অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১৭

0
716

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৭

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পৃথা কিছু বলার আগেই তুর্য আবার বুকে হাত দিয়ে বলল,

-“তার সাথে আবার জুটেছে তোমার আল’বদ’র এবং আল শাম’স ভাই দুইটা।”

পৃথা ফুঁসে উঠলো। এই লোক যখন তখন তার বাবা ভাইদের অপমান করা শুরু করে দেয়।‌ ব্রিটিশ লোক একটা। পৃথা কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠেই বলল,

-“একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আমার বাপ ভাইরা রাজা’কার, আল ব’দর, আল শা’মস কোনোটাই নয় বরং আপনি ব্রিটিশ। ১৯৪৭ সালে আমদের দেশ থেকে পালানো ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া বাচ্চা আপনি।”

তুর্য যেন আকাশ থেকে মাত্রই টুপ করে পড়লো। অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

-“ছিঃ ছিঃ মুরগির বাচ্চা। আমার মতো একটা নীরিহ হাসের বাচ্চাকে তুমি এভাবে বলতে পারলে? এসব কথা বলার আগে তোমার বুকটা একটুও কাঁপলো না।”

পৃথা এই লোকের অভিনয় দেখে আর আশ্চর্য না হয়ে পারলো না। মিনিটে মিনিটে ভোল বদলায় এই আধপাগল লোক। পৃথা কপাল টান টান করলো। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,

-“না কাঁপেনি। আমার বাপ ভাইকে রা’জা’কা’র, আলব’দর, আল শা’মস বলতে আপনার যেমন বুক কাঁপেনি তেমনি আমারও আপনাকে ব্রিটিশ বলতে একটুও বুক কাঁপেনি।”

তুর্যের চোখদ্বয় ছোট ছোট হলো। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“বাপ ভাই মিলে ভালোই তো আমার বিরোধীতা করতে শিখিয়েছে। যাক ব্যাপার না আমিও দেখি এরা আর কি কি করতে পারে। দিন শেষে ঐ রাজা’কার’দের আমার মতো মুক্তি সেনাদের হাতেই পরাস্ত হতে হবে দেখে নিও।”

পৃথা অবাক হলো। অবাক কন্ঠেই বলল,

-“আপনি মুক্তি সেনা? আপনি তো ঘসেটি বেগমের বংশধর যাকে সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। নিজের স্বাধীন দেশকে পরাধীন করতে উঠে পড়ে লাগেন আপনারা।”

তুর্য চিন্তায় পড়লো। খুব একটা ভুল পৃথা বলেনি। সেদিন বিয়ের আসরে বউ তার ছিল এবং স্বাধীনও ছিল। কিন্তু সে কি করেলো সেদিন বিয়ের আসরে বউকে ত্যাগ করে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করে চলে গেল দূর দেশে। আর এখন সেই শিকল কেটে আবার বউকে স্বাধীন করার কত প্রচেষ্টাই না চালাচ্ছে। তুর্য ভাবুক ভঙ্গিতেই বলল,

-“এই প্রথম তুমি একটা সত্যি কথা বললে।”

পৃথা মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

-“আমি সব সময়ই সত্যি বলি।”

-“তা না হয় বুঝলাম। এখন একটা কাজ করো তো। তাড়াতাড়ি আমার বাসায় চলে এসো।”

তুর্যের কথায় ভাঁজ পড়লো পৃথার কপালে। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

-“আপনার বাসায় আমি কেন যাব?”

তুর্য ভাবলেশহী, নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল,

-“দেখবো তোমায়, দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষন। চলে এসো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা ভরকালো কিছুটা। কেমনভাবে তাকে অধিকার নিয়ে বাসায় যাওয়ার কথা বলছে পুরুষটা। সে কি তুর্যের বিয়ে করা বউ নাকি যে বললেই যেতে হবে? তাছাড়া পুরুষ মানুষকে লাই দিলেই লাই পেয়ে যায়। মথায় উঠে নাচতে শুরু করে। যেমন এই পুরুষ শুরু করেছে। দুই দিন একটু কথা বলেছে তাও ভলোভাবে না। তাতেই এখন অধিকারবোধ নিয়ে বাসায় যেতে বলছে। পৃথা কপালে ভাঁজ ফেললো। তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল,

-“আপনি বললেই যেতে হবে আমাকে? যাব না আমি আপনার বাসায়।”

তুর্য চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। সে ঠিক জানতো এই নারী তার আদেশকে সরাসরি না দ্বারা প্রতিহত করবে। এর এ ছাড়া তো আর কাজ নেই কোনো। তাই তো মনের ভিতরে আগে থেকেই সকল হুমকি ধামকি সাজিয়ে রেখেছে তুর্য। ছেলেটা হুমকির স্বরে পৃথাকে বলল,

-“তুমি আমার বাসায় আসবে নাকি আমি তোমার বাসায় চলে আসবো? কোনটা?”

