#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ০৩
প্রতিজ্ঞা কখনো সংকল্পের সামনে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে নি।তবে সবসময় সংকল্পকে নজরে নজরে রাখতো।সংকল্প বিদেশে থাকাকালীন প্রতিজ্ঞা তার সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে নজরে রাখতো।প্রতিজ্ঞার ইচ্ছে ছিলো সে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে,তখন সংকল্পকে নিজের অনুভূতির কথা জানাবে।
প্রতিজ্ঞার মেডিকেল এডমিশন টেস্টের এক মাস আগে সংকল্প বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে আসে।প্রতিজ্ঞার আনন্দ তখন হাজারগুণে বেড়ে যায়।তার প্রাণপুরুষ তার সামনে থাকবে।সে ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় দেখতে পারবে।প্রতিজ্ঞা ভেবেছিলো সংকল্প নিজেদের ব্যবসায় যোগ দিবে।পরিবারের লোকেরাও তাই চেয়েছিলো।কিন্তু সংকল্পের ইচ্ছে ছিলো জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞানদান।শিক্ষকতা নামক পেশায় নিজেকে যুক্ত রাখতে চেয়েছিলো ছোট থেকেই।সেই সুবাধেই গণিত নামক বিষয়টাতে সে পিএইচডি করেছে।বিদেশে ভালো ভালো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে দেশে চলে আসে।দেশের প্রতি তার আলাদা টান,ভালোবাসা।
যেদিন প্রতিজ্ঞার মেডিকেল এডমিশনের রেজাল্ট দেয় ঐদিন ছিলো ওদের পরিবারের সবচেয়ে খুশির দিন।আনন্দের বন্যায় ভাসার দিন।প্রতিজ্ঞা ময়মনসিংহ মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে।আজকে তার স্বপ্নপূরণের দিন।এই দিনটার জন্যই কত কষ্ট,কত পরিশ্রম,কত সাধনা,অধ্যাবসায়,নির্ঘুম রাত্রীযাপন।ভাগ্যক্রমে,সেদিনই ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংকল্পেরও জয়েনিং লেটার আসে। বলা বাহুল্য,প্রতিজ্ঞার মা-ও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর।
সংকল্পের কথা জানতে পেরেই প্রতিজ্ঞার মাথায় ভূত চেপে বসে।সে মেডিকেলে পড়বে না।সব চিন্তা- ভাবনা,স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে দেয় সে ভালোবাসার জন্যে।সেই মুহুর্তে তার মনে হয়েছিলো তার প্রাণপুরুষকে সর্বক্ষণ নিজের সামনে দেখতে পাওয়া,তার সংস্পর্শে থাকা,তাকে নজরে রাখার এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।এই যে ভূত চেপেছিলো, সেই ভূত আর মাথা থেকে নামানো যায় নি।বাবা-মা, ভাই-ভাবী,পরিবারের সকলে তাকে অনেক বুঝিয়েছিলো কিন্তু তার একটাই কথা,সে বাড়ি থেকে এতো দূরে,সবাইকে ছেড়ে একা থাকতে পারবে না।কিন্তু সে তো জানে আসল সত্যিটা।বাড়ির সবার ছোট হওয়ায় প্রতিজ্ঞা বড্ড আদুরে।তাই বাড়ির লোকজনও তাকে বেশি জোর করে নি।সবসময়ই প্রতিজ্ঞার সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছে।প্রতিজ্ঞার বাবার একটাই কথা,
