#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৯.
তনয়ার ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। সে উঠে ঝিম ধরে কয়েক মুহূর্ত বসে থাকল। তারপর ওড়না খুঁজে নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দূরী খালা এসেছেন। দূরী খালার সাথে ওর বিয়ের পরদিন পরিচয় হয়েছিল। উনি একবেলা এসে বাড়ির সব কাজ করে দিয়ে যান। ফ্ল্যাটের একটা চাবিও ওনার কাছে থাকে।
তনয়া দরজা খুলেই হাসিমুখের দেখা পেল। খালা ঘরে ঢুকে নিজের ঘরের মতোই কাজ করতে শুরু করলেন। তিনি যখন ওদের বেডরুমের বিছানা গোছাতে গেলেন, তনয়ার খুব লজ্জা লাগল। বিছানার চাদর দেখলেই বোঝা যাবে এর ওপর দিয়ে বেশ ঝড়ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, “খালা, রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল আপনি ধুয়ে ফেলুন। আমি এটা করছি।”
খালা নিজের মতো কিছু একটা বুঝে নিয়ে চলে গেলেন৷ তনয়া তাড়াতাড়ি বিছানা গুছিয়ে ফেলল।
দূরী খালার সাথে সাথে থেকে সে নিজের সংসারটাও চিনতে শুরু করল একটু একটু করে। প্রতিটা শোপিস, ফুলদানির ফুলগুলো আর দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিং দেখল সময় নিয়ে। বারান্দাগুলো একেবারে ফাঁকা। গাছ লাগানো যায়৷ ওরা দার্জিলিং থেকে এলেই এখানে গাছ গালাবে সে। কী কী গাছ লাগালে সুন্দর হবে এখন থেকেই কল্পনা করে নিল।
এর মধ্যে সকালের নাস্তা হিসেবে দুটো ব্রেড কোনোমতে খেয়ে কড়া এক কাপ কফি নিয়ে ডিভানে বসে আরাম করে চুমুক দিল। এই ফ্ল্যাটে কেমন একটা ঝিরঝিরে শান্তি আছে। তার নিজের সংসার বলেই কি সে এরকম শান্তি অনুভব করছে?
দূরী খালা এলেন। তার মুখের সাথে হাসিটা টেপ দিয়ে যেন জুড়ে দেয়া। “খালা, আজকা কী রানবাম?”
“আজকে রান্নাবান্না থেকে আপনার ছুটি খালা। আমিই রান্না করব। আপনি বরং একটু কাটাকুটি করে দিয়ে যান।”
“কী কাটতাম?”
তনয়া উঠে গিয়ে সব দেখিয়ে দিয়ে এলো। এখন শান্তির সাথে সুখ সুখ ভাবও হচ্ছে। এখন থেকে সে বাড়ির মালকিন। একটা আস্ত সংসারে তার কথামতো রান্না হবে, কাজ হবে। ভাবা যায়! তনয়ার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে তো আগে ভেবে দেখা হয়নি!
*
স্বরূপের খোঁটা মনে আছে তনয়ার৷ “কোনোদিন তো কিছু রান্না করে খাওয়ালে না!”
ইশ! যেন কত সময় পেয়েছে! আজ খাওয়াবে ভালো করে। দুপুরে তনয়া রান্না করেনি। গতকাল মায়ের দেখা খাবারের কিছুটা বেচে ছিল। সেগুলো খালি করে একটু টিভি দেখে বিকেলের দিকে রান্না করতে গেল।
অনেকগুলো আইটেম করল, বিশেষ করে সে যেগুলো ভালো পারে সেগুলো। গতকাল দেখেছে, স্বরূপ ভর্তা পছন্দ করে। সে তিন রকমের ভর্তা করেছে, টমেটো ভর্তা, ডাল ভর্তা আর ডিম ভর্তা৷ শিলনোড়া থাকলে আরও করতে পারত, কিন্তু জিনিসটা এই বাড়িতে নেই। ব্লেন্ডার মেশিনের ভর্তা তার একটুও ভালো লাগে না।
গরুর মাংস বিশেষ কায়দায় বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করল, সাথে খুব অল্প মসলায় রান্না করা চিংড়ি, মটরশুঁটি দিয়ে বড় মাছ, ঝাল চচ্চড়ি আর সাদা ভাত।
সব শেষে ঘরে এসে সময় নিয়ে গোসল করল সে। সুন্দর একটা জামা পরল। চোখে কাজল দিল। পারফিউম সে সাধারণত মাখে না ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্য। তবে স্বামীর সামনে নিশ্চয়ই মাখা যায়! খুব সুন্দর ঘ্রাণওয়ালা সুগন্ধি উপহার পেয়েছিল সে। সেটা মেখে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তনয়ার মনে হলো, বিয়ে হলে মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায় কথাটা তাহলে মিথ্যে না! তার নিজেরই নিজেকে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর লাগছে!
*
অপেক্ষা শেষ হলো। স্বরূপ এলো। সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ চোখেমুখে। গতরাতে ঘুম হয়নি সেটার প্রভাবও আছে। তনয়াকে দেখে মৃদু হেসে সে ভেতরে চলে গেল।
গোসল সেরে খানিক বিশ্রাম নেয়া হয়ে গেলে তনয়া বলল, “খাবে না?”
“হুম খুব ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন বলতে গেলে কিছু খাওয়া হয়নি। এত চাপ যাচ্ছে না!”
“আহারে! চলো খাবে। আমি নিজে রান্না করেছি।”
স্বরূপের মুখ উজ্জ্বল হলো। “তাই নাকি? তাহলে তো এক্ষুনি বসতে হচ্ছে!”
টেবিলে খাবারের বহর দেখে চোখ কপালে উঠল স্বরূপের। “এতকিছু!”
“হ্যাঁ। তোমার জন্য।”
স্বরূপেটা মন মায়ায় আর্দ্র হলো। মেয়েটা কত কষ্ট করেছে! সে হাত ধুতে গেল। তখনই ফোনটা বাজল।
স্বরূপ ফোন ধরতে গেল। তনয়ার একটু বিরক্ত লাগল। খেয়েও তো কথা বলা যেত। এখন নিশ্চয়ই কোনো আকাশ ভেঙে পড়েনি!
কিন্তু ওর ভুল ভাঙল। স্বরূপ ভীষণ উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। তনয়া দৌড়ে গেল শোবার ঘরে। স্বরূপ ততক্ষণে একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে ফেলেছে। ফোনে কাকে যেন বলছে, “আমি রওনা হচ্ছি।”
তনয়া ওর হাত ধরে ফেলল, “কোথায় যাবে এখন?”
“মিলির মা স্ট্রোক করেছেন৷ অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে যেতে হবে।”
তনয়া বলল, “আমিও যাই?”
“না না, তুমি গিয়ে কী করবে? কাউকে চেনোও না। তুমি থাকো। অবস্থা ভালোর দিকে গেলেই আমি চলে আসব৷ আর কোনো অসুবিধা নেই, ভয় পেও না। এই বিল্ডিং খুবই সেইফ।”
তনয়া আর কিছু বলার খু্ঁজে পেল না। স্বরূপ চলে গেল। টেবিলের খাবারগুলো পড়ে রইল অযত্নে। খাবার মানুষ চলে গেছে।
তনয়া অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। স্বরূপ এলো না। কোনো ফোন করল না, ফোন রিসিভও করল না।
তনয়া যখন খাবারগুলো তুলে রাখছিল, তখন ওর চোখে পানি চলে এলো। সে সত্যিই ভীষণ যত্ন করে রান্না করেছিল!
আবার খারাপও লাগল নিজের স্বার্থপর চিন্তার জন্য। ওদিকে একজনের মা মরতে বসেছে, আর সে খাবার নিয়ে ভাবছে!
*
স্বরূপ ফিরল সকালে। ততক্ষণে অফিসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।
“মিলি আপুর মা কেমন আছেন?”
“ভালো না। শরীর একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কথাবার্তাও বন্ধ।”
স্বরূপ দ্রুত গোসল করে তৈরি হয়ে নিল। ততক্ষণে তনয়া নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। স্বরূপ নাস্তার টেবিলের দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল তনয়া তার জন্য অনেক রান্না করেছিল। সে তনয়ার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “স্যরি তনয়া, কাল কিছু খেতে পারিনি৷ এখনো সময় নেই একদম।”
সে টেবিলে বসল না। শুধু সিদ্ধ ডিম এক গ্লাস দুধ দিয়ে গিলে নিয়ে দৌড় দিল।
তনয়ার মনে হয়েছিল গতদিনের মতো একটা চুমু অন্তত কপালে জুটবে! তাও হলো না।
গতরাতে ঘুম হয়নি, খাওয়াও হয়নি৷ এখন আর ভালো লাগছে না। আলস্য ভর করেছে শরীরে।
সে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারাটা দিন এভাবেই কাটল তার। দূরী খালা কী করছে আজ দেখলও না। সংসারের প্রতি মন কি তবে সংসার করা মানুষটার ওপর নির্ভর করে? সম্পর্ক ভালো থাকলে বস্তুগত সুখ পাওয়া যায়, না থাকলে না? কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো খারাপ হয়নি, শুধু তনয়ার মন খারাপ হয়েছে।
*
বিকেলের দিকে রূপা এলো তনয়ার সাথে দেখা করতে। সে মূলত মিলির মাকে দেখতে এসেছিল। ওদের বাসা কাছে হওয়ায় চলে এসেছে। রূপা এসে অনেক গল্প করল। একগাদা গল্প, সব সংসারের।
যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে তনু?”
“ভালো।”
“ভালোবাসাবাসি হচ্ছে?”
তনয়া হাসল, “হ্যাঁ হচ্ছে। কিন্তু তোমার বন্ধু এখনো ভাবে Love is just a myth!”
“ও একটা মাথামোটা।”
“ঠিক বলেছ!”
দুই বোন একসাথে হাসল।
তনয়ার মন ভালো হয়ে গেল।
রাতে স্বরূপ ফিরল, তবে কিছুক্ষণের জন্যই। আবার রওনা দিল হাসপাতালে। তবে আজ খেয়ে গেল। তনয়া গতকালের রান্নাই গরম করেছিল। কিন্তু খেয়ে স্বরূপ কোনো মন্তব্য করল না। তার মন যেন অন্য কোথাও চলে গেছে।
তনয়া অভিমানে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বারান্দায় বসে রইল। স্বরূপের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সে জেগে আছে দেখলে নিশ্চয়ই কোনো কথা বলবে। কথা বলার ইচ্ছে এখন আর তার হচ্ছে না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু