#অবাধ্য_পিছুটান
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সুফিয়া বেগম ব্যস্ত হয়ে আটকালেন আবারও অতঃপর বললেন,
-“পিছনের দরজা দিয়ে যা।”
-“কেন?”
-“দেখছিস না বসার কক্ষে মানুষ। ঝামেলা হচ্ছে। ঝামেলার মধ্য থেকে যাওয়ার দরকার কি?”
সুফিয়া বেগম ভুল কিছু বলেননি। পৃথা শুনলো মায়ের কথা অতঃপর সে পিছনের দরজা থেকেই বেরিয়ে গেল বান্ধবীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তুর্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো পৃথার। শ্বশুর শালাদের বারবার বেড়িয়ে যেতে বলাকে বেহায়ার মতো উপেক্ষা করে বসে রইলো ছেলেটা। অথচ তার বউয়ের দেখা নেই। হয়তো এই রাজা’কার শ্বশুর আর আল’বদর আল শা’মস শালারা মিলে তার বউটাকে কোথাও সরিয়ে দিয়েছে। নতুবা এতক্ষনেও কি একবার এদিকটায় আসতো না? তুর্য কপাল কুঁচকে ভাবলো কিছুক্ষণ। পলাশ সিকদার যদি পৃথাকে ইচ্ছেকৃতভাবেই সরিয়ে দিয়ে থাকে তবে এভাবে এখানে বসে থেকে লাভ কি? পৃথাকে তার ভয়ে সরিয়ে দিয়ে থাকলে অবশ্যই সে যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকবে ততক্ষনে মেয়েকে বাড়িতে আনবে না। নাহ এভাবে এখানে বসে থাকাটা ঠিক হবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। যেভাবেই হোক বউকে তো নিজের নিকট নিতেই হবে। তুর্য বিচক্ষণ ভঙ্গিতে তাকালো বসার কক্ষের আনাচে কানাচে। পলাশ সিকদারের পানে তাকিয়ে বলল,
-“প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে এলাম অথচ শ্বশুর আর শা’লাদে’র ব্যবহারের কি শ্রী। একবার শুধু বউটাকে পাই তারপর জামাই আদর কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেব এই বলে রাখলাম।”
পলাশ সিকদার বিরক্তি নিয়ে তাকালেন তুর্যর পানে। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“না আমার বাড়ির জামাই আদর তোমার কপালে আছে আর না আমার মেয়ে তোমার কপালে আছে। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”
তুর্যর দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“চারদিকে শুধু রাজা’কার, আল’বদর, আল শা’মস এ ভরপুর। তাতে কি? আমি কি কম শক্তিশালী নাকি? ১৯৭১ সালের যুদ্ধে এই রাজা’কার জনগোষ্ঠী পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়ে কম চেষ্টা তো করেনি তাদের জিতিয়ে দেওয়ার। তবুও শেষ পর্যন্ত জয় লাভ বাঙালিরাই করেছে। তেমনি আমিও জিতবো। একদিন না একদিন এই রাজা’কারদের হাত থেকে আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে উদ্ধার করবোই করবো।”
এই টুকু বলে থামলো তুর্য। আবার বলল,
-“বেহায়া যখন হয়েছি, বেহায়া আরও হবো।
তবুও আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে উদ্ধার করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”
পলাশ সিকদার, পিয়াস এবং পিয়াল তিনজনই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। তুর্য উঠে দাঁড়ালো, তাদের এই দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে গলায় ঝুলানো চশমাটা চোখে পড়লো। অতঃপর আরুশকে আদেশ দিল,
-“আরুশ চল আমরা। এখানে থেকে আর কাজ নেই আমাদের।”
কথাটা বলেই তুর্য ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। আরুশ একবার দুই পুত্রসহ পলাশ সিকদারের পানে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। বাইরে এসে দেখলো তুর্য বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আরুশ অবাক হলো। নিজের বসের নিকট এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“স্যার কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন?”
তুর্য তাকালো আরুশের পানে। চোখ থেকে চশমা খুলে বলল,
-“তোর বের হতে এত দেরী হলো কেন আহাম্মক। দেখছিলি তো ঐ রাজাকার আর তার রক্তে গড়া দুইটা আল’বদর, আল শা’মস আমার দিকে কি ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। আর একটু হলেই মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে বিধবা করে দিয়ে আমি অক্কা পেয়ে যাচ্ছিলাম, বাবাহ!”
আরুশ বলল না কিছুই। ড্যাব ড্যাবিয়ে শুধু চেয়ে রইলো তুর্যের পানে। ছেলেটা বোঝার চেষ্টা করলো তুর্য কি সত্যিই বলছে নাকি অভিনয় করছে? কারন তুর্যের সাথে সে যতদিন আছে এর মধ্যে কখনও কাউকে ভয় পেতে দেখেনি সে। তার উপরে আবার অভিনয়ে পাকা পোক্ত এই লোক। আরুশকে মেয়েদের মতো এভাবে ড্যাব ড্যাবিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো তুর্য। কপাল কুঁচকে বলল,
-“তুই কি আমাকে মারতে চাস মীর জাফরের বংশধর? তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি চালু কর। বলা তো যায় না কখন আবার ঐ রাজা’কার তার দলবল নিয়ে আমার মতো হাঁসের বাচ্চার উপর হানা দেয়।”
একটু থামলো তুর্য। গাড়িতে উঠে বসলো অতঃপর ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
-“আমি বোধহয় একটা ভুল করেছি আরুশ।”
আরুশ ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল,
-“কি স্যার?”