“তোমার জীবন,তুমি যা ভালো মনে করবে তাই করবে।জোর করে কিছু হয় না।”
প্রতিজ্ঞার সাথে তার বাবার সম্পর্ক অনেক ভালো,বন্ধুত্বপূর্ণ।প্রতিজ্ঞা দেখতে হুবহু তার দাদির মতো।সে যেদিন জন্মছিলো সেদিন আনোয়ার সাহেবের প্রমোশন হয়েছিলো।সবমিলিয়ে আনোয়ার সাহেব মেয়েকে বড্ড বেশি ভালোবাসেন।যা চায়,তার কয়েকগুণ বেশি মেয়েকে দেন।তিনি জানেন তার মেয়ে কখনো এতো আহ্লাদে খারাপ কিছু করবে না।এই বিশ্বাস তার মেয়ের প্রতি আছে।তবে প্রতিজ্ঞার মা অনেক জোরাজোরি করেছিলো।পরে প্রতিজ্ঞার বাবা,ভাই মিলে মাকে বুঝিয়েছিলো।
শুধু সাবিহা ছাড়া এই সত্যি আর কেউ জানে না,প্রতিজ্ঞার নিষেধ।সাবিহারও ভালো লাগে,তার ভাইকে কেউ আড়াল থেকে এতো ভালোবাসে।
প্রথম যখন সংকল্প জয়েন করলো,তখন থেকেই সে মেয়েদের থেকে অনেক প্রপোজাল পেয়ে আসছে।সিনিয়রদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় এই বিষয়গুলা প্রতিজ্ঞার নখদর্পনে ছিলো।প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সে রামিম আর সাব্বির কে পুলিশ সাজিয়ে মেয়েদের কল দিয়ে ভয় দেখাতো। একদিকে সংকল্পের হাতে থাপ্পড় অন্যদিকে পুলিশের ধমক,সব মিলিয়ে মেয়েরা আর সাহস করতো না।এখন প্রতিজ্ঞা দ্বিতীয় বর্ষে।এখন জুনিয়রদের নিজে শাসায় আর সিনিয়রদের নকল পুলিশ দিয়ে ভয় দেখায়।মাঝে মাঝে তার হিং সে হয়,কেনো তার প্রাণপুরুষ এতো সুন্দর! কেনো তার ব্যক্তিত্ব এতো নজরকাড়া!কেনো সবাই এতো আকর্ষিত হবে তার প্রাণপুরুষের দিকে।কিন্তু সে প্রকাশ করে না,সে ছাত্রী-শিক্ষকের বিষয়টা মাথায় রেখেই গত দু’বছর চলে আসছে।তার ব্যক্তিত্ব অন্যরকম।ভালোবাসে বলেই ছ্যাছড়ামি করতে হবে?ঢলে পড়তে হবে?গায়ে পড়া স্বভাব তার পছন্দ নয়।
সংকল্প প্রতিজ্ঞাদের অরডিনারি ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনস্,কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বিষয়ে ক্লাস নেয়।প্রতিজ্ঞা ক্লাসের সিআর,টপ স্টুডেন্ট নামেই পরিচিত।তার আচার-আচরণে সে কখনোই কাউকে বুঝতে দেয় না সে সংকল্পকে ভালোবাসে,পা গলের মতো ভালোবাসে।শুধু তাদের ফ্রেন্ডদের গ্রুপটাই এই কথা জানে।তাদের উপরও প্রতিজ্ঞার কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে,কেউ যেনো ঘুণাক্ষরেও এই কথা জানতে না পারে।সে একটা সময়ের অপেক্ষায় আছে।তার মতে,সঠিক সময়ে সব হবে।
তাছাড়া তার মা এই ভার্সিটিরই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।মায়ের সম্মানও জড়িয়ে আছে তার কাজকর্মে।
মিমকে ঐদিন ধমকানোর পরে মিম এখন প্রতিজ্ঞাকে দেখলেই অন্য রাস্তায় হাঁটা শুরু করে,লুকিয়ে থাকে।বেচারির অবস্থা থেকে প্রতিজ্ঞারা মজা পায়,হেঁসে লুটোপুটি খায়।
