“ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন বলছি আমাকে। এই বিয়ে আমি কিছুতেই করব না। আপনার মতো একটা মা’স্তা’ন’কে কখনোই বর হিসেবে স্বীকৃতি দিব না আমি।”
“স্বীকৃতি দাও বা না দাও বিয়ে তো তোমার আমাকেই করতে হবে। এই আবরার খান ইহান কোনো মঞ্চের জোকার নয় যে তার মান ইজ্জত নিয়ে তোমরা তামাশা করবে আর সে বসে বসে সেটা উপভোগ করবে।”
“আমি ইচ্ছে করে এমনটা করি বিশ্বাস করুন। আমি নিরুপায় ছিলাম।”
“হাসালে! নিরুপায় মাই ফুট। আমাকে এবং আমার পরিবারকে ভরা মজলিসে অপমান করার প্ল্যান করে নিয়ে এখন কী না অসহায়ত্বের গল্প শোনানো হচ্ছে? কিন্তু এই ইহান অতটাও বোকা নয় যে তোমার এক্টিং-এ গলে যাবে। বিয়ে তো তোমার আমাকে করতেই হবে। এসেছি বিয়ে করতে সো বিয়ে করে বউ নিয়ে মান ইজ্জত সমেত বাড়ি ফিরব। লেজ গুটিয়ে চলে যাওয়ার পাত্র ইহান নয়।”
“প্লিজ ছেড়ে দিন আমায়। আমার ফ্যামিলিতে এটা জানতে পারলে অনেক বড় প্রবলেম হয়ে যাবে। ভাইয়া তো আমাকে মে’রেই ফেলবে।”
“সেসব তোমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। এখন এসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে দ্রুত বধূরুপে সজ্জিত হয়ে এসো। গো ফার্স্ট।”
ইহান নিঝুমকে জোরে ধাক্কা মে’রে একটা ঘরের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে যায়। ইশারায় ও’য়া’র্নিং দিয়ে যায় যাতে দ্রুত তৈরি হয়ে নেয়। ইহান চলে যেতেই নিঝুম এলোমেলো ভাবে কাঁদতে থাকে। নিজের ওপর চরম রাগ হচ্ছে তার। কেন যে অদিতির কথা মতো ওকে পালাতে হেল্প করল এখন তো নিজেই ফেঁসে গেল। ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুজে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে নিঝুম। তার বাবা, ভাই-এর কানে এসব কথা পৌঁছলে একদম কুরুক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে। ভয়ে প্রচন্ড রুপে কম্পিত হচ্ছে নিঝুমের অন্তরিক্ষ।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পার্লার থেকে চারজন বিউটিশিয়ান এসে হাজির নিঝুমের সম্মুখে। তাদের দেখা মাত্র নিঝুম হাত জোর করে কেঁদে কেঁদে বলল,
“প্লিজ আমাকে হেল্প করুন। এখান থেকে পালাতে সাহায্য করুন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।”
বিউটিশিয়ান গুলো একে অপরের মুখ চাওয়া- চাওয়ি করল। অতঃপর একজন বলল,
“দেখুন ম্যাডাম আমাদের কাজ আপনাকে পরিপূর্ণ রুপে সজ্জিত করে তোলা। এর বাহিরে কোনো কিছু করার এখতিয়ার আমাদের নেই। কোনো রকম এদিক ওদিক হলে আমাদের গ’র্দা’ন যাবে। সো আপনি প্লিজ চুপটি করে বসুন আমরা আপনাকে তৈরি করে দেই। আমাদের হাতে এক ঘন্টার সময় আছে এরমধ্যে আপনাকে তৈরি করার অর্ডার আছে। আপনি প্লিজ শান্ত হয়ে বসুন।”
নিঝুম আর কিছু বলল না। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না করতে লাগল। তার কাছে মেবি আর কোনো অপশন নেই। বিয়েটা এবার তাকে করতেই হচ্ছে। বিউটিশিয়ান গুলো নিঝুমের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে নিজেরাই এগিয়ে এসে সাজানোর কাজ শুরু করল। নিঝুম অসহায়ের মতো সবটা সহ্য করছে। এছাড়া আর উপায় কী?
