#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ২২
বাহিরে ভারী বর্ষণ ভিতরে মাহানুরের এমন রসিকতা দেখে কপালে কয়েক ভাঁজ পরলো আরহামের। কাশতে কাশতে আর হাঁচি দিতে দিতে তার অবস্থা খারাপ। তার ওপর আবার অসহ্য মাথার ব্যাথা। মাহানুর মুখ ভনিতা সিরিয়াস করে আরহামের কপালে হাত দেয়। মাহানুর একদম স্বাভাবিক ভাবেই আরহামের তাপমাত্রা চেক করলো। আরহাম নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো। ধক করে উঠলো তার চিত্ত। অশান্ত হয়ে ধুরুম ধুরুম শব্দ করতে লাগলো। সেও মাহানুরের হাতের স্পর্শ পেতে চায় এটাই বুঝাতে চাচ্ছে। আরহাম ঘোলাটে নজরে শুধুই তাকিয়ে থাকলো।
-আপনার শরীর প্রচন্ড মাত্রায় গরম। বৃষ্টি সহ্য করতে পারেন না তাহলে কেনো হিরোগিরি করে ভিজতে গেলেন! ওয়েট আমার কাছে মেডিসিন আছে।
মাহানুর দ্রুত তার ব্যাগ নিয়ে বিছানায় বসে। মেডিসিনের ছোট ব্যাগ বের করে জ্বরের ঔষধ খুঁজতে লাগলো। সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজে বুঝলো সে সব ঔষধই এনেছে শুধু জ্বরেরই কোনো ঔষধ আনেনি। আরহামকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহানুর মেকি হেসে বলল,
-আসলে আমি না জ্বরের কোনো মেডিসিনই আনিনি। গেস্টিকের মেডিসিন আছে। দেবো?
-এক কাজ করো এখানের সবগুলো মেডিসিনই আমাকে খাইয়ে দেও! তারপর ওয়েট করতে থাকো আমার ম’রার!
দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল আরহাম। মাহানুর বলল,
-তাওবা তাওবা! এতো খারাপ ওয়াইফ আমি নই। মা’রার হলে কোনো পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো এই কয়েকটা ঔষধ খাইয়ে মা’রবো না।
-স্বপ্ন পরে পূরণ করিও এখন আমার ব্যাগে যেয়ে দেখো। রিদ কয়েকটা মেডিসিন দিয়েছিলো সেখানে আছে কী না।
-ওকে।
মাহানুর ব্যাগের আনাচে কানাচে খোঁজে তবে একটা ঔষধও পায় না। কাশতে কাশতে আরহামও শেষ প্রায়। মাহানুর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
-কোনো ঔষধই তো নেই ব্যাগে! এক কাজ করি রিদ ভাইয়াকে কল করি।
-হ্যাঁ। দেও।
-কিন্তু এখন রাত একটা তিন বাজে। সে জেগে থাকবে?
-হ্যাঁ থাকবে। তুমি ল্যাপটপ দিয়ে ভিডিও কল দেও।
-ঠিক আছে।
মাহানুর আরহামের ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসলো। কয়েকবার কল দেওয়ার পর এক পর্যায় রিদ কল রিসিভ করলো। বিরক্তকর ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বলল,
-শালা নিজে তো ঘুমাস না এখন আমার ঘুমও হারাম করছিস! এখন কোনো কল দেওয়ার সময়?
-রিদ ভাইয়া শালা না শালী! আমি মাহানুর।
তন্দ্রা উড়ে গেলো রিদের। হাত ধারা আঁখিজোড়া ডলে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। বিচলিত মুখে মাহানুরকে দেখে বলে,
-আরেহ শালিসাহেবা যে! এতো রাতে আমি আপনাদের কী কাজে আসতে পারি?
-আপনার বন্ধুর বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হঠাৎ করে ভীষণ জ্বর হয়েছে। আপনি নাকি তার ব্যাগে মেডিসিন ভরে দিয়েছিলেন? কোথায় আমি তো পেলাম না!
