গহন_কুসুম_কুঞ্জে ৪.

0
425

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৪.

বারান্দায় বিকেলের রোদে বসে চুল শুকাতে শুকাতে হাওয়াই মিঠাই দুটো খাচ্ছিল তনয়া। দুই হাতে দুটো। তার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এভাবে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার। নেহায়েতই লোকে পাগল বলবে বলে কখনো খায়নি।

এই বারান্দায় অনেকটা সময় পর্যন্ত রোদ থাকে বলে মা এখানে আচার শুকাতে দিয়েছে। আকাশ পরিষ্কার। চিকন একটা সাদা মেঘের রেখা দূর আকাশের প্রান্তে ভেসে আসে আলতোভাবে। সূর্যের আভা কমলা হয়ে আসছে। তনয়ার মনটা কেমন কোমল হয়ে আছে৷ ছাড়া ছাড়া চিন্তাগুলো হুটহাট আসছে যাচ্ছে মনে আলতো রেখাপাত করে।

তার জীবনে প্রথম প্রেমে পড়া বলে কিছু ছিল না। তবে কিছু ঘটনা মনে না রেখে থাকা যায় না৷ ওইযে রাস্তার পাশের বড় কদম গাছটা, ওটার আড়ালে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকত রোজ বিকেলে। তনয়া বিরক্ত হতো, আবার কেমন মজাও লাগত। সে জানালা দিয়ে একটু পরপর লুকিয়ে দেখত ছেলেটা আছে নাকি চলে গেছে।

মুখচোরা ছেলেটা কিছুই বলতে পারেনি তাকে। শুধু দেখে গেছে৷ এরপর একদিন সে হুট করে মরে গেল! মা যখন বলছিলেন অমুক ছেলেটা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে গেছে, তখন কী ভীষণ অবাক হয়েছিল তনয়া! ছেলেটার মা বাবার সম্পর্ক ভালো ছিল না৷ রোজ বাড়িতে অশান্তি হতো। সহ্য করতে না পেরেই…তনয়ার মনে হয়েছিল আহারে, ছেলেটাকে একবার যদি জিজ্ঞেস করা হতো, তুমি কেমন আছো? ইচ্ছে করলেই সে জিজ্ঞেস করতে পারত। কিন্তু কখনো ইচ্ছেটাই হয়নি। সে হয়তো একটু মমতার আশায়, একটু ভালো থাকতে ওর কাছে আসতো!

কিংবা ইউনিভার্সিটির পবিত্র! কয়েকটা বছর একসাথে পড়াশুনার পরেও তনয়ার বিন্দুমাত্র ধারণা হয়নি ছেলেটা তাকে কতটা পছন্দ করে! বিদায় অনুষ্ঠানের দিন সে খুব আবেগ নিয়ে বলেছিল, “বিশ্বাস কর তনু, ধর্ম ছাড়া পৃথিবীর আর যে কোনো কিছু ছাড়তে হলে আমি তোর জন্য ছাড়তে পারতাম। চলে যাচ্ছি আজ৷ তুই খুব ভালো থাকিস। তোর জন্য পৃথিবী হয়তো আরও অনেক ভালোবাসা জমা করে রেখেছে অন্য কারো কাছে।”

পবিত্র চলে গেছে ইংল্যান্ড৷ যাওয়ার আগেই তনয়াকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছে।

ভালোবাসা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বোধ্য বিষয়গুলোর একটা।

“তনু…কী কিনে এনেছিস দেখালি না যে…”

মা ঢুকলেন ঘরে। ঘর থেকে বারান্দায়। ওর হাওয়াই মিঠাই দুটো তখন শেষের পথে। মা হেসে বললেন, “তুই কি বাচ্চা?”

“না। আমি তো একটাই কিনেছিলাম৷ পরে দুটো কিনে দিল..”

“কে?”

“স্বরূপ।”

“দেখা হয়েছিল ওর সাথে?”

“হুম।”

“তারপর?”

“তারপর কী?”

“সব ঠিকঠাক?”

তনয়া প্রশ্নটা বুঝতে পারল না। বলল, “হুম। কোনো সমস্যা নেই।”

মা চারশো ভোল্ট বাল্বের মতো জ্বলে উঠলেন হঠাৎ করে। তারপর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে প্রস্থান করলেন। তনয়া বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ঘটনাটা কী হলো?

