#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ০৯
আঁধারিয়া মেঘ ছুটে চলেছে কোনো এক অজানা উদ্দেশ্যে।রাত দশটা কি এগারোটা!সংকল্প-রাইমার গাড়ি আহমেদ মেনশনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।দু’জনের-ই মুখ ভার।একবার মনে হচ্ছে সব দোষ অপর মানুষটার।পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সব দোষ নিজেদের।নিজেদের করা একটা ভুলের জন্য আজ কারো জীবনেরই সমীকরণ মিলছে না।সমীকরণ মাঝপথে এসে আঁটকে গেছে।যতই সূত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে, ততই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে,আরো পেঁচিয়ে যাচ্ছে সমীকরণ।কোন সে অজানা সূত্র যা প্রয়োগ করা মাত্রই সব প্যাঁচ ছুটে যাবে।জটিল সমস্যাগুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে।কে জানে সেই সূত্র!সকল রহস্য রাইমা নামক সমীকরণেই আঁটকে যাচ্ছে।তাহলে কি রাইমা জানে সেই সূত্র!যা প্রয়োগ করা মাত্রই সবার জীবনের সব দুঃখ হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিশে যাবে।
সংকল্প এবং রাইমা সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় প্রতিজ্ঞা এসে পথ আঁটকায়।পেছনে বন্ধুমহল দাঁড়ানো।প্রতিজ্ঞার পরনে সাদা রঙের শাড়ী।সংকল্প কপাল সংকুচিত করে আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখলো প্রতিজ্ঞাকে।মেয়েটা সাদা শাড়ী কেনো পরেছে!চেহারার ভাবমূর্তি দেখে তার গতিবিধি বুঝার উপায় নেই।রাইমা চুপ করেই রইলো।কথা বাড়ালেই কাহিনী বাড়বে।এসব ঝামেলা বরাবরই তার অপছন্দ।তাছাড়া নিজের বিপদ কেই-বা যেচে পড়ে ডেকে আনতে চায়।এর থেকে চুপ থাকা শ্রেয়।
সংকল্প নিরবতা ভাঙলো।বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি এখানে?”
প্রতিজ্ঞা অদ্ভুত হাসলো।বললো,
“বেস্ট ফ্রেন্ডের ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।আমি থাকবো তা কি করে হয়?”
বাক্যটি যেনো সূচের মতো বিধলো সংকল্পের বুকে।ভালোবাসার মানুষ কিছু মুহুর্তেই বান্ধবীর ভাই হয়ে গেলো!।নিজেকে সামলে নিলো সংকল্প।কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“ওহ!সামনে থেকে সরো।পথ আটকে আছো কেনো?”
প্রতিজ্ঞা আবারো হাসলো।বললো,
“নতুন বর-বউকে শুকনো মুখে কিভাবে প্রবেশ করতে দেই?”
পরক্ষণেই রাইমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“নতুন বউ শুনেছি তোমার শাশুড়ী নাকি তোমাকে বরণ করে নি?ব্যাপার না।কাল করে নি আজ করবে।”
সংকল্প-রাইমা দু’জনই বুঝার চেষ্টা করছে কি হতে চলেছে।তখনই সাবিহা তার মাকে নিয়ে এলো,হাতে বরণডালা।জাহানারা বেগমের মুখ ভার।কাঠিন্যতার সহিত বরণ করলেন নতুন বউকে।
প্রতিজ্ঞা-ই জাহানারা বেগমকে রাজি করিয়েছে এসব করতে।প্রতিজ্ঞার বাবা- ভাই এসেছিলো তাকে নিয়ে যেতে।কিন্তু সে যায় নি।জোর করলে উত্তেজিত হয়ে পরবে বলে জোর করে নি তারা।প্রতিজ্ঞাকে রেখেই চলে যায়।
বরণশেষে প্রতিজ্ঞা রাইমাকে সংকল্পের ঘরে নিয়ে যায়।পেছন পেছন সংকল্প এবং বন্ধুমহলও আসে।ঘরটা ফুলের গন্ধে মো মো করছে।কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।কিন্তু এই সাজানো যেনো রাইমা-সংকল্প কারোরই সহ্য হলো না।
সংকল্পের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।রাগান্বিত হয়ে বললো,
“এসব কি?এই ঘর কে কে সাজিয়েছে?এখানে কি নাটকের শ্যুটিং হচ্ছে?”
প্রতিজ্ঞা টলমলে দৃষ্টিতে দেখলো তার প্রাণপুরুষের রাগ।কিন্তু তাতে খুব একটা পাত্তা দিলো না।হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো।মুচকি হেঁসে বললো,
“আমি সাজিয়েছি স্যার।এই কৃত্রিম আলো,এই ফুল আমি এনেছি।আমি সাজিয়েছি পুরো ঘর একদম আমার কল্পনার মতো করে।ভালো হয় নি?”