-আহারে আমার দোস্তের কিসমতে হানিমুন নেই! যা আরহাম বেটা তোর আগে আমিই বাপ হয়ে যাবো।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে আরহাম। মাহানুর কপালে হাত দিলো। তারা চিন্তায় মরে যাচ্ছে আর এই লোক শয়’তানি করছে!
-ভাই কোথায় রেখেছেন যদি একটু বলতেন?
-ওহ ইয়েস। একদম বড় চেইনের ভিতরে একটা সিক্রেট চেইন আছে সেটা খুললেই পেয়ে যাবে।
-আচ্ছা।
মাহানুর ব্যাগ নিয়ে বসে। বড় চেইন খুলতেই হঠাৎ রিদের কিছু একটা মনে পরে যায়। দ্রুত কণ্ঠে বলল,
-ধেৎ! শালিসাহেবা ওয়েট ওয়েট। আরহাম তুই খুলে বের কর।
মাহানুর আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম চোখ বন্ধ রেখে শান্ত হয়ে বলল,
-মাহানুরই খুলুক তেমন আহামরি কিছু নেই।
-আরেহ বেটা!
রিদ আরহামকে কিছু একটা বুঝাতে চাইলো কিন্তু আরহাম কিছুই বুঝলো। হাঁসফাঁস করতে লাগলো রিদ। মাহানুর চেইন খুলেই মৃদু কণ্ঠে একটা চিৎকার দিলো।
-ইয়াক! কেমন মেডিসিন ভিতরে!
আরহাম বুঝলো না মাহানুরের কথার মানে। মাহানুরের মনে ঘটকা লাগলো। ব্যাগ উল্টো করে সবকিছু বিছানায় ফেললো সে। নিদিষ্ট কিছু জিনিসের ওপর নজর যেতেই আরহাম বিব্রত হয়ে মাথা সহ কপাল চেপে ধরলো। রিদকে অসংখ্য ভয়ংকর ভয়ংকর গা’লি দিতে লাগলো। সামনে পেলে সে এখন রিদকে কাঁচা চিবিয়ে খেত!
-রিদের বাচ্চাআআআআ!
রিদ ততক্ষণে কল কেটে দিয়ে পালিয়েছে। মাহানুরের ছানাবড়া আঁখিজোড়ায় মুহূর্তেই রাগের আভাস দেখা যায়। আরহাম জানে এখন কথা শুনতে শুনতে অর্ধেক ম’রে যাবে সে। তাই আলগোছে জ্বরের ঔষধ নিয়ে নিলো।
-এইসব কী?
আরহাম কোনোরকম পানি নিয়ে ঔষধ খেয়ে নিঃশাস ছাড়লো। গ্লাস রেখে বিছানার দিকে যেতে যেতে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-তুমি বাচ্চা মেয়ে নও যে এগুলো চেনো না!
-আচ্ছা আপনি কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন আমার সাথে?
আরহাম বিছানায় বসলো। এমনেই তার মাথায় আগুন চড়ে আছে তার ওপর মাহানুরের খামোখা চিৎকার চেঁচামেচি ভালো লাগছে না তার। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে,
-এগুলো তেমন আহামরি জিনিস নয় জাস্ট জ’ন্মনি’য়ন্ত্রণ । তাই এতো রিএক্ট করারও প্রয়োজন নেই।
-এইসব আপনার ব্যাগে কিভাবে আসলো? সাথে নিয়ে ঘুরেন?
-ওহ গড! আমার ব্যাগে যা যা ছিল সব রিদ ভরে দিয়েছে। আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি ও এইরকম কিছু দেবে!
-সে কোথা থেকে পেলো? আর অবিবাহিত মানুষদের এইসব দিয়ে কী কাম?