নববর্ষের অনুষ্ঠান তিনদিন পর।হাতে একদমই সময় নেই।সবার রিহার্সাল করা শেষ হলেও প্রতিজ্ঞারা সবার শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই তিনদিনই তাদের হাতে সময়।সংকল্প গান-বাজনা পছন্দ করে বিধায় তাদের ডিপার্টমেন্টের সাংস্কৃতিক কাজকর্মের দায়িত্ব সংকল্পের উপর থাকে।এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।সবার গান,নাচ সে দেখে নিয়েছে।এখন শুধু এই গ্রুপটারই বাকি।সে সবাইকে অনেক ধমকেছে শেষ সময়ে এসে নাম দেওয়ায়। কিন্তু সাবিহা তাকে বোঝানোয় কাজে দিয়েছে।
ক্লাস শেষ করে সবাই কমন রুমে বসে আছে।কে কি করবে,তাই নিয়েই আলোচনা করা হচ্ছে।প্রতিজ্ঞা নাচ পারে না,তাই সে নাচবে না।সে আর সাবিহা গান করবে,সেই গানে বাকিরা নাচ করবে।পোশাক নিয়ে আলোচনা চলছিলো, প্রতিজ্ঞা সেসবে মাথা ঘামায় না।সে দূরে বসে গিটারে টুংটাং সুর তুলছে,
“পাগল হয়ে আছি, তোরই কারণ
সাথে করে এনেছি, নে এই মন
তোর হাসির ছল, তোর চুলের দল
আমাকে কেড়ে নে
তোর চোখের ঝিল জানি
পেরোনো মুশকিল মানি
তাও পারিনা যে, এগিয়ে গিয়েছে
আমারই দুটো পা
তোকে একার দেখার লুকিয়ে কী মজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানেনা
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানেনা।”
গান গাওয়াকালীন সংকল্প কমন রুমে প্রবেশ করে।তার কেনো জানি মনে হলো গানটা তার উদ্দেশ্যে গাওয়া।পরক্ষনেই নিজেকে নিজে শাসালো,কিসব ভাবছে সে!এটা হতে পারে না।বাকিরা সংকল্পকে দেখে নিজেদের বকবকানি বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু প্রতিজ্ঞা সংকল্পকে খেয়াল করে নি।
সংকল্প রাগী শিক্ষক হওয়ায় ওর সামনে সবাই কাচুমাচু অবস্থায় থাকে।কখন না বেয়াদবি হয়ে যায়,আর থাপ্পড় মা*রে।শিক্ষকমহলে সংকল্পের অনেক পরিচিতি।পড়াশুনার ব্যাপারে যেমন সে সিরিয়াস,তেমন আদব-কায়দাতেও।যার জন্য সে থাপ্পড় মা*রলে ও কেউ কিছু বলে না।আর বললেও সংকল্পের যায় আসে না।
সংকল্প দপাদপ পায়ে প্রতিজ্ঞার কাছে গিয়ে থমথমে গলায় বলে,
“প্রেমে পড়েছো?”
উপস্থিত সবাই এমন প্রশ্ন শুনে হা করে তাকিয়ে আছে।প্রতিজ্ঞার ধ্যান ভাঙ্গতেই সে ঢোক গিলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“জ্বী স্যার?”
সংকল্প ধমকে উঠে।রাগান্বিত হয়ে বলে,
“জিজ্ঞাসা করেছি যে প্রেমে পড়েছো নাকি?সেই কখন থেকে আমি এসে দাঁড়িয়ে আছি।তোমার পাত্তাই নেই।কই হারিয়ে গেছো?এমনিতেই শেষ সময়ে এসে নাম দিয়েছো তোমরা। অন্য সব কাজ ফেলে এখন আবার আমাকে এসব দেখতে হচ্ছে।”
প্রতিজ্ঞা নতমুখী হয়ে বলে,
“স্যরি স্যার।গান প্র্যাকটিস্ করছিলাম তাই আপনাকে খেয়াল করি নি।”
সংকল্প আবার ধমকে উঠে। কাঠকাঠ গলায় বলে,
“একটা থাপ্পড় পড়লে সব দিকে খেয়াল হবে।বাই দ্য ওয়ে, তুমি এই গান সিলেক্ট করেছো গাওয়ার জন্যে?নববর্ষে তুমি এই গান গাইবে?সিরিয়াসলি?”
