#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৭
“শোন আপু, তুমি আজ বাড়িতে না আসলে তুমি তোমার ইচ্ছেমতো যেদিন বাড়িতে আসনে সেদিন কিন্তু আমিও দেখা করব না, কথাও বলব না। আমার নামও ইনাম ইয়াদ মনে রেখো, মাথায়ও রেখো। আমি এক কথার মেয়ে।”
ইনাম সকাল সকাল তোয়াকে ফোন করেছে। কোন এক জরুরি কাজে তার বাড়িতে যেতে বলছে। এদিকে তোয়ার টিউশনি আছে। বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতে হয়। কাজের বেশি প্রেশার নিলেই রূম্পা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবকিছু ভেবে দেখল তোয়ার কিছুতেই যাওয়া হবে না। সে চাপা গলায় বলল,
“দিনে দিনে ব্যস্ততা বাড়ছে। মাকে কাজে সাহায্য করতে হয়। কালকে ভাইয়ার পরিক্ষা। আজকে কীভাবে তোর ওখানে যাই বল?”
ইনাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“ওহ কালকে ভাইয়ার পরিক্ষা? আমার খেয়াল ছিল না। তাহলে কী করব?”
“যেতে বলছিস কেন সেটা বল?”
“কালকে উনার সাথে দেখা করতে যাব। ভাবলাম রাতে আমি আর তুমি একসাথে গল্প করে কালকে তোমাকে সাথে নিয়ে দেখা করতে যাব। তুমি না বড় আপু।”
তোয়া এবার বিষয়টা বুঝল। সে বলল,“অ্যাই গাধী, তুই কোথায় দেখছিস যে বিয়ের আগে হবু বরের সাথে দেখা করতে বড় বোনকে কেউ নিয়ে যায়! কাউকে সাথে নিলে মন খুলে কথা বলবি কীভাবে? আর তোর বাপ এত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে কেন দিচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। মাত্র কলেজের মুখ দেখলি আর এখনই বিয়ে?”
ইনাম কিছু বলল না। তোয়া ইনামকে চুপ থাকতে দেখে বলল,“তুই না আবির ভাইয়াকে পছন্দ করতি?”
ইনাম এবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,“তুমি আবির ভাইয়াকে নিয়ে পড়ে আছ? এর আগে আমি অন্যকাউকেও পছন্দ করতাম ভুলে গেছ? আবির ভাইয়াকে বিরক্ত করতে ভাল্লাগে তাই ওরকম করতাম। মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে বসবে কে? এমনিই মামিরা দেখতে পারে এটাই অনেক। শাশুড়ি হইলে দাঙ্গাল বাধবে। থাক বাবা তার চেয়ে আমার বাপ যাকে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে করে নিই। বাপের মনে কষ্ট দিতে চাই না। বড় কথা হচ্ছে লোকটা ভালো আছে।”
তোয়া উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কোন লোক?”
“আরে যার সাথে আমার বিয়ে হবে।”
“তুই দেখেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“বাসায় এসেছিল?”
“হ্যাঁ। উনার মা-বাবা, ছোট বোন আর উনি এসেছিলেন। সবাই অনেক ভালো, জানো!”
তোয়া মৃদু হেসে বলল,“তোর ভাগ্যটা অনেক ভালো হোক, ইয়াদ। তুই অনেক ভালো থাক ওই মানুষটার সাথে যাকে আল্লাহ আগে থেকে তোর জন্য ঠিক করে রেখেছেন।”
______
আজ নিশোর পরিক্ষা। রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠেছে সে। ঘুমোনো মানেই সময় নষ্ট করা ভেবে রাত সাড়ে তিনটার দিকে এলার্ম সেট করে রেখেছিল। মাসখানেক হলো এই রুটিন মাফিক চলছে সে। এলার্ম বেজে উঠতেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। এলার্ম বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। দশ মিনিট পর একদম ফ্রেশ হয়ে ওযু করে বেরিয়ে এলো। জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। একাধারে তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত শেষ করে রান্নাঘরে চলে গেল। রূম্পা বেগম উঁঠেছেন। চারদিকে ফজরের আজানের ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। ছেলেকে রান্নাঘরে দেখে রূম্পা বেগম এগিয়ে এলেন।
শান্তস্বরে বললেন,“আমি চা করে দেই?”
নিশো মৃদু হেসে বলল,“না মা, আমি করে নিতে পারব। তুমি নেবে এক কাপ?”
