অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ #অবন্তিকা_তৃপ্তি #পর্ব_২৫

0
540

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৫

রান্নাঘরে বিয়ে বাড়ির খাবার রাঁধা হচ্ছে। বাড়ির বউরা বাবুর্চিদের খাবার রান্নার উপকরণ একে একে এগিয়ে দিচ্ছেন। কজন বাড়তি লোকও এসে বসেছে চেয়ার নিয়ে। মহিলারা গল্প করতে করতে রান্না করছেন। তুলি তখন সবে রান্নাঘরে ঢুকবে বলে রুম থেকে বেরিয়েছে। শুভ্র গোসলে গেছে।বাথরুমে যাওয়ার আগে বলে গেছে, সে ফিরে এসে যেন তুলিকে সামনে পায়। তুলি শুভ্রর কথা শুনেনি। ওই নির্লজ্জ পুরুষের কথা শোনা মানে, তুলির আজ সারাদিন ঘর থেকে না বেরুনো। বিয়ে বাড়িতে এসেছে, টুকটাক সাহায্য না করলে কেমন খারাপ দেখায় না?
তুলি রান্নাঘরে ঢুকবে, তখন কানে এলো এক মহিলা বলছেন;

‘তানির মার মনটা ভাঙল শেষ অব্দি। আফরোজা তো ছেলে বউ সমেত বিয়ে খেতে এলো।’

ফাহিমা মসলা বাটছেন। উত্তর দিলেন তিনি;

‘কপালে নাই তো কী আর করার। আমি ভালো মানুষ, ভাবলাম আফরোজা আপার দুঃখ এবার শেষ করে দেই। বিয়েটা হলে লাভ ছিল না বলো? শুভ্র এ বাড়ির জামাই হলে আব্বার রাগ পড়তো না?যে কারণে আব্বাকে দিয়ে দাওয়াত পাঠালাম আমি আর তোমার ভাই। কী হলো শেষ অব্দি? নিজের কপাল নিজেই পোড়াল আফরোজার আপা। এই বিয়ে শেষ হলে এ কেউ মুখ দিয়ে কখনো কেউ বলবে এ বাড়ি আসার জন্যে। আমি তাও এবার বলে আনালাম। আর কী আনব? কে করবে আব্বার সাথে যুদ্ধ? আরেকবার বললে আমাকে শুদ্ধ বাপের বাড়ি পাঠাবে। চৌধুরী বাড়ির পুরুষদের যা রাগ, আমার চৌদ্দ পুরুষের ওমন রাগ নেই।’

তুলি তাদের কথোপকথন শুনে আর ভেতরেই গেলো না। রাগে চলে এলো রুমে। শুভ্র তখন মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে। সে শার্ট পড়ছিল। তুলি গিয়ে দরজায় খিল তুলে দিল। শুভ্র দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজে পেছনে ফিরল। তুলির দিকে চেয়ে দুষ্টু হেসে বললো;

‘কী ব্যাপার? দিন দুপুরে দরজা বন্ধ করছ কেন?’

তুলি এসব কথা পাত্তা দিল না। সোজা শুভ্রর সামনে দাঁড়াল। বললো;

‘আমরা কবে ঢাকা যাচ্ছি?’

‘আজ, কেন?’

‘আম্মুকে কিছু বলবেন না, আপনার বড় মামি আপনাদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়েছেন শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে তানির বিয়ের কথা বলার জন্যে। এখন আমি আপনার স্ত্রী আছি দেখে তারা নেক্সট টাইম আপনাদের এ বাড়ি আনাবে না।’

শুভ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো;

‘তুমি এসব কোথা থেকে শুনলে?’

