#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ০৪
আজ নববর্ষ।দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন।বাঙ্গালী জাতির বড্ড আকাঙ্ক্ষিত দিন পহেলা বৈশাখ।জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের বাঙ্গালিরা এই দিনটি উদযাপন করে থাকে।পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব।এই উৎসবটি শোভাযাত্রা,মেলা,পান্তাভাত খাওয়া,হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়।এই দিনে নারীরা লাল-সাদা রঙের শাড়ী,ছেলেরা পাঞ্জাবি পরিধান করে।পুরো বাংলাদেশ উৎসবমুখর হয়ে থাকে।
প্রতিজ্ঞা,সাবিহা,সোহানা,রিমা,ফিহা,আয়েশা আজকে একই রকম লাল পাড়ের সাদা শাড়ী পরিধান করেছে।রামিম, সাব্বির সাদা পাঞ্জাবি।প্রতিজ্ঞা,সাবিহা নাচ না করলেও ওদের সাজ বাকিদের মতোই।ওদের নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমেই অনুষ্ঠান শুরু হয়।ওদের সম্পদনার ভিন্নতা,নতুনত্ব হলো প্রতিজ্ঞা,সাবিহা গান গাইবে এবং গানের তালে তালে বাকিরা নাচ করবে।একটা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো দুই নারীর অতুলনীয়, মোহনীয় সুরে।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
মঞ্চের পাশ থেকে কেউ একজন প্রতিজ্ঞাকে প্রাণভরে নয়ন জুড়িয়ে দেখতে থাকলো,চোখে মুগ্ধতা।গান-নাচ শেষ হতেই তার ধ্যান ভাঙ্গে দর্শকের হাততালিতে মুখরিত পরিবেশে।নিজেকে নিজে আবার শাসায়।এটা তার করনীয় নয়,এমনটা কোনোদিনও সম্ভব নয়।সংকল্প আজ অনুষ্ঠান সঞ্চালনার কাজে দায়িত্বরত।নাচ-গান শেষে ওরা কমনরুমে চলে যায়,বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
সাবিহা সোহানা,রিমা,ফিহা নিজেদের মেক আপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।সাব্বির,রামিম সবার জন্য ঠান্ডা কোমল পানীয় নিয়ে আসে।প্রতিজ্ঞা একপাশে ফ্যানের নিচে গিয়ে বসে থাকে।
আয়েশা নিরবতা ভাঙ্গে।নিজের গোল চশমাটা ঠেলে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“জানিস,আমি নাচ করার সময় লক্ষ্য করেছি সংকল্প স্যার প্রতিজ্ঞার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।”
প্রতিজ্ঞা ফট করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আয়েশার দিকে।সবার চোখে এখন আয়েশার প্রতিবিম্ব। সাবিহা খুশি হয়ে বললো,
“কি বলিস!ভাই সত্যিই প্রতিজ্ঞাকে দেখছিলো?”
“হ্যাঁ রে বাবা।চোখের ভাষা অন্যরকম ছিলো।আমি দেখেছি।”আয়েশা ভাবুক হয়ে বললো।
ফিহা চট করে বলে উঠলো,
” বাহ বাহ!আমাদের ভাবুকরাণী এতোকিছু বুঝলো কিভাবে?যে সারাদিন পড়াশুনায় মুখ ডুবিয়ে রাখে সে কিনা চোখের ভাষা নিয়ে কথা বলছে!ইন্টারেস্টিং।”
আয়েশা মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
“মজা নিস না তো।আমি প্রেম করি নি তো কি হয়েছে?প্রেৃ করতে দেখেছি,ঐখান থেকেই জেনেছি।গল্পেও পড়েছি নায়িকার কোনো পারফমেন্স করলে নায়ক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।”
সোহানা প্রতিজ্ঞাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“প্রিতু এটা কিন্তু মোক্ষম সময়।এখনই প্রপোজ করে ফেল।”
প্রতিজ্ঞা মেঝের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল খুঁটতে খুঁটতে বললো,
“সঠিক সময় আসুক।”
“সঠিক সময় কবে আসবে?অপেক্ষা করতে করতে দেখবি পাখি ফুড়ুৎ।”রামিম ধমকে উঠে বলে।
রামিমের কথায় প্রতিজ্ঞা চট করে তাকায়।চেহারায় ভয়ের আভাস,চোখে অসহায়ত্ব।থেমে থেমে শক্ত কন্ঠে বললো,
“এমন কিছু হবে না,হতে পারে না।”
সাব্বির স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো,
“এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম জিনিস হচ্ছে সময়।মানুষকে কিভাবে উলটপালট করে দিতে হয়,তা সময়ের থেকে ভালো কেউ জানে না।মানুষের সকল পরিকল্পনার বিনাশ করতে সময় একটুও ভাবে না।সময় মানুষের বিনাশকারী।সময় কোন দিক দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তা টেরও পাবি না।”
সোহানা সাব্বিরের সাথে সম্মতি জানায়।বলে,
“হ্যাঁ রে।প্রকৃতি সব ভালোবাসার পরিণতি দেয় না।সব ভালোবাসা প্রকৃতি এপ্রুভ করে না।সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে করতে দেখবি সময় চলে যাচ্ছে, প্রকৃতি সায় দিচ্ছে না।”
প্রতিজ্ঞা ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো।ওরা খারাপকিছু বলে নি।মনে ভয়েরা ঝেঁকে বসছে।তখনই
রিমা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠলো,
“ওরা ঠিকই বলছে রে প্রিতু।দেখিসনি আমার ক্রাশকে প্রপোজ করার আগেই সে বিয়ে করে ফেললো।কয়েকদিন আগে তো একটা বেবিও হয়েছে।”
রিমার কথা শুনে সবাই ওর দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সিরিয়াস মোমেন্টেও এই মেয়ের উল্টা পাল্টা কথা না বললে হয় না।রামিম ওর মাথায় চাটি মেরে বললো,
“তোর ক্রাশ কয়টা জীবনে গুণেছিস?যারে দেখোস তার উপরেই তো ক্রাশ খাস।ফালতু!”