-ফার্মেসি থেকে নিয়েছে হয়তো। তোমার বাকি প্রশ্ন সকালে রিদকে কল করে জিগ্যেস করিও এখন আমাকে ঘুমোতে দেও।
কথা বলতে বলতে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো আরহাম। মাহানুর থম মেরে বসেই রইলো।
________________
বর্ষণ থেমে এক উজ্জ্বল সূর্যের দেখা মিলেছে সকালে। হালকা বাতাস আবার একটু রোদ আবহাওয়াটা মন্দ নয়। সকাল ছয়টা বাজে এখন। সূর্যের কিরণ দেখে মাহানুরের মন নেচে উঠলো। আজ তারা সারাদিন ঘুরবে তাই বৃষ্টি কামনা করছে না সে। জানালার পর্দা ফাঁক করে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে একবারে জামা পরিবর্তন করে আসে মাহানুর। আরহামের তন্দ্রাও ততক্ষণে ভেঙে গিয়েছে। মাহানুর আজ হাটু পর্যন্ত ব্ল্যাক টপ আর জিন্স পেন্ট পরে। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করে নেয়। মুখে একটু পাওডার আর ঠোঁটে লিপগ্লোস দিয়ে নিলো। আজ তারা চেরাপুঞ্জি যাবে। চেরাপুঞ্জির স্থানীয় নাম হচ্ছে সোহরা। চেরাপুঞ্জিতে পাহাড়ের অপরূপ রূপের সাথে আছে মেঘের হাতছানি। কোথাও সরু পাহাড়ি রাস্তা, কোথাও গভীর খাদ। সারাদিন এই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে সন্ধ্যার পূর্বে তারা আবার এখানে ফিরে আসবে।
আরহাম বের হলো। সেও কালো শার্ট জড়িয়েছে গায়ে আর হাটু পর্যন্ত সাদা রঙের পেন্ট। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তারা আজ সেম কালার ড্রেস পরেছে। মাহানুর রাতের পর আরহামের দিকে তাকাতেও দ্বিধাবোধ করছে। আরহাম ফোনে কিছু একটা করতে করতে বলল,
-আপনি ব্যাগপ্যাক কী রেখে যাবেন মেডাম?
মাহানুর হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। আরহাম নিজের ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করতে করতে বলল,
-ট্যুরে এসেছেন অথচ ট্যুরের অভিজ্ঞতা নেই! ব্যাগ সাথে করে নিয়ে চলুন সেখানে অনেকসময় অনেক জিনিসের প্রয়োজন হবে। আপনার সর্বপ্রথমই প্রয়োজন পরবে ড্রেসের।
-ড্রেসের কেনো? আমি কী খালি গায়ে যাচ্ছি?
আরহাম ব্যাগ গুছিয়ে চেইন লাগাতে লাগাতে তপ্ত নিঃশাস ছাড়লো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-সেখানকার জলপ্রপাত দেখে গোসলের জন্য লাফাবেন আপনি। তাই ড্রেস অতি প্রয়োজন।
-গোসল করা যাবে?
-হ্যাঁ।
-ওয়াও! ধন্যবাদ বলার জন্য। আর আপনি আপনি বলতে হবে না আমার নিজেকে বুড়ি মনে হয়।
-বুড়িকে তো বুড়িই মনে হবে!
-অ্যাই, একদম বেশি বলবেন না।
-আচ্ছা। এখন চলো।
মাহানুর কাঁধে ব্যাগ জড়াতে জড়াতে কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল,
-আপনার শরীর এখন কেমন আছে?
-বেশ ভালো।
মাহানুর আর কিছু বলল না। আরহাম মুচকি হাসলো। ব্যাগ নিয়েই একবারে বেরিয়ে পরলো দুইজন। আরহাম হাঁটতে হাঁটতে মাথায় কালো ক্যাপ, কালো ম্যাক্স আর সানগ্লাসে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে নিলো। আর মাহানুর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে নিলো। আরহাম সেটা দেখে গলা ঝেরে জিগ্যেস করলো,
-মেন্টেলের সাথে আবার কানাও নাকি?
-শাট আপ। ধুলোবালিতে আমার এলার্জি তাই চশমা পরতে হয়।
-ওহ!
সবাই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত। একসাথে নাস্তা করতে একটা রেস্তোরাঁ ঢুকে। মাহানুর রাকাকে পেয়ে আরহামকে ভুলেই গেলো। দুইজন একসাথে বসে বকবক করতে থাকে। হেবা আড়চোখে মাহানুরকে দেখছে। মাহানুরকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলছে সে। একটি টেবিলে মাহানুর, রাকা, তুলশী আর হেবা বসেছে। তাঁদের বরাবর টেবিলে আরহামরা বসেছে।
-তো গতরাত কার কেমন কাটলো? (তুলশী )
-আমার তো ভীষণ বোরিং কেটেছে আপু। তোমাদের বন্ধু আগে আগেই ঘুমিয়ে পরেছিল তারপর আমি একা মুভি দেখে রাত কাটালাম। (রাকা)
-হাহাহাহা। মাহানুরকে দেখে তো লাগছে সে সারারাতই না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে!(তুলশী)
-একদম! দেখো তার চোখ, মুখ ও ফুলে আছে! আহারে বনুকে আমাদের দুলাভাই ঘুমাতে দেয়নি? (রাকা )
তাঁদের এহেন কথায় মাহানুর ইতস্তত করতে লাগলো। নরম কণ্ঠে বলল,
-সেরকম কিছুই না আপু।
-উম হয়েছে আমরা বুঝি বোন। নতুন নতুন বিয়ে হলে স্বামীদের ভালোবাসার ডোজ একটু বেশিই থাকে। (তুলশী)
মাহানুরের এবার ভীষণ হাসি পেলো। মেয়ে মানুষ কত বেশি বুঝে! সে মুখ ফুটে কিছু বললও না আর তারা কত কী বানিয়ে নিলো। আরহাম মাহানুরকে আনমনে হাসতে দেখে ইশারায় জিগ্যেস করে কী হয়েছে। মাহানুর দুইপাশে মাথা নাড়ালো। মানে কিছুই না।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সবাই জিপের সামনে আসে। আজকে আরহাম মাহানুরের পাশে পিছনের সিটে বসে। ড্রাইভারের সাথে সাদাফ আর সামনের সিটে হেবা আর একজন গাইড ছেলে। একসাথে সবকয়টা জিপ স্টার্ট দেওয়া হয়। আঁকাবাঁকা পথে জিপ ছুটছে গতিতে। ক্রমশঃ শুধু ওপরের দিকেই যাচ্ছে তাঁদের জিপ। সবুজ পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়েই উড়ে যাচ্ছে মেঘ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাহারি রঙের পাকাদালান, ভবন আস্ত একটা শহর চোখে ভাসছে তাঁদের। মেঘেদের আনাগোনা দেখেই বুঝতে পারলো চেরাপুঞ্জি এসে পরেছে তারা। মাহানুর ব্যস্ত সৃষ্টিকর্তার অপরূপ তৈরি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খানিকটা হলেও ক্যামেরায় বন্দি করায় আর আরহাম ব্যস্ত সৃষ্টিকর্তার তৈরি অপূর্ব মানবীকে দেখতে।
আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথ ছুটতে ছুটতে অবশেষে তারা পৌঁছে গেলো কাঙ্ক্ষিত চেরাপুঞ্জি সেভেন সিষ্টার জলপ্রপাতে। শত শত পর্যটকদের ভিড়ে সবাই জিপ থেকে নিচে নামলো। আরহাম মাহানুরের একহাত মুঠি করে চেপে ধরলো যাতে ভিড়ে হারিয়ে না যায়। কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে মেঘগুলো সরে যেতেই তাঁদের চোখের পর্দায় বন্দি হলো এক মন মুগ্ধকর দৃশ্য। সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত পাহাড়ের চুড়ো থেকে বেয়ে নেমে আসা পাশাপাশি সাতটি জলপ্রপাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য। মাহানুর অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
-ওয়াও! অ্যামেজিং!
