অবাধ্য_পিছুটান #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১৮

0
730

#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

সোফার উপরে বসতে বসতে বললেন,

-“আজ সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে পৃথাকে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল আকদ।”

সুফিয়া বেগম, পিয়াস, পিয়ালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলছে পলাশ শিকদার এসব? পৃথার আবার বিয়ে দিবে? পিয়াস হতবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পড়লো। বাবাকে এতদিন সে বেশ বিচক্ষণ মানব বলেই জানতো। কিন্তু আজ সে এ কেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? পিয়াস হতবাক স্বরে বলল,

-“এসব কি বলছো বাবা? পৃথার আবার বিয়ে? আজই পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

পলাশ শিকদার তাকালেন ছেলের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-“আমার মাথা ঠিকই আছে পিয়াস। এ ছাড়া আর উপায় নেই কোনো। তুর্য চৌধুরী ইতমধ্যে পৃথার সম্মুখে চলে এসেছে। এখন যদি মেয়েটাকে সে সবকিছু বলে দেয় তখন কি হবে ভেবেছো?”

বাবার সব কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো পিয়াস এবং পিয়াল। কেন যেন সে পলাশ শিকদারের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারছে না তারা। অতীতে তার পিতা মাতার একটা ভুলের কারনে পৃথার জীবনটা আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মাত্র দশ বছর বয়স ছিল মেয়েটার। কোনো বাবা সেই বয়সে কিভাবে একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে? তাও বিশ বছরের এক যুবকের সাথে? সে তো তুর্য বিয়ে না মেনে চলে গিয়েছিল বলে পৃথা বেঁচে গিয়েছিল। আর যদি তুর্য তখন বিয়েটা মেনে নিতো তখন কি হতো পৃথার? দশ বছর বয়সে একটা মানুষের না আসে শারীরিক পরিপক্কতা আর না আসে মানসিক পরিপক্কতা সেখানে তাদের বোন এমন এক বৈবাহিক সম্পর্ককে কিভাবে টেনে নিয়ে যেত সারাজীবন? বাবা মায়ের এমন কর্মে মাঝে মাঝে রাগ হয় পিয়াস এবং পিয়ালের। শুধুমাত্র তাদের সম্মান করে বিধায় মানুষ দুটোর মুখের উপর বলতে পারে না কিছু। আর তাছাড়া তারা এই সাত বছরে নিজের বাবা মায়ের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ততা দেখেছে। যারা নিজেরাই অনুতপ্ত হয়ে গুমড়ে গুমড়ে ম’রে প্রতিনিয়ত তাদের আর কি বলা যায়? কিন্তু এখন আবার কি শুরু করেছে পলাশ শিকদার? বহুদিন আগে নিজেদের কর্মকে ধুলিসাৎ করার জন্য আবার একই খেলায় মেতে উঠতে চাইছে। পিয়াল কিছুটা ক্ষেপে গেল বাবার উপর। সদ্য একুশ বছরে পদার্পণ করা যুবক পিয়াল। বয়সের ভারে শরীরের রক্ত টগবগে তার। পিয়াল কিছুটা ক্ষীপ্ত কন্ঠেই বাবার উদ্দেশ্য বলল,

-“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার বাবা? কিসের বিয়ে? একবার বিয়ে বিয়ে খেলায় মেতে আমার বোনটার জীবন নষ্ট করেছো এখন আবার কি চাইছো তুমি? তাছাড়া তালাক…”

এই টুকু বলতেই হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিল পিয়াস। বয়সের ভাড়ে সে বেশ বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ বটে। তাছাড়া বাবা মা ভক্তও বেশ। পিয়াস বেশ ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,

-“বাবা পৃথার বিয়ে দেওয়া ছাড়া কি আর ওকে তুর্যের থেকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই? ওকে তো আমরা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারি।”

পলাশ শিকদারের থমথমে মুখশ্রী। গম্ভীর কন্ঠে তিনি বললেন,

-“তোমার কি মনে হয় ওকে কোথাও পাঠিয়ে দিলেও সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তুর্য পৃথার আর খোঁজ করবে না? ছেলেটা যদি ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে আসতে পারে পৃথার খোঁজে তবে অন্য কোথাও কি যেতে পারবে। মনে রাখবে লোহা লোহা কাটে। তেমনি পৃথাকে একবার বিয়েটা দিয়ে দিলে তুর্য আর কিছুই করতে পারবে না।”

সুফিয়া বেগম এতক্ষন বসে বসে শুনছিলেন স্বামী সন্তানের কথা। তার ভীষন বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,

-“তাহলে পৃথাকে ওর কাছে দিয়ে দাও। তুর্য যখন ওকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে, মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে এতটা দূরে চলে এসেছে তখন আমাদেরও উচিৎ ওদের এক করে দেওয়া।”

হাজার হলেও মা তো। কোনো মা ই চায় না তার মেয়ের সংসার ভাঙুক। মনে মনে এত কথা বললেও সাহস করে স্বামীকে বলতে পারলেন না কিছুই। কারন মেয়ের জীবনের এই অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তিনিই। বহুদিন আগে নিজের বান্ধবীর সাথে সম্পর্কটা গাঢ় করার জন্য বান্ধবীর ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের আবদারটা সুফিয়া বেগমই করেছিলেন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন মহিলা। একটু সাহস জুগিয়ে স্বামীকে বললেন,

-“ওদের তো তালাক হয়নি এখনও। এর মধ্যে মেয়ের অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবাটাও কি অন্যায় নয়?”