“এই একদম ফালতু বলবি না।ক্রাশ কয়টা আর হবে,বেশি না মাত্র তিপ্পান্নটা।কাউকেই প্রপোজ করার সুযোগ পাইনি।করার আগেই হয় কেউ হয়তো বিয়ে করে ফেলেছে,কেউ হয়তো মিঙ্গেল আবার কাউকে কয়দিন পর ভাল্লাগে না নাহয় নতুন কারোর উপর ক্রাশ খেয়ে ফেলি। আনার কি দোষ বল!” ঠোঁট উল্টিয়ে বলে রিমা।
সবাই সেন্টি ইমুজির মতো মুখ করে ওর দিকে চেয়ে থাকে।কখন কি বলতে হয় এই মেয়ে জানে না।
সাবিহা প্রতিজ্ঞার কাছে যেতে যেতে সবাইকে ধমক দিলো।বললো,
“এই কি শুরু করেছিস তোরা?চুপ কর।ওকে কেনো ভয় দেখাচ্ছিস? তবে প্রিতু আমিও চাই তুই এখনই ভাইকে সব বলে দে।এখনই সুবর্ণ সুযোগ।”
সবাই তাতে সম্মতি দেয়।প্রতিজ্ঞা তখন চুপচাপ কিছু ভাবে।তারপর বলে উঠে,
“সামনের মাসে তোর ভাইয়ের জন্মদিন না?”
“হ্যাঁ কেনো?”
“ঐদিনই তাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাবো।”
নিচের দিকে তাকিয়ে বলে প্রতিজ্ঞা। সবাই তাতে খুশি হয়ে যায়।তারপর আবার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
পালাক্রমে সকল শিক্ষার্থীদের নাচ-গান,আবৃত্তি,অভিনয় শেষে প্রতিজ্ঞার একক গানের পালা।উৎসুক দর্শক চেয়ে আছে মঞ্চের দিকে।অপেক্ষা আরেকটা মিষ্টি মুহুর্তের।প্রতিজ্ঞা দৃষ্টি সংকল্পে নিবদ্ধ করে টুংটাং করে সুর তুললো,
মনে রেখো আমার এ গান
শুধু মনে রেখো আমার এ গান(!!)
কত যে কথা মনে লুকোনো
হয়নি তোমাকে আজও শোনানো (!!)
বলে যায় আমার এ গান
আজ বলে যায় আমার এ গান
মনে রেখো আমার এ গান
শুধু মনে রেখো আমার এ গান(!!)
তুমি কি জানো কেউ আড়ালে বসে
তোমাকে জীবন দিয়ে ভালো সে বাসে(!!)
তার মনের যত কথা
আর গোপন প্রেমের ব্যথা(!!)
বলে যায় আমার এ গান
আজ বলে যায় আমার এ গান
মনে রেখো আমার এ গান
শুধু মনে রেখো আমার এ গান(!!)
যদি গো তোমায় বলি আমি তার নাম
তুমি কি বাসবে ভালো, দেবে তার দাম(!!)
কত আশায় কাঁদে প্রাণ
কত নীরব অভিমান(!!)
বলে যায় আমার এ গান
আজ বলে যায় আমার এ গান
মনে রেখো আমার এ গান….
পুরোটা সময় সে একদৃষ্টিতে সংকল্পের দিকে তাকিয়ে ছিলো।সংকল্পের কেনো জানি মনে হয়েছে গানটা প্রতিজ্ঞা তাকে উৎসর্গ করেই গেয়েছে।সে বিব্রতবোধ করলো।সে নিজের মনের ভাবনাকে গুরুত্ব দিলো না।নির্লিপ্ততা তার স্বভাব।
প্রতিজ্ঞা মঞ্চ থেকে নামতেই সংকল্প তাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“তোমার তো এই গান গাওয়ার কথা ছিলো না!স্ক্রিপ্টে তো অন্য গান ছিলো!”
প্রতিজ্ঞার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। গাল ফুলিয়ে বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে অধর প্রসারিত করে বললো,
“কত কিছুই তো স্ক্রিপ্টে থাকে না,তবুও তো সেগুলো ঘটে!পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হয় না স্যার।”
বলে চলে যায় প্রতিজ্ঞা।সংকল্প নিলীন দৃষ্টিতে প্রতিজ্ঞার যাওয়া দেখলো।কি বুঝিয়ে গেলো মেয়েটা?এখানেও সে নির্লিপ্ত,তার মন-মস্তিষ্ক দুটোই নির্লিপ্ত।
#চলবে….
[আমি পুরোটা গান লেখতাম না।তবে সম্পূর্ণ গান না লিখলে আপনারা অনুভূতি বুঝতেন না,ধন্যবাদ।গল্পটা একপাক্ষিক ভালোবাসার,সিনেমাটিক হবে।তবে আপনারা তো জানেনই আমি শেষটা সুন্দর রাখি]