প্রতিজ্ঞা মাথা নেড়ে চোখ পিটপিট করে বলে,
“না স্যার!”
“তাহলে?”
“স্যরি স্যার।” ঠোঁট উল্টিয়ে বলে প্রতিজ্ঞা।
এর মাঝেই সাবিহা বলে উঠে,
“ছেড়ে দে না ভাই,বকছিস কেনো!”
সংকল্প সাবিহার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়,যেনো ভস্ম করে দিবে। কাঠকাঠ গলায় বলে,
“কতবার বলেছি কলেজে আমি কারো ভাই নই,শুধুই স্যার!
বাসায় যেয়ে নেই,বুঝাবো ভালো করে।”
সাবিহাও পাত্তা না দিয়ে বলে,
“ঠিক আছে।বাড়িতেও কেউ আমার স্যার নয়,শুধুই ভাই।তাই না স্যার?”
সাবিহার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে।সংকল্প রাগী দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতেই সবাই চুপ হয়ে যায়।সাবিহাকে উদ্দেশ্য করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“তোকে একটা থাপ্পড় দিবো,বেয়াদব।”
সাবিহা চোয়াল ঝুলিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“তুমি-ইতো বললে!”
“চুপ!এই তোমরা এদিকে এসো।কে কি পারফরম্যান্স করবে আমাকে দেখাও,লিস্ট দাও।”
সাবিহাকে চুপ করতে বলে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে সংকল্প।
অন্যদিকে, প্রতিজ্ঞা নিচের তাকিয়ে বিড়বিড়ায়,
“প্রেমে পড়িনি স্যার,ভালোবাসি,অনেক ভালোবাসি।হৃদয়ে জুড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে বড্ড বেশিই ভালোবাসি।সে জানে না আড়াল থেকে ভালোবাসার কত সুখ,কত আনন্দ। সে জানে না আমার গোপন ভালোবাসার পরিধি কতটা বিশাল।একদিন পুরো পৃথিবী জানবে,আমি তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি,সাথে জানবেন আপনিও।”
সংকল্পের ধমকে প্রতিজ্ঞার ভাবনার সুঁতা ছিঁড়ে।সংকল্প কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“এই তোমাকে কতবার ডাকতে হয়?কি হয়েছে তোমার? কোথায় হারিয়ে যাচ্ছো বারবার?তোমার থেকে এগুলা আশা করি না প্রতিজ্ঞা। ”
প্রতিজ্ঞা মনে মনে বলে,
“আপনাতেই তো হারিয়ে যাচ্ছি বারবার।সব দোষ তো আপনার।আমার হৃদয় চুরি করে নিজের রাজত্ব চালাচ্ছেন।
মুখে বলে,
“স্যরি স্যার।”
“এখন কি এখানে আসার জন্য তোমাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে?তোমাদের পারফরম্যান্সের লিস্ট করছি,শুনতে পাও নি?” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে সংকল্প।
প্রতিজ্ঞা চোখ পিটপিট করে বলে,
“না স্যার!”
“কি?” চোখ ছোট ছোট করে বলে সংকল্প।
প্রতিজ্ঞা নিজেও জানে না আজকে এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার সে কেনো করছে।সংকল্পের কাছে যেতে যেতে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“আসছি স্যার।”
সংকল্প বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থাকে।
#চলবে….
[আপনাদের গল্প ভালো লাগছে না?সত্যি বলতে আমারও লাগছে না,খাপছাড়া লাগছে।সবটাই হসপিটালে থাকার প্রভাব।মেইন কাহিনী এখনো শুরুই করি নি।ছোট্ট পরিসরে ভালোবাসা প্রকাশ করবো,ওয়েট।]