আশেপাশের সকলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। মাহানুর নিজেও কয়েকটা ছবি তুললো। আরহামকে বলল তার কয়েকটা ছবি তুলে দিতে। রাকা জোর করে তাঁদের দুইজনের একসাথে একটি ছবি তুলে দিলো। মুহূর্তেই মেঘে ঢেকে ফেললো সাতবোন ঝর্ণার অমায়িক দৃশ্য। তারা সকলে সারীবদ্ধ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার কিনার ধরে কিছুটা নিচে গেলো। পাহাড়ের কিনারে অনেকটা সিঁড়ির মতো আকৃতি করা। তবে এখানকার পানিতে নামার কোনো সুবিধা নেই। ছবিটুবি তুলে পুনরায় ওপরে এসে পরলো। মাহানুরের খেয়ালই নেই আরহাম যে তার হাত ধরে রেখেছে। ওপরে এসে হাত ছেড়ে দেয় আরহাম। এখন তারা রওনা হবে চেরাপুঞ্জির ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে উদ্দেশ্যে।
লিভিং রুট ব্রিজগুলোর জন্যও মেঘালয় বিখ্যাত।নদীর ওপর দিয়ে তৈরি এক ধরণের ঝুলন্ত সেতু যা ইলাস্টিকা গাছের সংযুক্ত শিকড় ব্যবহার করে তৈরি। কিছু সময়ের মধ্যেই লিভিং রুট ব্রিজে এসে পরে তারা। এখন তাঁদের ২৫০০ ফুট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে তবেই ব্রিজের দেখা মিলবে। মাহানুর ব্যাগ টাইট করে ধরে হাঁটা শুরু করে। এখানে শুধু তারা নয় তাঁদের মতোই আরো অনেক টুরিস্টই এসেছে। এক ঘন্টা হাঁটতেই হাঁপিয়ে উঠলো মাহানুর। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢোক ঢোক করে পানি গিলে আবারও হাঁটা ধরে। আরহাম সবার আগে। এইরকম জার্নি তার জন্য কিছুই না। তাঁদের ট্রেনিংয়ে এর থেকেও বেশি সিঁড়িতে চড়তে হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে জান যায় যায় অবস্থা সকলের। মাহানুরেরও একই। আর কিছুটা পথই বাকি। একটু বিশ্রাম করতেই আবার হাঁটা ধরলো। অবশেষে মঞ্জিলে এসে পরলো তারা। মাহানুর খুশিতে আর্তনাদ করে উঠলো,
-ইয়াহু। আই এম ডান।
আরহাম মাহানুরের বাচ্চামো দেখে হাসলো। ব্রিজের নিচে ছোট কু এর মতো একটি পুকুর। পাথরের ওপর একদম স্বচ্ছ পানি টলমল করছে। অনেকেই সেখানে গোসল করছে। রাকা তার হাসব্যান্ডকে নিয়ে নেমে পরলো সেখানে। মাহানুর ভাবলো সেও নামবে। আরহামকে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-আমার ব্যাগ রাখুন। আমি গোসল করতে যাচ্ছি।
-এখানে অনেক পুরুষলোক আছে। গোসল না করলে হয় না?
-আমার এতে প্রবলেম নেই। টাটা।
সাবধানে পা ফেলে মাহানুরও পানিতে নেমে পরলো। হাতে পানি তুলে নিজের মুখে ছিটালো। একজন আরেকজনকে পানি ছিটাতে লাগলো। পরিহিত জামা ভিজে শরীরে সাথে লেগে আছে মাহানুরের। আরহাম যখন খেয়াল করলো আশেপাশের ছেলেরা কামুক দৃষ্টিতে মাহানুরের দিকে তাকিয়ে আছে তখন মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো তার। এই মেয়ে তার সব কথাই উপেক্ষা করে। একটা কথাও ভালো মেয়েটির মতো শুনে না! না একে বড়োসড়ো কোনো শিক্ষা দিতে হবে। মনে মনে ভাবলো আরহাম। সবার সাথে তাঁদের ব্যাগ রেখে সেও পানিতে নেমে পরে। মাহানুর ডুব দিয়ে উঠে আচমকা স্মুখীন আরহামকে দেখে চমকে যায়। মুখ থেকে পানি ঝেরে হেসে বলে,
-শেষমেষ আপনিও এসে পরলেন! ভালো ভালো।
আরহাম আপাদমস্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহানুরের শরীরে। ওড়না ভালোভাবে নিলেও ভেজা শরীর প্রত্যেকটা ভাঁজে ভাঁজে স্পষ্ট হয়ে আছে। আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-গোসল হয়েছে এখন এসো চেঞ্জ করবে।
-চেঞ্জ করারও জায়গা আছে?
আরহাম আঙুল দিয়ে কিছুটা দূরে ইশারা করে। পাহাড়ের খাঁজে ছোট ঘরের মতো জায়গা। সেখানেই মেয়েরা ড্রেস চেঞ্জ করে। মাহানুর বলল,
-সুন্দর তো। কিন্তু আমি আরেকটু পর উঠবো আপনি যেতে পারেন।
মাহানুর সরে যেতে নিলে আরহাম খপ করে তার হাত চেপে ধরে। মাহানুর মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। রাগে মুখ লাল হয়ে গিয়েছে আরহামের। মাহানুরকে একপ্রকার টেনেই পানি থেকে উঠালো সে। ব্যাগ নিয়ে ছোট ঘরের মধ্যে নিয়ে যায় মাহানুরকে। ভিতরে এসে ছেড়ে দেয়। মাহানুর চেঁচিয়ে বলে,
-এটা কোন ধরণের ব্যবহার? আর আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার কেনো করছেন?
-ব্যাগ থেকে শুকনো ড্রেস পরে দ্রুত বের হও।
-আমি কিছু জিগ্যেস করেছি?
-তর্ক করো না নুর। যেটা বলছি সেটা করো।
-শুনবো না আপনার কোনো কথা আমি। বিয়ের পর থেকেই এটা করো না ঐটা পরো না! উফফ ডিসগাস্টিং! এই ভেজা জামা পরেই যাবো আমি।
-আমার রাগ বাড়িও না।
-আপনার রাগ আপনার কাছেই রাখুন তোয়াক্কা করি না আমি। আপনি আমার কেউ না এটা মাথায় রাখবেন।
শক্ত মুখে বাক্য শেষ করে মাহানুর বেরিয়ে যেতে নিলে আরহাম বলিষ্ঠ হাত দিয়ে মাহানুরের দুইগাল চেপে ধরে। আর একহাত দিয়ে মাহানুরের দুইহাত পিঠের সাথে চেপে ধরে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে। ফোঁস ফোঁস শ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল,
-আমি তোর স্বামী আমার কথাই তোর চলতে হবে বেয়াদব। বারবার বলেছি, জামা নিয়ে সাবধান করেছি কিন্তু না সে একই কাজ করে! এখন আরহাম চৌধুরীই তোর সব এটা মনে,প্রাণে আর মস্তিকে ঢুকিয়ে নে।
মাহানুর ফুসছে। অতিরিক্ত রাগের কারণে তার শ্রী মুখ লাল বর্ণ ধারণ করে। আরহামের হাতে কামড় দিয়ে বসে সে। মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে আরহাম। মাহানুর ক্রোধাদ্বিত হয়ে বলে,
-সাহস কত বড় আমাকে ব্যাথা দেয়! নেক্সট আমার সাথে এমন জঘন্য ব্যবহার করলে এর থেকেও ভয়ংকর কামড় পাবেন।
আরহামের মেজাজ তুঙ্গে। মাহানুরকে বের হওয়ার সুযোগ দিলো না সে। পিছনে পাথরের সাথে চেপে ধরলো তাকে। মাহানুর আঁতকে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই হিংস্র আরহাম অনাকাঙ্ক্ষিত একটি কাজ করে বসলো। মাহানুরের ভেজা ওষ্ঠজোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো সে। দাঁতধারা পর পর গাঢ় জখম করে দিতে থাকলো মাহানুরের কোমল মেয়েলি ওষ্ঠ। মাহানুর এহেন কান্ডে স্তব্ধ। কোনো প্রতিক্রিয়া করারও সুযোগ পেলো না সে।
_______________
আজ মেডিকেলে এসেছিলো সুনহেরা। কোনোরকম ক্লাস করে বান্ধবীদের সাথে ক্যাম্পাসে এসে বসে। তার অবচেতন মন শুধুই আয়াসকে খুঁজে চলেছে। উদাসীন মনে বান্ধবীদের রেখে হাঁটতে থাকে সে। সুনহেরা বিড়বিড় করে বলল,
-কোথায় যে লুকিয়ে আছে চশমা পরা বিলাতিইদুর কে জানে!