—————–
তিন কবুল বলার মধ্যে দিয়ে ইহান, নিঝুমের শুভ পরিণয় সম্পন্ন করা হলো। ‘আদৌও কী শুভ হলো নাকি সবটাই অশুভ’ এ প্রশ্নের উত্তর কারোরই জানা নেই। সময়ই সবটা এক্সপোজ করবে।
বান্ধবীর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে হলো নিঝুমকে। সকলে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যায় আর সে যাচ্ছে বান্ধবীর বাড়ি থেকে। অদ্ভুত!তাই না সবকিছু?
ওদের বিয়েটা হয়েছে শরিয়ত মোতাবেক যেখানে তার বান্ধবী অদিতির বাবা-মাকে নিঝুমের বাবা-মা হিসেবে প্রক্সি নেওয়া হয়েছে। কোর্ট ম্যারেজ করতে গেলে অনেক ঝামেলা অনেক ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হবে তাই সরাসরি এটাই বেস্ট সাজেশন বলে মনে করেছে ইহান।
গাড়িতে ইহানের পাশে বধু রুপে বসে আছে নিঝুম। সামনের সিটে শুধু ড্রাইভার ড্রাইভ করছে। ইহান সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে অনেকটা টায়ার্ড সে। বাড়িতে গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিতে হবে। মাথাটাও কিঞ্চিৎ ব্যথা করছে।
নিঝুম গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে তার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে তাকে নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেছে। কেন যে আজ এ বাড়িতে সে আসতে গেল। না এলে তো এসব কিছু ঘটতোই না। কাঁদতে কাঁদতে সকালের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় নিঝুমের……
ফ্ল্যাশব্যাকঃ
—————
আজ নিঝুমের বেস্ট ফ্রেন্ড অদিতির বিয়ে।হুট করেই বিয়েটা ঠিক হয়ে যায়। কাছের বান্ধবী হিসেবে বিয়েতে ইনভাইটেশন পায় নিঝুম। অদিতি বারবার করে বলে দিয়েছে সে যেন সকাল সকাল উপস্থিত থাকে নয়তো সে বিয়ে করবে না। নিঝুমের পরিবার খুবই সিনসিয়ার।
মেয়েদের একা বাহিরে বের হওয়ার পারমিশন নেই সেখানে।বিশেষ করে বাবা,ভাই জানতে পারলে খুব ঝামেলা হবে। তাই নিঝুম অনেক কষ্টে তার মাকে ম্যানেজ করে চুপিচুপি এখানে এসেছে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। এর আগে কখনোই নিঝুম একা কোথাও আসেনি। তার মা অবশ্য ছাড়তে চায়নি নিঝুমের আকুতি-মিনতি দেখে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আবার স্বামী ভক্ত নারী। স্বামীর কথা অবাধ্য হন না কখনো।
অদিতিদের বাড়িতে এসে নিঝুম অদিতির বাবা – মায়ের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে অদিতির রুমে চলে যায়। সেখানে অদিতির সঙ্গে পুরো দুপুর পর্যন্ত লেগে থাকে। অদিতিকে বধু সাজে সজ্জিত করা সবকিছুই নিঝুমের সম্মুখে হয়। নিঝুম, অদিতি দু’জনে খুব মজা করে এটা ওটা নিয়ে। হঠাৎ যখন বর এসেছে, বর এসেছে বলে সকলে বেড়িয়ে যায় সে ঘর থেকে তখন অদিতি গিয়ে ঘরের দরজাটা আটকে দেয়। নিঝুম অবাক চোখে বলে,
“কী রে অদু দরজা বন্ধ করলি কেন?”