একটু পর ফোন এলো রূপার। প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করল, “স্বরূপ কি তোর প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছে?”

“হ্যাঁ তা দিয়েছে..”

রূপাও ওপাশ থেকে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

তনয়া কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে রইল। তারপর ভাবল ব্যাপারটা আরো ঘেটে যাবার আগে থামাতে হবে। সে মোটেও বদ ছেলেটাকে বিয়ে করবে না! সে যখন বাবার ঘরের দিকে গেল তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল বাবা দারুণ খুশি খুশি গলায় কাকে যেন ফোনে বলছেন, “এবার ভাই আমার মেয়ের বিয়েটাও ভালোয় ভালোয় দিতে পারব। চমৎকার পাত্র পেয়েছি। কী যে শান্তি লাগছে বলে বোঝাতে পারব না।”

তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে আর কিছুই বলল না৷ চলে গেল নিজের ঘরে। বাবার এত আনন্দটাকে সে আবারও অসম্মতি জানিয়ে নষ্ট করে দিতে পারবে না! বাবা বুঝতে দেননি। কিন্তু তার এই গলার স্বর বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি কতটা চাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন!

তনয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর মনে হলো, তার হাতে আসলে কিছুই নেই। যা হচ্ছে সেদিকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার ভাগ্য।

*****

স্বরূপ জানালার পাশে ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে কী একটা ভাবছিল। ঘরে একটা শব্দ হলো। ইঁদুর কি? বড় ফ্ল্যাটটা খাঁ খাঁ করে সারাক্ষণ। সে বাদে আর কারো বাস নেই এখানে। অবশ্য কিছু ইঁদুর, তেলাপোকা আর একগাদা মশা তাকে সঙ্গ দিতে থেকে যায়। এদের ঝেঁটিয়েও তাড়ানো মুশকিল! মানুষগুলোও এমন করে থেকে যেত যদি!

লোপার সাথে বিচ্ছেদের পর স্বরূপ আগের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে বড় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। ভালো চাকরি, একার আয়, এমন কোনো বিলাসদ্রব্য নেই যা সে কেনেনি। অথচ বাসাটাতে কোনো শান্তি লাগে না তার। মা এলে কিছুটা ভালো লাগে, এখন মাও নেই। মা বেশিদিন থাকতেও পারেন না। তার নিজের প্রতিষ্ঠা করা স্কুল আছে। সেই স্কুলের পেছনে সারাদিন চলে যায়। মা প্রায়ই ওকে বলেন গ্রামে চলে যেতে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে সে করবেটা কী? হাল চাষ করার সামর্থ তো তার নেই।

তবে এই জীবনটা আর যাই হোক, ঝামেলাযুক্ত নয়। এদিকে সবাই তার জীবনে ঝামেলা তৈরি করার জন্য হাত ধুয়ে লেগে গেছে। কোথা থেকে যেন একেকটা মেয়ে ধরে এনে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বরূপ কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারছে না যে সে নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে চায় না৷ ভালোবাসতে পারবেও না। এডজাস্ট করে থাকা, বউয়ের নিত্যনতুন আবদার পূরণ করা, রোজকার ন্যাকামি সহ্য করা এসব ইচ্ছে তার মরে গেছে।

শেষবার দেখা মেয়েটা ভালোই ছিল। তবে তার কেন যেন এসব নিষ্পাপ চেহারার মেয়েদের আরও বেশি বিশ্বাস হয় না। লোপার চেহারা কি কম নিষ্পাপ ছিল? অথচ মেয়েটা বের হলো বিশ্বাসঘাতক, ব্যভিচারিনী। সেই ঘটনার পর তিনটা বছর স্বরূপ সারারাত ঘুমাতে পারনি। চোখ বুজলেই ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে যেত। তার দম বন্ধ হয়ে আসত। মনে হতো সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে!

