#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪১
হসপিটালে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে এসেছিলো মান্থলি চেকআপে’র জন্য কিন্তু এখানেই তোঁষা’র কিছুটা পেইন উঠে গেলো। ডক্টর জানিয়ে দিলো বেবি আজরাতেই ডেলিভারি করা হবে। আরহামে’র যেন মাথা ঘুরে উঠলো। আট মাস পঁচিশ দিনে যেই ভয় আরহাম পেলো না সেই ভয় ও পাচ্ছে এখন। কাঁধে কারো হাত টের পেতে মাথা তুললো আরহাম। এতক্ষণ মুখ দুই হাতে ঢেকে বসে ছিলো। ডক্টর আদিত্য তুষার’কে জানাতেই তথ্য আর তুষার হাজির এখানে। ওদের আসার পর পর ই শেখ বাড়ীর সকলে একে একে উপস্থিত হলো। তোঁষার মা আরহামে’র সামনে আসতে মাথা নিচু করে রাখলো আরহাম। কেন জানি চাচি’র সাথে চোখ মিলাতে পারে না। দোষ কার এটা বলা যায় না। পরিস্থিতি’র কবলে পরে সবাই দোষী আবার বলা যায় সবাই সময় আর হাল অনুযায়ী আচরণ করেছে। কেউ তাহলে দোষী না।
তোঁষা’র মা ধীরে ধীরে আরহামে’র বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ওনার নীরব কান্নায় আরহামে’র ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেলো। শান্ত ভাবে চাচি’কে জড়িয়ে ধরলো ও কিন্তু কথা বলতে পারলো না। হাজার চেষ্টা করে ও না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আরহাম তোঁষা’র মাথায় সুন্দর করে হাত চালিয়ে আদর করে দিচ্ছে। তোঁষা তখনও অল্প স্বরে কাঁদছে। পাশেই তথ্য নানা কথা বলে বুঝাচ্ছে তোঁষা’কে। ও শুনছে বলে মনে হলো না। বারবার আরহামে’র হাতটা খামচে ধরে রাখছে। ঢোক গিলে গিলে বারবার যেন ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করলো। একটু পরই তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হবে। তুষার এসে তথ্য’কে পাশের সোফায় বসালো। হাতের প্যাকেট খুলে কাটা ফল আর কিছু শুকনো বাদাম ওর হাতে দিয়ে বললো,
— ফিনিস করো।
বলেই উঠে আরহামে’র পাশে বসলো। ও জানে আরহাম’কে বললেও এখন খাবে না তাই নিজেই পর মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে বললো,
— কোন কথা শুনতে চাইছি না আপাতত।
আরহাম মাথা নামিয়ে মুখ খুলে খেয়ে নিলো। কোন এক সময়ে গর্জন করা আরহামে’র এহেন ভেজারুপ আচরণ সত্যি ই বিরল। কে জানতো পরিস্থিতি তাদের এহেন কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবে?
সন্ধ্যার পর তোঁষাকে ওটিতে নেয়া হলে বাঁধলো বিপত্তি। আরহাম ছাড়া ও এখানে থাকবে না। এমন ভাবে নড়াচড়া শুরু করলো যে বাচ্চা’র অবস্থান উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। অগত্যা আরহামকে’ও বিশেষ পোশাক পরিয়ে ভেতরে নেয়া হলো। এক পাশে বসে তোঁষার হাতটা শক্ত করে ধরলো ও। তোঁষা’র যখন এনেস্থিসিয়া’র প্রভাবে নিভু নিভু চোখ তখনও সে মৃদুস্বরে বলে গেলো,
— প্রাণ যেও না আর। আমি ভয় পাই৷ কাছে থাকো। হাত ছেড়ো না। তোমার বাবু আজ ও ব্যাথা দিচ্ছে কিন্তু থামছে না। ও অনেক পঁচা একটা বাবু প্রাণ। আমি ওকে কখনো আদর করব না। পঁচা বাবু
আরহামে’র লাল হওয়া চোখ জোড়া দিয়ে তখন অনবরত পানি পরছে। ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে করা কান্না’র দরুন বারবার ভাঙাচুরা দেহটা কেঁপে উঠছে।
বাইরে সকলে উত্তেজিত হয়ে বসে আছে। তোঁষার মা আর চাচি দুইজন কেঁদে অস্থির। তথ্য তাদের সামাল দিচ্ছে। তুরাগ শেখ ও এক জায়গায় মাথা নিচু করে বসা। তথ্য’র চোখটা ওটির দরজায়। বলিষ্ঠ এক সাবেক আর্মি ম্যান দাঁড়িয়ে সেখানে। নিজেকে যতটাই শক্ত দেখাক না কেন তথ্য জানে তুষার ভেতরে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আছে। বোন’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা দেয়া তুষার নিশ্চিত এই মুহুর্তে শান্ত নেই।
.
