“তুমি নাকি সংকল্প স্যারকে গতকালকে প্রপোজ করেছো?”
আদুরে স্বরে ভণিতা করে ঠোঁট টিপে মিমকে জিজ্ঞাসা করলো প্রতিজ্ঞা।
সিনিয়রের কাছ থেকে এমন বাক্য শুনে প্রথম বর্ষের মিম লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললো।প্রতিজ্ঞার যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে।সে তার দু’পাশে দাঁড়ানো রামিম আর সোহানার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে মিমের দিকে নজর দেয়।মিম তখনো লজ্জায় মাথানত অবস্থায় দাঁড়ানো।তৎক্ষনাৎ প্রতিজ্ঞার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে,কঠিন স্বরে বলে,
“তুমি জানো সংকল্প স্যার ম্যারিড?”
বাক্য কানে প্রবেশ করতেই মিম বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে।তার চোখ-মুখে আঁধার নেমে আসে।
প্রতিজ্ঞা ধমকে উঠে। বলে,
“কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
“না আপু!” বলতে বলতে আবার মাথা নত করে ফেলে মিম।
তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা রাগান্বিত হয়ে মিমের গাল এক হাত দিয়ে চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“না জেনে কোনো কাজ কেনো করবি?তুই জানিস না কাউকে প্রপোজ করতে হলে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হয়?বল জানিস না?”
মিম চোখ-মুখ খিচিয়ে আছে।প্রতিজ্ঞাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।প্রতিজ্ঞাকে রেগে যেতে দেখে রামিম এবং সোহানা ভয় পেয়ে যায়।আশেপাশের শিক্ষার্থীরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।সোহানা, রামিম প্রতিজ্ঞার কানে কানে বলে,
“সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।এখনই মানুষের ভিড় হয়ে যাবে।ছেড়ে দে ওকে।”
বন্ধুদের কথা শুনে প্রতিজ্ঞা চারিদিকে নজর দিলো।সত্যিই আশেপাশের মানুষ তাদের দেখছে।এখন জটলা বাঁধলেই সমস্যা হবে।তাই সে মিমকে ছেড়ে দেয়।একটা হাসি দিয়ে মিমের গালে,মাথায় হাত বুলায়।মিমের কাঁধে দু’হাতে ময়লা ঝাড়ার মতো করে হাত চালিয়ে বলে,
“নেক্সট টাইম কাউকে প্রপোজ করলে তার সম্পর্কে জেনে নিও,ওকেএএএএই?আর হ্যাঁ,আমি সংকল্প স্যারের ওয়াইফ মিসেস আফনান আহমেদ সংকল্প!”
মিম আবার বিস্ময় নিয়ে তাকায় প্রতিজ্ঞার দিকে। এই বাক্য শ্রবণ হতেই তার চেহারার ব্যাথা কোনদিক দিয়ে পালিয়েছে সেও জানে না।তার চোখেমুখে ভয়ের আভাস।সে ঢোক গিলে থেমে থেমে বলে,
“স্যরি আপু, আমি জানতাম না।”
প্রতিজ্ঞা হাসি দিয়ে মিমকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে মুখ শক্ত করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“এই কথাগুলো যাতে কেউ না জানে।জানলে তোর অবস্থা খারাপ করে দিবো।”