গত দেড় বছর ধরে এসব আর হয় না। বরং একটা নির্লিপ্ততা চলে এসেছে জীবনের প্রতি। কিছুই ভালো লাগে না টাইপ হতাশার জীবন।

আবারও রান্নাঘরের দিক থেকে ভেসে আসা শব্দে উঠে পড়ল সে। সেদিকে যেতে গিয়ে মোবাইলের নোটিফিকেশন লাইট জ্বলতে নিভতে দেখে ফোনটা তুলে নিল হাতে। এমনিতে তার মোবাইল সাইলেন্ট থাকলেও হাতে থাকে বলে কল ধরতে অসুবিধা হয় না। আজ দূরে ছিল। এই ফাঁকে ফোন এসেছে মোট চল্লিশটা। মা আর বন্ধুবান্ধবের ফোন৷ ভয় পেয়ে গেল স্বরূপ। তাড়াতাড়ি ফোন করল মাকে।

মা যে খবরটা জানালেন তাতে তার মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল। গা জ্বলতে শুরু করল। মনে মনে বলল, “ইডিয়ট! পিওর ইডিয়ট! এতকিছুর পরেও একটা মেয়ে বিয়েতে রাজি হয় কোন সুখে?”

ইচ্ছে হলো তনয়াকে ফোন করে চেঁচামেচি করতে। কিন্তু নাম্বার নেই তার কাছে। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। তারপর চলে গেল বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়াল।

এখন শীত পড়তে শুরু করেছে। রাতের পানি আরও ঠান্ডা। তবুও তার গরম লাগছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে এ কোন আপদ আসতে চলেছে!

********

পরের বেশ কয়েকটা দিন কেমন করে যেন কেটে গেল! তনয়ার সাথে স্বরূপের কথা হলো না আর৷ তনয়াও ভয়ে তাকে ফোন করল না। এদিকে দুই পরিবারের সরব আয়েজনে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকল। তাদের অনেকদিন পর দেখা হলো। বিয়ের কাবিননামায় সই করবার দিন।

স্বরূপ সকাল থেকেই প্ল্যান করছে কী করে তনয়াকে একটা শিক্ষা দেয়া যায়। বড়সড় একটা ধমক দিলে কেমন হয়? নাকি কাবিননামায় সই করার পর কানের কাছে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বাংলা সিনেমার মতো বলবে, “তোমাকে আমি স্ত্রীর কোনো অধিকার দেব না। আমার বাড়িতে তোমাকে থাকতে হবে পাশের বাড়ির লোকের মতো।” আরও নানা প্ল্যান করে সেগুলো প্ল্যান এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে মনে মনে সাজিয়ে সে তনয়াদের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

প্রাথমিক আপ্যায়নের পর যখন তনয়াকে বসার ঘরে আনা হলো তখন স্বরূপের মুখে আপনাআপনি তালা লেগে গেল।

মিষ্টি রঙের শাড়িতে তনয়াকে এত স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল যে স্বরূপ ইচ্ছে করেও বেশিক্ষণ চোখ সরিয়ে রাখতে পারছিল না৷ তার ওপর ওর চেহারায় বাড়তি একটা কোমলতা আছে যা সবার থাকে না৷

সইটই হয়ে যাবার পর ওদের কথা বলার জন্য একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো কিছুক্ষণের জন্য। স্বরূপ প্ল্যানগুলো সব ভুলে চুপচাপ বসে রইল। তনয়া কী বলবে তাই বুঝতে পারল না। সে ভেবেছিল স্বরূপ তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না দেখে ভারি অবাক হলো।

একসময় জিজ্ঞেস করল, “আপনি ঠিক আছেন?”

স্বরূপ ঠিক সেই মুহূর্তে যেন সব ঘোর কাটিয়ে তার বাস্তব মূর্তিতে ফেরত আসতে পারল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। গরু কুরবানি দেখেছ?”

“জি?”

“দেখেছ কি না?”

“হ্যাঁ।”

“কুরবানির পর তারা কী করে?”

“কী করবে? কিছু করার ক্ষমতাই থাকে না।”

“সেম সিচুয়েশন হিয়ার।”

তনয়া হেসে ফেলল। স্বরূপ ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি একটা ইমোশনাল ফুল।”

“কেন?”

“তোমাকে যা মারাত্মক দেখাচ্ছে! আমার মতো আধা রোবট জাতীয় প্রাণী বিয়ে না করলে ভালোবাসায় চাপা পড়ে মরে যেতে।”

তনয়া লজ্জা পাবে কি না বুঝতে পারল না। লোকটা কি প্রশংসা করছে? বোকার মতো বলল, “তাহলে ভালোই হলো। মরে গিয়ে কাজ নেই।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “মাথাভর্তি পাটের আঁশ। বুঝবে কেমন করে?”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here