#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৬
শুভ্র এবং তুলির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে আগামী ২৫ মে বাদ আসর। হাতে আছে মাত্র দশ দিনের মতো। এখন থেকেই দুই পক্ষের মানুষদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। শুভ্র ইদানীং হাসপাতাল তৈরির কাজে ভীষণ ব্যস্ত সময় পাড় করছে। হাসপাতালের কাজে টাকা পয়সা লাগছে প্রচুর, সে জন্যে চেম্বারও করা লাগছে নিয়মিত। তাই সে বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা আফরোজার উপর চাপিয়ে নিজে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তুলি অবশ্য এতে সক্রিয়। বিয়ের কেনাকাটা সবেতেই আফরোজা তুলিকে সাথে নিয়ে ঘুরেন। হাতে আছে আর পাঁচদিন। আজকেও আফরোজা বেরিয়েছেন শপিং এ। সঙ্গে তুলি, আর জোবায়ের। আজ বিয়ের বেনারসি কেনা হবে। আজকালকার যুগে লেহেঙ্গা খুব চলে, কিম্তু শুভ্রর এক কথা। বিয়ে বলুক আর বৌভাত নাহয় হলুদ,প্রতিটা অনুষ্ঠানে শাড়িই পরতে হবে। তাই তুলি শুভ্রর পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কিনতে এসেছে।
দোকানদার শাড়ি দেখাচ্ছে। একটা ছোট কিশোর ছেলে শাড়িগুলো পরে পরে দেখাচ্ছে। আফরোজা এখন থেকে একটা লাল শাড়ি দেখিয়ে বললেন;
‘অ্যাই তুলি, এটা দেখ। সুন্দর না?’
তুলি শাড়িটা নেড়ে দেখল। বেশ সুন্দর শাড়ি। তুলি আয়নার সামনে গিয়ে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে শুভ্রকে ছবি পাঠাল। শুভ্র এখন কনস্ট্রাকশন এরিয়ায়। সবাইকে বলছিলো, কোন দিকে কোন জিনিসটা বসাবে। তুলির মেসেজ পেয়ে শুভ্র চেক করল। লাল শাড়ি পরে মুচকি হেসে ছবি পাঠিয়েছে তুলি। নিচে লেখা;
‘বউকে কোন রঙে দেখতে চায়, শিশু ডক্টর।’
শুভ্র হাসল। লিখে পাঠাল, ‘ লালে আমার বউকে বধূ লাগবে। তবে হালকা গোলাপীতে শুভ্রর বেস্ট বধূ লাগবে।’
তুলি মেসেজটা পেয়ে হাসল। আফরোজাদের কাছে গিয়ে বললো;
‘হালকা গোলাপি রংয়ের শাড়ি দেখি, আম্মু?’
আফরোজা দোকানদারকে তুলির কথামতো শাড়ি দেখাতে বললেন। তুলি একটার পর একটা শাড়ি দেখে তারপর একটা শাড়ি পছন্দ করল। সেটা গায়ে জড়িয়ে হালকা হেসে ছবি তুলে শুভ্রর ফোনে পাঠাল। শুভ্র তুলির মেসেজরই যেন অপেক্ষায় ছিল। শুভ্র ছবি দেখে মুগ্ধ হলো ভীষণ। মনেমনে কল্পনা করল, বিয়েতে এই শাড়ি সাজে তুলিকে কেমন দেখাবে। শুভ্র রিপ্লে করল; ‘বেস্ট ওয়ান। শুভ্র’জ পারফেক্ট ওয়াইফ।’
তুলি হাসল। তারপর শাড়িটা নিয়ে আফরোজাদের পাশে এসে বললো;
‘আম্মু, এই শাড়িটাই নেই?’
আফরোজা হেসে উঠলেন। বললেন;
‘তোকে সবচেয়ে ভালো এতটাই মানিয়েছে।’
তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলো। আফরোজা তারপর শাড়িটার টাকা মেটালেন। তারপর একে একে অলংকারসহ মেকআপ, প্রসাধনী সামগ্রীও কেনা হলো।
সারাদিন শপিং করে তুলি ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছে মাত্রই। মনে মনে ভাবছে, আগের আকদই ঠিক ছিলো। কোন ঝামেলা নেই, শুধু কবুল বলা আর বিয়ে হয়ে যাওয়া। এসব অনুষ্ঠান বিরক্ত লাগছে তুলির। পাঁচদিন যাবত ক্লিনিক করে বাসায় এসে আবার এসব ঝামেলা। গা ধরে যাচ্ছে ব্যথায় এবার। আগামীকাল থেকে তুলি ক্লিনিকে ছুটি নিয়েছে। জয়েন করবে বিয়ের তিনদিন পর। তারপর আবার সেই একঘেয়ে জীবন। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব ভাবনার মধ্যে শুভ্রর কলটা তখনই এলো। তুলির মনে হলো সমস্ত ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই শুভ্রর একটা কলেই হাওয়া হয়ে গেছে। তুলি কল ধরলো। লম্বা করে সালাম দিল মজা নিয়ে। শুভ্র হাসলো। ছোট্ট করে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলো;
‘কী ব্যাপার, আজ এত পতি ভক্তি? মাথায় কী চলছে তোমার?’
তুলি হেসে বললো; ‘সওয়াব কামাচ্ছি, শিশু ডক্টর।’
শুভ্র পেডিয়াট্রিকে এমডি করার পর থেকে তুলি শুভ্রকে ‘শিশু ডক্টর’ ডাকে। আগে ‘স্যার’ ডাকত বলে শুভ্র বেশ রাগ করতো। শুভ্রর মতে; হাসবেন্ডকে আদর করে কত নামে ডাকা যায়। এই ‘স্যার’ আবার কী ডাক? অবশেষে তুলির ডাক বদলেছে। তবে এতোবছর চেষ্টা করেও তুলির মুখ থেকে ‘আপনি’ ডাক কোনক্রমেই শুভ্র ‘তুমি’ তে কনভার্ট করতে পারেনি। অসম্ভব এক ব্যপার যেন এটা।
শুভ্র তুলির কথায় হেসে বললো; ‘আর কটাদিন, তারপর আরও এক্সট্রা ভাবে সাওয়াব কামাবো তোমাকে দিয়ে।’
তুলি অবাক হওয়ার ভান করে বললো: ‘কিভাবে?’
শুভ্র দুষ্টু হাসলো। বললো: ‘ওআওয়ার ফার্স্ট নাইট ইজ কামিং,তুলি।’
শুভ্রর এমন কথায় তুলি লজ্জা পেল বোধহয়। এতটা রাত দুজন একসঙ্গে কাটিয়েছে, অথচ তুলি এখনো সেই প্রথম রাতের ন্যায় লজ্জা পায়। রীতিমত ‘বাসর, নাইট’ এসব শুনতেই পারে না। শুভ্র এসব ভেবে হাসলো।
তুলি মেকি রাগ দেখিয়ে বললো; ‘আপনার জীবনে কয়বার আসে এই ফার্স্ট নাইট?’
শুভ্র উত্তর দিল- ‘একবারই আসবে, পাঁচদিন পর।’
তুলি বললো- ‘তাহলে এতবছর কী ছিল?’
শুভ্র হাসল। জড়ানো গলায় বললো;
‘ওসব রাতের অনুভুতি অন্যরকম ছিলো, তুলি। কিন্তু সামনে যে রাতটা আসবে, সেটা আলাদা একদম। তুমি প্রপারলি আমার জন্যে বৌ সাজবে, আমরা শ লোকের সামনে কবুল বলবো। আমাদের বাসর সাজানো হবে, ফুলের বিছানায় তুমি ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে। আমি আসবো, ঘোমটা সরিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলবো-‘মা শা আল্লাহ। তুমি লজ্জা পাবে। তারপর-‘
‘তারপর আমরা কথা বলবো সারা রাত।’
শুভ্রর মুখ থেকে তুলি কথা কেড়ে নেয়। শুভ্র হাসে; কৌতুক করে বলে; ‘হ্যাঁ, চাঁদের আলোয় বসে আমরা দুজন এই রাতটায় শুধু কথাই বলব। আর কিছু না।’
তুলি শুভ্রর কথার ধরনে হেসে উঠে। এখনো এত দুষ্টু কথা বলে এই শুভ্র। তুলির হাসি শুনে শুভ্রও হাসে, তারপর দুষ্টুমি বাদ দিয়ে সুন্দর করে জিজ্ঞেস করে;
‘তারপর আজকে সারাদিন কী কী করলে বলো?’
