প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৪০

0
427

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০

আরহামে’র মেজাজটা আজ একটু খারাপ হয়ে আছে। এই দুইদিন ধরে তোঁষা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এর কোন ধরাবাঁধা কারণ নেই। শুধু শুধু ই এটা ওটা নিয়ে জ্বালাচ্ছে। রাতে ঘুমে ঢলবে অথচ ঘুমাবে না। ওর চোখে ঘুম নেই মানে আরহামে’র চোখেও ঘুম নেই। ঘুমহীনা চোখে মুখে আরহামের শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। এরমধ্যে তোঁষার আজগুবি কিছু বায়না ওকে আরো জ্বালিয়ে তুলছে।

— প্রাণ?

তোঁষার ডাকে আরহাম তাকালো। গায়ে ভেজা টিশার্ট টা লেপ্টে। গরমে কিচেনে তোঁষার ফরমায়েশ করা মাটন রান্না করতেই এই দশা। এর সাথে খাবে ছিদরুটি। আরহামে’র হাত এই রুটি বানাতে ভীষণ কাঁচা। পরপর রেসিপি দেখলেও সে বানাতে পারলো না। হচ্ছে ই না। শেষ মেষ না পেরে রুটিই বানালো। তোঁষার ফ্যাট খাওয়া নিষিদ্ধ অথচ মেয়েটা এখন ভাজাপোড়া খাচ্ছে ঠেসেঠুসে। সাথে দুই একটা আরহামে’র মুখেও ঠেসে দিবে। আজ সকালে ও বায়না ধরেছিলো আলু পরটা খাবে। ঘুমে ঢুলুঢুলু আরহাম ভাবলো কয়টা ই বা খাবে? দুটো বানাতে বানাতেই চুলা থেকেই শেষ করে দিলো তোঁষা। এতেও পেট ভরে নি তার। আরহাম কতো বললো একটু ফল খেতে। কে শুনে কার কথা? অন্য রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুজে বসে ছিলো তোঁষা। না পেরে আরো দুটো বানিয়ে তোঁষার সামনে দিতেই তোঁষা হাসি হাসি মুখে খেয়ে নিলো।
সারাটা দিন জ্বালিয়ে মে’রে এখন ডাকা হচ্ছে। আরহাম গায়ের ভেজা শার্ট’টা খুলে ওয়াশরুমে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

— গোসল করবি আয়।

— ডাকলাম না?

তপ্ত শ্বাস ফেলে আরহাম এগিয়ে এলো। তোঁষার চুলের বেণী খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?

— আমাকে ভালোবাসো না তুুমি।

— সত্যি ই তো।

— কি সত্যি?

— যেটা তুই বললি?

— তাহলে কাকে ভালেবাসো? তোমার বাবু’কে?

— বাসিই তো।

নাকের পাটা সহসা ফুলে উঠলো তোঁষা’র। চোখ দুটো গরম করে তাকিয়ে বললো,

— তাহলে তোমার বাচ্চা তোমার পেটে নাও।

— এখন তো নেয়া যাবে না। কিছুদিন পরই আমি নিব।

— আবার আমাকে ব্যাথা দিক তোমার বাবু তখন আমি ও ওকে ব্যাথা দিব।

আরহাম তোয়াক্কা করলো না। তোঁষা’কে ধরে নিলো গোসল করাতে। ভিজতে ভিজতে মাত্র করা রাগটা ভুলে বসলো তোঁষা। এখন প্রচুর উৎফুল্ল মননে পানি দিয়ে আরহামকে ভেজাচ্ছে সে। গোসল করতে করতে তোঁষা’র মন একদম চাঙ্গা হয়ে গেলো।
নিজের ভেজা চুলের পানি আরহামে’র মুখে ঝেড়ে দিয়ে বললো,

— আজ ও কি আসবে ঐ আপুটা?

— না।

— কেন?

