#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_২৫
মৃদু হেসে মেসেজটা আবার পড়ল সে,“বাহিরে ঠান্ডা বাতাস। রোমিয়োর মতো বাহিরে জুলিয়েটের জন্য পায়চারি করতে হবে না তোর। জুলিয়েট যাবে না। যা ঘুমো এখন।”
তোয়াকে রিপ্লাই কী পাঠাবে সেটা ভাবতে থাকলো আবির। তখনই আরও একটা মেসেজ এলো। ফোনটা আবিরের হাতেই ছিল। মেসেজটা দেখে মুখটা মলিন হলো আবিরের। এদিক ওদিক তাকিয়ে মেসেজদাতাকে খুঁজতে থাকলো সে। মেসেজদাতা তোয়া নয় ফালাক। সে মজা করে তোয়ার ফোন থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে। দ্বিতীয় মেসেজে সেটাই বলেছে ফালাক। আবির ভাবলো, নিশ্চয়ই দাঁত কেলাতে কেলাতে লিখেছে ফালাক,
”তোয়া ভেবে ভুল করিস না, ভাইয়া। ওকে যে শক দিয়েছিস সেটা মাসখানেক থাকবে। যা রুমে গিয়ে ঘুমা নইলে ট্রেন মিস করবি, আমি তোকে বারবার ডাকতে পারব না।”
আবির মনটা খারাপ করে নিজেদের রুমে চলে গেল। রাত অনেকটাই বাকি তবু যেন এখন ঘুমোলে একটু পরই উঠতে হবে। ফোন রেখে তাড়াতাড়ি ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিল আবির। মনকে সান্ত্বনা দিল- রাত জাগা ঠিক হবে না।
_______
ট্রেনে উঠে বসেছে সবাই। বিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইয়াদের মা জোর করে সবাইকে খাইয়ে দিয়েছে। বেশ খানিকটা পথ। না খেয়ে বের হলে রাস্তাতেই ক্ষুধা পেয়ে যাবে।
সবাই নিজেদের সিটগুলোতে পরিবারের সবাই মিলে বসেছে৷ জাফর সাহেব এবং তার স্ত্রীর পাশের সিটে বসে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। রূম্পা বেগম জাফর সাহেবকে খেয়াল করে বললেন,
“এখনো রেগে আছো?”
জাফর সাহেব জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,“ছেলে-মেয়ে মানসম্মান নিয়ে খেলছে, রাগ হবে না?”
রূম্পা বেগম বললেন,“আমারও ওদের বিষয়টা অজানা ছিল। নিশো- ফালাকের বিষয়টা টের পেলেও মেয়ের বিষয়টা সম্পূর্ণ অজানা। তবে পছন্দ শুধু আবিরই করে, তোয়া না। আবির তো ছেলে হিসেবেও খারাপ না। ছেলে ভালো৷ কাজ ভালো। সবই ভালো।”
জাফর সাহেব শক্তগলায় বললেন,
“এত মানুষের সামনে উপস্থাপন করার তো কোন প্রয়োজন ছিল না।”
“তুমি দেখ না, অনেক জায়গায় বিয়ে বাড়িতে আরেকটা বিয়ে ঠিক হয়। ওরা ভয় পেয়েছিল। বয়স কম, ভুল করে ফেলেছে। যাদের সামনে বলেছে তাদের সাথে বছরেও একবার দেখা হয় না আমাদের। ইয়াদের মায়ের বিয়েতে একবার, ও হলে একবার তারপর মনে হয় একবার গিয়েছিলে ওদের গ্রামে। যাদের সাথে দেখাই হয় না সেখানে সামান্য এই ব্যাপার ঘটে যাওয়ায় ছেলে-মেয়েদের ওপরে রাগ করো না৷ তোমার রাগ করার বাজে স্বভাব। এসবের জন্য সম্পর্ক নষ্ট হয়৷ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো এসব।”
জাফর সাহেব কিছু ভাবলেন। পিছনের দিকে একবার সবাইকে দেখে আবার রূম্পা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ঠিকই বলেছ। এসব আমার থেকে আর কে ভালো জানে? কিন্তু ছেলে- মেয়ে ওগুলো কী করল বলো তো!”
