#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য কপাল টান করে তাকালো পৃথার পানে অতঃপর বলল,
-“কেন ওদের তোমার মানুষ মনে হয় না?”
পৃথা আহাম্মক বনে গেল। কি বলছে এই পুরুষ? মান ইজ্জত আবার মানুষ হলো কবে? মান ইজ্জত মানুষ তো দূরে থাক ধরা ছোঁয়ারও কোনো বস্তু নয়। ছোট বেলা থেকে সে মান ইজ্জত শুধুমাত্র এই মুখে মুখেই শুনে এসেছে কখনও এদের চোখে দেখার সৌভাগ্য পর্যন্ত হয়নি। আর এই পুরুষ কিনা বলছে মান ইজ্জত মানুষ! পৃথা বোকা বোকা কন্ঠে বলল,
-“মান ইজ্জত মানুষ হলো কবে থেকে?”
তুর্য নির্বিকার। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-“মানুষ এখনও হয়নি তো, হবে ভবিষ্যতে। ভাবছি বউয়ের সাথে পরিবার পরিকল্পনায় বসবো খুব শীঘ্রই। মুরগির বাচ্চা আর হাঁসের বাচ্চা মিলে গোটা পঁচিশে টিয়া পাখির বাচ্চার মতো ছাও পোনার জন্ম দেব। তারপর সেই ছাও পোনার মধ্যেই বেছে বেছে দুটোর নাম দেব মান এবং ইজ্জত।”
পৃথা ভরকে গেল। ভরকানো কন্ঠে বলল,
-“মুরগির বাচ্চা আর হাসের বাচ্চা মিলে টিয়া পাখির বাচ্চা কিভাবে হবে?”
তুর্য বিরক্ত হলো ভীষন। তার মতো এত বিচক্ষণ একজন মানুষের বউ কিনা এত বোকা। তার এই টুকু কথার মানে বুঝতে পারছে না? নিশ্চই ঐ রা’জা’কা’র শ্বশুর, আল’বদর, আল শাম’স শা’লা’দে’র মধ্যে থেকে বউটার মস্তিষ্ক এভাবে ফুলে উঠেছে। তুর্যের এখন ভীষন খারাপ লাগছে। কেন সেদিন বাচ্চা বউটাকে বিয়ের আসরে ফেলে ইংল্যান্ড পাড়ি জমিয়েছিল? সেদিন যদি সে বিদেশে না গিয়ে বউকে আপন করে নিত। বাচ্চা বউটাকে নিজের কাছে রেখে কোলে পিঠে করে মানুষ করতো তাহলে নিশ্চই বউটা এতটা মোটা মাথার অধিকারী হতো না। তুর্য বিরক্তিভরা কন্ঠেই বলল,
-“আমি বললেই কি ওরা হাঁস মুরগি আর টিয়া পাখির বাচ্চা হবে নাকি? ওগুলো তো আমি ওদের ভালোবেসে বলি। বাস্তবে তো এরা সবাই মানুষের বাচ্চা।”
পৃথার মাথা ঘুরে উঠলো। মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান হারাবে এই ভদ্রলোকের যুক্তি তর্ক শুনে। এই পুরুষ এইসব কি উদ্ভট কথা বলছে? প্রথমে বলল “মান ইজ্জত মানুষ” তারপরে কি সব মুরগির বাচ্চা হাসের বাচ্চা তাদের আবার টিয়ার বাচ্চা সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেল মেয়েটার। এই মুহূর্তে পৃথার নিজেকে কেমন মানসিক রোগী মানসিক রোগী মনে হচ্ছে। আচ্ছা সে নিজে মানসিক রোগী নাকি এই পুরুষ মানসিক রোগী কোনটা? পাবনা থেকে পালিয়ে আবার রাজশাহীতে এসে উঠেনি তো আবার! আরুশ তুর্যের এই অসুস্থতার কথাই বলেছিল হয়তো? পৃথা চোখ বড় বড় করে তাকালো আরুশের পানে, চোখে পড়লো ছেলেটা কেমন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথার ভয় হলো। এ কোন পাগল ছাগলের কাছে এসে পড়লো সে? ছোট বেলা থেকে এমনিই এই পাগলে ভয় পায় পৃথা। ছোট বেলায় একবার রাস্তায় তাকে একা পেয়ে এক পাগল ধাওয়া করেছিল সেই থেকে পাগলে ভয়। এখানেও তো পৃথা একাই। আর আরুশ তো এই পাগলের লোক। যদি কোনোভাবে তাকে ধরে মারে। সেদিনই তো সকলের সম্মুখে থাপ্পর মারলো। কি জোরে থাপ্পরটা ছিল। ব্যথায় তাৎক্ষণিক পৃথার মনে হয়েছিল তার দাঁত নড়ে গেছে। মেয়েটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। অতঃপর হুট করেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। পৃথাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে হকচকালো তুর্য। সেও ছুটলো মেয়েটার পিছু পিছু। কিন্তু দরজার নিকট আসতেই খেয়ালে এলো সে অর্ধ নগ্ন। দেহের উর্ধ্বভাগে নেই কিছুই নিচে শুধুমাত্র একটা শুভ্র রঙা তোয়ালে জড়ানো। তুর্য নির্লজ্জ ঠিক আছে তাই বলে এতটাও নির্লজ্জ নয় যে অর্ধ উ’ল’ঙ্গ হয়ে শুধুমাত্র একটা তোয়ালে জড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াবে। তুর্য নিজ কক্ষের দরজার সম্মুখে গিয়েই থেমে গেল। আরুশকে তাড়া দিয়ে বলল,
-“আমার বউকে তাড়াতাড়ি ধর আরুশ।”
১৬.
পৃথা দৌড়ে বেরিয়ে এলো তুর্যদের বিল্ডিং থেকে। তবে সে এসেই থামলো না বিল্ডিং সম্মুখে। দৌড়ে আরও কিছু দূরে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হাঁটুতে ভর দিয়ে জোড়ে জোড়ে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। অতঃপর আবার স্বাভাবিক গতিতে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু কিছুটা দূরে যেতেই পৃথা অনুভব করলো তার নাম ধরে ডাকছে কেউ একজন, পুরুষালী সে কন্ঠস্বর। আবার ঐ ব্রিটিশ পাগল আর তার চ্যালাটা না তো? মেয়েটা দাঁড়ালো না। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। তবে তাই বলে পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকাটা থামেনি বরং আরও বেশি করে শোনা যাচ্ছে ডাকটা। পৃথা আবারও দৌড়াতে গিয়েও থেমে গেল। কন্ঠস্বরটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আরুশ কিংবা তুর্যের কন্ঠের ন্যায় মনে হচ্ছে না। পৃথা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো অতি পরিচিত একটি মুখশ্রী। একি এ তো পৃথার কলেজের একজন সম্মানীয় অধ্যাপক নাহিদ স্যার। যদিও বয়সে নিতান্তই অল্প বয়স্ক পুরুষ সে তবুও স্যার তো, তাদের পড়ায়। অথচ তার এত ডাকাডাকি সত্ত্বেও পৃথা চলে যাচ্ছিলো বেয়াদবের মতো। মনে মনে অনুতপ্ত হলো মেয়েটা ততক্ষণে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো নাহিদ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“কতক্ষন ধরে ডাকছি আপনাকে শুনছেন না?”
পৃথা জ্বীহ্বা নাড়িয়ে ওষ্ঠ ভেজালো। আমতা আমতা করে বলল,
-“দুঃখিত স্যার, আমি শুনিনি।”
নাহিদ আর এই বিষয়ে তেমন কথা বাড়ালো না। স্বভাবসুলভ ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“আপনি এখানে?”
-“জ্বী আমার বাসাই এখানে স্যার।”
-“ওহ, আমি একটা কাজে এসেছিলাম এখানে। তা কলেজে যাচ্ছেন নাকি?”
পৃথা মাথা নাড়ালো। মুখে জবাব দিল,
-“হ্যা।”
নাহিদ আবারও হাসলো। অতঃপর বলল,
-“আমিও যাচ্ছি। চলুন একসাথে যাই আমরা।”
পৃথা বারন করতে চেয়েও পারলো না। হাজার হলেও শিক্ষক মানুষ। তার মুখের উপর না কিভাবে বলবে? পৃথা সায় জানালো নাহিদের কথায়। পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো দুজন। ততক্ষণে তুর্যও নিচে চলে এসেছে আরুশকে নিয়ে। বিল্ডিং এর সম্মুখে দাঁড়াতেই তার চোখে পড়লো অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি। তার বউয়ের পাশে কিনা অন্য একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। আর তার বউও কি সুন্দর অবলীলায় হেটে যাচ্ছে ঐ অল্প বয়সী ছোকরার পাশে। তুর্যের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই। বক্ষপিঞ্জরে জ্বলে উঠলো হিংসা’ত্মক মনোভাব। তুর্য অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। ভারী কন্ঠে বলল,
-“এই শিয়ালের বাচ্চাটা আবার কে খোঁজ নে আরুশ।”
আরুশ তুর্যের আসার কিছুটা আগেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাই পৃথার সাথে থাকা ছেলেটাকে বেশ ভালোভাবেই দেখে নিয়েছিল। আরুশ পৃথা এবং নাহিদের হাঁটার পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“খোঁজ নিতে হবে না স্যার। ছেলেটা ম্যামের কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ নাহিদ ভুঁইয়া। প্রথম যেদিন ম্যামকে খুঁজতে তার কলেজে গিয়েছিলাম সেদিন দেখেছিলাম।”
আরুশের কথায় তুর্যের ক্রোধ যেন বাড়লো আরও। কপালের রগগুলো ফুলেফেঁপে নীলচে হয়ে ধরা দিল সাথে সাথে। থমথমে কন্ঠে সে বলল,
-“মহিলা কলেজে কেন অল্প বয়সী শিক্ষক থাকবে? দেশে কি মহিলা শিক্ষক কিংবা বয়স্ক শিক্ষকের অভাব পড়েছিল?”
আরুশ তাকালো তুর্যের ক্রোধিত মুখ পানে। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমি আগেই বলেছি স্যার শিক্ষক পিতার সমতুল্য।”
তুর্য কটমট করে তাকালো আরুশের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“চুপ থাক আহাম্মক। তোর এই ব্যাটাকে কোন দিক থেকে আমার বউয়ের বাপ মনে হচ্ছে? এই ব্যাটার সাথে কি এখন আমার শ্বাশুড়িকে বিয়ে দেওয়া যাবে? এ ব্যাটা কি আমার শ্বাশুড়ির মতো অর্ধ বুড়ির পানে দুষ্টু দৃষ্টি দিবে? উল্টো এর হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে এটা আমার শ্বাশুড়ির মেয়ের দিকে দুষ্টু দৃষ্টি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।”
আরুশ আর কিছু বলার অবকাশ পেল না। তুর্য তো ভুল কিছু বলেনি। আর তাছাড়া এই নাহিদ ব্যাটার হাব ভাবও খুব একটা ভালো ঠেকেনি তার নিকট। কলেজের স্যাররা থাকবে ভাব নিয়ে। তাদের আচরণ হবে অন্যরকম। তা নয় এ তো ছাত্রীর পিছনে পিছনে দৌড়ে ছাত্রীর সাথে ভাব বিনিময় করে। কোন কলেজের শিক্ষক ছাত্রী তার ডাকে না সাড়া দিলে পিছনে পিছনে দৌড় শুরু করে? নিশ্চই এই নাহিদ শিয়ালের মনে অন্য কিছু চলছে।
১৭.
সময় গড়ালো। পৃথার কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্রই। কলেজের সম্মুখে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য এবং আরুশ, অপেক্ষা করছে পৃথার জন্য। মেয়েটাকে গেট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই গাড়িতে উঠে বসলো তুর্য। পৃথা তাদের গাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটু গলা বাড়িয়ে ছেলেটা বলল,
-“গাড়িতে উঠে এসো পৃথা।”
আচমকা কারো এমন কথায় হকচকালো মেয়েটা। তবে পরক্ষনেই পাশ ফিরে তুর্যকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। সাথে কিছুটা ভয়ও লাগলো। এই পাগলটা আবার এখানে কেন চলে এসেছে? আগে তো তাকে একদম দেখতেই পারতো না আর এখন পিছন ছাড়ছে না। এদের উদ্দেশ্য কি? তারপর আবার গাড়িতে উঠতে বলছে। কোথায় না কোথায় নিয়ে গুম করে দিবে বা তার সাথে কোনো খারাপ কাজও করতে পারে। কথাগুলো ভাবতেই আঁতকে উঠলো পৃথার নাজুক কিশোরী হৃদয়। আজকাল কোনো মেয়েই তো নিরাপদ নয়। রোজই পত্রিকা খুললে অসংখ্য মেয়েদের সম্ভ্রাম হারানোর হাহাকার চোখে পড়ে। সেখানে এই লোক তো পৃথার অপরিচিত। পৃথার হৃদয়ে ভয় ডানা মেললো। দুই হাতে সে খামচে ধরলো নিজের কলেজ ড্রেসের দুই পাশ। তখনই আবার ভেসে এলো তুর্যের ভারী কন্ঠস্বর। থমথমে কন্ঠে সে বলল,
-“গাড়িতে উঠে এসো।”
পৃথা আর দেরী করলো না একটুও। তুর্যের পানে একবার তাকিয়ে আবারও দৌড় শুরু সম্মুখের দিকে। তুর্যের কপালে ভাঁজ পড়লো। এমনিই সকালে অন্য পুরুষের সাথে দেখে মেজাজটা চটে ছিল এখন আবার এই মেয়ে তাকে উপেক্ষা করলো। সকালেও তাকে উপেক্ষা করে দৌড়ে চলে গেল, আবার এখনও। অথচ সকালে পরপুরুষের সাথে কি সুন্দর হেসে খেলে হেঁটে গেল। শরীরের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটে উঠেলো ছেলেটার। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে গেল পৃথার পানে। দুপুরের দিকে রাস্তা ফাঁকা থাকায় অল্পতেই মেয়েটাকে ধরে ফেললো তুর্য। পৃথা তবুও তুর্যের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা চালালো। কিন্তু ছেলেটা ছাড়লো না তাকে। বরং এক প্রকার টেনে হিচড়ে ছুঁড়ে ফেললো গাড়ির ভিতরের দিকে অতঃপর নিজেও গাড়ির ভিতরে ঢুকে বসলো। পৃথার এক হাত শক্ত করে ধরে আরুশকে আদেশের সুরে বলল,
-“বাইরে যা তুই।”
চলবে…..