আশেপাশে নজর বুলিয়ে সামনে তাকাতেই আয়াসকে দেখতে পেলো সে। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। কিছুটা এগিয়ে যেতেই তার হাসি নিভে গেলো। পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকলো শুধু। আয়াসের কাছে যাওয়ার ইচ্ছেও ম’রে গেলো তার। অত্যাধিক সুন্দরী একটি মেয়ের সাথে হেসেখেলে কথা বলছে আয়াস। সুন্দরী মেয়েটা বারবার আয়াসের দিকে তাকাচ্ছে। সুনহেরা দুঃখিত মন নিয়ে অন্যপাশে চলে যেতে উদ্যত হয়। ভাগ্যক্রমে আয়াস তাকে দেখে। ফ্রেন্ডদের কিছু একটা বলে দৌড়ে আসে সে।
-সুনহেরা দাঁড়ান।
সুনহেরা আয়াসের কণ্ঠস্বর শুনে দ্রুত সেদিকে তাকায়। আয়াস তার নিকটে চলে এসেছে। সুনহেরা স্মিত হাসার চেষ্টা করে বলল,
-আপনি? কোনো দরকার ছিল?
-ছুটির পর দাঁড়াবেন একসাথে যাবো। আম্মু বলল আপনাকে একা ছাড়তে না।
-ওহ।
-ক্লাস শেষ?
-শেষ নয় তবে আমার ভালো লাগছিলো না তাই চলে এসেছি। এখন বাসায় যাবো।
-কিন্তু আমার তো আরো কয়েকটা ক্লাস আছে।
-সমস্যা নেই বাহিরে গাড়ি আছে আমি একাই চলে যেতে পারবো।
-আপনি নাহয় একটু অপেক্ষা করুন।
-থাক প্রবলেম নেই তো। আপনি ধীরেসুস্থে ক্লাস করুন।
-ওকে। আসেন এগিয়ে দিয়ে আসি।
-আচ্ছা।
সুনহেরা আয়াস বরাবর হাঁটছে। সুনহেরা নিজেকে ধাতস্থ করে জিগ্যেস করে,
-আপনার সাথের মেয়েটা কী আপনার জিএফ ছিল? অনেক সুন্দর দেখতে কিন্তু!
-তেমন না। আমার ফ্রেন্ডের জিএফ হয়।
-ওহহ!