— গতকাল ই তো এলো।

— আজও আসবে।

— আচ্ছা দেখা যাবে। এদিক আয়।

তোঁষা এলো না। ভেজা পায়ে বারান্দায় হাটা দিতে গিয়েই পা পিছলে পরতে নিলো৷ আরহাম ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে টেনে কোনমতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। বুকটা ফুলে উঠছে ওর। শব্দ করছে ধুকপুক করে। মাত্র ই তুঁষটা পড়ে যেতো তখন কি হতো? কথাটা ভাবতেই আরহামে’র বুকের উঠানামা বৃদ্ধি পেলো। তোঁষার এসবে হেলদুল নেই। ও আরহামে’র বুকের লোমগুলোতে নিজের গাল ঘষে আদর দিচ্ছে।
এই মুহুর্তে রাগ হলো আরহামে’র। চাইলো ধমকে দিতে। কিন্তু করলো না। নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে।
তোঁষা’কে ধরে আস্তে করে বসিয়ে নিজে বসলো ওর পাশে।
তোঁষা পা নাচাতে নাচাতে বললো,

— খাব না এখন?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরহাম বললো,

— কথা শুন আমার প্রাণ।

— বলো।

— আর কখনো এভাবে দৌড়াদৌড়ি করবি না। তোর পেটে একটা বাবু আছে তুঁষ। ছোট্ট একটা প্রাণ৷ তুই দৌড়ে যদি এখন পরে যেতি তখন তোর সাথে এই ছোট্ট প্রাণটা ও তো ব্যাথা পেতো। বল পেতো না?

তোঁষা মাথা নাড়লো। আরহাম পেটে হাত বুলিয়ে দিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া কিছুই করার নেই। তোঁষা ভুলে যাবে এই কথা। উঠে খাবার নিয়ে এসে যেই না রুমে ঢুকবে ওমনিই শুনতে পেলো তোঁষা বেশ জোরে জোরে ধমকাচ্ছে কাউকে। ভ্রু কুচকে রুমে ঢুকা মাত্র আরহাম হেসে ফেললো। পেট থেকে কাপড় সরিয়ে আঙুল তুলে রিতীমত শাসাচ্ছে তোঁষা। বাবু ওকে কিক মে’রেছে। কেন মা’রলো? এটাই অভিযোগ। তোঁষা কি করেছে? এখন যদি তোঁষা মা’রে তখন কি হবে?
এসব বলে বলে তোঁষা ধমকাচ্ছে৷ শেষে শুধু বললো,

— এখন মাফ করলাম। আর মা’রবি না তাহলে আমিও মা’রব।

কথাটা বলা মাত্র আবারও জোরে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো। আরহাম কিছু বুঝে উঠার আগেই তোঁষা হাত মুঠ করে পেটে এক আঘাত করলো। আঘাত করা মাত্র নিজেই ব্যাথায় কেঁদে উঠলো। পরপর আরেকবার আঘাত করার আগেই আরহাম দৌড়ে এসে তোঁষার গালে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন হওয়াতে দুইজনই অবাক। বাকরুদ্ধ। তোঁষা ভীতু ভীতু চোখে তাকালো আর আরহাম তাকালো অনুতপ্তের চোখে। তোঁষা’র পেটে এক হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেকহাত রাখলো ওর গালে। এমন না সে জোরে চড় মে’রেছে কিন্তু তোঁষার অভিমান জমা হলো। জমে একদম টাইটুম্বুর হলো তার চোখ। কথা বললো না তোঁষা। আরহাম কতবার সরি বললো লাভ হলো না। অভিমানীর অভিমান ভাঙানোর কাজটা মোটেও সহজ হলো না৷
.
বিকেল নাগাদ তথ্য আর তুষার হাজির হলো আরহামে’র ফ্ল্যাটে। তোঁষা তখন আরহামে’র বুকে ঘুম। তুষারের হাতে আরহাম একস্ট্রা চাবি দিয়ে রাখাতে ওদের ঢুকতে সমস্যা হলো না। তথ্য এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিলো। বাইরে প্রচুর গরম। তুষার ফ্রিজ হাতালেও ঠান্ডা পানি পেলো না৷ আরহাম রাখে না৷ তোঁষা’র খাওয়া নিষেধ এমন কিছুই আরহাম খায় না৷
তুষার বরফের কয়েক টুকরো নিয়ে তা গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে দিয়ে তথ্য’র জন্য আনলো। তথ্য মুচকি হেসে পুরোটা পানি শেষ করলো। এরপর উঠে হাটা দিলো কিচেনে। তুষার মানা করলো না৷ করেও লাভ নেই। তথ্য শুনবে না। এসেই ও রান্না করে এখানে। আরহাম তোঁষা’র কাহিনী শুনামাত্র তথ্য’র মনে আরহামে’র প্রতি সম্মান ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। ভাই বোন না থাকায় তাকে বসিয়েছে ভাইয়ের আসনে।
তুষার ও সাহায্য করলো তথ্য’কে। ওদের রান্না প্রায় শেষ তখন কিচেনে এলো আরহাম৷ এসেই তুষারকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— কেমন আছো ভাই?

