#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_২০
সকাল নয়টার দিকে ট্রেন এসে গন্তব্যে পৌঁছলো। সবাই একে একে ট্রেন থেকে নেমে গাড়ির দিকে গেল। জাভেদ সাহেব ইয়াদের বাবাকে কল দিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়াতে বললেন কারণ এখানে কখনো আসা হয়নি কারো। কেউ এখানকার বাড়ি চিনে না। বড়ির ব্যাগটা নিশো নিজেই তুলে নিয়েছে। এখানে থাকবেই শুধু তিনদিন। ছেলেদের আবার অনেক জামাকাপড়ের প্রয়োজন হয় নাকি – এটা ভেবে নিজে আর আলাদা ব্যাগ আনেনি। ওদিকে নিজেদের ব্যাগ দুইটা জাভেদ সাহেব নিয়েছেন। একটা তার নিজের আর রাবেয়া বেগমের অন্যটা ফালাকের। আবিরের হাতে নিজের ব্যাগটা। প্লাটফর্ম থেকে নেমে আসার সময় আবির খেয়াল করল তোয়ার হাতে তার ব্যাগ রয়ে গেছে। এগিয়ে এসে মৃদু গলায় বলল,
“ব্যাগটা দে। তোর টেনে নিতে হবে না।”
তোয়া অবাকভঙ্গিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকলো। তোয়ার এই কান্ডে আবির বলে উঠল,
“কী হয়েছে?”
“দেখছি সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো! তুই চাইছিস আমার ব্যাগ! অন্যরকম কিছু ঘটে গেল না তো!”
আবির চোখ বন্ধ করে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ব্যাগটা নিতে তোর কষ্ট হচ্ছে ভেবে নিতে চেয়েছিলাম। মনে হচ্ছে তোর কাছে থাকাই বেটার।”
তোয়া এবার মুচকি হেসে বলে উঠল,“নে নে। আমার হাত ব্যথা হয়ে যাবে নইলে।”
আবির ব্যাগটা তোয়ার হাত থেকে নিয়ে নিল। ফালাক আর নিশো পাশাপাশি হেঁটে আসছিল। তাদের পাশের আবির আর তোয়া ছিল। ফালাক স্মিতগলায় নিশোকে ডেকে বলে উঠল,
“দেখুন, দেখুন। ”
নিশো ফালাকের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“কী? তোকে? তোকে দেখার কথা আবার বলতে হয়?”
ফালাক নিশোর দিকে কিছু মুহূর্ত দেখে দৃষ্টি এবং মাথা দুটোই নামিয়ে নিল লজ্জায়। ফালাকের লজ্জারাঙা মুখটা দেখে মৃদু হাসলো। ফালাক বলল,
“আমি আমাকে দেখতে বলিনি৷ ভাইয়া আর তোয়া আপুকে দেখতে বলেছি।”
নিশো ভ্রু কুঁচকে শুধালো, “কেন? কী হয়েছে?”
“ওদের ওপর নজর রাখবেন।”
“নজর রাখতে হবে কেন?”
“রাখলেই বুঝবেন।”
“বলো।”
“আবির ভাইয়া তোয়া আপুকে পছন্দ করে।”
“কী!” আঁতকে উঠল নিশো। আবির তোয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল তারা দুজন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জোরেই চিৎকার দিয়ে ফেলেছে সে। নজর সরিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিল সে। মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে- কথা আসলেই সত্যি? এটাও সম্ভব!
_____
চারদিকে উৎসবের আমেজ। রাতে আকাশটা যেন তারায় তারায় সেজেছে। একপাশে একফালি চাঁদ নজর কাড়ছে। নিশো ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে বসে আকাশ দেখছে। বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে রাস্তা পর্যন্ত ঝিলমিল করতে থাকা বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। এখানে আসার সময় বাড়ির সবকিছু এলোমেলো ছিল। সাজানো হচ্ছিল। এখন সবটা বিন্যস্ত। কোথাও যেন কোনরকম কমতি নেই। বৃহৎ ছাদের পূর্বপাশটা গায়ে হলুদের থিমে সাজানো হয়েছে। তার সামনের দিকটায় লাল, নীল, সবুজ চেয়ার সারি সারি করে সাজানো। লোকজন আসতে শুরু করেছে। নিশো, আবির দুজনই এ বাড়ির ছেলেগুলোর সাথে কাজে হাত লাগিয়েছিল। কাজ যখন প্রায় শেষ তখনই নিশো বাড়ির সামনের দিকের ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে পিছনে দেয়ালে হেলান দিয়ে চাঁদ দেখছিল।
আবির এসে পাশে দাঁড়ালো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতে করতে বলল,“সিগারেট খাওয়া ছাড়লি কবে?”