‘আমি রান্নাঘরে যাওয়ার সময় শুনেছি।’

তুলি মিথ্যা বলছে না, শুভ্র জানে। শুভ্র বিশ্বাসও করে, তার নানাবাড়ির মানুষ চূড়ান্ত স্বার্থপর। কিম্তু আফরোজা এমন জেদ ধরলেন, শুভ্র মানা করতে পারেনি। রাগে শুভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সে বললো;

‘আমরা আজ চলে যাচ্ছি। ওরা বলবে কেনো, আমি আম্মুকে বারবার অপমানিত হতে এখানে আসতে দিবো না।’

কথাটা বলে শার্ট পরে শুভ্র বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শুভ্র ভেবেছিল আফরোজাকে কিছু বলবে। কিন্তু ভাই-ভাবিদের সঙ্গে আফরোজাকে হাসতে দেখে শুভ্র থেমে গেলো। মন চাইল না মায়ের এই সুন্দর মুহূর্তটা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে।

তারপর- তারপর সেদিন বিয়ে থেকে আসার পর শুভ্ররা আর কখনো চৌধূরী বাড়ি যায়নি। আফরোজা অপেক্ষা করেন, কেউ আসবে তাকে নিতে। বলবে একবার যাওয়ার জন্যে। কিন্তু না, কেউই আসে নি। শুভ্র বুঝে,
কিছু কিছু অভিমানের জোরটা বড্ড বেশি থাকে। অভিমান কাটলেও, সেখানে জন্ম নেয় ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ কেড়ে নেয় নিজের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কগুলো। ক্ষোভের দাবানলে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয় সম্পর্কগুলো। সম্পর্কের আহুতি দিয়েই যেন ক্ষোভের শান্তি।
___________________
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেছে। শুভ্রর স্বামী হওয়ার তিন বছর ছয় মাস কেটেছে। তুলি এবার এমবিবিএস শেষ রে এখন একটা ক্লিনিকে জব নিয়েছে। সামনে ডিগ্রিও করার ইচ্ছা আছে। শুভ্র এরমধ্যে এমডি করেছে ক্লিনিকাল সাইডে, পেডিয়াট্রিক বিষয়ে। তুলির বাবা বহু বছর পর দেশে আসলেন। তার মাথায় আপাতত অন্য ভাবনা চলছে। সেই ভাবনা থেকে তিনি দাওয়াত করলেন শুভ্র আর আফরোজাকে নিজেদের বাসায়। শুভ্র হসপিটাল থেকে ফিরে আফরোজাকে নিয়ে গেলো তুলিদের বাসায়। তুলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল শুভ্রর জন্যে। যেই না শুভ্রর গাড়ি তুলি দেখল, সঙ্গেসঙ্গে তুলি হেসে লুকিয়ে গেলো। তুলির জন্যে ইয়াসমিন গোলাপি রঙের শাড়ি বের করে রেখে এসেছিলেন বিছানার উপর। তুলি শাড়িটা একটু নেড়েচেরে ব্লাউজ-পেটিগোট নিয়ে বাথরুমে গেলো।

শুভ্র বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। তার মুখোমুখি ইয়াজিদ সাহেব। তিনি শুভ্রকে সরাসরি এই প্রথম দেখলেন। শুভ্র চুপচাপ বসে আছে। মূলত ইয়াজিদ সাহেবের সঙ্গে সে কী কথা বলবে খুঁজেই পাচ্ছে না। ইয়াজিদ সাহেব এবার নিজেই মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা তুললেন;

‘শুভ্র ভালো আছো তো? হাসপাতালের কাজ কেমন যাচ্ছে?’

‘ভালো যাচ্ছে আঙ্কে- সরি বাবা।’

শুভ্র লজ্জা পেয়ে গেছে। আঙ্কেল আর বাবা বলার অভ্যাসের মধ্যে সে সবসময়ই কনফিউজড হয়ে যায়। এটা নিয়ে তুলির কাছে সে কম বকা খায়নি। তবুও পারেনা। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ইয়াজিদ সাহেব বললেন;

‘শুনলাম নতুন হাসপাতাল তৈরি করছো?’

‘জ্বি বাবা। অন্যের চাকরি আর কত? নিজের কিছু একটা হওয়া উচিত।’

‘টাকা পয়সার ব্যাপার তো অনেক। সামলাতে পারছো তো?’

