের দিকে পূর্ণদৃষ্টি ফেলে বললেন,“যাও এখান থেকে৷ বড়দের মধ্যে তোমাদের আর থাকতে হবে না।”

“নিশোকে অন্তত আশকারা দিস না জাভেদ।”

জাফর সাহেব নিশোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলেন। পরিবেশ ভারি হওয়ার আগেই নিশো সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। ফালাক নিজেও ধীরে ধীরে সবার চোখের আড়াল হয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।

রাবেয়া বেগম উন্মুখ হয়ে বসে ছিলেন ফালাকের আশায়। ফালাক পাশে এসে বসাতেই বলে উঠলেন,

“ভাইয়ের কথা তো ভালোই জানাতে পারলেন, নিজের বেলায় লুকোলেন কেন? আপনার থেকে এটা আশা করিনি।”

ফালাক মাথানিচু করে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,“আমার ভয় লেগেছিল।”
“এখন ভয় লাগল না?”
“এখন তো তাড়নায় বের হয়ে গেছে। বুঝলাম না এমন কীভাবে হলো।”

ফালাকের ফুপু এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখছিলেন। তিনি এতক্ষণে রাবেয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

“ছাড়ো তো ভাবি। আমাদের এত সুন্দর মেয়ের জন্য আমাদের ওত সুন্দর ছেলে নিশোই ঠিক আছে৷ এই লিয়াকতের মেয়েও যেমন, ছেলেও তেমন। মেয়ের চেয়ে ছেলে আরও হাড়ে বজ্জাত। নিশো আর ফালাক এখন কিছু না বললেও আমি নিজেই পরে এই বিয়ের কথা উঠতেই দিতাম না। মগের মুল্লুক নাকি!”

রাবেয়া বেগম মলিনমুখে বললেন,“যার তার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব নাকি? আমার মেয়ে ফেলনা না। একমাত্র মেয়ের আমার।”

পাশ থেকে রূম্পা বেগম বললেন,“ছেলে-মেয়েদের কান্ডে তোমার ভাই খুব রেগে গেছে। তার মেজাজ এখন ঠিক হলেই হয়েছে।”

রাবেয়া বেগম সম্মতি জানিয়ে বললেন,“ঠিক বলেছেন,আপা। ভাই এখন ঠান্ডা হলেই হয়েছে। আর আমার মেয়েটাও না! ফট করে এমন একটা কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল?”

রূম্পা বেগম রাবেয়া বেগমকে মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,“একদম ওকে রাগ দেখাবে না। ওরা একে অপরকে পছন্দ করে, বলেছে ভালো করেছে। চিন্তা তো দূর হয়েছে। আল্লাহ বাঁচালো। অন্য কোথাও ছেলের জন্য বউ আর মেয়ের জন্য মেয়ে-জামাই খুঁজতে হলো না। আর শোনো, তোমার মেয়ে আমার হবু বউমা, মিনসে যারা করে করুক আমি দুজনকেই মেনে নিয়েছি।”

ফালাক শব্দ করে শ্বাস ফেলল। একটু স্বস্তি লাগছে তার। ভেতরে ভেতরে ভালোও লাগছে এটা ভেবে যে, অতঃপর মানুষটা তার হবে।
___

আবির আর তোয়া এসে বাড়ির সামনেটায় দাঁড়ালো। পাশ দিয়েই রাস্তা। চারদিকে অন্ধকার বেড়ে চলেছে শুধু কিছুক্ষণ পরপর গাড়ির আলোতে আলোকিত হচ্ছে সব। আশেপাশে আর কোন মানুষ তেমন দেখা যাচ্ছে না।

আবির দুজনের মধ্যাকার নিরবতা ভাঙল। বলল,

“কী বলবি, বল? ডেকে আনলি কেন?”
“তুই পাগল?”
“পাগল কেন হব? আমার কোন আচরণে মনে হয়েছে আমি মানসিক হসপিটালের সেবা নিচ্ছি?”
“তুই ওখানে কী বললি?”
“শুনিসনি? আরেকবার বলব?”
“মিথ্যা কেন বললি?”
“মিথ্যা কেন মনে হলো তোর?”
“তো কি সত্যি?”
“তোর কী মনে হয়? তোর মনে হয় আমি এতগুলো মানুষের সামনে মিথ্যা কথা বলব? আর মিথ্যা বললে তোকে নিয়েই কেন বলব? বলতেই পারতাম আমি একজনকে ভালোবাসি।”

তোয়া আবিরের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার এই কথা অন্য কোনসময় ভালো কোন মুহূর্তে, ভালো একটা সম্পর্ক বিল্ড-আপের পর শুনলে সুখসেব্য লাগত এখন এখন সে অনুভূতির কোন জায়গা নেই। সে শুধু বারংবার অবাক হচ্ছে। এ যেন পরমাশ্চর্যের বিষয়।

