প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৩৩

0
270

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৩

খুবই ধীর গতিতে চোখের ভেজা পাপড়িগুলো নড়াচড়া শুরু করলো। লাল হওয়া ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ নড়লো বুঝি। জ্ঞান ফিরার সময় টুকু কিছুই মনে করতে পারলো না আরহাম। তবে হঠাৎ নিজের হাতটা শক্ত এক হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করলো। মাথাটা কাত করে সেদিকে তাকাতেই দেখা মিললো তুষারের। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আদনান। আরহামে’র চোখ খোলা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো কিছুটা আদনান,

— ভাই? ভাই চোখ খুলেছে।

তুষার চোখ বুজে ছিলো। আদনানে’র কথায় তাকাতেই দেখলো আরহাম তাকিয়েছে। ভেজা চোখে দেখে যাচ্ছে দুই ভাইকে। আরহামে’র মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তখন কতটা কার্যকর জানা নেই অথচ তার মুখ দিয়ে নাম বের হলো,

–তুঁষ।

কথাটা এতই ধীরে ছিলো কেউ বুঝলো না। তুষার দাঁড়িয়ে আরহামে’র মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে ডাকলো,

— আরু।

আরহাম উত্তর করতে পারলো না। তুষার সময় দিলো। আদনান ডক্টরকে ডেকে আনতেই উনি চেক করলেন। জানালেন এখন ঠিক আছেন আরহাম কিন্তু পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। ঠিক কবে হাঁটতে পারবে বলা যাচ্ছে না। হয়তো মাস খানিক সময় লাগবে। হাটাচলা এখন একদম নিষিদ্ধ আরহামে’র জন্য। বেড রেস্ট মাস্ট। ডক্টর যাওয়ার ও প্রায় আধ ঘন্টা পর সম্পূর্ণ হুঁশে ফিরলো। এদিক ওদিক তাকিয়েই দেখলো একজন নার্স কিছু মেডিসিন গুছাচ্ছে আর কাউচটাতে আদনান মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করলো আরহাম। নার্স ওকে উঠতে দেখেই এগিয়ে এসে বললো,

— স্যার প্লিজ নড়বেন না। আপনার পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। হাটতে পারবেন না এখন।

— ভাই? ভাই কোথায়?

— তুষার স্যার? উনি মাত্র ই বাইরে গেলেন?

— আমি কখন থেকে এখানে?

— গত দুই দিন ধরে স্যার। আপনার অ্যাকসিডেন্ট এর পর আজ ই জ্ঞান ফিরলো।

মাথায় বাজ পরলো যেন আরহামে’র। দুই দিন! তাহলে ওর তুঁষ? পাগলের মতো উঠতে নিলেই পরে যেতে নিলো। ততক্ষণে আদনান এসে ধরেছে ভাইকে। শান্ত স্বরে বলছে,

— ভাই, এমন করো না। হাটতে পারবে না তুমি।

— ছাড়!

— কথা শুনো।

— ছাড় বলছি!!

আরহামে’র ধমকে ছেড়ে দিলো আদনান তবুও ভাইকে শান্ত করতে চাইলো। এদিকে আরহাম তোঁষা’র চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা। এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্র্যাচ দেখলো দুটো। আদনান জানে ভাইকে থামানো যাবে না তাই দুটো এগিয়ে দিতেই আরহাম সেটাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যেটাতে ভর দিয়ে উঠে হাটা ই কষ্টসাধ্য সেটাতে ভর দিয়ে দৌড়ে যেতে নিতেই মুখ থুবড়ে পরলো আরহাম। নার্স ঘাবড়ে গেলো সাথে সাথে। আদনান দৌড়ে এসে ভাইকে ধরলো। আরহামে’র মুখে একটাই কথা,

— আমার তুঁষ।

বহু কষ্টে আরহামকে নিয়ে গাড়িতে তুলতেই আরহাম ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— গাড়ি থেকে বের হ।

— ভাই শুনো। আমি তোমাকে দিয়ে আসি। কোথায় যাবে?

— বের হ আমার গাড়ি থেকে!