‘হয়ে যাচ্ছে। আমরা তিন বন্ধু মিলে করছি, বাকি টাকা শর্ট পড়ায় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়া হয়েছে।’

‘টাকা লাগলে আমাকেও বলো। চেষ্টা করবো সাহায্য করার।’

‘লাগলে বলব বাবা।’

ইয়াজিদ থামলেন। আর কী কথা বলবেন খুঁজে পেলেন না। তবে শুভ্র ছেলেটাকে সামনাসামনি দেখে তিনি দারুণ সন্তুষ্ট। যেমন দেখতে ভালো, তেমনি আচার ব্যবহার। মেয়ের জন্যে একদম সোনা পেয়েছেন ইয়াজিদ। তবে ইয়াজিদ যদি জানতেন, শুভ্র বেডরুমে তারই মেয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত অসভ্যতা করে, তাহলে হয়তো আজকে তিনি শুভ্রর সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করতেন না। শুভ্র মনেমনে হাসলো খানিক। বাইরের মানুষের সঙ্গে শুভ্র হচ্ছে ভদ্র পুরুষ, অথচ বউয়ের সঙ্গে? চূড়ান্ত অভদ্র। একমাত্র তুলি এর ভক্তভোগী, তুলি জানে শুভ্র কেমন ফাজিল এবং অসভ্য।

ইয়াজিদ এবার স্ত্রীকে ডাকলেন। ইয়াসমিন রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে বানাতে আফরোজার সঙ্গে গল্প করছিলেন। স্বামীর ডাক শুনে তিনি এলেন। ইয়াজিদ বললেন;

‘মেয়েকে নিয়ে আসো।’

‘আনছি।’

কথাটা বলে ইয়াসমিন তুলির ঘরের দিকে ছুটলেন। তুলি তখন সবে শাড়ি পড়ছে। শাড়ি সামলাতেই পারছে না তুলি। শাড়ি নিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করা লাগছে। ইয়াসমিন তুলির এমন বেহাল অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। তুলি মায়ের দিকে চেয়ে ঠোঁট উল্টে বলল;

‘আম্মু পড়ায় দাওনা এটা।’

ইয়াসমিন এসে শাড়ির আগা ধরলেন। শাড়ি সুন্দর করে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন;

‘তুই এতো বছরেও শাড়ি পরা শিখলি না। আজ বাদে কাল উঠিয়ে নিবে। তখন কিভাবে পড়বি?’

তুলি উত্তর দেয়না। মাকে তো আর বলতে পারে না, ও বাড়িতে তাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্যে দুজন আছে। শুভ্রর আম্মু আর স্বয়ং শুভ্র। তুলি শাড়ি পরতে পারে না দেখে, শুভ্র একদিন তুলির সামনে বসে ইউটিউব থেকে দেখে শাড়ি পরা শিখেছে। তারপর দেখে দেখে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে তুলিকে। সঙ্গে অসম্ভব দুষ্টুমি তো আছেই। হাতটা বড্ড চলে শুভ্রর, খালি ওখানে ছোঁয় এখানে ছোঁয়। তুলি হাসলো। ইয়াসমিন তুলিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে অলংকার হালকা কিছু পড়ালেন। শুভ্র যে বালা দিয়েছিল তুলিকে, তুলি সেটা হাতে দিলো। শুভ্র একটা লকেট দিয়েছিলো ইদানীং। লকেটে তুলি আর শুভ্রর প্রথম অক্ষর,
‘ST’ দেওয়া, লকেটের ভেতরে দুজনের ছবিও আছে। তুলি সেটাই পড়লো আজ। শুভ্রকে আজ সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। তাই তুলি একদম শুভ্রর মনমতো সেজেছে।
___
তুলিকে নিয়ে আসা হলো শুভ্রর সামনে।তুলি ধীর পায়ে এগুচ্ছে। তুলিকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছিল, শুভ্র হা হয়ে তুলিকে একবার দেখলো। পরপরই সবাই পাশে আছে দেখে শুভ্র চোখ সরিয়ে নিলো। গলা খাকারি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। ইয়াসমিন তুলিকে শুভ্রর পাশে বসালেন। শুভ্র গা ঘেষে বসেছিলো তুলি। শুভ্র বড়রা পাশে আছে দেখে একটু সরে বসলো। তুলি এটা দেখে মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। আসছে তুলির লাজুক বর, হ্যাহ!