সংকল্পের যেনো এই উৎফুল্লতা সহ্য হলো না।দ্রুত পায়ে প্রতিজ্ঞার কাছে গিয়ে তার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।আকস্মিক আক্রমণে প্রতিজ্ঞা ঠাহর করতে পারলো না কি হলো।চোখ-মুখ খিচিয়ে আছে সে।সংকল্প যেনো তার সব রাগ এই হাতের উপর দেখাচ্ছে।সবাই হতবিহ্বল চোখে নিরব দর্শকের মতো চেয়ে রইলো।
সংকল্প দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“নাটক হচ্ছে এখানে?”
প্রতিজ্ঞা সময় নিলো।ব্যাথায় তার চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।কিন্তু এই ব্যাথা মনের ব্যাথার তুলোনায় নিমিত্ত মাত্র।খিচিয়ে রাখা চোখ খুললো সে।কিছুক্ষণের মধ্যেই যেনো শান্ত চোখগুলা জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়ানক হয়ে গেছে।প্রাণ পুরুষের এমন রুদ্ররূপ সে আগে কখনো দেখেনি।ঢোক গিলে শক্ত গলায় বললো,
“জীবন নামক নাটক হচ্ছে স্যার।যেখানে আমি-আপনি-আমরা একেকটা ক্ষুদ্র চরিত্র মাত্র।বিয়ে হয়েছে,বধূবরণ হয়েছে,বউভাত হয়েছে তাহলে ফুলসজ্জায় কি সমস্যা স্যার?”
“প্রতিজ্ঞা…..!”
চেচিয়ে বলে উঠলো সংকল্প।ঘরে উপস্থিত প্রতিটা প্রাণীর পায়ের তলা যেনো কেঁপে উঠলো।প্রতিজ্ঞা হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় আছে।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“এখন এতো রাগ কোথা থেকে আসছে মিস্টার আফনান আহমেদ সংকল্প? কাল কোথায় ছিলো রাগ?”
সংকল্প হাত ছেড়ে দেয়।প্রতিজ্ঞার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বলে,
“কাল আমার কাছে অনেক কিছুই অজানা ছিলো,যা আজ প্রকাশ্যে।আমি কোনো কিছুই নিজ ইচ্ছেতে করিনি।আর আমাকে যে দোষারোপ করছো,আসলেই কি দোষ আমার?তোমার দোষ নেই?অস্বীকার করতে পারবে?সব দোষ তোমার প্রতিজ্ঞা।আমি মাত্রই পরিস্থিতির স্বীকার।”
প্রতিজ্ঞার দৃষ্টি ঝাপসা।আসলেই তো দোষ তার।সংকল্প তো তার ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত ছিলো না।তাহলে তার দোষটা কোথায়!তার সাথে প্রতিজ্ঞার অন্যকোনো সম্পর্কও ছিলো না যে সে বিয়ে আঁটকাবে।সে তো বাবার কথা রেখেছে।
প্রতিজ্ঞা সামলালো নিজেকে।শক্ত গলায় বললো,
“হ্যাঁ,দোষ আমার।তার প্রায়শ্চিত্তও করছি আমি।হ্যাভ অ্যা সুইট বেড অব রোজেস্,স্যার।”
বলে দরজা ভিড়িয়ে বন্ধুমহল নিয়ে চলে যায় প্রতিজ্ঞা।
সংকল্প নিজের রাগ দমনে ব্যস্ত।রাইমা পানির গ্লাসটা সংকল্পের দিকে এগিয়ে দেয়।মুখের সামনে পানির গ্লাস দেখতে পেয়ে গ্লাসদাতার দিকে তাকায় সংকল্প।পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মা*রে মেঝেতে।গ্লাসটার ভাঙ্গা অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে।
এতোক্ষণ চুপ থাকা রাইমা যেনো আর চুপ থাকতে পারলো না।খেট খেট করে বললো,
“হোয়াই আর ইউ এনগ্রি উইদ মি?”
সংকল্প রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রাইমার দিকে।শক্ত গলায় বলে,
“জানেন না কেনো?”
রাইমা আমতা আমতা করে বললো,
“আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না এই বিয়ে নামক নাটক করার।আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।মা-বাবা আমাকে মিথ্যে বলে বিডিতে নিয়ে এসে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি আপনার সাথে কথা বলার।কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা গিয়েছে।তাই বাধ্য হয়ে নাটক করেছি।”
সংকল্পের রাগ যেনো তিরতির করে আরো বেড়ে গেলো।বললো,
“এতোসব কিছু নাটক লাগছে আপনার কাছে?আপনার নাটকের জন্য কয়টা জীবন নষ্ট হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন আপনি?”
রাইমা স্বাভাবিক গলায় বলে,
“পাচ্ছি।তবে আপনি এতো গবেট কি করে?দ্য গার্ল,প্রতিজ্ঞা লাভস্ ইউ ভেরী মাচ।বাট ইউ ডিডন্ট ইভেন নো,হাউ?ফিলিং সো বেড ফর হার।”
“আমি গবেট?” রাগান্বিত স্বরে বলে সংকল্প
“টু মাচ।হোয়াটএভার,আই নিড অ্যা ফোন।মা-বাবা আমার পাসপোর্ট, ডকুমেন্টস,ফোন সব লুকিয়ে ফেলেছে।দ্যাট’স হোয়াই,আই ক্যান্ট কমিউনিকেট উইদ এনিওয়ান।বিসাইডস্,আই ডোন্ট নো এনিথিং ইন বাংলাদেশ।সো,আই হ্যাড টু গেট ম্যারিড।”
সংকল্প কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো।জিজ্ঞাসা করলো,
“কি করতে চাচ্ছেন আপনি?”
