#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৪)
————
“দয়া করে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।”
হুইলচেয়ার টানতে টানতে এগিয়ে এসে উক্তিটি বললেন অনিলা খান। তার পদার্পণে উপস্থিত আগন্তুক গণ একটু নড়েচড়ে উঠলেন। তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন,
“ভদ্রতা শেখানোর প্রয়োজন নেই। সৌজন্য জ্ঞান আমাদের যথেষ্ঠ পরিমাণে রয়েছে কিন্তু আপনাদের সেটা কতটুকু আছে এটাই ভাববার বিষয়।”
অনিলা খান কৌতুহলী কন্ঠে বললেন,
“মানে কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন আর আপনাদের পরিচয় কী? এখানে কেন এসেছেন?”
তাদের মধ্যে থেকে একজন টগবগে তরুণ গর্জে উঠে বললেন,
“আমার বোনকে আটকে রেখে আবার বড় বড় কথা বলা হচ্ছে। ডাকুন নিঝুমকে। কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ওকে? এখুনি বের করে নিয়ে আসুন। আমার বোনকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”
“মিস্টার আহসান আপনি এখানে?” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথাটি বলল ইহান।
ইহানের গলা শুনে উপস্থিত সকলে ওপরে তাকালো। ইহান ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। ইহানকে দেখা মাত্র মধ্য বয়স্ক লোকটি অর্থাৎ মিস্টার আহসান তেজী কন্ঠে বললেন,
“ওহ তারমানে এসব প্ল্যান করে করা হয়েছে। কী চাইছ টা কী তুমি?”
ইহান ওনাদের কথার মানেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে কিন্তু ইচ্ছে করে না বোঝার ভান করে বলল,
“আপনি এসব কী বলছেন মি.আহসান পরিষ্কার করে বলুন।”
“এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে এখন না বোঝার ভান করে আছো তাই না। তোমার হবু বউ পালিয়েছে বলে তুমি সেই মাশুল আমার মেয়ের ওপর থেকে ওঠালে কেন জবাব দাও। নাকি ইচ্ছে করে আমাকে জব্দ করতে এসব করেছ।”
ইহান মৃদু হেসে হেলেদুলে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। অতঃপর পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসে বলে,
“কুল ডাউন মি. আহসান। আপনার বয়স হয়েছে এই বয়সে এত উত্তেজনা শরীরের জন্য অতন্ত্য ক্ষতিকারক। তারচেয়ে বরং আপনি এখানে বসুন, চা খান, মেয়ে- জামাইকে দোয়া করুন তারপর খুশি মনে বাড়িতে চলে যান।”
ইহানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মি. আহসান কিছু বলতে নিবে তার আগেই তার ছেলে নুহাশ আহসান দ্বিগুণ তেজস্বী কন্ঠে বলে ওঠে,
“জাস্ট শাট আপ মি.খান। আপনাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সন্ধি অনেকটা, “আগুনে ঘিঁ ঢালার মতো।” এত কথার সময় নেই। আপনি আমার বোনকে ডেকে দিন ওকে নিয়ে আমরা চলে যাব এখনই।”
ইহান একটু হতাশ হওয়ার অভিনয় করে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে আপনারা যেমনটা চাইবেন।”
অতঃপর ইরাকে পাঠানো হয় নিঝুমকে নিয়ে আসার জন্য। নিঝুম এতক্ষণ দোতলার সিঁড়ির কাছে পিলারের পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে সবটাই শুনেছে। তার মনে এখন একটি প্রশ্ন ঘোর পাক খাচ্ছে তা হলো, ” তার বাবা-ভাই আর ইহান কী পূর্ব পরিচিত? তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো দন্ড রয়েছে নয়তো এভাবে কথা বলবে কেন? কীসের দন্ড তাদের?” নিঝুমের ভাবনার মধ্যেই ইরা তার সম্মুখে উপস্থিত হয়। নিঝুমকে ইরা নিচে যাওয়ার জন্য ডাকলে ওর ভীষণ ভয় হয় তবুও গুটি গুটি পায়ে নেমে আসে। নিঝুম সিঁড়ি দিয়ে নেমে চুপচাপ অনিলা খানের নিকটে গিয়ে দাড়ায়। অতঃপর অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। অনিলা খান চোখের ইশারায় তাকে আস্বস্ত করেন, সাহস জোগানোর চেষ্টা করেন। নিঝুম কিঞ্চিৎ ভরসা পায়। এদিকে নিঝুমের বাবা নিঝুমকে দেখে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে একদম ওর সামনে এসে দাড়ায়। নিঝুম মাথা নিচু করেই আছে চোখ তোলার সাহস হচ্ছে না। হঠাৎ পর পর কয়েকটি “ঠাস, ঠাস” শব্দে মুখরিত হয় পুরো মজলিস। সকলে নির্বাক শুধু ইহান ব্যতিত। ও যেন আগে থেকেই জানত এমন কিছু হবে। মি.আহসান আবারও হাত ওঠাতে গেলেই নুহাশ দৌড়ে এসে বাবাকে থামায়। নিঝুম নুহাশের বড় আদরের। একটু শাসনে রাখে তবুও মনে মনে ভীষণ ভালবাসে কিন্তু সরাসরি ধরা দিতে আপত্তি করে। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে নুহাশ নিঝুমকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“আহ বাবা এসব তুমি কী করছ? বোনের গায়ে হাত কেন তুলছ?”
