#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৬
ঘড়ির কাঁটায় নয়টা বেজে গেছে। যত রাত বাড়ছে শীতের তাপ তত বাড়ছে। কুয়াশায় ঢেকে গেছে রাস্তা ঘাট। কুয়াশার কারণে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কাছের জিনিসটা দেখা গেলও দূরের জিনিসটা যেন দেখা বড্ড দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘন কুয়াশার মাঝেই জাহিন তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গাটাই অয়ন্তির ফোনের লাস্ট লোকেশন হিসেবে ট্রেস করা হয়েছে। রাস্তায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করা হয়েছে কিন্তু রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেও কুয়াশার কারণে গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যার জন্য গাড়িটা কোন রাস্তা দিয়ে গেছে তাও বুঝা যাচ্ছে না। জাহিনের পাঞ্জাবির হাতা গুটানো, গলার দিকের দুটো বোতাম খোলা, চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে। টেনশনে শরীর গরম হয়ে আছে তার। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট, ক্ষণে ক্ষণে সেটা ঠোঁটের মাঝে রেখে শরীরের নিকোটিনের চাহিদা মিটাচ্ছে। এই পর্যন্ত সাত থেকে আটটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছে সে। সিগারেট খাওয়া জাহিনের তেমন অভ্যাস নেই কিন্তু আজ যেন এই না হওয়া অভ্যাসটা তরতর করে বাড়ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। নির্বাচন অফিসে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজে সবটা দেখেছে তার গাড়িতে কি করে ফোনটা রাখা হয়েছে। লোকটার সমস্ত শরীর কালো পোশাক দিয়ে আবৃত ছিল, মুখে মাস্ক আর মাথায় কালো ক্যাপ পড়া ছিল যার জন্য চাইলেই চিনতে পারে নি মানুষটি কে? তবে লোকটি যে একজন দক্ষ কারিগর গাড়ির লক খুলার জন্য সেটা জাহিন খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে। পুলিশের কাছেও যেতে পারছে না অয়ন্তির কিডনাপিং কেসটা নিয়ে। একবার যদি এই ঘটনাটা লিক হয়ে যায় তাহলে অয়ন্তির চরিত্র কালো দাগ পড়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না তাই যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে সেটাও রাতের মাঝে। জাহিনের পেছেনেই রিহান দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত গার্ডরা আর দলের ছেলেরা এই কুয়াশার মাঝেই অয়ন্তিকে হন্যে হয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। রিহান ভয়ে ভয়ে বলে।
“ভাইয়া আর খেও না তোমার অভ্যাস নেই।”
জাহিন চোখ বন্ধ করে লম্বা এক টান দিলো সিগারেটে। এত টুকু সময়ে বুঝা হয়ে গেছে তার অয়ন্তিকে টাকার জন্য কিডন্যাপ করা হয় নি বরং শত্রুতার জের ধরে এটা করেছে আর কে করেছে এটাও ভালো করে জানে। একবার শুধু অয়ন্তিকে খুঁজে পাক তারপর ওই খলিল তালুকদারকে সে দেখে নিবে। শত্রুতা হলো গিয়ে তার সাথে কিন্তু তার জন্য তার বউকে কেন এই শত্রুতার মাঝে টেনে আনবে? বউ তার কি ক্ষতি করেছে? এভাবে যদি পরিবারের সদস্যদের উপরে হাত দেয় তাহলে তো নিজের এই শান্ত শিষ্ট রুপটা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে সকলের সামনে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা ধরণের বাজে বাজে চিন্তা ভাবনা। অয়ন্তির উপর অত্যা’চার করছে না তো কিডন্যাপারা তার উপর শোধ নেওয়ার জন্য। মেয়েটা যে বড্ড দুর্বল হৃদয়ের। রাগে জাহিনের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, পানি টলমল করছে দুচোখ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে রেগে মেগে গগন কাপিয়ে চিৎকার করে সামনে থাকা মাঝারি সাইজের গাছটা সজোরে লাথি মারে। গাছটা সাথে সাথে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে যায়। সবাই চমকে জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিন নিজের কোমরে দু হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। ইচ্ছে করছে ওই খলিল তালুকদারকে জনসম্মুখে এনে সকলের সামনে কু’কু’রের মতো পিটাতে। তাহলে যদি এই রাগের পরিমাণটা একটু হলে কমে। জাহিন হিং’স্র গলায় নুহাশকে হাঁক ছেড়ে ডাকল। নুহাশ রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিলি জাহিনের ডাক শুনে দৌঁড়ে আসে জাহিন বলল।
“গাড়িটা কোন রাস্তা দিয়ে গেছে ট্রেস করা গেছে।”
নুহাশ কাচুমাচু হয়ে বলে, “না ভাই আসলে কুয়া…।”
নুহাশকে বলার সুযোগ না দিয়েই জাহিন চেঁচিয়ে বলে উঠে, “কি বা’ল ফালাইতাছোস তোরা যে এতজনে মিলে একটা গাড়ি ট্রেস করতে পারতাছোস না।”
নুহাশ ঢোক গিলল। নম্র, ভদ্র জাহিন যে ভীষণ ক্ষেপে গেছে বেশ বুঝতে পারছে সে। এই মুহূর্ত কিডন্যাপরদের মাঝে কাউকে যদি হাতের কাছে পায় জাহিন তার সাথে কি যে হবে সেটা একমাত্র উপরওয়ালাই জানে। নুহাশ পুনরায় কিছু বলতে যাবে তখনই একজন গার্ড হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে।
“স্যার গাড়িটা ট্রেস করা গেছে।”
জাহিন কিছু বলার আগেই নুহাশ বলল, “কোথায়?”
“দিরামগঞ্জের (কাল্পনিক নাম) আশেপাশে গাড়িটা দেখা গেছে। আর নয়ত দিরামগঞ্জ পেরিয়ে অন্য শহরেও ঢুকতে পারে যেহেতু ওখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো নেই তাই বলা যাচ্ছে না এগজ্যাক্টলি গাড়ির কোথায় গিয়ে থেমেছে।”
জাহিন আনমনে আওড়াল, “দিরামগঞ্জ।”
কথাটা বলে জাহিন নিজের ফোন বের করল। কল লিস্টে গিয়ে একটা নাম্বার বের করে ফোন করল। দুই বার রিং হতেই জাহিন ভারী কন্ঠে বলল, “আমি বলছি।”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কি বলল শুনা গেল না। জাহিন পুনরায় বলা শুরু করল, “তোর শহরে একটা কালো রঙের গাড়ি ঢুকেছে হয়ত বা সেই গাড়িতে থাকা লোকজন একটি মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। শহরের যেই প্রান্তে থাকুক না কেন ওরা ওদের খোঁজ আমার চাই বুঝতে পেরেছিস। আর ছেলেগুলাকে অক্ষত রাখবি ওদেরকে আমি পরে দেখে নিবো।”
বলেই ফোন কেটে দিয়ে গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওই রাস্তা দিয়ে যতগুলা রাস্তা মিলিত হয়েছে সব জায়াগা গুলাতে লোক পাঠাও। পুরো জায়গা তন্ন তন্ন করে খোঁজবে একটা জায়গাও যেন বাদ না পড়ে।”
গার্ড চলে যায় জাহিনের কথা শুনে। জাহিন গাড়িতে উঠে বসে নুহাশকে বলল, “গাড়ি স্টার্ট দে।”
প্রত্যেকটা গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করল এই ঘন কুয়াশার মাঝেই। জাহিন ফোন বের করে অয়ন্তির নাম্বার কল করল না ফোন সুইচ অফ বলছে। একবার শুধু ওই ছেলেগুলাকে হাতের কাছে পাক তারপর যে হাত দিয়ে অয়ন্তির ফোন সুইচ অফ করেছে সেই হাত দিয়ে যেন আর জীবনেও ফোন বন্ধ না করতে পারে সেই ব্যবস্থা জাহিন নিজ হাতে করবে।
_________
তিন জন পুরুষ গোল হয়ে বসে রয়েছে। তাদের মাঝে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তিনজনের হাতেই ম’দের বোতল। একজন পুরুষ বলে উঠে।
“ওই জননেতা জাহিন আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে না তো।”
“আরে না যদিও সিসি ক্যামেরাতে ধরা পরি তাহলে কুয়াশার কারণে বুঝতে পারবে না গাড়ি কোন দিকে গেছে। দুটো এলাকা পেরিয়ে এখানে এসেছি। এত সহজ না ধরা। এখানে আসতে আসতে গাড়ির তেল ফুরিয়ে যাবে ওই ব্যাডার।”
আলম চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু ভাই মেয়েটা এখনও উঠে না কেন মরে টরে গেল নাকি।”
মানিক চেঁচিয়ে বলল, “ওই পিন্টুর বাচ্চা তুই কি ক্লোরোফর্মের ডোজটা বেশি দিয়ে ফেলেছিস নাকি।”
পিন্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “না না এত বেশি দেই নি আমি।”
“তাহলে উঠে না কেন?”