পুণরায় ধমাকালো আরহাম। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে তুষার ই আনিয়েছিলো। অগত্যা মেডিসিনের প্যাকেটটা আরহামে’র কাছে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল আদনান। আদনান নামতেই শোঁ শোঁ আওয়াজে চলে গেল আরহামে’র গাড়িটা। আদনান সেদিকটায় তাকিয়ে ই রইলো।

গতকাল তুষারের ফোনে ফোন আসে একটা। হসপিটাল থেকেই ছিলো সেটা। তখনই জানা যায় আরহামে’র খবর। রাস্তা থেকে মানুষ ধরে হসপিটালে নিয়েছিলো। ফোনে চার্জ না থাকায় পরিচিত কাউকে পায় নি। গতকাল ফোন অন হতেই সর্বশেষ নাম্বার পায় তুষারের তাই সেটাতেই কল করা হয়। তুষারের সাথেই ছিলো আদনান তাই দুই ভাই ছুটে আসে। জেনারেল ওয়ার্ড থেকে কেবিনে শিফট করে।

কাঁধে কারো হাত পেতেই আদনান তাকালো। তুষার দাঁড়িয়ে। আদনান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

— ভাই চলে গিয়েছে।
_______________________

এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে আরহাম ফিরলো। দারোয়ান এগিয়ে এসে সাহায্য করলো নামতে। কোনমতে লিফট এ উঠে বাইশ তলায় গেলো ও। লক খুলে প্রবেশ করেই ডাকতে লাগলো,

— তুঁষ? প্রাণ আমার, কোথায় তুই?

বলতে বলতে রুমের লক খুলে ভেতরে এলো। লাইট অন করা কিন্তু তোঁষা নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ধুকপুক করা বুকে ভেতরে এসে ওয়াশরুমের খোলা দরজায় তাকাতেই অন্তরআত্না কেঁপে উঠলো। তোঁষা ফ্লোরে পরে আছে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরলো আরহাম। ওয়াশরুমের ফ্লোরে গিয়ে বসে কোলে তুলে নিলো তোঁষা’র মাথাটা।

— তুঁষ? এই প্রাণ। চোখ খুল না? কি হয়েছে তোর? চোখ খুল না? ভয় পাই তো। এই যে এসেছি আমি। উঠ না। কষ্ট হচ্ছে আমার প্রাণ।

তোঁষা উঠলো না। আরহাম নিজেই হাটতে পারে না কিভাবে তুলবে এখন তোঁষা’কে। ট্যাবটা ছেড়ে পানি নিয়ে তোঁষার মুখে চোখে ছিটালো। টেনে যতটা পারলো বুকে তুললো। তোঁষা চোখ খুললো অনেক পর। আরহাম’কে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। অভিযোগ করলো রোজকার ন্যায়। জানালো সে ভয় পেয়েছে। জ্ঞান ফিরলেও যথেষ্ট দূর্বল দেখালো তোঁষা’কে। আরহাম চাইলেও কোলে তুলতে পারলো না। মানিয়ে তোঁষা’কে বললো,

— একটু দাঁড়া।

তোঁষা দাঁড়ানোর পর বহু কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়ালো আরহাম। ভর দিয়ে কোনমতে গিয়ে বসলো বিছানায়। তোঁষাকে বলে বলে ইনসুলিন আনালো।
মূলত না খাওয়ার কারণেই হয়তো তখন মাথা ঘুরেছে।
তাকিয়ে দেখলো জগের ভেতর রুটি ভিজিয়ে রাখা কিছুটা। হয়তো তোঁষা খেয়েছে। আরহামে’র বুকটা চিনচিন করা শুরু করলো। তুঁষটা কি না খাওয়া ছিলো?
তোঁষা ইনসুলিন এনে আরহামে’র হাতে দিলো। আরহাম কোনমতে তোঁষা’র বাহুতে পুশ করলো। তোঁষা এসে সোজা আরহামে’র পাশ ঘেঁষে বসে পরলো। মুখটা ফুলিয়ে রেখে বললো,