থামলো তুর্য আবার বলল,

-“আমি তোমার বাসায় আসলে কিন্তু তোমার বাপ ভাইকে ধরে ধরে বলবো তুমি এখানে আমাকে আসতে বলেছো। আমি কিছুতেই আসতে চাইছিলাম না কিন্তু তোমার নাকি আমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে তাই জোর করে এনেছো।”

পৃথা বোকা বনে গেল। এসব কথা সে কখন বলল? ছেলেটা বানিয়ে বানিয়ে কেমন মিথ্যা বলছে। পৃথা চোখ বড় বড় করে বলল,

-“আমি এসব কথা কখন বললাম? মিথ্যাবাদী লোক একটা।”

-“সে তুমি জানো আর আমি জানি আর কেউ তো আর জানে না।”

পৃথা তেতে গেল। কটমট করে বলল,

-“বাবা তাহলে ঠিকই বলছে কিন্তু আপনি আমাকে মিথ্যা বলে ঘুরিয়েছেন।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“তোমার বাবা আমাকে নিয়ে আবার কি বলেছে?”

পৃথা অতটা ভাবলো না। সরল মনে জবাব দিল,

-“বাবা বলেছেন তিনি আপনাকে চিনেন না অথচ আপনি সেদিন গাড়িতে বলেছিলেন আমার বাবা আপনাকে ভালোভাবে চিনে।”

তুর্যের কপালের ভাঁজ হালকা হলো। সে তো আগে থেকেই জানতো এ কথা। ঐ প্রথম যেদিন শ্বশুরের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো সেদিনই তো সে বলেছিল,

-“রা’জা’কা’র’রা ভালো মানুষ চিনে না।”

এ আর নতুন কি? তুর্য পৃথার কথায় ততটা পাত্তা দিল না। মেয়েটাকে আবার হুমকি দিয়ে বলল,

-“আমার বাসায় আসবে নাকি আমি তোমার বাসায় আসবো? গাড়িতেই আছি আমি। গাড়িটা আমার বাসার সম্মুখে না থামিয়ে সোজা তোমার বাসার সম্মুখে থামাবো বলে দিলাম।”

পৃথা ভয় পেয়ে গেল। এই আধপাগল লোক যদি একবার তার বাড়িতে চলে আসে তাহলেই তো বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। তারপর যদি আবার ঐসব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে তবে তো আজ ম’র’তে হবে নির্ঘাত। পৃথা তাড়াহুড়ো করলো। ব্যস্ত হয়ে বলল,

-“আমি আসছি, এক্ষুনি আসছি।”

তুর্য বাঁকা হাসলো। হাত ঘড়ির পানে একবার তাকিয়ে বলল,

-“তাড়াতাড়ি এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার।”

কথাটা বলেই কল কাটলো তুর্য। পৃথা পড়লো মহা চিন্তায়। ভয়ে তো বলে দিল সে যাবে কিন্তু তুর্যের বাসায় যেতেও কেমন ভয় ভয় লাগছে। অত বড় ফ্ল্যাটে মাত্র দুইজন পুরুষের বসবাস সেখানে একা একটা মেয়ে যাবে যদি ওরা খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে পৃথার সাথে? যদিও মেয়েটার মনে হচ্ছে না তুর্য এমন কিছু করতে পারে তবুও এই অতি আধুনিক সভ্যতায় বিশ্বাস করতে কে আছে? দীর্ঘদিনের অতি পরিচিত মানুষগুলোও হুট করে নিজের রূপ বদলে নিতে দুইবার ভাবে না সেখানে তুর্য তো অপরিচিত এক পুরুষ। আবার না গিয়েও উপায় নেই কোনো। ছেলেটা একবার এ বাড়িতে চলে আসলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। মনের মধ্যে একরাশ চিন্তা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো পৃথা। কলেজ ব্যাগের মধ্য থেকে মরিচ গুলিয়ে রাখা একটা স্প্রের বোতল রাখলো তার কাঁধ ব্যাগে। নিজের নিরাপত্তার জন্য ব্যাগে সর্বদা এ মরিচ গোলানো স্প্রে রাখে পৃথা। আজও সে বোতল নিয়ে নিল নিজের নিরাপত্তার জন্যই। যদি তুর্য বা আরুশ তার সাথে অপ্রত্যাশিত কিছু করার চেষ্টা করে তবে সেও এর প্রয়োগ করবে। মনের মধ্যে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। বসার কক্ষে এসে সে আবারও মুখোমুখি হলো বাবার। সেই যে লোকটা এখানে বসেছে আর ওঠেনি। পৃথাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকালেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

-“আবার কোথায় যাচ্ছো?”