আলম এক ঢোক ম’দ খেয়ে আশালীন ভঙ্গিতে বলে উঠে, “ভাই মা’লটা কিন্তু দেখতে হেব্বি টসটসে যদি একটু টেস্ট করতে পারতাম। তাহলে শরীর মন দুটোই চাঙ্গা হয়ে যেতো।”
মানিক আলমকে লাথি মেরে বলে, “শালা মাইন্ড ঠিক কর। বস বলেছে মেয়েটার গায়ে যেন একটুও আঁচড় না লাগে। আর তুই মনে মনে এসব চিন্তা করে বসে আছোস। যা খাবারের কিছু কিনে নিয়ে আয় আর কতক্ষণ বসে বসে এই ম’দ গিলব।”
“আমি পারব না। তোরা যা আমি আছি এখানে।”
“হো তোকে রেখে যাই এখানে আর মেয়েটির সাথে তুই উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস। চুপচাপ খাবারের কিছু নিয়ে আয় যা।”
পিন্টু আর আলম চলে গেল রয়ে গেল শুধু মানিক এই পোড়া বাড়ির সামনে।
______
অয়ন্তি পিটপিট চোখে তাকাল। চারিদিকে অন্ধকার দেখে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে পুনরায় তাকাল। শুয়া অবস্থায় পুরো জায়গাটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে। ঘরের মধ্যভাগে একটা লাইট জ্বলছে যেটার আলো খুবই ক্ষীণ। অয়ন্তি ধীরে ধীরে উঠে বসল। উঠে বসতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়, অয়ন্তি বা হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে আবারো চারিদিকে নজর বুলাল। কোথায় আছে সে, এটা কোন জায়গা? কেমন জানি গা ঝমঝমে পরিবেশ। নিজের গা থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। অয়ন্তির গা গুলিয়ে আসছে এই গন্ধে। মনে হচ্ছে ভেতরের সব কিছু বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি। অয়ন্তি সাথে সাথে গায়ের উপরে থাকা চাদরটা সরিয়ে ফেলে। এই চাদর থেকেই মবিল আর মদের তীব্র গন্ধ আসছে। অয়ন্তির চোখে এই ক্ষীণ আলো সয়ে আসতেই চারদিকের সব কিছু সে অল্প অল্প দেখতে পারছে। বিকাল দিকের সব কিছু মনে পড়তেই অয়ন্তি উঠে দাঁড়ায়। বাহির থেকে কারো গুনগুনানোর সুর ভেসে আসছে। অয়ন্তি খালি পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে জানলার ধারে ভিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে এক জন পুরুষ আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে আর ম’দ খাচ্ছে। আর বাকি দুজন কোথায়? অয়ন্তি বাইরের জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করল চারিদিকে গাছগাছালিতে ভরা। অয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলল। এই সুযোগ তাকে পালাতে হবে। অয়ন্তি নিঃশব্দে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে দরজার হাতলে হাত রেখে টান দিলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ। অয়ন্তি শরীরের সমস্ত শক্তি কাটিয়ে দরজা টান দিল কিন্তু না খুলল না। দরজার টানাটানির শব্দ পেয়ে মানিক পেছন ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে।
“ভাবি উঠেছেন আপনি।”
অয়ন্তি চিৎকার করে বলে, “প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি যে এভাবে আমাকে আটকে রেখেছেন।”