দীর্ঘ এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড পর পৃথিবীর বুকে ছোট্ট এক প্রাণ পদার্পণ করলো। নিজের হাজিরি জাহির করতে সে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। বাবা’র চোখে মুখের আতঙ্ক ভাবটা ঘুচিয়ে হাসি ফুটালো সেই প্রাণ। আশ্চর্য হয়ে আরহাম তাকিয়ে রইলো সেই ছোট্ট একটা প্রাণের দিকে। সবার আগে তার হাতেই তুলে দেয়া হলো। ভীতু চোখে তাকিয়ে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট প্রাণ’কে কোলে তুলে নিলো আরহাম। ছোট্ট প্রানটা বুঝি বুঝলো বাবা’র অস্তিত্ব। একদম চুপ করে রইলো সে। আরহাম অপলক তাকিয়ে রইলো সেদিকে। লাল ঠোঁট, গোল গোল চোখ, ঘন পাঁপড়ি’তে ঘেরা এক ফুটফুটে নরম বদনে’র প্রাণ। এ কিনা ছিলো আরহামে’র তুঁষে’র পেটে? ভাবা যায়? আরহাম তো ভাবতে পারে না৷ কিছুতেই না। পাগল পাগল লাগে নিজেকে।
অশ্রু চোখে আরহাম চুমু খেলো তার অস্তিত্ব’কে। ছোট্ট প্রাণটা বুঝি হাসলো। হামি তুলে একটা হাত মুখে পুরে দিলো।
নার্স এসে ওকে নিতে নিলেই আরহাম বাঁধ সাধলো। ও দিবে না। মন ভরে নি দেখে দেখে। এই রুপের সাগরে ডুবে থাকা রত্ন আজ উঠে এসেছে। একে দেখলেই কি মন ভরে নাকি?
নার্স বুঝানোর পর আরহাম ছাড়লো। তাকালো ওর তুঁষে’র দিকে। এখন ঘুম ওর তুঁষ। এগিয়ে এসে সকলের সম্মুখেই আরহাম তোঁষা’র ঠোঁটে চুমু খেয়ে কানে ফিসফিস করে বললো,
— এই ছোট্ট প্রাণ তোর ছোট্ট পেটে কিভাবে ছিলো প্রাণ? একদম তোর মতো নরম। তারাতাড়ি উঠে যা তুঁষ। আমরা ওকে একসাথে দেখব আবার। পালব। ভালোবাসব। তুই, আমি আর ছোট্ট একটা প্রাণ।
তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হলো কেবিনে শিফট করতে। বাইরে থাকা শেখ বাড়ীর সকলে উল্লাসে মেতে উঠলো। তোঁষা’র ছেলে হয়েছে শুনেই সকলে খুশি। তুষার ও খুশি তবে সে খুব করে চাইছিলো আরহামে’র একটা মেয়ে হোক। বাবা’রা মেয়েদের অনেক নিকটের হয়। হয়তো আরহাম তাহলে বুঝতো নিজের করা ভুলগুলো। যদিও ভুল বুঝার বা স্বীকার করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
________________
শেখ বাড়ীতে দুই দিন থেকে আরহাম বউ, বাচ্চা সহ নিজের ফ্লাটে ফেরত এলো। কারণ একমাত্র তোঁষা। কিছুতেই ওখানে থাকবে না। ওর ভালো লাগে না। অগত্যা তথ্য সহ তুষার ও এখানে এলো। আরহাম না করেছে বারকয়েক। তথ্য নিজেও প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় তোঁষা সহ আবার বাচ্চা সালাম দেয়া ও ঝামেলা একা আরহামে’র হাতে।