— ভালো। একটা খুশির খবর আছে?

— তুমি বাবা হচ্ছো এর থেকেও খুশির?

তুষার হাসলো। জানালো,

— আদনানে’র বিয়ে ঠিক হয়েছে।

— বাহ৷ ভালো তো।

— যাবি না?

— না ভাই। তুঁষের সমস্যা হবে।

— আমরা আছি তো।

— আচ্ছা দেখা যাবে।

ঘুম থেকে উঠে তোঁষা তথ্য’কে দেখে খুশি হলো। তথ্য’কে আপু বলে ডাকে ও। তথ্য ও নিজের বোনের মতো আদর করাতে তোঁষা’র হয়তো তথ্য’র প্রতি টানটা বেশি।
রাত প্রায় আটটার দিকে ওরা বেরিয়ে গেলো। তুষারের বাহুতে মাথা এলিয়ে তথ্য ঢাকা শহরের ব্যাস্ত রাস্তা দেখে যাচ্ছে। তুষারের শক্ত হাতের মুঠোয় ওর হাতটা। তুষার সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— কিছু খাবে?

— খাব তো।

— কি খাবে?

তথ্য ঠোঁট কামড়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— আপনাকে।

তুষার চোখ পাকিয়ে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝালো সামনে রিক্সাওয়ালা। তথ্য সেই দৃষ্টি দেখেও হেসে ফেললো। তুষার আর কথা বাড়ালো না। আজকাল তথ্য’টা বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। কেমন বেহায়া বেহায়া চোখ করে তাকিয়ে থাকে।

________________

তোঁষা হেলান দিয়ে খাটে শুয়ে ছিলো। পাশে আরহাম। হঠাৎ তোঁষা মুখ চোখ খিচিয়ে নিলো। প্রথমে আরহাম খেয়াল না করলেও পরে দেখলো যখন তোঁষা শুয়ে পরলো অথচ মুখে শব্দ করলো না। আস্তে ধীরে খিঁচুনি বাড়লো। আরহাম ব্যাস্ত হলো। ভয় পেলো। তোঁষার গালে হাত দিয়ে ঝাকিয়ে ডাকলো,

— তুঁষ? এই তুঁষ? ব্যাথা হচ্ছে?

আরহাম খেয়াল করলো ওর পেটে। কাপড়টা উঠাতেই খেয়াল করলো পেটে’র চামড়ায় স্পষ্ট পায়ের ছাপ। বাবুটা আজ বেশ ছটফট করছে। এই ব্যাথায় ছটফট করছে তোঁষা অথচ কাঁদছে না। আরহাম তোঁষার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বারকয়েক ডাকলো। তোঁষা উত্তর না দিয়ে খিঁচে রাখলো নিজের নাক, মুখ। আরহাম তখন ভয় পেয়ে গেলো,

— এই তুঁষ কাঁদ। কাঁদ না। কিছু বলব না আমি। সত্যি বলছি। কাঁদ তুই।

তোঁষা কাঁদলো না। তার জমাট হওয়া অভিমান ভুলে নি সে। আরহাম খেয়াল করলো বাচ্চাটা আজ বেশি পা ছুড়াছুড়িঁ করছে। এত এত আঘাত পেয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তোঁষা। আরহাম এতে যেন আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো। ভোঁতা অনুভূতি হলো ওর। তোঁষা আজ এত মাস পর কোন বিষয় মনে রাখতে পেরেছে এতে খুশি হবে নাকি এই দশায় কষ্ট পাবে তা ভেবে পেলো না ও।

#চলবে…..

[আর বেশি পর্ব বাকি নেই। অতি দ্রুতই ইতি টানব ইনশা আল্লাহ।
এতদিন না দেয়ার কারণ হলো গরমে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। দুঃখীত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here