পলাশ শিকদার তাকালেন স্ত্রীর পানে। থমথমে কন্ঠে বললেন,

-“অন্যায়! কিসের অন্যায়? অন্যায় তো করেছিল ঐ তুর্য আমার মেয়েকে বিয়ের আসরে ফেলে গিয়ে। বিয়ের দিনই সে নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিল। সাত সাতটা বছর আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর রাখেনি। একটা বারের জন্যও জানতে চায়নি আমার মেয়েটা বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে। এতগুলো বছর পরে আজ এসেছে আমার মেয়েকে বউ বলে দাবি করতে, বউকে নিতে।

থামলেন পলাশ শিকদার। আবার বললেন,

-“আমি মানলাম ভুলটা আমাদের ছিল। বিশ বছরের এক তরতাজা পুরুষের সাথে দশ বছরের এক কন্যার বিয়ে দেওয়া ছিল আমাদের চড়ম ভুল। তাই বলে ও আমার মেয়েকে ফেলে যাবে? আমার মেয়েটা তো কোনো দোষ করেনি। এমনকি ও তখন ভালোভাবে বিয়ের মানেটাও বুঝতে শিখেনি। ওর জন্য, শুধুমাত্র ওর জন্য আমার মেয়েটাকে কত কি না সহ্য করতে হয়েছে, এলাকা পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে আমাদের। তারপরেও সবটা মেনে নিয়েছিলাম। পৃথার জীবনের অতীতের কিছুই সামনে আনিনি ওর। কিন্তু এখন তুর্য এসে কোথা থেকে জুটলো? আবার বউ‌ বলে দাবি করছে আমার মেয়েকে। এতদিন কোথায় ছিল সে? কই আমার মেয়ের খারাপ সময়ে তো তাকে দেখিনি মেয়ের পাশে। যাক ধরে নিলাম বিয়ের দিনের ঘটনায় রেগে চলে গিয়েছিল। নিজের পাশে একজন নাবালিকা মেয়েকে মানতে পারেনি কিন্তু তারপর! তারপর কেন ও এই সাতটা বছর আমার মেয়ের খোঁজ খবর নিল না? ও অন্তত একটা কল করে মাফ চাইতে পারতো সবার থেকে। একবার বলতে পারতো ও বিয়েটা মেনে নিয়েছে তাহলে তো আর আমার মেয়েটাকে সমাজের চোখে ছোট হতে হতো না, সমাজ পরিবার বাজে মন্তব্য করার সুযোগ পেত না।

পলাশ শিকদার থেমে গেলেন আবারও। একটু সময় নিয়ে বললেন,

-“আমি সেই ছেলের হাতে আমার মেয়েকে কখনওই তুলে দেব না যে ছেলে আমার মেয়েকেই বিয়ের আসরেই ত্যাগ করেছিল।”

পলাশ শিকদারের প্রতিটি কথা সত্যি। এরপরে আর কিছু বলার থাকে না কারোরই। তবুও পিয়াস বলল,

-“তাই বলে তালাকহীন একটা মেয়েকে তুমি অন্যত্র বিয়ে দিতে পারো না বাবা।”

-“এমনিও ওদের বিয়ের রেজিস্টি হয়নি। তখন পৃথার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। এত অল্প বয়সে বিয়ে আইন বহির্ভূত।”

সুফিয়া বেগম ইতস্তত করলেন। আমতা আমতা করে বললেন,

-“তবুও তালাকের একটা ব্যাপার আছে। শরিয়ত মোতাবেক তো বিয়ে হয়েছিল ওদের।”

পলাশ শিকদার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রীর পানে। তীক্ষ্ম কন্ঠে বললেন,

-“তা আমি বুঝে নেব। তালাক দিইয়ে আমি বিয়ে দেব আমার মেয়ের। তবে পাত্রপক্ষ আজ সন্ধ্যায় পৃথাকে দেখতে আসবে তা জেনে রেখো।”

২২.
পৃথা দাঁড়িয়ে আছে তুর্যের ফ্ল্যাটের দরজার সম্মুখে। ভিতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে মেয়েটা। পৃথার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই খুলে গেল দরজাটা। মেয়েটা প্রথমে ভরকে গেলেও পরক্ষনে সামলে নিল নিজেকে। চোখ তুলে সম্মুখ পানে তাকিয়ে দেখলো তুর্য হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথা আমতা আমতা শুরু করলো। তবে সে কিছু বলার আগেই তুর্য বলল,

-“এত দেরী করলে কেন? সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি।”

পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-“আপনার সাথে কথা বলার বড়জোর পনেরো মিনিটের মধ্যে এসেছি আমি। এটা দেরী?”