_______________
আজ তুলির হলুদ সন্ধ্যা, ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। তুলিকে আজ সবুজ পাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি পরিয়ে সোফায় বসানো হয়েছে। তুলির সকল কাজিনরা আজ সবুজ রঙের শাড়ি পরে আছে। রুমে হালকা আওয়াজে গান বাজছে।
‘মেহেন্দি হ্যা রাচনেওয়ালি,
হাতো ম্যা গেহরী লালি’
সবাই গানের সঙ্গে গুনগুন করছে। একসময় অপেক্ষা শেষ হলো, হলুদ নিয়ে ঘরে এলেন ইয়াসমিন। তুলির পাশে বসে প্রথমেই চুমু বসালেন মেয়ের কপালে। তারপর তুলির দু গালে হলুদ লাগিয়ে হালকা হেসে বললেন;
‘হলুদের মতোই ফুটে থাকুক তোর সারা গা। স্বামী সোহাগী হ, মা।’
ইয়াসমিন তার চোখ থেকে কাজল নিয়ে তুলির কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন। তুলির মনে পড়ল, সাজেকে একবার শুভ্র কয়লার কালি দিয়ে তুলির কানের পেছনে নজর ফোঁটা দিয়ে দিয়েছিল। তখন বিয়ের শুরু-শুরু সময় ছিলো। তারপর ধীরে ধীরে একে অন্যের প্রেমে পড়া, লাজুক শুভ্রর খোলস ভেঙে অসভ্য শুভ্র হওয়া, তুলিও শুভ্রর সামনে খোলা বইয়ের মতো হওয়া। সবকিছুই এখনো তরতাজা স্মৃতি। আজ তুলি সেই শুভ্র স্বামীকেই আবার স্বামী হিসেবে কবুল করতে যাচ্ছে। এবার শুভ্রর বাসায় তুলির একটা সংসার হবে। শুভ্রর কথামতো সেই সংসারের রানি হবে তুলি। আর শুভ্র, শুভ্র রাজা। নিজেদের এসব কথা ভেবে তুলির বুকটা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত তৃষ্ণায়।
একে একে সবাই তুলির শরীরে হলুদ মাখিয়ে দিলো। তুলির সারা শরীরে এক ফোঁটাও জায়গা নেই। সবখানেই কাঁচা হলুদ। তুলিকে দেখে মনে হচ্ছে হলুদের মিশ্রণে ডুব দিয়ে এসেছে ও। তুলি নিজেকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো;
‘বিয়ে মানেই একগাদা হলুদ ডুবে যাওয়া, উফ।’
তুলিকে এই অবস্থায় দেখে সব কাজিনরা হাসছে। পুরো হলুদ মুখের মধ্যে একমাত্র তুলির চোখটাই সাদা। একজন তো মজা করে শুভ্রকে ভিডিও কল দিয়ে বসলো। শুভ্র ফোনের ওপাশ থেকে তুলিকে দেখে হাসতে হাসতে শেষ। শুভ্র হাসতে হাসতে বললো;
‘হলুদ বোধহয় একটু কম পড়েছে শালিকা। আরো লাগানো উচিত ছিল।’
শুভ্রর কণ্ঠ শুনে তুলি সামনে চোখ তুলে তাকাল। শুভ্র ভিডিও কলে। তুলি লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢাকল। শুভ্র দেখে ফেলেছে, আর দেখানো যাবে না। ওপাশ থেকে শুভ্র এটা দেখে টিপ্পনি কেটে বললো:
‘খুব লুকিয়ে পড়েছ, তুলি। আমরা তো কেউই তোমাকে দেখতে পারছি না। শালিকারা, আপনারা কেউ দেখছেন আপনাদের বোনকে?’
সবাই একসঙ্গে জোরে বলে উঠল;
‘না, দুলাভাই।’
সবাই এভাবে মজা নিচ্ছে দেখে তুলি মুখ লুকানো অবস্থায় হেসে ফেলল। তুলির দেখাদেখি সবাই হেসে উঠল। হলুদ সন্ধ্যা এভাবেই স্বপ্নের মতো কাটলো এই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ দম্পত্তির।
#চলবে