তুর্য বড়ই নীরিহ মুখ করে জবাব দিল,
-“আমার শ্বশুরের নামটা রাজা’কাররের সাথে সাথে শিয়ালও রাখা উচিৎ ছিল বোধহয়। ব্যাটার শুধু হাস মুরগির উপর নজর। দেখছিস না আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে আটকে রেখেছে আবার হাসের বাচ্চার মতো আমিটাকে ধাওয়া করছে।”
আরুশ শুনলো তুর্যের কথা। তার ভীষনভাবে বলতে ইচ্ছে হলো,
-“কই আপনাকে তো কেউ ধাওয়া করেনি। আপনার শ্বশুর আর শা’লা’রা এতক্ষনও তো অনেকবার রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়েছিল আপনার দিকে আবার মা’র’তে’ও এসেছিল। কই তখন তো ঠিক তেজী স্বরে তাদের সাথে কথা বলেছেন, বেহায়ার মতো বসে রয়েছেন। এবার নিশ্চই কিছু একটা ভেবে এভাবে ঢং দেখিয়ে পালিয়ে এসেছেন আবার শ্বশুরের বদনামও করছেন।”
মনে মনে এতগুলো কথা বললেও মুখে কিছু বলার সাহস হলো না আরুশের। এখন কিছু বলা মানে নিজের গলায় নিজে ফাঁ’সি চড়ানো। এই কথাগুলো একবার যদি আরুশের মুখ থেকে কোনোভাবে বের হয় দেখা যাবে তার বস তার ঘাড় ধরে রাস্তার কোনো বড়সড় ট্রাকের নিচে ফেলে বলছে,
-“যা মীর জাফরের বংশধর ট্রাকের চাকার নিচে পিষে চ্যাপ্টা হয়ে যা।”
নিজের জানের মায়া সব প্রানীর আছে। আরুশও তাই চুপ রইলো। চুপচাপ নিজের গাড়ি স্টার্ট করলো।
৭.
পড়ন্ত বিকাল। সূর্যটা তার তেজ কমিয়ে ঢলে পড়েছে ইতমধ্যে। আকাশের এক কোন জুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে নিজের বিদায়ের। তুর্য এই কর্ষনে এসেও দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথাদের বাড়ির সম্মুখে। বিকালের দিকে হুট করেই কল এলো আগামীকাল ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। ব্যবসার জরুরী কাজ পড়েছে। দেশে ফিরেছে খুব বেশিদিন হয়নি। আর যে কয়টা দিন হয়েছে তাও বউ খোঁজার পিছনেই লাগিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ ওদিকে ব্যবসা পড়ে রয়েছে তার নিজ গতিতে। এখন সে গতিতেও তো গা ভাসাতে হবে। নয়তো বউকে খুঁজে পেলেও তাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে অক্ষম হবে তুর্য। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো ছেলেটা। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো পলাশ সিকদারের বাড়ির দিকে। যদি একটা বার দেখা পাওয়া যায় তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটার। তাকে দেখার যে হৃদয়ে বড় তৃষ্ণা জমেছে সেই বহুদিন আগে থেকে।
পৃথা তাদের বাড়ির ছাদেই ছিল। একা একা ঘুরছিলো পুরো ছাদময়। মাথায় তার গভীর চিন্তা। দুপুরে তার মা হঠাৎ তাকে রিদিদের বাড়িতে কেন পাঠালো মাথায় ঢুকছে না। ও বাড়িতে গিয়ে দেখলো রিদি কলেজে গিয়েছে। তাহলে সে কল করলো কিভাবে? মাকে এসে প্রশ্ন করলে মা উল্টো রাগ দেখিয়ে বলল,
-“আমি কি তোকে মিথ্যা বলেছি? হবে হয়তো রিদি কল করেনি অন্য কেউ করেছে। আমি রিদি ভেবেছি।”
কিন্তু কথা হলো যদি রিদি কল না করে তাহলে কে কল করেছিলো? তার উত্তরও সুফিয়া বেগম দিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন,
-“আমি কি জানি? আমি তো রিদি ভেবেছিলাম।”
পৃথা নিজ মনে দুপুরে ঘটা ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে তাকালো রাস্তার দিকে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল রাস্তার ওপাশে। তুর্যকে দেখে বিন্দুমাত্র চিনতে অসুবিধা হলো না মেয়েটার। এ তো সেই ব্রিটিশ লোকটা। পৃথার ভ্রু কুঁচকে এলো। এই লোকটা এখানে কি করছে? তুর্যকে সম্মুখে দেখেই মেজাজ বিগড়ালো পৃথার। একে একে মনে পড়লো সকল অপমানের কথা। দাঁত কিড়মিড় করে আশেপাশে তাকালো পৃথা। হঠাৎ ছাদের এক কোনে পড়ে থাকা কিছু ইটের টুকরা চোখে পড়তেই মাথায় খেলে গেল শয়’তানি বুদ্ধি। ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো মেয়েটা। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ইটের টুকরা গুলোর নিকটে। একটু ঝুঁকে হাতে তুলে নিল বেশ বড়সড় একটা টুকরাটা। অতঃপর ছাদের কিনারে এসে এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ দ্বারা নিশানা করলো তুর্যর ফর্সা কপালটা। সময় ব্যয় না করে ডান হাত দ্বারা দ্রুতই ইটের টুকরাটা ছুঁড়ে মারলো তুর্যের কপাল বারাবর। বাহ ইটের টুকরাটা খুব সুন্দরভাবেই লেগে গেল তুর্যের কপালে। চমকে উঠলো তুর্য। দ্রুত নিজের ডান হাত তুলে কপাল চেপে ধরলো। কন্ঠে তুললো “আহহহ” মূলক ব্যথাতুর ধ্বনি। পৃথা দ্রুত বসে পড়লো আড়ালে যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। তুর্য কপালে হাত দিয়েই আশেপাশে তাকালো। নাহ কোথাও দেখা যাচ্ছে না কাউকে। তাহলে ইটের টুকরাটা কে মারলো? নিশ্চই তার রাজা’কার শ্বশুরের দলের কেউ। এ ছাড়া এখানে তো তার কোনো শত্রু নেই। তুর্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কপাল থেকে হাত নামিয়ে ধরলো চোখের সম্মুখে। দেখলো কিছুটা লাল র’ক্ত লেগে আছে হাতে। তুর্য কপাল টানটান করে দেখলো সে রক্ত। অতঃপর হতাশ কন্ঠে বলল,
-“আসলাম মুরগির বাচ্চার মতো বউটাকে খুঁজতে। আর বাড়ি ফিরতে হচ্ছে হাসের বাচ্চার মতো আমিটার কপাল ফাটিয়ে।”
৮.
সূর্যটা আকাশ দখল করেছে। চারদিকে নিজের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। তুর্যর ঘুম ভাঙেনি এখনও। হোটেলের শুভ্র রঙা বিছানা দখল করে উদম শরীরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। কোমড় অব্দি পাতলা চাদর টানা। ফর্সা পিঠটা দৃশ্যমান জানালা থেকে আসা মৃদু আলোয়। উস্কো খুস্কো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কপাল জুড়ে। তুর্যর ঘুমের মধ্যেই কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। বাহির থেকে আরুশ দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো,
-“স্যার! স্যার!”
আরুশের ডাক কর্ণে পৌঁছাতেই বিরক্ত হলো তুর্য। ঘুমের মধ্যেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো ছেলেটা। আরুশ আবার ডাকলো,
-“স্যার নয়টা বেজে গেছে। আমাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।”
নয়টা বেজে গেছে! তুর্যর কর্ণে আঘাত হানলো কথাটা। এত দেরী হলো আজ তার ঘুম ভাঙতে? আজকেই তো বেশ কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় চলে যেতে হবে তাকে। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করার আগে একবার পৃথার কলেজে যেতে চাইছিলো। অথচ ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই নয়টা বাজিয়ে দিল। সব এই মেয়েটার দোষ। কাল রাতে বউয়ের চিন্তায় চিন্তায়ই তো ঘুমাতে দেরী হয়েছে। না মেয়েটা ধরা দিচ্ছে তার নিকট আর না শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে। ধপ করে চোখ মেললো তুর্য। দুই হাতে ভর করে বিছানায় উঠে বসলো। মুহুর্তেই ফর্সা শরীর থেকে খসে পড়লো পাতলা চাদরটা। দৃশ্যমান হলো প্রসস্ত বক্ষের পেটানো ফর্সা শরীর। কালো বড় বড় লোমে আবৃত সে বক্ষস্থল। নাভির নিচে পড়নের প্যান্টটা স্থান পাওয়ায় পেটে দুই চারটা ভাঁজ স্পষ্ট। ডান হাত তুলে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল ছেলেটা অতঃপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর কন্ঠে আরুশকে বলল,
-“তুই যা এখানকার সব কাজ কর্ম মিটিয়ে নে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এক্ষুনি।”
চলবে…..
NOTE : আজকের পর্বে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিছু লাইন টেনেছি। এগুলো কোনোভাবেই আমি মুক্তিযুদ্ধকে হেয় বা বিকৃত করার মানসিকতা নিয়ে করিনি। শুধুমাত্র পাঠকদের বিনোদন দিতে লাইনগুলো টেনেছি। তবুও যদি কারো সমস্যা হয় অবশ্যই জানাবেন আমি লাইনগুলো কে’টে দেব।