“আমি যেনো অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করতে পারি,আপনি ম্যানেজ করে দিন।এমনিতেও আমি কয়েকদিন পর পালিয়ে যেতাম।এখন আমার জন্য সুবিধা-ই হলো।এই কালচার আমার ভালো লাগে না।আমি অন্য কালচারে বড় হয়েছি।এসবে আমি মানিয়ে নিতে পারবো না।এডজাস্ট করতে কষ্ট হবে আমার।”
“আপনিই তো বললেন আপনার পাসপোর্ট লুকানো।আমি কিভাবে পাবো?আর আপনি এতো ভালো বাংলা বলেন কিভাবে?”
রাইমা ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
“বাবা-মা সবসময় বাংলাতে কথা বলতো।”
“ওহ!”
“ইয়েস।বাট কিভাবে আমি পাসপোর্ট পাবো?”
“ওয়েট করতে হবে।”
“হাউ লং?”
“ডোন্ট নো।”
“আমি যেদিন অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটে উঠবো,সেদিন আপনার জন্যে একটা সারপ্রাইজ থাকবে।”
“কি সারপ্রাইজ?”আশ্চর্য হলো সংকল্প।
“এখন যদি বলে দেই,আর আপনি আমাকে হেল্প না করেন!বলবো না।”
“সাসপেন্স!”
“সামথিং লাইক দ্যাট।ইট উইল চেঞ্জ ইউর লাইফ।”
“উমম,ডিভোর্স পেপার?” কিছুটা ভেবে প্রশ্ন করলো সংকল্প।
রাইমা রহস্যময় হাসি হেঁসে বললো,
“নোপ।”
সংকল্প প্রশ্নার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাইমার দিকে।
রাইমা বিছানায় বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,
“আমি অনেক টায়ার্ড,সংকল্প।এই আপনার নামটা অনেক কঠিন উচ্চারণ করতে পারি না।অন্য আরেকটা নাম বলুন তো!”
সংকল্প থমকালো।তার ইচ্ছে করছে এই মেয়েকে আছাড় মা রতে।কোনোমতে রাগ সংবরন করে বললো,
“আফনান!”
“ওহ, ইয়েস।আফনান!আআআআফনাাান,সাউন্ডস বেটার এন্ড দ্য প্রোনান্সিয়েশন ইজ ইজিয়ার।”
সংকল্প কিছু বললো না।চুপচাপ নিজের নাম গবেষণা দেখলো।রাইমা কিছুক্ষণ মৌন থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“আফনান,আমি ঘুমাবো এখন।তোমার লায়লার কাহিনী দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।তুমি তোমার লায়লাকে সামলাও।টাটাহ,গুড নাইট।হ্যাভ অ্যা সুইট নাইট উইদ প্রতিজ্ঞা।”
তারপর সংকল্পকে ঘর থেকে বের করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
সংকল্প কিছুক্ষণের জন্য বোকাবনে গেলো।নিজের ঘরের দরজার বাহিরে সে দাঁড়িয়ে আছে।ভাবা যায়!এই মুহুর্তে সংকল্পের রাগ লাগছে না,কষ্ট লাগছে না।বিস্ময় লাগছে,যে থমকেছে বড্ড!নারীর কত রূপ!তাদের ভালোবাসার ধরন কত ভিন্ন!একজন এতো বছর ভালোবেসে প্রকাশ করলো না,যেই সে বিয়ে করে নিলো এখন সে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে।আরেকজন আবার অন্যকাউকে ভালোবাসে বিধায় দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করছে।নিজের জীবনের সাথে জড়িত নারীদের কত ভিন্নরূপ।একজন ভালোবাসার জন্য ঘর থেকে বের করে দিলো,আরেকজন ভালোবাসার জন্য খু*ন করতে আসে!
সংকল্প ঠোঁট উল্টে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“ভালোবাসা ভাই তোর জয় হোক।কত রূপ দেখাইলি ভাই!বহুরূপীতার জন্য তোকে নোবেল ছুঁড়ে মা রা হোক!”
ভালোবাসা যেনো কানে কানে বললো,
“এই তো মাত্র শুরু!”
সংকল্প অসহায় দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বোলালো।তারপর ছাঁদে চলে গেলো।রাতের আকাশ ছাড়া এই দুঃখ দূর করার মতো কেউ নেই।কিছুক্ষণের জন্য সংকল্প যেনো ভুলে গিয়েছিলো তার জীবনে ঝড় চলছে,কালবৈশাখী ঝড়!
ছাঁদে গিয়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো সংকল্পের।ঐ তো অদূরে রেলিং এ হাত দিয়ে সাদা শাড়ী পরিহিতা প্রতিজ্ঞা দাঁড়িয়ে!
#চলবে….