এরমধ্যে মহাঝামেলা হচ্ছে তোঁষা’র মুড সুইং। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন এই মেয়ের এত মুড সুইং হয় নি যা পোস্ট প্রেগন্যান্সিতে হচ্ছে। আরহাম তাই না পেরে রাজি হয়েছে। তথ্য’কে অবশ্য রান্নাঘরে যাওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এই দিক সালাম দিতে আরহাম ই যথেষ্ট। এর মধ্যে আদনান হুটহাট করে হাজির হয় বাসার খাবার নিয়ে। নিয়ম করে দুপুর রাত শেখ বাড়ী থেকেই খাবার পাঠানো হচ্ছে। এদের না করলেও উপায় নেই।
আগামী মাসেই আদনানে’র বিয়ে। আরহাম তোঁষা’র ছোট্ট প্রাণটার এখন ছয়মাস বয়স।
এতে সকলেই খুশি। খালি শেখ বাড়ীর আঙিনায় এবার ফুলের সমাহার দেখা দিলো দিলো ভাব। তোঁষা’টা ফিরার অপেক্ষায় দিন প্রহর গুনছে সকলে। এক সাথে বাড়ীর দুটো ফুল বাড়ী ছাড়া এই শোক কি আদৌ ভুলা যায়?
নিশুতি রাতে কান্নার শব্দে তোঁষা’র ঘুম ভেঙে গেলো। আরহাম ছোট্ট প্রাণ’কে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে। কিছুতেই থামছে না ও। তোঁষা বিরক্ত হয়ে গলা উঁচিয়ে দিলো এক ধমক। বাচ্চাটা সাথে সাথে থেমে গেলো। আরহাম নিজেও চমকে গেলো। বুকে থাকা প্রাণ’টাকে আরেকটু বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকাতেই দেখলো রাগে ফুঁসছে ও। আরহাম কিছু বলার আগেই বললো,
— ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো।
— কে ওর মা?
তোঁষা ভাবলো। আসলেই কে ওর মা? সবাই বলে তোঁষা ওর মা। কথাটা মনে পরতেই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এই বাবু’র জন্য আরহাম ওকে ততটা ভালোবাসে না। রাতে তো তোঁষা বুকে ঘুমায় অথচ এখন থাকে এই বাবুটা।
আরহাম তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে। সব ঠিক থাকলেও তোঁষা রেগে যায় খাওয়াতে গেলে। কিছুতেই খাওয়াবে না। এখনও ফিডার খেতে চাইছে না ছোট্ট প্রাণ’টা। এতটুকুন বাচ্চাকে এমনিতেও ফিডার দেয়া উচিত না৷ না পেরে আরহাম ফিডার দিয়েছে।
হঠাৎ যেমন তোঁষা’র ঘুম ভেঙেছিলো তেমন ই হঠাৎ ই আবার ঘুমিয়ে গেলো। মানে এতক্ষণ ঘুমেই ছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আরহাম। তাকালো বুকে থাকা প্রাণটার দিকে। সে তার ঠোঁট কাঁপিয়ে টলমল চোখে তাকিয়ে বাবা’র দিকে। বুক কামড়ে উঠে আরহামে’র। ছেলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— আর কাঁদে না বাবা’র প্রাণ। মা উঠলে বকবে না আমার প্রাণ’কে। আমার বাবা খাবে এখন। এখনই মা খাওয়াবে। কাঁদবি না কিন্তু।
বাবুটাও চোরা চোখে বাবা’কে দেখলো। কাঁদলো না ও। হয়তো ও জানে মা জেগে গেলে খেতে দিবে না৷ তাই চুপচাপ বাবা’র কথা মেনে নিলো।
আরহাম অতি সন্তপর্ণে ছেলেকে তোঁষা’র কাছে নিয়ে খাওয়ালো। ঘুমন্ত তোঁষা টের পেলো না। টের পেলে নিশ্চিত রেগে যেতো। ভাবতেই হাসলো আরহাম।
#চলবে……