নিশো আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই আনমনে বলে উঠল,“যেদিন মনে হলো তোর বোনকে আমিও ভালোবাসতে শুরু করেছি সেদিন।”
আবির সিগারেটে আগু*ন জ্বালালো তারপর তৃপ্তিসহকারে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে টান দিল। নিশোর কথায় হাসলো সে। বলল,
”তা কবে থেকে মনে হলো?”
”মাস খানেক ধরে।”
“মানে এতদিন সিগারেট ছাড়া আছিস?”
“হ্যাঁ। তোর বোনকে পেতে তার শ*ত্রুকে ছাড়তেই পারি।”
“আমারও কি তাহলে ছাড়া উচিৎ?”
”প্রেমে পড়েছিস?”
আবির মাথা আকাশের দিকে উঁচু করে ধোঁয়া ছাড়ল তারপর বলল,“প্রেমিকা বা বউয়ের কথায় ছাড়ার আগে নিজে থেকে সেটা ছেড়ে দেওয়া উত্তম নয় কি?”
“হুম।”
নিশো আবিরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, তোয়ার ব্যাপারে কথা বলা কি ঠিক হবে? আবির নিশ্চয়ই ভালো ছেলে কিন্তু বিষয়টা একটু কেমন অদ্ভুত হয়ে যায়- দুই বাড়িতেই দুই ভাইয়ের ছেলে মেয়ে ফেঁসে গেল!
মানুষ ছাদে আসতে শুরু করেছে। সামনে রাখা চেয়ারগুলো এতক্ষণ খালি পড়ে থাকলেও এখন আর সেটা নেই। যে যার সিট দখল করে নিয়েছে। চিলেকোঠার একপাশে হলুদ শাড়ি পরিহিত, সাজসজ্জা করা কয়েকটা আঠারো-বিশ বছর বয়সী তরুণী দাঁড়িয়ে খোশগল্প করছে আর হাসাহাসি করছে। তাদের মধ্যে একজন, উচ্চতা বেশ ভালো, দেখতেও নজর না ফেরাতে পারার মতো সুন্দর মেয়েটা কিছুক্ষণ পরপর আবিরকে দেখছে। আবির সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে আগের মতোই সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। নিশোর মা এসে নিশোকে ডাক দেওয়ায় আবিরকে এখানেই থাকতে বলে মিনিট দুয়েক আগে সে নিচে গিয়েছে।
চিলেকোঠার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা দল ছেড়ে আবিরের দিকে এগিয়ে এলো। মেয়েটাকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে আবির ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
“জি? কিছু বলবেন?”
মেয়েটা আবিরের হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলল,”আপনাকে যখনই দেখেছি তখনই খেয়াল করেছি সিগারেট খাচ্ছেন। এটা খুব পছন্দ?”
আবির হাতের সিগারেটটা ফেলে দিল। মৃদু হেসে বলল,“হুম, খুব পছন্দ৷ মানুষ পছন্দের জিনিস নেশায় পরিণত করে। সেরকম আমারও হয়েছে।”
“কেউ নিষেধ করে না? বলে না সিগারেট খেলে হৃদয় পু*ড়ে যাবে, কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না?”
আবির হয়তো মেয়েটার মতিগতি কিছুটা বুঝলো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো। মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা ফেলে আরেকটা খাচ্ছেন?”
“ওটা শেষ হয়ে গেছিল। আমি দারুণ স্মোক করি। একটা শেষ হতেই আরেকটা। আপনি বয়সে অনেক ছোট, এসব বুঝবেন না।”
“আমাকে ছোট মনে হচ্ছে?”
“নন?”
“যেভাবে ছোট বলছেন, ততটুকুও নই।”
“সিগারেটের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলেন?”
“একা একা দাঁড়িয়ে আছেন দেখলাম তাই এলাম। বিরক্ত করলাম?”