তারপর প্রতিজ্ঞা,সোহানা এবং রামিম চলে যায় ক্যান্টিনে।তাদের বাকি বন্ধুরা ক্যান্টিনেই আছে।
প্রতিজ্ঞারা মিমকে তাদের ডিপার্টমেন্টের ভবনের সামনে আটকিয়ে ছিলো। তিনতলা থেকে সবটা অবলোকন করে সংকল্প।উপর থেকে কথা না শুনলেও সবটাই দেখেছে সে।প্রতিজ্ঞাকে সে ভালো করেই চেনে।তার বোন সাবিহার বেস্টফ্রেন্ড।
আফনান আহমেদ সংকল্প,একটা কথার বেশি দু’টো কথা বলতেও যে ভাবে,হিসাব করে।স্বভাবে গম্ভীর,রগচটা, ঘাড়ত্যাড়া।শাহআলম আহমেদ এবং জাহানারা আহমেদের বড় ছেলে।সংকল্প এবং সাবিহা দুই ভাই-বোন।শাহআলম আহমেদরা দুই ভাই,তিনি বড়।ছোট ভাই সাইদুল আহমেদ,তার স্ত্রী মাধুরি আহমেদ।তাদের জমজ দুই ছেলে,রাহিব-সাহিব।তাদের যৌথ পরিবার, পারিবারিক ওষুধের ব্যবসা,কোম্পানির নাম আহমেদ ফার্মাসিউটিক্যালস্।সংকল্প পারিবারিক ব্যবসায় থাকতে চায় না।দুই বছর আগে বিদেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করে।
প্রতিজ্ঞা রাহমান,এসিপি আনোয়ার রাহমান এবং প্রফেসর তাসলিমা রাহমানের মেয়ে।প্রতিজ্ঞার বড় ভাই তানিম রাহমান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি।সে বিবাহিত, চার বছরের একটা মেয়ে আছে।প্রতিজ্ঞা ছোট হওয়ায় সবার বড্ড আদুরে।
ফিহা,রিমা,সাব্বির,আয়েশা ক্যান্টিনের একটা টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে।তখনই রামিম,সোহানা এবং প্রতিজ্ঞা ওদের পাশে এসে বসে।প্রতিজ্ঞা পানির বোতল হাতে নিতে নিতে সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করে,
” আমার ননদিনী কোথায়?এখনো আসলো না যে?”
রিমা বললো,
“অন দ্য ওয়ে।”
সাব্বির মুখ ভেঙচিয়ে বললো,
“রোমিওর পাত্তা নেই,জুলিয়েট ননদিনী, ননদিনী করে।”
প্রতিজ্ঞা চোখ গরম করে ওর দিকে পানির বোতলটা ছুঁড়ে মারে। সাব্বির বোতলটা ধরে ফেলে।উপস্থিত সবাই হেঁসে ফেলে।
সোহানা ধমকিয়ে বলে,
“এই পাত্তা দেয় না কি হুহ?সংকল্প স্যার প্রতিজ্ঞার কথা জানে না, নাহয় ঠিকই পাত্তা দিতো।”
রামিম বললো,
“পাত্তা না,আগলে রাখতো।”
প্রতিজ্ঞা বিপরীতে মুচকি হাসলো।
ফিহা আর আয়েশা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এই বাদ দে তো।মিমের সাথে কি করছিস সেটা বল!”
মিমের কথা শুনতেই প্রতিজ্ঞা চমৎকার হাসলো।সোহানা হাসতে হাসতে বললো,
“ওয় নিজেকে মিসেস সংকল্প নামে পরিচয় দিয়েছে।তা শুনে তো ঐ মেয়ে ভয়ে শেষ।”
আয়েশা তখন নিজের গোল চশমা ঠেলে ভাবুক হয়ে বললো,
“সবাই প্রপোজ করলে সংকল্প স্যার থাপ্পড় মারে। প্রতিজ্ঞা যেদিন প্রপোজ করবে তখনও যদি থাপ্পড় মারে!”
“মারলে হাত ভেঙ্গে দিবো হুহ।আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে মারা বুঝিয়ে দিবো হুহ।”
পেছন থেকে সাবিহা এসে হাসতে হাসতে বলে।সবাই শব্দ করে হেঁসে ফেলে।ওর কাঁধে গিটার ঝুলানো দেখে রিমা জিজ্ঞেস করলো,
“কি রে গিটার আনছিস কেন?”