“আরে ভেবো না আর ওসব। তুমি একটা বিষয় দেখো, আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমাদের কাছেই থাকবে।”
“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ।”
“ফালাককে তোমার কেমন লাগে? কত গুণী একটা মেয়ে, মাশাআল্লাহ।”
”তোমার ছেলেকে লাইনে আনতে পারবে।”
“বেলাইনে আছে না-কি?”
”যে ভুলগুলো আছে তা ঠিক শুধরে দেবে।”
“তার মানে পছন্দ তোমার?”
“অপছন্দের কী আছে?”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ।” বলেই মৃদু হাসলেন রূম্পা বেগম।
তোয়া আর ফালাক একসাথে পাশাপাশি বসেছিল। ফালাক একের পর এক নিজের ভাইয়ের কথা বলেই যাচ্ছে তোয়া চুপচাপ শুনে যাচ্ছে আবার থেকে থেকে ফালাককে চুপ করতে বলছে। ফালাক তবুও থামছে না। তোয়াকে ক’মাস আগের কথা বলা শুরু করল,
“তুমি একদিন শাড়ি পরে আমাদের বাড়ি গেছিলে মনে আছে? টকটকে লালশাড়ি। সেদিন ভাইয়া তোমাকে ছবি তুলে দিয়েছিল। ভাইয়ার ফোন কখনো দেখেছ? ওইদিনের ছবি ভাইয়া এখনো তার ফোনের ওয়াল পেপারে রেখেছে।”
তোয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,“ধুর, ওই বালডা সারাজীবন আমার সাথে ঝগড়া করে গেল আর এখন কি না এসব শুনতে হচ্ছে? সবই আমার কপাল।”
“ভালোবাসায় দুই ধরণের সম্পর্কে থাকে। একটায় এই যে তোমাদের মতো সবসময় ঝগড়া হয় আর আরেকটায় লজ্জা থাকে বেশি।”
“তোরটা বুঝি লজ্জার? কাল কী করে দুজন একসাথে বলে উঠলি ওত মানুষের সামনে? সবাই অবাক হয়েছে। আমার সাদাসিধা ভাইটাও মানুষের সামনে বলে উঠল!”
ফালাক মৃদুস্বরে বলল,“কী জানি, কীভাবে যেন হয়ে গেল ওমন।”
আবির হঠাৎ নিজের নিজের সিট ছেড়ে ফালাকের পাশে এসে দাঁড়ালো। ফালাক, তোয়া দুজনই আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফালাক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলো।
“ভাইয়া, কিছু বলবি?”
আবির মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“তুই নিশোর ওখানে গিয়ে বোস একটু।”
ফালাক বুঝতে পারল, আবির তোয়ার সাথে একটু কথা বলতে চাইছে। রাতের পর থেকে দুজনের আর একসাথে কোন কথা হয়নি। ফালাক উঠে দাঁড়াতেই তোয়া ফালাকের হাত চেপে ধরল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোর ওখানে যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকবি।”
আবির সহসা তাড়া দিয়ে বলল,
”ফালাক যা তো এখান থেকে। আমার ওর সাথে একটু কথা আছে।”
তোয়া পাশে থেকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ফালাক কোথাও যাবে না। তোর এখানে কী কাজ? তুই এখান থেকে যা। যা এখান থেকে।”
ফালাক উঠে নিশোর পাশের সিটে গিয়ে বসতেই নিশো সেদিকে তাকালো। আবিরকে দেখতে পেল না সে। একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। আবিরের উঠে যাওয়া টের পায়নি সে কিন্তু ফালাকের ধপ করে বসার শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল নিশোর। পাশে তাকিয়ে ফালাককে দেখে বলল,
“তুমি এখানে কেন? বাবা দেখলে কী বলবে?”
ফালাক ভ্রু কুঁচকে নিশোর দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় শুধালো,
“বাবাকে ভয় পেতে শুরু করলেন কবে থেকে?”
“আগে পাইনি, এখন পাই।”
“এখন কেন পান?”
“একজনকে ভালোবাসি তাই।”
ফালাক মৃদু হেসে বলল,“ তা ভালোই বা বাসেন কাকে আর ভয়ই বা পান কেন?”