“ভাবি চুপচাপ বসে থাকেন। নিশ্চয়ই খুব খিদা পাইছে আপনের। সমস্যা নাই খাবার আনতে গেছে একটু পরে নিয়া আসবে।”
“আমার খিদে নেই। আপনি দয়া করে দরজা খুলে দিন।”
“মাপ করবেন পারব না এটা করতে।”
অয়ন্তি আহাজারিতে মানিকের মন গললো না। অয়ন্তি হাঁপাতে শুরু করল। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে তার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে অয়ন্তি পিছিয়ে যায়। পিঠ গিয়ে ঠেকে দেয়ালের সাথে। অয়ন্তি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে দুর্বল গলায় বলল।
“কোথায় আপনি নেতা মশাই, কোথায় আছেন? আপনার অয়ন্তি যে আপনার থেকে আজ অনেক দূরে চলে এসেছে। এই আধারে ডুবে থাকা ঘর থেকে কখন নিয়ে যাবেন আপনার সাথে আমায় নেতা মশাই? একটু জলদি আসুন না আমার কাছে, আমার যে খুব ভয় হচ্ছে এখানে থাকতে।”
বলতে বলতে অয়ন্তি চোখ বন্ধ করে নেয়।
__________
“কি মেয়েটিকে নিয়ে কেউ একজন চলে গেছে মানে কি?”
যবুকটি দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলল। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে আলম বলল, “হ্যাঁ বস আমরা খাবার আনতে গিয়েছিলাম কিন্তু ফিরে এসে দেখি মানিককে মে’রে মেয়েটিকে কেউ একজন নিয়ে চলে গেছে।”
“মেয়েটিকে কেউ নিয়ে গেছে সেটা তোরা বুঝেছিস কিভাবে?”
“আমার খাবার কিনে এসে দেখি লোকটি মেয়েটিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে দ্রুত এখানে থেকে চলে যায়। আমার পিছু নিতে চাইলেও নিতে পারি নি কারণ গাড়ির চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি আমার।”
“শু’য়ো’রে’র বাচ্চারা তোরা কোনো কাজের না।”
আলম ভয়ে ভয়ে বলে, “এখন কি করব আমার বস?”
“ওই মানিক কি মা’রা গেছে?”
“হ্যাঁ বস মা’রা’ই গেছে। আমরা চেক করেছে এক্কেবারে শরীর ছেড়ে দিছে ও।”
“তোদের যে জিনিসটা জন্য ফোন দিয়ে সাবধান করতে চাইছিলাম এখন সেই জিনিসটাই তোদের কাছে নেই। তার আগেই মেয়েটিকে নিয়ে কোনো এখন আগন্তুক চলে গেল। ওই লোকের মুখ দেখেছিস তোরা?”
“না বস।”
“ঠিক আছে এই জায়গা থেকে কেটে পড়। ওই জাহিন যেকোনো সময় তোদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।”
কথাটা বলে কল কেটে দিয়ে যবুকটি মনে মনে ভাবে যেহেতু অয়ন্তিকে কেউ নিয়ে গেছে তার মানে ওইটা জাহিনের শত্রুর মধ্যে কেউ হবে বন্ধু হলে ফোন করে নিশ্চয়ই বলত বউ কোথায় আছে তার। কিন্তু তা না করে নিজের সাথে করে নিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। কিন্তু জাহিনের এই শত্রুটা আবার কে? এই লোকের আর কত শত শত্রু আছে এই দুনিয়াতে?বন্ধুর থেকে মনে হচ্ছে শত্রু সংখ্যাটাই বেশি জাহিনের।
________
আকস্মিক রাসেলের কাঁধে কেউ হাত দিতেই চমকে উঠে রাসেল পেছন ফিরে তাকায়। কাইফ অবাক হয়ে বলে, “কি হলো এভাবে চমকে গেলে কেন?”
“না আসলে আমি ভাবছিলাম ভাবি কোথায় থাকতে পারে? এত খোঁজার পরেও ভাবিকে কেন পাচ্ছি না। আর এমন নিরিবিলি জায়াগাতেযে কেউ কাঁধে এভাবে হাত রাখলে চমকে উঠা স্বাভাবিক নয় কি।”
কাইফ একটা ভ্রু উঁচু করে বলল, “ওও।”
“ঠিক আছে চলো এখানে থেকে। এখানে আর লাভ নেই অন্য জায়াগাতে গিয়ে খুঁজতে হবে ভাবিকে।”
রাসেল হন্ততন্ত হয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছে যেন কাইফের কাছে থেকে সে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করল। কাইফও তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে রাসেলের পেছন পেছন যেতে শুরু করল।
________
দিরামগঞ্জে যেই লোকদের জাহিন অয়ন্তিকে খোঁজার কাজে লাগিয়েছিল তাদের থেকে খবর এসেছে তাদের এলাকায় কোনো কালো গাড়ি ঢুকে নি। তারমানে কিডন্যাপররা দিরামগঞ্জ যায় নি। জাহিনের গাড়ি দিরামগঞ্জের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। দুটো এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে কিন্তু অয়ন্তি কিংবা কিডন্যাপারদের কারো কোনো কোন চিহ্ন পায়নি। রইল আর একটা এলাকা সেখানে গার্ডরা গিয়েছে কিন্তু কোনো খবর আসছে না এখনও। জাহিন ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে রয়েছে কপালে হাতে রেখে। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। পুরো শহর জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় চলে গেছে যে এতো খোঁজাখুজির পরও সে পাচ্ছে না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। নুহাশ আড় চোখ জাহিনের দিকে তাকাল। কি যে হবে তারেই কল্পনা করছে সে? সকালের মধ্যে যদি অয়ন্তিকে খুঁজে না পায় তাহলে এই শহরের বুকে একটা ঝড় বয়ে যাবে নির্বাচনের আগেই। নুহাশ ঢোক গিলে ড্রাইভ করাতে মনযোগ দিল। এর মাঝে জাহিনের ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে রিহান কল করেছে। ওপাশ থেকে রিহানের কথা শুনে সাথে সাথে নুহাশকে বলল।
“এক্ষুনি গাড়ি থামা।”
নুহাশ হতবাক হয়ে বলে, “কিন্তু কেন ভাই?”
“যেটা বলছি সেটা কর।”
নুহাশ গাড়ি থামল। জাহিন গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে গিয়ে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে বলে, “গাড়ি থেকে নাম আর ওখানে গিয়ে বস।”
নুহাশ নির্বাক হয়ে নামল গাড়ি থেকে। জাহিন গাড়িতে উঠতে উঠতে বলে, “তুই কি বসবি নাকি তোকে এখানে রেখে চলে যাব।”
নুহাশ দ্রুত পায়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। জাহিন হাই স্পিডে গাড়ি চালাতে শুরু করল। নুহাশ সিট বেল্ট লাগানোর সময় টুকু পায় নি তার আগে জাহিন গাড়ি স্টার্ট করে বসে। নুহাশ ব্যস্ত হাতে নিজের সিট বেল্ট লাগালো। আধ ঘন্টার রাস্তা জাহিন বারো মিনিটে পাড় করল। রিহানের বলা স্থানে এসে জাহিন জোরে গাড়ি ব্রেক করল। গাড়ির ফ্রন্ট থেকে রিভ’লবার বের করে জাহিন গাড়ি থেকে নামল। নুহাশ এক পল জাহিনের দিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে জাহিনের পেছন পেছন দৌঁড়ে যায়। জাহিনকে দেখার সাথে সাথে রিহান দৌঁড়ে এসে বলে।
“ভাইয়া ভাবি নেই এখানে?”