” ডিসিশন ফাইনাল, নববর্ষের অনুষ্ঠানে গান গাইবো।”
সবাই “ইয়াহু” বলে চিৎকার করে উঠে বলে,
“তাহলে আমাদের নাচ ফাইনাল।”
সাব্বির বলে উঠে,
“প্রতিজ্ঞা একটা গান কর।অনেকদিন তোর গান শুনি না।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ গান কর একটা প্রতিজ্ঞা।”
সাবিহা বলে।সবাই সম্মতি দেয় তাতে।
প্রতিজ্ঞা খুব ভালো গান করে।কিন্তু ছোটবেলায় শিখেনি।দুই বছর আগে সংকল্পকে দেখে যখন তার ভালোলাগা,খারাপ লাগা নিয়ে গবেষণা করছিলো,তখন জানতে পারে সংকল্প গান অনেক পছন্দ করে।তারপরেই গানের শিক্ষক রেখে গান করা,রেওয়াজ করা প্রতিজ্ঞার রুটিন হয়ে গিয়েছিলো।
“না না এখন গান গাইতে ইচ্ছে করছে না।”
“না তা গাইবা কেনো!গান তো শিখছোই জানের জান পরাণের পরাণ সংকল্পের জন্য।আমাদের কেন শুনাইবা?”
সোহানা মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো।
সবাই মুচকি হেসে সম্মতি জানালো।বললো,
“ঠিক ঠিক।”
প্রতিজ্ঞা চোখ গরম করে তাকিয়ে সাবিহার থেকে গিটারটা নিয়ে নিলো।গাইতে শুরু করলো,
“হে সখা, মম হৃদয়ে রহো।
সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো ॥
নাথ, তুমি এসো ধীরে সুখ-দুখ-হাসি-নয়ননীরে,
লহো আমার জীবন ঘিরে–
সংসারে সব কাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো ॥
হে সখা,মম হৃদয়ক রহো।”
গান শেষ হতেই ক্যান্টিনে উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করে।ক্যান্টিনের পরিবেশটাই যেনো গানের সুরে পরিবর্তন হয়ে গেছে।উপস্থিত সবাই যেনো গানের তালে কোনো ভিনদেশে সুরের রাজ্যে হারিয়ে গেছিলো।
গান শুরু হওয়ার পরপরই সংকল্প ক্যান্টিনে এসেছিলো।সুরের ছন্দে সে নিজেও ডুবেছিলো এতোক্ষণ।সে জানে কে গান গেয়েছে,এই সুর,এই গলার স্বর সে চিনে।আগেও কয়েকবার এই সুর তার কানে প্রবেশ করেছে।মন বলেছিলো ঐ বন্ধুদের আড্ডার সামনে যেতে,কিন্তু মস্তিষ্ক তার গম্ভীর স্বভাবকেই গুরুত্ব দিয়েছে।তবে সুরেলা কন্ঠের অধিকারী মেয়েটাকে সে বাহবা দিতে ভুলে নি।সে চলে যায়।
প্রতিজ্ঞা সংকল্পকে পিঠ পিছ দিয়ে উল্টোদিকে বসে ছিলো।প্রতিজ্ঞার বরাবর ক্যান্টিনে একটা আয়না আছে।সংকল্প যদিও ভেবেছিলো তাকে কেউ দেখেনি।কিন্তু প্রতিজ্ঞা ঠিকই দেখেছে। সংকল্প চলে যেতেই প্রতিজ্ঞা হাসি চওড়া করে বিড়বিড়ায়,
“আপনার উপস্থিতি, আপনার চলাচল,প্রতিটি পদক্ষেপ আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে স্নায়ু উদ্দীপনার মতো প্রবাহিত হয়।আমি অ্যালকোহলে আসক্ত হইনি কখনো,আপনাতে আসক্ত হয়েছি।আপনার অবস্থান আমার হৃদয়ে আছে এবং সারাজীবন থাকবে।”
#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#১ম_পর্ব
#চলবে…
[একটা মেয়ে ভালোবাসলে কি কি করতে পারবে,তার এক ঝলক দেখাবো।আশা করি,”স্রোতস্বিনী”-র মতো আপনাদের পাশে পাবো।হ্যাপি রিডিং]