#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১২.
“নৌকায় করে যাওয়া যায় না?” নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে চলতে থাকা নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলল তনয়া।
স্বরূপ বলল, “যাবে, তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
“একটু দেরি হলে কী যায় আসে?”
“বাড়িতে অনেক কাজ।”
“আমি সাহায্য করব কাজে।”
স্বরূপ তনয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “তুমি কোন কাজটা করবে শুনি?”
তনয়া মিষ্টি হেসে বলল, “আমি কী কী করতে পারি তুমি জানোও না।”
“করো যা খুশি৷ কিন্তু এখন নৌকায় যাব না।”
“প্লিজ!”
“নো।”
“তাহলে আমি যাবই না।”
স্বরূপ বিরক্ত হয়ে বলল, “বাচ্চাদের মতো করছ কেন?”
“কারন আমি বাচ্চা।”
“দুদিন পর তোমার বাচ্চা হয়ে যাবে, আর এখন নিজেকে বাচ্চা দাবি করছ!”
তনয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেল। স্বরূপও আর কিছু বলল না৷ অনেকক্ষণ দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হলো না।
দেখা গেল কোনে স্টিমার এখন ছাড়বে না৷ একটু দেরি হবে। তখনো সকাল পুরোপুরি হয়নি৷ রোদ ওঠেনি। সূর্যটা ঝলমল করে উঠছে অল্প অল্প করে। নদীটাকে বিষন্ন প্রান্তরের মতো লাগছে। স্বরূপ কিছুক্ষণ ভাবার পর ঠিক করল তারা নৌকায় করেই যাবে৷
নৌকা ঠিক করা হলো। শুধু তারা নয় আরও দু’জন একই নৌকায় একই জায়গায় যাবে। তারাও নবদম্পতি। স্বরূপের সাথে ছেলেটার কথাবার্তা হলে জানতে পারল তারা পাশের গ্রামেই থাকে৷ প্রথমবার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে।
নৌকায় চড়ে বসতেই মাঝি ইঞ্জিন চালু করে দিল। পানি কেটে এগিয়ে যেতে থাকল নৌকা। তনয়া কিছুটা মন খারাপ করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম বৈঠা বেয়ে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবে।”
স্বরূপ বলল, “সেই নৌকা দিয়ে যেতে হলে পরেরদিন পৌঁছুতে হবে।”
তনয়া আর কিছু না বলে বাইরে তাকিয়ে রইল। নদীর পাড়ে সবুজ গাছের বন, পাখির ডাক, খোলা আকাশ, অল্প অল্প করে চড়তে থাকা রোদ আর পাশ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া নৌকাগুলোকে ফেলে তারা এগিয়ে যেতে থাকল। মাঝে মাঝে সে হাত বাড়িয়ে পানি ছুঁয়ে দিল। ভীষণ ঠান্ডা পানি৷ কোথা থেকে আসছে এই পানি? এই উন্মত্ত স্রোত যাচ্ছেই বা কোথায়? কখনো তো ভেবে দেখা হয়নি।
তনয়া এতটা তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে হঠাৎ হাসির শব্দে সে খানিকটা চমকে তাকাল। তাদের সাথে নৌকায় ওঠা মেয়েটা হাসছে। তার স্বামী কানে কানে কী সব যেন বলছে। মেয়েটা গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে। ওরা ভুলে গেছে আশেপাশে আরও মানুষ আছে। তনয়া স্বরূপের দিকে তাকাল। সে বিরক্ত মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা, বিরক্ত হবার কী আছে? ওরা যা করছে তাই তো স্বাভাবিক। তাদের মতো দুজন দুই মেরুতে বসে থাকবে নাকি?
তনয়ার এবার মাঝেমধ্যেই প্রকৃতি থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছিল। চোখ ঘুরে ঘুরে সেই নবদম্পতির দিকে আটকে যাচ্ছিল। মেয়েটা আচার খাচ্ছিল, তার স্বামী ভাগ বসাতে চাইছিল বারবার। ওর মুখ থেকে কেড়ে দিয়ে নিজের মুখে পুরে দিচ্ছিল৷ হয়তো প্রকাশ্যে চুমু খেতে পারছিল না বলেই।
ছেলেটার একটা হাত বরাবর মেয়েটার কাঁধ বা কোমর জড়িয়ে রেখেছিল। তার সতর্ক গলা বারবার বলছিল, বেশি নড়াচড়া করবে না তো, পড়ে গেলে কী হবে? তুমি যা ছটফটে!