ইয়াজিদ বললেন;

’আফরোজা, শুভ্র তুলির সম্পর্কটা এবার এগুনো উচিত। কথা দিয়েছিলাম, মেয়েকে দু বছর পরে তুলে দিবো। দেরি হয়েছে কিন্তু কথা রাখবো আমি। আরও আগেই দিতে পারতাম। কিম্তু আমি দেশে নেই, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে সেটা বাবা হয়ে মন মানছিল না আমার, রাগ করো না এটার জন্য। এখন আমি দেশে এসেছি, আমি চাই তুলিকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে-গুজিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি পাঠাব। কী বল তুমি?’

শুভ্র অবাক হয়ে ইয়াজিদের দিকে তাকাল। তুলি হাসছে মনেমনে। আফরোজা খুশি হয়ে বললেন;

‘অবশ্যই। তুলিকে আমি নিজের মেয়ের থেকে কম দেখিনি ভাইজান। ও আমার ঘরে আসা মানে আমার একটা মেয়ের অভাব পূরণ করা। আমরা রাজি।’

শুভ্র এবার হালকা হাসলো। ইয়াজিদ বললেন;

‘কথাবার্তা তাহলে সাড়া যাক। জোবায়ের? তোমার বোন আর দুলাভাইকে নিয়ে ছাদ ঘুরে আসো। যাও।’

জোবায়ের হেলেদুলে এসে শুভ্রর হাত ধরলো। বললো;

‘চলো দুলাভাই। আপু আসো আসো।’

শুভ্র জোবায়েরকে কোলে তুলে নিলো। জোবায়ের এতেই হম্বিতম্বি করে উঠে বলল;

‘কোলে না কোলে না। আমি বড় হয়ে গেছি দুলাভাই। নামাও আমাকে।’

শুভ্র হেসে ফেলল। বললো;

‘ওরে বাবা। বড় হয়ে গেছে জবু?’

শুভ্র জোবায়েরের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলছে, তুলি সামনে। ছাদের দিকে এগুচ্ছে। শুভ্রও তুলির পেছন পেছন ছাদের দিকে গেল। ছাদের দরজা পেরুতেই জোবায়ের কোল থেকে জোর করে নেমে গেলো। শুভ্রর দিকে চেয়ে বলল;

‘তোমরা গল্প করো। আ’ম গিভিং ইউ গাইজ প্রাইভসি। এনজয়।’

কথাটা বলে দৌঁড়ে চলে গেলো জোবায়ের। শুভ্র হাঁটুর বয়সী বাচ্চার মুখে এ ধরনের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তুলিকে জিজ্ঞেস করল;

‘ও প্রাইভসি দেওয়া শিখলো কিভাবে?’

তুলি কপাল কুঁচকে বললো;

‘আরে ওর ফ্রেন্ড। একেকটা ভয়াবহ পাকনা। ওদের থেকেই মনে হয়।’

শুভ্র হালকা হাসলো। বললো;

‘সেদিনের জোবায়ের আজকে আমাদের প্রাইভসি দিচ্ছে। ভাবা যায়? আগে তো আমাদের সঙ্গে পিছু পিছু ঘুরত।’

তুলি হাসল। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো;

‘দেখতে দেখতে তিন বছরে কেটে গেছে, না?’

তুলি শুভ্রকে দেখে। শুভ্র এগিয়ে এসে তুলির কোমর চেপে ধরে। তুলি শুভ্রর বুকের সঙ্গে মিশে যায়। শুভ্র তুলির কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে বলে;

‘এবার অফিসিয়ালি, এন্ড ইকুরেটলি আমার বউ আমি ঘরে তুলব।’

‘তারপর-‘

‘তারপর আবারো যাবো সাজেক হানিমুন। তারপর দুই থেকে তিন হয়ে ফিরবো আমরা।’

তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। শুভ্র বলল;

‘আমি আর অপেক্ষা করবো না কিন্তু তুলি। বিয়ের এক বছরের মধ্যে আমার একটা পরী চাই।’

‘পরী চাই? ছেলে না?’

তুলি জিজ্ঞেস করল। শুভ্র তুলির কপালে চুমু খেয়ে বললো;

‘আল্লাহ যা দেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ।’

#চলবে
গল্পটা শেষের দিকে। আমার পরবর্তী ধারাবাহিক গল্পের নাম;
#বিবাহ_বিড়ম্বনা। এগেইন বিয়ে নিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here