জাহিন অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করল, “ছেলেগুলা কোথায়?”
“একজনকে পেয়েছি।”
গাড়ির হেড লাইটের আলোতে জায়াগাটা আলোকিত হয় আছে। জাহিন গার্ডদের পেরিয়ে ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়ায়। জাহিন হাঁটু ভেঙ্গে বসে ছেলেটার মুখোমুখি হয়ে ঠান্ডা গলায় বলে।
“অয়ন্তি কোথায়?”
কোনো কথা বলল না ছেলেটা। জাহিনের রাগ মাথায় চড়ে যাচ্ছে। বা হাত দিয়ে ছেলেটার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে চিবিয়র চিবিয়ে বলে, “কথা বলচ্ছিস না কেন? কথা বলার জন্য কি অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে নাকি।”
মানিকের শরীর ভেঙ্গে আসছে। তাকে মাথায় আঘাত করা হয় নি আকস্মিক তার ঘাড়ের ধারে কেউ যেন ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল আর সাথে সাথে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই তার। কিন্তু আলম আর পিন্টু উত্তেজনার বশে মানিককে মৃত ভেবে ভুল করে বসে। জাহিন এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে। নজর বোতল ভর্তি ম’দের উপরে পড়তেই একটা বোতলের ক্যাপ খুলে মানিকের মুখে জোর করে ভরে দেয়। মানিকের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম যেন, হাত বাঁধা থাকার কারণে চাইলেও জাহিনকে সরিয়ে দিতে পারছে না। সবাই নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে জাহিনের হিং’স্র রুপটা দেখছে। জাহিনের এমন রুপ তারা আগে কখন দেখে নি এটাই প্রথম। জাহিন অর্ধেকের বেশি মদ মানিককে জোর করে খাইয়ে দিয়ে মদের বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে।
“নে এবার বল অয়ন্তি কোথায়? কোথায় সরিয়ে ফেলেছিস অয়ন্তিকে।”
মানিক কাশতে শুরু করল। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে সে এই মুহূর্তে বেঁচে ফিরল। মানিক হাপাতে হাপাতে বলল, “বিশ্বাস করুন আমি জানি না।”
“তুই জানিস না তাহলে কে জানে?”
“আমি সত্য বলছি আমি কিচ্ছু জানি না। আমার ঘাড়ে হঠাৎ করেই কেউ ইলেকট্রিক শক দেয় আর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এরপর কি হয়েছে কিচ্ছু জানি না।”
“তোর দলের আর লোক কোথায়?”
“আমি জানি না। ওরা খাবার আনতে গিয়েছিল। ওদের সাথে কি হয়েছে কিচ্ছু জানি না আমি।”
জাহিন কন্ঠে তেজ এনে বলল, “জানিস না! ঠিক আছে বলতে হবে না তোকে এই মুহূর্তে। তবে তোর মুখ থেকে আমি সব কথা বের করে ছাড়ব।”
জাহিন মানিককে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা পোড়া বাড়িটার ভেতরে ঢুকে। ঘরের এক কোণে দুটো লাল গোলাপ পড়ে রয়েছে অযত্নে। জাহিন বুঝতে পারল ফুল দুটো অয়ন্তির খোঁপায় গুঁজে দেওয়া সেই ফুলগুলা। জাহিন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নেতিয়ে যাওয়া ফুলগুলা হাতে তুলে নেয়। আর একটু আগে আর একটু আগে যদি সে এসে পৌঁছে যেতে তাহলে হয়ত অয়ন্তিকে পেয়ে যেত। এত কাছে এসেও অয়ন্তিকে সে হারিয়ে ফেলল পুনরায়। কিন্তু এবার কে অয়ন্তিকে এখান থেকে নিয়ে গেল? এই নতুন শত্রুটা আবার কে? মানিকের কথা শুনে মনে হল সে সত্য কথা বলছে। মাথা কাজ করছে না তার, ঘটনাটা যেন জটিলতায় পরিণত হচ্ছে। এখন কোন পথে যাবে সে আগে তাও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গাড়িটা চিহ্নিত করতে পেরেছিল এবার কি করবে? এর মাঝে জাহিনের ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে সিম কোম্পানির অফিস থেকে কল এসেছে। জাহিনের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। আজ এই ফোনটার জন্য সমস্ত কিছু হয়েছে। প্রচন্ড রেগে চিৎকার করে ফোনটা আছাড় মারল ফ্লোরে। মুহূর্তের মাঝে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল ফোনটা। জাহিনের চিৎকার আর কিছু ভাঙ্গার শব্দ শুনে নুহাশ আর রিহান ভেতরে ঢুকে এসব দেখেও কিছু বলল না। কি বলবে তারা কিছু বলার নেই তাদের। জাহিন হুংকার ছেড়ে বলল।