“না, না। নাম কী আপনার?”
“আমার নাম ইভা। আপনি নিশ্চয়ই আবির ভাইয়া?”
“বাহ, আমাকে চিনেন দেখছি।”
“হ্যাঁ ওই একটু চিনি আর কি!”
“আচ্ছা, এখানে থাকুন। এনজয় করুন। আমি আসছি।” বলেই আবির প্রস্থান করল।
ইভা আবিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল। যতক্ষণ আবিরকে দেখা যায় ঠিক ততক্ষণ দেখল। পরিশেষে মিটিমিটি হেসে হে নিজেও স্থান পরিত্যাগ করল।
______
হলুদ শুরু হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কিছু বাঙালি রীতিনীতি আছে, যেগুলো আনন্দের সাথে ত্রুটিহীনভাবে সবাই পালন করে থাকে। ইয়াদকে অনেকক্ষণ আগেই উঁচু বসার জায়গাতে বসানো হয়েছে। একে একে অনেকে গিয়ে নাশতার খাবারের এটা ওটা খাওয়াচ্ছে, ছবি তুলছে এবং হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে।
আবির, তোয়া, ফালাক, নিশো চারজন একপাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বাড়ির বড়রা অন্য জায়গায় কাজে ব্যস্ত অথবা আড্ডা জমিয়েছে। ইয়াদদের বাড়ির একজন তাদের চারজনের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“তোমরা হলুদ মাখাবে না? রাত হয়ে যাচ্ছে তো। যাও যাও দুজন দুজন করে ওঠো।”
চারজন নিজেদের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ফালাক বলে উঠল,“তোয়া আপু, কার সাথে যাবে?”
তোয়া নিশোর দিকে তাকালো। নিশো চুপচাপ বসে আছে। নিশোকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আবিরের দিকে তাকালো। বলল,
“আবির ভাইয়া, চল আমি আর তুই যাই।”
ফালাক মুচকি হেসে নিজেও আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ভাইয়া, যা তাড়াতাড়ি। দেরি করিস না।”
ফালাক নিশোর দিকে ফিরে তাকালো। আবির উঠার আগে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলো তখনকার সেই মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। কী যন্ত্রণা! মেয়েটা সেই কখন থেকে তাকে নোটিশ করে যাচ্ছে৷ আবির তোয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তোয়া ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো দীর্ঘশ্বাসের কারণ৷ আবির মাথা ঝাঁকিয়ে, কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
তোয়াও আর দেরি না করে আবিরের সাথে সাথে চলে গেল। ওরা চলে গেলে ফালাক নিজের চেয়ারটা আরেকটু নিশোর দিকে এগিয়ে এনে কাছাকাছি বসলো।
ভারি গলায় শুধালো, “কিছু হয়েছে? মন খারাপ করে আছেন কেন?”
নিশো মাথা বাঁকিয়ে ফালাকের দিকে ঘুরল। সামনের আবার নজর রেখে বলল,“চিন্তা হচ্ছে।”
“কীসের চিন্তা?”
“এই যে, দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। রেজাল্টের সময় এগিয়ে আসছে। জানি না কী হবে! আমার চেয়ে অসহায় আর দুটি নেই হয়তো।”
“বিয়ে বাড়ি এসে এসব মনে করা কেন? আল্লাহ ভালো কিছুই করবেন। এখন উঠুন, দাঁড়ান। আমরা হলুদ দিতে যাব না?”
নিশো সহসা বলে উঠল,“সবাই শাড়ি পরেছে, তোমরা দুজন পরোনি কেন?”
“এমনি পরিনি৷ উঠুন এখন।”
ফালাকের জোরাজুরিতে উঠে দাঁড়ালো নিশো। নিজের বাম হাতে ফালাকের হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে সেদিকে তাকালো সে। ফালাক নিশোর হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে সাথে সাথে হাতটা সরিয়ে নিল। নিশো নিজের হাতটা সামনে নিয়ে দেখলো পাঁচশো টাকার নোট। অবাক চোখে ফালাকের দিকে চাইলো।
ফালাক মৃদু হেসে বলল,“ইয়াদের বড় ভাই না আপনি? ওকে এটা ধরিয়ে দেবেন আর ওর জন্য দোয়া করবেন।”
#চলবে……
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link