— খাব।

আরহাম ওকে রেখেই ক্রেচে ভর দিয়ে কিচেনে গেলো। কোনমতে ব্রেডে কেচআপ লাগিয়ে ভেতরে সালাদের পুর দিয়ে নিয়ে নিয়ে এলো। তোঁষা’র সামনে রেখে ওকে খেতে বলতেই নাক মুখ কুঁচকালো তোঁষা। খাবে না ও এটা। আরহাম আহত চোখে তাকিয়ে রইলো। তবুও জোর করতেই তোঁষা হাতে তুলে ছুঁড়ে মা’রে ফ্লোরে। মুহুর্তে ই তা ছড়িয়ে গেলো। আরহাম কিচ্ছুটি বললো না। ফোন হাতে তুলে খাবার অর্ডার দিলো।
কাছাকাছি হওয়াতে খুব দ্রুত ই খাবার এলো। তোঁষা’র সামনে খাবার রেখে ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে ব্রেডটা খেয়ে নিলো আরহাম। পায়ের ব্যাথায় টিকা যাচ্ছে না। মেডিসিন নিতেই হবে।
যেই খুঁতখুঁত স্বভাবের আরহাম কোনদিন রাস্তা ঘাটে খায় না সেই আরহাম আজ ফ্লোরে তোঁষা’র ছুঁড়ে ফেলা খাবারটা অনায়াসে খেয়ে নিলো।
তোঁষা আপনমনে খাচ্ছে বিছানায় বসে। আরহাম মেডিসিন খেয়ে তোঁষা’কে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। তোঁষা ঘুমাবে না। আরহাম ক্লান্ত ভাবে শুধু বললো,

— অনেক কষ্ট হচ্ছে প্রাণ। একটু ঘুমাতে দে।

— আদর করো।

— এখন না।

— না এখনই করো।

— পাগলামি করে না প্রাণ।

তোঁষা কথা না বলে আরহামে’র বুকে উঠে গেলো। হয়তো আজ এই প্রথম তোঁষা’কে না চাইতেও সাড়া দিলো না আরহাম। তার শরীরে কুলাচ্ছে না। কিছুতেই না।
.
কান্নার শব্দে হঠাৎ ই ঘুম ভাঙলো আরহামে’র। টেনে চোখ খুলে তাকালো কোনমতে। ঘন্টা খানিক হলো ঘুমালো। কান্নার উৎস খুঁজে তাকালো এদিক ওদিক। আলমারির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বসে কাঁদছে তোঁষা। আরহাম উঠতে চাইলেও পারলো না। কোনমতে আধশোয়া হয়ে বসে ডাকলো তোঁষাকে। তোঁষা সাড়া দিলো না। দেখে মনে হলো হয়তো পরে গিয়ে এভাবে বেকায়দায় বসে আছে। একদম ছোট ছোট চুলে মনে হলো এক বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে। আরহাম পুণরায় ডাকলো,

— তুঁষ? প্রাণ উঠে আয়। কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস? আয় আমার কাছে।

— তুঁষ উঠবে না। তুঁষ ব্যাথা পেয়েছে। কোলে তুলে নাও।

আরহাম কত করে বললো কিন্তু তোঁষা উঠলো না। অগত্যা শরীরটা ঠেলে বিছানার কিণারায় আনলো ও। ওর ক্রেচ দুটো দরজায় পাশে পরে আছে। নিশ্চিত তোঁষা ফেলে রেখেছে ওখানে।
না পেরে এবার শরীরের উপরিভাগ ছেড়ে দিলো আরহাম। ওমনিই শরীরটা ওর ছিটকে পরলো ফ্লোরে। ব্যাথায় মুখ কুঁচকালো আরহাম। পায়ে একদমই বোঁধ পাচ্ছে না৷ কোনমতে শরীরটা টেনে সেচড়ে নিলো তোঁষা’র কাছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,

— আয়।

তোঁষা এবারেও মানলো না। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষার হাতটা টেনে আনলো নিজের কাছে। তোঁষা এবার আরহামে’র কোলের উপরে ধপ করে বসলো। বসেই গলাটা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে দিলো কাঁধে। এভাবে তোঁষা পায়ে বসাতে ব্যাথায় জর্জরিত আরহামে’র মুখটা লাল হয়ে গেলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here