“ওই খলিল তালুকদারকে ছাড়ব না আজকে। আমি ওর লা’শ ফেলব আজকে তারপর জংলি কু’কু’রের খাদ্য বানাব।”
কথাটা বলে জাহিন বেরিয়ে পড়ে। নুহাশ আর রিহান একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে জাহিনকে আটকিয়ে রিহান বলে।
“ভাইয়া তুমি আমার কথাটা শুনো। মাথাটা একটু ঠান্ডা করো।”
জাহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার সামনে থেকে সর রিহান না হলে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলব আমি।”
নুহাশ বলল, “ভাই আর ক’দিন পর নির্বাচন এখন যদি তুমি ওই খলিল তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে হামলা করো বুঝতে পারছো ঘটনা কোন দিক মোড় নিবে।”
জাহিন চিৎকার করে বলে উঠে, “আমার বউকে কিডন্যাপ করা হয়েছে নুহাশ। এখন আমাকে ওই নির্বাচন নিয়ে ভাবতে বলছিস তুই।”
“ঠিক আছে ভেবো না কিন্তু এটা ভেবে দেখো খলিল তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে এভাবে হামলা করলে তোমার নামে পুলিশ কেস হতে পারে। পরে কি করে তুমি ভাবি খুঁজে বের করবে? একটু ঠান্ডা হও তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
জাহিন নুহাশের কথা শুনে হাটু ভেঙ্গে মাটিত ধপ করে বসে পড়ে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ঠিক যেমন পাঁচ বছর আগে লেগেছিল তেমনটা। এটার জন্য সে নিজের জীবনে কাউকে আনতে চাই নি কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তার জীবনে একজন মানুষ এসেছিল। সেই মানুষটা আজ তার থেকে দূরে কতটা দূরে আছে মানুষটা? অজান্তেই জাহিনের দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা নোনা জল। সবাই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে জাহিনের দিকে। জাহিনকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে সকলের বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সকলে ভীড়ে একজনের ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে পৈশাচিক হাসি যেই হাসিটা সবার অগোচরে রয়ে গেছে।
________
অয়ন্তি চোখ বন্ধ করে মাথাটা হেলিয়ে রেখেছে সিটের উপরে। চেহারা শুকিয়ে গেছে তার এই কয়েক ঘন্টায়। চোখের নিচে কাল দাগ পড়ে গেছে। তার পাশেই ড্রাইভিং সিটে একজন যবুক বসে রয়েছে আর এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিতে নেই কোনো কামুকতা আছে শুধু এক আকাশ সমান ভালোবাসা। যে ভালোবাসা একজন পুরুষ সযত্নে তুলে রাখে মনের মাঝে তার একান্ত নারীটির জন্য। যবুকটি হাত বাড়িয়ে অয়ন্তির এলোমেলা চুল গুলা কানের সাইডে গুঁজে দিয়ে মোলায়েম গলায় বলে।
“কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না অয়ন্তি কেউ না। সবসময় তোমার সামনে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াব।”
#চলবে
বানান ভুল হলে একটু বুঝে নিয়েন। এত বড়ো পর্ব একটু আধটু বানান ভুল হতেই পারে। আমি মানুষ কোনো রোবট নই যে এক্কেবারে শুদ্ধ হবে সব কিছু।