পৃথা অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বলল,

-“এই তো সামনের বিল্ডিং এ। আমার নতুন এক বান্ধবী ঐ বিল্ডিং এ বাসা ভাড়া নিয়েছে। কলেজে গেলাম না ঘরে একা একা বসে ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম ওর বাসা থেকে ঘুরে আসি একটু।”

পলাশ শিকদার মেয়েকে সন্দেহ করলেন না। উল্টো তিনি চাইছিলেন মেয়ে এই মুহূর্তে ঘরের বাইরে যাক। আবার বাইরে গেলে যদি তুর্যের সাথে দেখা হয়ে যায় সেই ভয়ে কলেজে যেতে দেয়নি। তবে সামনের বিল্ডিং যেতে তো বাঁধা নেই। সেখানে তুর্য আসবে কোথা থেকে। প্রথমে একবার ভাবলেন মেয়েকে এমনিই যেতে দিভে কিন্তু পরক্ষনেই কি ভেবে আবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লোকটা। পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“চলো আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।”

পৃথা চমকালো। ভয় ডানা বাঁধলো তার হৃদয়ে। বাবা তাকে দিয়ে আসতে যাবে? কোনোভাবে যদি পলাশ শিকদার একবার টের পেয়ে যায় পৃথা মিথ্যা বলেছে, সে কোনো বান্ধবীর বাড়িতে নয় বরং এক অপরিচিত পুরুষের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে তখন কি হবে? পৃথার গলা শুকিয়ে এলো। মেয়েটা আটকাতে চাইলো নিজের বাবাকে। জোরপূর্বক হেসে বলল,

-“তোমার যেতে হবে না বাবা। এই তো সামনের বিল্ডিং এ যাব আমি। তুমি আবার শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবে কেন?”

পলাশ শিকদার তাকালেন মেয়ের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-“আমার সাথে এসো নয়তো যেতে হবে না তোমাকে।”

পৃথা পড়লো মহা বিপাকে। না গিয়েও তো উপায় নেই তাহলে তুর্য এখানে চলে আসবে। আর বাবাকেও যদি এখন বলে সে যাবে না তবে নিশ্চই তার বাবা সন্দেহ করবে। বান্ধবীর বাড়িতে বাবার দিয়ে আসা নিয়ে আসা তো আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেখানে বাবা যাবে শুনেই যাব না বলাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। অগত্যা পৃথাকে তার বাবার প্রস্তাবে রাজী হতে হলো। মনের মধ্যে একরাশ ভয় নিয়ে চললো সে বাবার সাথে। নিজেদের বাসার পরে তিনটা বিল্ডিং রেখে চতুর্থ বিল্ডিং এর সম্মুখে এসে থামলো পৃথা। ঢোক গিলে পলাশ শিকদারকে বলল,

-“চলে এসেছি বাবা। এই বিল্ডিং এই আমার বান্ধবীদের বাসা।”

পলাশ শিকদার মেয়ের কথার সত্যতা পেলেন। এ বিল্ডিংটা তো তাদের বাসায় কাছেই, ধরতে গেলে সামনেই। তিনি আর ঘাটলেন না বিষয়টা নিয়ে। বিল্ডিং এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বললেন,

-“তুমি ভিতরে যাও তাহলে। আমি আসছি এখন।”

পৃথা এক প্রকার নিঃশ্বাস আটকে বাবাকে প্রশ্ন করলো,

-“তুমি ভিতরে যাবে না বাবা?”

-“না।”

পলাশ শিকদারের এক অক্ষরে উত্তর। পৃথা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক তার বাবা অনন্ত এখানে এসে একটা কাজের কাজ করলো। পলাশ শিকদার একবার বিল্ডিং এর ভিতরে গেলেই তো পৃথা ধরা পরে যেত বাজেভাবে। আর তারপর সোজা উপরে। পৃথা ঠোঁট টেনে একটু হাসলো। নম্রভাবে বলল,

-“আচ্ছা আমি ভিতরে যাচ্ছি।”

পৃথা বাক্যের সমাপ্তি ঘটিয়েই দ্রুত ঢুকে গেল বিল্ডিং এর ভিতরে। পলাশ শিকদারও আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে চলে এলেন নিজ বাড়িতে। বসার ক্ষে ঢুকতেই দেখা পেলেন পিয়াস এবং পিয়াল বসে রয়েছে সোফার উপরে। তাদের সাথে সুফিয়া বেগমও রয়েছেন। সকলের চোখ মুখে চিন্তার ছাপ। বাবাকে আসতে দেখেই পিয়াস উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

-“হুট করে কল করে আসতে বললে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

পিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই পিয়াল বলল,

-“ঐ তুর্য চৌধুরী আবার কোনো সমস্যা করেছে নাকি বাবা?”

পলাশ শিকদার একবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রী সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,

-“আমি পৃথার আবার বিয়ে দেব।”

পলাশ শিকদারের কন্ঠে তোলা প্রতিটি ধ্বনি যেন বিস্ফোরণ ঘটালো উপস্থিত সকলের মধ্যে। পিয়াস গোল গোল চোখ তাকালো বাবার পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

-“কি?”

পলাশ শিকদার পরপর আবার একটা বিস্ফোরণ ঘটালেন বসার কক্ষে। সোফার উপরে বসতে বসতে বললেন,

-“আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে পৃথাকে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল আকদ।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here