অদিতি ততক্ষণাৎ একটা চা’কু নিজের বাম হাতের শিরার ওপর রেখে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
“ঝুম তুই এখনই আমাকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবি নয়তো আমি সু’ই’সা’ই’ড করবো।”
নিঝুম কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। অদিতিকে সিরিয়াস দেখে সে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। এমনিতেই ছোট থেকে সে ভীষণ ভিতু স্বভাবের মেয়ে। অদিতির কান্ডে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আবির্ভাব ঘটেছে। সে ওড়নার আঁচল দিয়ে সেগুলো মুছে নিয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বলে,
“প্লিজ এমন করিস না অদু। আমি শুনবো তোর কথা। প্লিজ চা’কু টা হাত থেকে ফেলে দে।”
অদিতি চা’কু ফেলে না। সে অবস্থাতেই বলে,
“নাহ, আগে আমাকে এখান থেকে বের কর তারপর এটা ফেলবো। হাতে সময় খুব কম দ্রুত করবি।”
নিঝুম কম্পিত কন্ঠে বলে,
“আ আআচ্ছা কী করতে হবে আমায় বল।”
তারপর অদিতি প্ল্যান মাফিক নিঝুমের সাহায্য নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, “আমি ভীষণ দুঃখিত দোস্ত তোকে বিপদে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছি। কিন্তু কী করব বল? আমি যে সাঈদকে ভীষণ ভালবাসি।আমাদের দু বছরের সম্পর্ক। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সাঈদকে ছাড়া আমি বাঁ’চ’ব না। আজ আমরা বিয়ে করবো। বিশ্বাস কর আমার কাছে অন্য কোনো উপায় থাকলে তোকে বিপদে ফেলতাম না। আজ আমি তোর চোখে হয়তো অপরাধী হয়ে গেলাম কিন্তু বিশ্বাস কর একদিন তুই ঠিক বুঝবি আমার আজকের অসহায়ত্ব, ঠিক যেদিন তুই কাউকে ভালবাসবি সেদিন। আমি আসি রে পারলে এই অদুকে ক্ষ’মা করে দিস।”
অদিতি চলে যায়। নিঝুম অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে সেই চলে যাওয়া। সাঈদ হলো নিঝুমদের কলেজের সিনিয়র বড় ভাই। অদিতির সঙ্গে সাঈদের সম্পর্ক চলছে এটা এতদিনে জানতে পারেনি নিঝুম। অদিতি তার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও কেমন চুপিসারে লুকিয়ে গেছে সবটা তার কাছ থেকে। ভাবনা থেকে বেড়িয়ে ওপরে চলে যায় নিঝুম। অদিতির জায়গায় নিজে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।
বর যাত্রীদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। যখনই কনেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠানো হয় তখনই ঘটে বিপত্তি। কনে নেই ঘরে শুধু নিঝুম একা। অদিতির বাবা- মা এসে তখন নিঝুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। নিঝুম ভয়ে আমতা আমতা করতে করতে সব সত্যি স্বীকার করে নেয়। ব্যাস ততক্ষণে অদিতির হবু বর আবরার খান ইহান সেখানে উপস্থিত হয়ে সব ঘটনা শুনে ফেলে। কনের আসতে লেট হচ্ছে দেখে ইহান বুঝে গিয়েছিল নিশ্চয়ই কোনো গড়বড় আছে তাই তো সে সোজা ওপরের ঘরে চলে আসে। অতঃপর সব সত্যি জেনে যায়। অদিতির বাবা – মা ইহানের কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু ইহান তখন নিঝুমকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। অদিতির বাবা-মা সঙ্গে সঙ্গে না বলে দেয় কারণ তারা জানে নিঝুমের পরিবার কতটা সম্পর্কে।
কিন্তু ইহান নাছোড়বান্দা সে কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না। অগত্যা নিঝুমকে জোরজবরদস্তির বিয়েটা করে নেয় সে। এবার পরবর্তীতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য তা বিধাতাই ভালো জানেন।
——————-
চলবে,
#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-১)
নামিহা নিশি