তুর্য মৃদু হাসলো। অতঃপর বলল,

-“তোমার অপেক্ষার কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত যে কতটা ব্যথাদায়ক তা যদি তুমি একটা বার বুঝতে তবে আর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে না।”

কথার ইতিতে গিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো ছেলেটা। দরজা থেকে সরে গিয়ে আবার বলল,

-“এসো ভিতরে এসো।”

পৃথা ভিতরে গেল। কাঁধ ব্যাগটা বসার কক্ষের সোফায় রাখতেই তাকে তাড়া দিল তুর্য। ছটফটে কন্ঠে বলল,

-“বসবে পরে, আগে রান্নাঘরে চলো।”

পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

-“রান্নাঘরে কেন যাব? আমি কিন্তু রান্না টান্না একদম পারি না। আপনি যদি আমাকে এখানে রান্না করার উদ্দেশ্যে এনে থাকেন তবে বলে রাখি আপনি ভুল স্থানে ভুল কার্যক্রম চালাতে চাইছেন।”

পৃথার কথায় তুর্য শরীর দুলিয়ে হাসলো। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

-“তোমাকে রান্না করতে হবে না। আমি রান্না করবো তুমি চেয়ে চেয়ে শুধু দেখবে। এসো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা অবাক হলো। অবাক সুরেই প্রশ্ন করলো,

-“আপনি রান্না করতেও পারেন?”

-“পারি তো। ইংল্যান্ডে যখন ছিলাম তখন তো একা একা রান্না করেই খেয়েছি।”

পৃথা হাসলো তৎক্ষণাৎ। মুখে হাত দিয়ে বলল,

-“আপনি ইংল্যান্ডে থাকতেন? তবে আপনাকে ব্রিটিশদের বংশধর বলে ভুল করিনি তো।”

তুর্য শীতল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। মৃদু হেসে বলল,

-“তুমি কখনও ভুল করোনি।‌ যা ভুল ছিল আমার ছিল আর তার শাস্তিও ভোগ করছি ভীষণ বাজে ভাবে।”

পৃথার ওষ্ঠের হাসি উবে গেল। নরম দৃষ্টিতে সে তাকালো তুর্যের পানে। কোমল কন্ঠে শুধালো,

-“কি ভুল করেছিলেন আপনি?”

তুর্য হাসলো আবারও। ভীষন সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যেতে চাইলো পৃথার প্রশ্নটা। একটা ঝুড়িতে কিছু চাল নিয়ে সে হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-“আমি রান্না করবো আর তুমি শুধুমাত্র বসে বসে খাবে তা তো চলবে না। চালটা ধুয়ে নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো চাল ধুতে শুরু করলো। ক্ষানিক সময়ের ব্যবধানে চাল ধোয়া শেষ করে মেয়েটা খেয়াল করলো তুর্য একটা ছু’রি দিয়ে সবজি কাটছে। পৃথা এগিয়ে গেল সেদিকে। তুর্যকে বলল,

-“দিন আমি করছি। আপনি বরং রান্না চাপান।”

তুর্য সাথে সাথে নাকোচ করে দিল পৃথার এ প্রস্তাব। সবজি কাটতে কাটতে বলল,

-“তার কোনো প্রয়োজন নেই। পরে দেখা যাবে সবজির বদলে ছু’রি নিজের হাতে চালিয়ে দিয়েছো।”

পৃথার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। সে মানলো না তুর্যের কথা। বরং ছেলেটার হাত থেকে ছু’রি’টা কেড়ে নিয়ে বলল,

-“সরুন আমি কাটছি।”

তুর্যও এবার আর কিছু বলল না। সবজি কাটার দায়িত্ব সে পৃথাকে দিয়ে গেল রান্নার দিকে। মেয়েটা সবজি কাটছিল আর আড়চোখে দেখছিলো তুর্যকে। চুলার আঁচে ছেলেটার ফর্সা মুখটা কেমন রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উৎপাত দেখা যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে রান্নার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। পৃথা যেন তুর্যের এই রূপেই হারিয়ে গেল মুহুর্তেই, মুগ্ধ হলো তার দৃষ্টি। এতদিন ঝগড়ায় ঝগড়ায় নিজের ক্রাশ খাওয়াকে দমিয়ে রাখলেও আজ আর পারলো না। ছোট খাটো একটা ক্রাশ খেয়ে বসলো তুর্যের উপরে। আর সাথে বেখেয়ালিতে নিজের হাতটাও কেটে বসলো অবশেষে। সে সত্যিই তুর্যকে দেখতে গিয়ে সবজির বদলে হাতেই ছু’রি চালিয়ে দিয়েছে। তবে খুব বেশি কাটার আগেই লাফিয়ে দূরে সরে গেল মেয়েটা। কন্ঠে তুললো “আহহহ” মূলক ব্যথাতুর ধ্বনি। হকচকালো তুর্য। চুলার দিক থেকে পাশ ফিরে তাকিয়েই দেখলো পৃথার বাম হাত কেটে লাল রক্তের আভাস দেখা দিয়েছে। অস্থির হয়ে উঠলো ছেলেটা। দ্রুত এলো পৃথার নিকট। মেয়েটার কাটা হাত খানা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলল,

-“কি হয়েছে দেখি।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here