মি.আহসান গর্জিত কন্ঠে বললেন,
“তো কী করতাম। কোথা থেকে পেল এত সাহস।বারণ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল? ওর বোকামির জন্যই আজ এতো কিছু হয়েছে।”
নিঝুম মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে। তার যে বলার মতো কিছুই নেই। নুহাশ বাবার হাত ধরে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে বাড়ির কথা বাড়িতে গিয়ে হবে। এখন চলো বোনকে নিয়ে বাড়িতে যাই।”
নুহাশের কথায় স্বায় জানালো মি.আহসান। কিন্তু আঁতকে উঠল নিঝুমের অন্তর। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে। অজানা কারণেই এ বাড়ি থেকে যেতে নারাজ নিঝুমের অন্তরিক্ষ। বারংবার মনের মধ্যে কড়া নাড়ছে অনিলা খানের বলা গতরাতের কথা গুলো। তার এক মন চাইছে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতে কিন্তু আরেক মন তা চাইছে না। তখনই মি. আহসান কড়া গলায় বললেন,
“নুহাশ তোমার বোনকে বলো চলে আসতে।”
নুহাশ গিয়ে নিঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগে। নিঝুম চেয়েও কিছু বলতে পারছে না অসহায় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে অনিলা খানের দিকে। ঠিক তখনই ইহান একটু উচ্চ স্বরে বলে,
“দাড়ান”
অনিলা খান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তিনি এটারই অপেক্ষায় ছিল। ইহান বসা থেকে উঠে একদম ওদের কাছে চলে যায়। অতঃপর নুহাশের হাত থেকে নিঝুমের হাতটি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয়। নিঝুনকে টেনে নিজের কাছাকাছি নিয়ে দাড় করায়। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে,
“এত রাগ ভালো নয় মি.আহসান। আপনার মেয়ে অন্যায় করেছে আপনি শাসন করেছেন। যেটা আমি চেয়েও করতে পারছিলাম না সেটা আপনি করে দিয়েছেন। আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এখন আপনি যেটা করছেন সেটাতে আমি ভীষণ অখুশি হয়েছি। আপনি আমার বউকে আমারই চোখের সামনে দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। দিস ইজ নট ফেয়ার মি আহসান।’
” আমার মেয়েকে আমি নিজে যাচ্ছি সেটা তুমি বলার কে?”
“আপনার একমাত্র জামাই।”
দাঁত কেলিয়ে কথাটি বলে ইহান। রাগে নুহাশের শরীর জ্বলে ওঠে। সে নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“বোন ঝটপট চলে আয়।”
নিঝুম এক পা ও নড়ে না। এবার মি. আহসান বলে,
“চলে এসো বলছি।”
নিঝুম তাও নড়ে না। ইহান শব্দ করে হেসে ওঠে। অতঃপর হাসি থামিয়ে বলে,
“দেখেছেন তো আমার বউ আমাকে ছেড়ে যেতেই চাইছে না।”
নুহাশ চোয়াল শক্ত করে বলে,
“বোন তুই কী আসবি।”
এবার নিঝুম মুখ খোলে। রিনরিনিয়ে বলে,
“নাহহহ।”
নুহাশ, মি.আহসান এবং তাদের সঙ্গে আগত সকলে সদস্য গণ ভীষণ অবাক হয়। মি.আহসান তো বলেই দেন,
“ভেবে বলছ তো। এই বাড়িতে থাকতে হলে তোমাকে আহসান বাড়ির সকলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে হবে।”
নিঝুমের গলা ধরে আসছে তবুও কোনো মতে কঠোর গলায় বলল,
“হুম ভেবেই বলছি।”
নুহাশ নিঝুমের নিকটে এগিয়ে এসে বলে,
“পাগলামি করিস না বোন বাড়ি চল।”
নিঝুম কন্ঠে কঠোরতা বজায় রেখে বলে,
“চলে যাও তোমরা।”
নুহাশ হতবাক হয়। এই কোন নিঝুমকে দেখছে সে। একদিনেই এতটা বদলে গেল কী করে। নুহাশ কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। মি.আহসান এবার শেষ বারের মতো বলে,
“আরেক বার ভেবে দেখতে পারো।”
নিঝুম ফের একই উত্তর দেয়। অতঃপর মি.আহসান নুহাশ এবং তার সঙ্গে আসা সঙ্গীদের নিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। ওনারা চলে যেতেই নিঝুম ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে কান্না শুরু করে দেয়। ইহান আড়চোখে একবার সেদিকে দেখে। অনিলা খান ইরাকে দিয়ে নিঝুমকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। ইশান এখনো বেঘোরে ঘুমচ্ছে এসব কিছুই সে টের পায় নি। বিয়েতে আমন্ত্রিত সকলে পাশেই গেস্ট হাউসে আছে তাই তারাও এসবের কিচ্ছু জানে না। শুধু ইরা,ইহান,নিঝুম, অনিলা খান এবং কয়েকজন কাজের লোক এসবের সাক্ষী। কাজের লোকগুলো নিজেদের মতোই কাজ করছে ফ্যামিলি ম্যাটারে নাক গলানো তাদের জন্য নিষিদ্ধ। ইরা নিঝুমকে নিয়ে চলে যেতেই ইহানও সেদিকে অগ্রসর হয় কিন্তু ঠিক তখনই অনিলা খান বলে ওঠে,
“কেন করলি এমন?”
ইহান পেছন ঘুরল। ভ্রু কুঁচকে দাড়িয়ে রইল।অনিলা খান ফের বললেন,
“নিঝুমের করা ওই সামান্য অপরাধের জন্য তুই যে ওকে বিয়ে করিস নি এটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম আজ পুরোপুরি সিওর হলাম। ওনাদের সঙ্গে কীসের শত্রুতা তোর যার মাশুল ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে গুনতে হচ্ছে?”
“এতকিছু জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না মা। সময় হলে ঠিক সবটা জানতে পারবে। তবে এতটুকু জেনে রাখো এই পরিস্থিতির জন্য আমি দায়ী নই। দায়ী তোমরা। প্রথমত দায়ী তুমি, যে আমার অতীত জানা সত্ত্বেও আমাকে বিয়ের পিরিতে বসতে বাধ্য করেছে। দ্বিতীয়ত দায়ী ওই মেয়েটা, যে নিজের বান্ধবীর উপকার করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছে। আর তৃতীয়ত দায়ী ওই মেয়েটার বাবা মি.আহসান, যার সঙ্গে আমার শত্রুতা বিগত চার বছর ধরে।”
কথা শেষ করে ইহান চলে যেতে নিলেই অনিলা খান দৃঢ় কন্ঠে বলেন,
“এখন তুই যাদের যাদের দায়ী করছিস এমন না হয় এক সময় এই বিয়ের জন্য তাদের কাছেই তোকে কৃতজ্ঞ থাকতে হয়।”
ইহান কিচ্ছু বলে না আর। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। ঘরের দরজার কাছে দাড়িয়ে দেখে ইরা নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু নিঝুম সে তো একাধারে কেঁদেই চলেছে। ইহান রুমে ঢুকে ইরাকে ইশারায় চলে যেতে বলে। ইরা বিনাবাক্যে রুম থেকে চলে যায়।
——————-
চলবে,
নামিহা নিশি