“আমি নামাজ পড়ে খাব। তুই খা। বিস্কিট আছে র্যাকে। নিস ওখান থেকে।”
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা শোন।”
“জি।”
“তোর বাবা বলল..” থেমে গেলেন রূম্পা বেগম। কথাটা মন ভালো করার মতো হলেও এর আগে সেভাবে ঘটেনি তাই সঙ্কোচবোধ করছেন তিনি।
নিশো কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল,“থেমে গেলে কেন? বলো।”
রূম্পা বেগম ঘরের দিকে দেখে নিশোর দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,“তোর বাবা তোকে একটু অপেক্ষা করতে বলল। মসজিদে আগেই যাস না।”
চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিশো। অবাক হয়ে বলল,“বাবা আমার সাথে মসজিদে যাবে?”
রূম্পা বেগম ওপর নিচ মাথা নাড়লেন। মুচকি হেসে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ বল। সবকিছু ঠিক হতে শুরু করেছে।”
নিশোও ঠোঁটে হাসি লেপ্টে বলল,”আমাকে ডাক দিতে বোলো। আমি ঘরেই আছি।”
নিশো ঘরে চলে গেল। ফালাকের কথা মনে পড়ছে তার। বাবাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার পর মোটে একবার কথা হয়েছিল তাদের। শুধু বাড়ির পরিবেশ আর বাবার কথা জানিয়েছিল তাকে। ফালাক হেসে বলেছিল- “দেখেছেন! বিপদ সবসময় হতাশা নিয়ে আসে না। আল্লাহ বিপদের পরপর সুখ দেন। এই বিপদটা প্রয়োজন ছিল। এবার আপনি ভালোভাবে নিশ্চিন্তে পরিক্ষা দিন আর আমাকে জিতে নিন। এই সুযোগ বারবার পাবেন না। এই ফালাককে হারালে কাঁদতে হবে আড়ালে, বুঝেছেন!”
সেদিনের পর দুজনের আর কথা হয়নি। নিশো নিজেও চায় না তাদের কথা হোক বা সাক্ষাৎ হোক। এখনই এভাবে ভালোবাসা এত প্রকাশ না করে মাস দেড়েক অপেক্ষা করা যাক। তবে আজ সে পরিক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ফালাকের সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করল।
চায়ে শেষ চুমুক দিতেই বাহির থেকে জাফর সাহেবের গলা শুনতে পেল নিশো। “আসছি, বাবা।” বলেই চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে এলো। বাহিরে এসে দেখল জাফর সাহেব সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশোকে আসতে দেখেই বললেন,
“চল, বাপ। জামায়াত শুরু হবে, সময় বেশি নেই।”
নিশো আর দেরি না করে পকেট থেকে টুপি বের করে বাবার সাথে রওয়ানা দিল।
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। চারদিকে স্নিগ্ধ বাতাস। এ বাতাস যেন হৃদয়কে প্রশান্ত করে দিতে যথেষ্ঠ। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে দলে দলে মানুষ বের হতে শুরু করেছে। নিশো আর জাফর সাহেব একসাথেই বের হলেন। দুজন হাঁটছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিশো খেয়াল করল তার বাবা তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে হয়তো। নিজেই বাবার সঙ্কোচ কাটাতে বলল,
“বাবা, কিছু বলবেন?”
জাফর সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,“বলতে তো চাচ্ছিলাম কিন্তু কীভাবে কী বলব বুঝতে পারছি না।”
“বলেন সমস্যা নেই। আমিই তো।”
জাফর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আমাকে মাফ করে দিস, বাপ। আমি তোর ওপর অন্যা*য় করেছি অনেক।”
নিশো চলা থামিয়ে দিল। বাবার মুখের দিকে তাকালো। জাফর সাহেব ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। মুখ নিচু করে নিলেন। নিশো মৃদু গলায় বলল,
“বাবাদের ক্ষমা চাইতে হবে কেন? এত বড় করেছেন। আমার ওপর হক আছে আপনার। আমি আপনাকে সম্মান করি।”
“কম কথা শোনাইনি তো তোকে। পারলে মাফ করে দিস।” বলে দুই হাত এক করে নিশোর সামনে তুলতে গেলে নিশো খপ করে বাবার হাত ধরে হাত নামিয়ে দিল। পরক্ষণেই বাবার এক হাত নিজের মাথায় নিয়ে বলল,
“আজ আমার পরিক্ষা বাবা। এই হাত দিয়ে মাফ চেয়ে আমাকে পাপী না বানিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিন, বাবা।”
জাফর সাহেব রাস্তার মাঝখানেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। নিশোর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বাবা এমন একটা কাজ করে বসবে সেটা ভাবতেই পারেনি সে। মানুষ পরিবর্তন হতে শুরু করলে বুঝি এভাবেই হয়! নিশোও সময় ব্যয় না করে আলতো করে বাবাকে জড়িয়ে পিঠে হাত রাখলো। আহ শান্তি! কে বলে বাবারা ভালোবাসতে পারে না!