তোয়াকে চুপ থাকতে দেখে আবির বলে উঠল,

“ভালো হয়েছে আজ এমন পরিস্থিতি এসেছে নইলে তোকে কবে জানাতে পারতাম জানি না। এখন পুরোটাই তোর ওপর নির্ভরশীল।”

তোয়া সহসা শুধালো,
“কী নির্ভর করবে?”
“ভবিষ্যৎ দুজনের একসাথে হওয়ার দিকে পা বাড়াবো নাকি আলাদাই এগুতে হবে।”

তোয়া মাথানিচু করে ভাবুক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিছুক্ষণ পর বলল,

“আমি বুঝতে পারছি না। তোর সাথে তো আমার সেরকম সম্পর্ক কখনো ছিল না।”
“ছিল না বলেই হয়তো আমার দিক থেকেই শুধু ভালোবাসা গাঢ় হয়েছে। তোর দিক থেকে হয়নি।”
“আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“ভেতরে।”
“বাহিরে ডেকে আনলি কেন?”
“জানতে। জানা হয়ে গেছে।”

তোয়া ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে আবির পিছন থেকে ডেকে দাঁড়াতে বলল। তোয়া আবিরের কথানুযায়ী দাঁড়িয়ে পিছন দিকে ঘুরে তাকালো। আবির নিজে এবার দু’ পা এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“তোর কিছু বলার নেই?”
“আমি এখনো বিষয়টা মেনে নিতে পারছি না, আবির ভাই। অবাস্তব লাগছে সবকিছু।”
“একটু অন্যভাবে ভেবে দেখ না। তুই থেকে তুমি আএ ঝগড়া, ঝামেলা থেকে বেরিয়ে একটু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ। কিছু দেখতে পারছিস?”

আবিরের কথাবার্তা অন্যরকম লাগছে তোয়ার কাছে। এভাবে আবির কোনদিন কথা বলেনি। দেখা হলেই, সামনাসামনি বা কাছাকাছি হলেই সবসময় দুজনের মধ্যে দা-কুমড়ার মতো সম্পর্ক গর্জে উঠত। এই আবিরকে সে চিনতে পারছে না একদমই চিনতে পারছে না। এই অবস্থায় আগের মতো বিরোধের জন্য আগে আগে ঝামেলা বাঁধাতেও ইচ্ছে করছে না।

নিজেকে ধাতস্থ করল তোয়া। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। তোকে অপরিচিত লাগছে। ভেতর থেকে বারবার ‘আপনি’ বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি ভেতরে যাচ্ছি, প্লিজ দাঁড়াতে বলিস না।”

আবির আর কথা বাড়ালো না। বুঝল, তোয়া বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তার সময় প্রয়োজন। তোয়া ভেতরে চলে যেতেই আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে নিজেকে এটা বলে সান্ত্বনা দিল যে, তোয়া অপছন্দ করলে সেটা মুখের ওপর বলে দিত, শুধু সে ধাক্কাটা নিতে পারেনি। সময় এলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।
___
রাত বারোটা। আবির আর নিশো একসাথে শুয়েছি। সকাল নয়টায় ট্রেন আছে। বাসায় ফিরতে হবে। দুজনের একজনেরও ঘুম ধরছে না অথচ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার কথা। নিশো তবুও ফোনটা রেখে জোর করে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে কিন্তু আবির! তার চোখে ঘুম নেই। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। বারবার এপাশ ওপাশ হচ্ছে। চোখে বন্ধ করে থেকেও কাজ হচ্ছে না। তোয়ার কথা ভীষণ ভাবাচ্ছে। মন বলছে তোয়াও হয়তো ঘুমায়নি।

ফোনের দিকে তাকালো আবির। রাত বারোটা সাত মিনিট। নাহ কিছুতেই ভালো লাগছে না৷ গা থেকে কম্বল সরিয়ে উঁঠে বসল। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে এলো।

আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি বাতাস। শরীর হিম হয়ে আসা বাতাস তবুও খুব একটা নজরে আসছে না তার। এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকল সে। হঠাৎ ফোনে মেসেজের শব্দ হলো। এতরাতে সাধারণত মেসেজ আসে না তার। পাওয়ার বাটন চাপলো সে। ফোনস্ক্রিনে চোখ বুলাতেই এদিক ওদিক তাকালো সে৷ নাহ কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেসেজটা তোয়ার। বিষয়টা তার কাছে অতি আশ্চর্যের। তোয়া সাধারণত এভাবে কখনো মেসেজ দেয়নি তাকে। তবে কি ওষুধে কাজ হলো।

মৃদু হেসে মেসেজটা আবার পড়ল সে,“বাহিরে ঠান্ডা বাতাস। রোমিয়োর মতো বাহিরে জুলিয়েটের জন্য পায়চারি করতে হবে না তোর। জুলিয়েটকে যাবে না। যা ঘুমো এখন।”

#চলবে…..

গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here