নিশো সম্পূর্ণ শরীর ফালাকের দিকে এগিয়ে আনলো। মুখটা এগিয়ে ফালাকের চোখে চোখ রেখে বলল,
”এই মেয়েটাকে ভালোবাসি। জীবনটা বেশ অগোছালো ছিল। সে-ই তো দায়িত্ব নিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে। তাকে ছাড়া আর কাকে ভালোবাসব?”
ফালাক চোখ নামিয়ে নিল। মাথা নিচু করে বলল,
”ভয় পান কেন?”
”আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই, ফালাক। সুখী দম্পত্তির মতো। আর আমাদের একসাথে পথচলা শুরুর আগেই আমি বাবাকে কোনভাবে কষ্ট দিতে চাই না। বাবা মনে কষ্ট পেলে আমাদের ওপর বাজে ইফেক্ট পড়বে। আমি চাই না কোন কিছু খারাপ হোক।”
ফালাক নিশোর দিকে তাকালো।
“আপনার চিন্তাভাবনা সুন্দর তবে শুধু এজন্য কেন? কোন কারণ বা কারণ ছাড়াও বাবা-মাকে কষ্ট দিতে হয় না।”
“তোমার মতো মেন্টালিটির মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন, ফালাক।”
”লাগবে অন্য মেয়ে? ঠিক আমার মতো বা আমার চেয়েও ভালো?”
“না থাক, এই একটাতেই চলবে যদিও চার চারটা জায়েজ আছে।”
”ফরজ পালন করেন আগে, ওই সুন্নাতের দিকে তাকাতে হবে না। আপনারা ছেলেরা এই একটা বিষয়ই ঢোল পিটিয়ে বলেন যে, চারটা বিয়ে জায়েজ আছে অথচ নামাজ, রোজা, দান, সাদকার কোন বালাই নাই।”
নিশো মুখ টিপে হাসলো৷ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“বউ আবার একটাতে হয় না-কি? কী যে বলো না!”
ফালাক রাগী চোখে নিশোর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বিয়ে আপনাকে করাচ্ছি দাঁড়ান। বিয়ে গুলিয়ে খাইয়ে দিব আমি।”
“বিয়ে ক্যামনে খায়?”
“থামবেন আপনি!”
নিশো হো হো করে হেসে উঠল। ফালাক মাড়ি শক্ত করে নিশোর দিকে চেয়ে রইল। নিশো কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ফালাকের দিকে তাকালো। উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তোমার বেশ পরিবর্তন হয়েছে টের পেয়েছ?”
“কী?”
“এই যে, আগে আমার দিকে তাকাতে লজ্জা পেতে আর এখন ঝগড়াও করো আবার রাগও দেখাও।”
”আমার এখন লজ্জা করে মাথা নিচু করে বসে মিটিমিটি হাসা উচিত?”
“তা নয়। পরিবর্তনটা খেয়াল করেছ নাকি সেটা বলো?”
“না।”
“তোমার এখানে এসে বসা উচিত হয়নি।”
“কে আসতে চেয়েছিল এখানে? আবির ভাইয়া তো তোয়া আপুর সাথে কথা বলবে বলে আমাকে এখানে এসে বসতে বলল।”
“নির্লজ্জ ছেলে হয়ে গেছে ওটা।”
“আপনার চেয়ে কম।”
“আমি কী করেছি?”
“কিছুই করেননি। চুপচাপ থাকুন। ঘুমোবো।”
“উহু ঘুমিয়ো না।”
“কেন?”
“ঘুমোলে নিশ্চয়ই তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগবে। এসব আমি হজম করতে পারব না। আমি মাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মায়ের সাথে বসে ঘুমাও।”
“কী আশ্চর্য!”
“আমার জায়গায় থাকলে তুমি বুঝতে, ফালাক। কীভাবে তুমি আমাকে আকর্ষণ করো। আমি নিজেকে সামলে রাখি৷ ভাবি আর তো কয়েকটা দিন।”
#চলবে…….
বেশ কয়েকদিন বাড়িতে কাজের প্রেশার, শরীর খারাপ, ইদের ব্যাপার সব মিলিয়ে ৫ দিন গল্প দিতে পারিনি৷ দুঃখিত আমি।
আজ রাত দশটার দিকে সম্ভব হলে আরেকটা পর্ব দিব আর লিখে উঠতে না পারলে আগামীকাল একই সময়ে ইন শা আল্লাহ।
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link