____
“আজ আপনার পরিক্ষা, আপনি এখনো আমাকে কিছু বললেন না। হঠাৎ পর করে দিলেন কেন? কী ভাবছেন বলুন তো? বাড়িতে আসতে হচ্ছে না, আমার সামনে পরতে হচ্ছে না, আমিও প্রেমিকার মতো আচরণ করছি না, দিনে আঠারো ঘণ্টা কল, মেসেজ করছি না বলে কী ভাবছেন আপনি? ক্যাডার হয়ে আবার অন্যদিকে দৌঁড় দেবেন না তো? আমি কিন্তু পা ভেঙে দেব আপনার।”
নিশো পড়ছিল। মোটামুটি সবরকম বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফালাককে কল দেবে বলে ফোনটা হাতে নিয়েছিল। পাওয়ার বাটন অন করতেই দেখল চারটা মিসড্কল আর একটা মেসেজ। ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল সে। ফোন, মেসেজ কিছুই টের পায়নি এতক্ষণ।
মেসেজ পড়েই মুচকি হাসলো সে। ‘পাগলী একটা!’ বলেই কল লাগালো ফালাকের কাছে।
বাবার সাথে বসে ছিল ফালাক। ফোন বেজে উঠতেই বাবার কাছে থেকে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলো। ফোন হাতে নিতেই ফোনস্ক্রিনে নিশোর নম্বর দেখে মৃদু হাসলো তারপর আবার মুখটা গম্ভীর করে কল রিসিভ করল।
“কল করেছেন কেন?”
“নিষেধ আছে নাকি?”
“অবশ্যই আছে।”
“আচ্ছা আজকের জন্য নিষিদ্ধ কাজটা করে ফেললাম।”
“শা*স্তি ভোগ করতে হবে তবে।”
“আজ শা*স্তি?”
“ তা নয়তো কী?”
“কী শা*স্তি শুনি!”
ফালাক এবার এদিক ওদিক দেখে বলল,” একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ বলো।”
“বাবা কোনকিছু না জেনে আবির ভাইয়ার বিয়ের কথা ভাবছে।”
“কোনকিছু না জেনে মানে? কী জানতে হবে?”
ফালাক ফস করে শ্বাস ফেলে বলল,“ও আপনি তো আবার ভাই হন। বোনের হয়ে আবার তেড়ে আসবেন না তো?”
“ক্লিয়ার করো।”
“এখনই যে স্বর! আচ্ছা পরিক্ষা দিয়ে আসুন পরে বলব। এটা বলতেই আর একবার শুধু কল দিব। আর দিব না প্রমিস।”
নিশো মৃদু হেসে বলল,“ প্রমিস করতে হবে কেন? আমি কল দিতে না করেছি?”
“আপনি বুঝবেন না।”
“তুমি খুব বোঝো?”
“হ্যাঁ বুঝি।”
“হুম। দোয়া করবা আমার জন্য। বের হব আধাঘণ্টার মধ্যে। যেতে হবে, গাড়ির ব্যাপার আছে আবার।”
“ভাইয়া বলল, সে যাবে আপনার সাথে।”
“তার এত সুবুদ্ধি আসে কোত্থেকে!”
“আমার ভাই বলে কথা!”
“রাখি?”
“সাবধানে যাবেন। ভালো করে পরিক্ষা দেবেন। আল্লাহ ভালো কিছু দেবেন। ভরসা রাখুন।”
“ভরসা আছে। রাখছি এখন। আল্লাহ হাফেজ। ”
“ শুনুন, কেউ আপনাকে ভালোবাসে। আল্লাহ হাফেজ।” বলেই কল কাটলো ফালাক। ফালাকের শেষ কথায় হাসি ফুঁটলো নিশোর মুখে। এই ভালোবাসাকে হেলায় হারাবে না সে।
#চলবে……
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link