-আর সুন্দরী ওয়াইফ থাকতে রিলেশন নামক হারাম সম্পর্কে জড়ানোর ছেলে আমি নই।
লাজে রাঙা হয়ে গেলো সুনহেরার দুইগাল। মাথা তুলে তাকাতে পারলো না। কী সব ভেবেছিলো সে! সুনহেরা জিব কাটে। হাঁটতে হাঁটতে মেইন গেটের সামনে এসে পরলো তারা। সুনহেরা বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-আসি।
-ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলে দিয়েছি দেখেশুনে নিয়ে যাবে।
-ওকে।
কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। রিদ আসার কথা ছিল অথচ এখনও তার খবর নেই! প্রচন্ড গরমে কপাল চুঁয়ে চুঁয়ে ঘাম ঝরছে তার। অসহ্য মুখে হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতেই রিদকে অগ্রসর হতে দেখতে পেলো সে। সোনালী চুলের স্টাইলিশ একটি মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে সে। মেয়েটা কথার ফাঁকে ফাঁকে রিদকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অহনা জানে এটা রিদের ফ্রেন্ড। এইরকম অনেক ফ্রেন্ড আর কাজিন আছে রিদের। তাঁদের সাথে অনেক ফ্রেন্ডলি রিদ। অহনার এই বিষয়টা পছন্দ না হলেও প্রিয় পুরুষ বলে মুখ বুজে সহ্য করে। মেয়েটা অহনাকে দেখে অন্যপাশে চলে গেলো।রিদ নিকটে আসতেই অহনা বলল,
-এতো সময় লাগলো কেনো? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।
-এক বন্ধুর বাসার থেকে আসলাম তাই দেরি হলো জান।
-কেনো? আপনার বাসায় কোনো প্রবলেম হয়েছে?
-একটু ঝগড়া লেগেছে আব্বার সাথে। আসো এখন।
অহনা হাঁটতে থাকলো রিদের সাথে। বিষন্নতা ছেয়ে আছে অহনার মনে। রিদ আড়চোখে সেটা দেখে জিগ্যেস করলো,
-মন খারাপ?
-আমার জন্য ঝগড়া হয়েছে না আপনাদের মাঝে?
করুণ কণ্ঠস্বর অহনার। মুখে একরাশ কালো ছায়া তার। রিদ হেসে বলল,
-বোকা মেয়ে সেরকম কিছুই না। তুমি আমার জীবনে আসার আগের থেকেই আমার আব্বার সাথে ভালো একটা সম্পর্ক ছিল না। বুঝলে?
-আপনি বিয়ের কথা বলেছিলেন?
-উফফ তুমি আগে এই আপনি আপনি বলা বন্ধ করো জান। তুমি বলো।
-কিন্তু তুমি বলতে আমার কেমন কেমন যেনো লাগে।
-লাগুক তারপরও তুমি বলবা। বুঝছো?
অহনা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। রিদের দিকে তাকিয়ে আবারও জিগ্যেস করলো,
-তুমি বিয়ের কথা বলেছিলে সেটা নিয়েই ঝগড়া হয়েছে না?
-হো। আর তোমার এইসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো আর আমি বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
অহনা চুপ। রিদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিগ্যেস করলো,
-তোমার দুই বন্ধু কোথায়?
-বাসায় চলে গিয়েছে তারা। মাহানুরদের সাথে কথা হয়েছিল?
-গতরাতে হয়েছিল।
-ওহ। আজ কোথায় থাকবে তুমি?
-থাকবো নে কারো বাসায়।
-এতো রাগ,জেদ ভালো না। বাসায় চলে যাও।
রিদ অসন্তুষ্ট হলো অহনার কথায়। চোখ, মুখ শক্ত করে রুক্ষ স্বরে বলল,
-ঐ বাসায় আমার আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাজিনদের বাসায় থাকবো আজ।
-মেয়ে কাজিন?
-হো।
অহনার মন খারাপ হয়ে গেলো। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,
-ম্যারিড?
-একটায় ম্যারিড আরেকটা সিঙ্গেল। জানো সিঙ্গেলটায় আমাকে পছন্দ করে।
অনেকটা প্রাউড কণ্ঠে বলল রিদ। অহনা কিছু বলতে পারলো না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় রিদ একজন টক্সিক পারসন। তাকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আবার অন্য মেয়েদের কাছেও যায়। যদিও অন্য মেয়েরা সম্পর্কে শুধুই কাজিন বা ফ্রেন্ড হয়। কিন্তু অহনা সহ্য করতে পারে না সে বেতীত অন্য কাউকে রিদের সাথে। তার কলিজা পুড়ে যায়। অথচ রিদের কাছে এটা সাধারণ বিষয়। অহনা মুখ ফুটে কিছু বলে না রিদও নিজ থেকে কিছু বুঝে না।
>>>>চলবে।