তনয়ার মন ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। সে রোদ চিকচিকে পানির দিকে তাকিয়ে মন হালকা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল বারংবার৷
হঠাৎ রোদ খানিকটা মলিন হলো। একখন্ড ধূসর মেঘ মাথার ওপর চাদর বিছিয়ে বসল। বৃষ্টি না হলেও রোদটা পড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া সেকরমই মনে হতে লাগল।
মেয়েটা এসময় তার স্বামীকে আবদার করে বসল, “একটা গান গাও না প্লিজ! এত সুন্দর ওয়েদার, নদী, এর মধ্যে তোমার গান হলে পুরো জমে যাবে!”
ছেলেটা ইতস্তত করছিল, খানিকটা লজ্জা পাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা।
অতঃপর সে গাইল। এত সুন্দর গাইল যে স্বরূপ পর্যন্ত চোখ ঘুরিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকাল তার দিকে।
গলা ছেড়ে চোখ বুজে সে গাইছিল, ” কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল, সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল…আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা…”
তনয়ার চোখে পানি চলে আসছিল বারবার। সে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল যাতে কেউ দেখতে না পারে।
********
ওরা গ্রামে পৌঁছুল বিকেলবেলা। স্বরূপদের গ্রামটা এত সুন্দর! ঢুকতেই তনয়ার মন ভালো হয়ে গেল। এত সবুজ জায়গা সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না৷ প্রচুর বরই, তেঁতুল, খেজুর আর তাল গাছ চোখে পড়ল। আরও অনেক গাছ ছিল, তনয়া কতগুলো ঠিকঠাক চেনেও না। সরু মেঠোপথ, ক্ষেতের আইল আর কোথাও চোখ আটকে না যাওয়ায় দেখা গেল বিস্তীর্ণ আকাশ, যার নীল তনয়ার শাড়ির রঙের সাথে মিলে যায়।
ওরা গরুর গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিল। তনয়া কখনো গরুর গাড়িতে চড়েনি৷ এমনকি এই জিনিস দেশে এখনো আছে তাই সে জানত না। গাড়ির দুলুনি তার ভীষণ ভালো লাগছিল। তখনো সামান্য রোদ বিরাজমান ছিল যারা উঁচু গাছগুলোর মাথা আলোকিত করে রেখেছিল। দিন ছোটো বলে অবশ্য রোদটুকু সরেও গেল খানিক পরেই৷ মিঠে বাতাস বইতে শুরু করল। তনয়ার মনে হলো বহুদিন পর সে সুন্দর একটা দিন কাটাল।
স্বরূপ নৌকা থেকেই তনয়াকে খেয়াল করছে। সে আজ উদাস, বিষন্ন, যেন বৈরাগ্য পেয়ে বসেছে তাকে। সে এবার গলা খাকারি দিয়ে ডাকল, “তনয়া…”
তনয়া তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “হু?”
“আফসোস হচ্ছে?”
“কেন?”
“বিয়েটার জন্য?”
তনয়া বুঝল নৌকায় থাকা দম্পতিকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছে স্বরূপ। হ্যাঁ তার কষ্ট হচ্ছিল বটে, কিন্তু এখন সেটা আর নেই। ক্রমশ ঘনায়মান সন্ধ্যার হাতছানি তাকে অন্য জগতের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছিল। যেন এই পৃথিবীতে মানুষ কিংবা তাদের অনুভূতি কিছুই নয়। সবটাই প্রকৃতির দখলে। সে ঘরে ফিরতে থাকা পাখিদের দিকে চেয়ে আনমনেই বলল, “না, কোনো আফসোস নেই।”
স্বরূপ একটু থমকে গেল। তারপর মনে মনে হাসল। তার ধারনা ভেতরে ভেতরে তনয়া আফসোসে মরে যাচ্ছে। অথচ সে জানে না, তনয়া খুব অল্পতেই খুশি হতে জানে। ছোটো ছোটো কারনে সে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বেড়ায় না। বরং কঠিন পরিস্থিতিতেও সে নিজেকে সামলে রাখতে, খারাপ সময়েও ভালো থাকতে জানে। জানে অন্যকেও ভালো রাখতে। মাত্র দু’দিনের সংসারে স্বরূপের সেটা জানার কথাও নয়।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু