গহন_কুসুম_কুঞ্জে ২.

0
470

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২.

রাতে খেতে বসে তনয়া খেয়াল করল অনেকগুলো আইটেম হয়েছে। মা এত করল কখন? এমনিতে মেহমান এলে সে যথেষ্ট সাহায্য করে, কিন্তু আজ যেহেতু তাকে দেখতে এসেছিল, তাই মা রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি। এতক্ষণ বোধহয় ভাবার সময় দিল। এবার খাবার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত জানতে চাইবে।

তনয়া মাঝেমধ্যে ভাবে তার মতো ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়। আশেপাশে এত অসুখী, হতাশ আর টক্সিক লোকজন দেখতে দেখতে সে যখন নিজের ঘরের দিকে তাকায় তখন সেখানে প্রশান্তিমাখা একরাশ অক্সিজেনের বয়ে যাওয়া টের পায় সে। মা বাবার ঝগড়া সে আজ অবধি দেখেনি। তাকে ছেলেবেলা থেকেই সেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তারা দিয়েছেন যেটা যে কোনো মানুষ পেতে চাইবে। তাই তো তার বিয়ের কথা শুরু হবার পর থেকে তার কাছ থেকে কখনো কোনো বিষয় লুকোছাপা হয়নি। যা কথা হয়েছে, তার সামনে হয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে তার মতামত নেয়া হয়েছে।

আজ খাবার টেবিল ভর্তি৷ খালা খালু আছেন, আছে রূপা আপু আর তার বর ফয়সাল ভাইয়া। আজ কি তাদের সামনে তার বিয়ের কথা তোলা হবে? হতে পারে। সম্বন্ধটা যেহেতু রূপা আপুর হাত ধরেই আসা।

তনয়ার অনার্স শেষ হলো সবে কিছুদিন। মাস্টার্সে তাদের ডিপার্টমেন্টে তেমন ক্লাস করতে হয় না৷ পরীক্ষাগুলো সময়মতো দিলেই হয়। নোটস জোগাড় করে রেখেছে সে৷ তবে পড়ায় কোথায় মন বসে? জীবনটা কেমন যেন সব কিছু থেকেও নেই এর মতো ম্যাড়ম্যাড়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র এডভেঞ্চার কী হতে পারে? বিয়ে?

এই পর্যন্ত অনেক বিয়ের সম্বন্ধই এসেছে। দেখাদেখিও হয়েছে বিস্তর। তবে একটা জায়গাতেই সবটা আটকে গেছে। তনয়া বারবার পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে যেন ঠিক মনমতো কাউকে পাচ্ছে না। যার সাথেই সে কথা বলছে, তার মনে হচ্ছে তারা ঠিক তনয়াকে দেখে পছন্দ করছে না। পছন্দ করছে ওর বাবার সম্পত্তি আর সম্মান দেখে। এখন পর্যন্ত কাউকে সে তার করা দুটো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে দেখেনি। প্রশ্ন দুটো সে সবাইকে করেছে। শুধু আজকের উজবুক লোকটাকে বাদ দিয়ে। প্রশ্ন করার সময়ই বা কোথায় পাওয়া গেল?

হড়বড় করে উল্টোপাল্টা বকে চলে গেল সে। কী যেন বলছিল? “আজকালকার দিনে এসব বিয়েটিয়ে কে করে? যাদের আইকিউ কম তারাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায়। পড়াশুনা করে ক্যারিয়ার গড়াটাই মেইন ফোকাস হওয়া উচিত। এখন বিয়ের আগেই বিয়ের চাহিদা পূরণ হয়ে বিয়ে দিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে কী?”

এসব কথার প্রতিবাদ করেনি তনয়া। বিরক্ত হয়ে শুনছিল। শুধু শেষ কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল তার। লোকটা বাঁকা হেসে বলেছিল, “তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি যদি তুমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারো তুমি ভার্জিন।”

তনয়া দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলেছিল, “গো টু হেল!” তারপর ছুটে চলে এসেছিল ছাদ থেকে।

পেছনে লোকটা পাগলের মতো হাসছিল।

“তনু, শুনতে পাচ্ছ?” বাবার ডাকে সম্বিত ফিরল তনয়ার। সে একমনে বিকেলের কথা ভাবছিল আর ভাতের ওপর এলোমেলো আঁকিবুঁকি করছিল।

মাথা তুলে সে বলল, “স্যরি বাবা। কিছু বলছিলে?”

“তোমার মতামত জানতে চাইছিলাম। কেমন লাগল স্বরূপকে? আমার তো বেশ লেগেছে। ভালো দেখতে, চমৎকার ক্যারিয়ার। কথা শুনে মনে হলো চিন্তাভাবনাও বেশ গোছানো।”

তনয়া মনে মনে বলল, “ছাই! হাতির মাথা! এমন লোককে ভালো লাগল কী করে!”

মাও বাবার সাথে যোগ দিলেন, “আমারও কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। পাটিসাপটা পিঠা কী মজা করেই না খেল! নিজে থেকে আরও দুটো চেয়ে খেল। এক্কেবারে আদুরে ছেলে!”

তনয়া এবার মনে মনে বলল, “মা-টাও না! যাকে মনমতো খাওয়াতে পারবে সেই তার চোখে ভালো মানুষ হয়ে যাবে!”

এবার ফয়সাল ভাইয়া যোগ দিলেন, “অনেকদিন ধরেই চিনি ওকে। ছেলেটা ভীষণ রকমের সৎ।”

তনয়া মনে মনে বলল, “সেজন্যই জানে না মেয়েদের সাথে কিভাবে সদ্ব্যবহার করতে হয়!”

রূপা কিছুই বলছিল না। চুপ করে চেয়েছিল তনয়ার দিকে। এত এত প্রশংসায় ভাসাভাসির মধ্যে দিয়ে টুপ করে ‘আমার ভালো লাগেনি’ বলে দেয়া যায় না৷ রূপার কথা শুনে খানিকক্ষণের জন্য তার মন দুর্বল হলেও ভেতরে ভেতরে সে ঠিকই জানে, ছেলেটার সাথে তার বনিবনা হবে না। এমন বিয়েতে লাভ কী? সে ছোট্ট সুন্দর একটা সংসার চায়। সেখানে ভালোবাসার পাশাপাশি একে অপরের প্রতি সম্মান মিলেমিশে থাকবে।

তনয়া একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এখনো শিওর নই। আমার তোমাদের মতো এত ভালো লাগেনি।”

কথাটা শোনার পর কেউই আর কোনো মন্তব্য করল না।তনয়া খেয়াল করল বাবার মুখটা কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে গেল। তার হঠাৎ মনে হলো, বাবা কি এক মুহূর্তের জন্য হলেও পস্তাচ্ছেন? তার কি মনে হচ্ছে, মেয়েকে বেশি ছাড় দিয়ে ভুল করে ফেলেছেন? তার থেকে বরং অনেক বাবাদের মতো জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেই ভালো করতেন? তার কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল।

রূপা এতক্ষণে কথা বলল, “আচ্ছা তনু, তুই তো এখনো শিওর হতে পারিসনি৷ কিন্তু না-ও তো করিসনি। তুই আরও সময় নে। আমি এখনই ওদের কিছু বলব না।”

মা এবার জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা কি তনুকে পছন্দ করেছে?”

“অপছন্দ করার কোনো কারনই নেই।”

সেই রাতে তনয়া শুতে গেল দেরিতে৷ ফয়সাল ভাইয়া এলে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়া হয়। তিনি নিজেই স্পেশাল কফি বানান, গান গেয়ে শোনান, আর তার ঝুলিতে আছে দেশ-বিদেশভ্রমণের বিচিত্র সব গল্পের পসরা। তনয়ার খুব ভালো লাগে সেসব শুনতে। কিন্তু আজ সে যেন কিছুতেই মন দিতে পারল না। রাতে শুয়েও এসবই এলোমেলো ভাবতে লাগল।

ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখল তুলোর মতো মেঘপুঞ্জ তাকে ঘিরে ধরে আছে। সে হাত দিয়ে মেঘ সরাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। মেঘের দল ফিসফিস করে কী যেন বলছে। বাতাসের তোড়ে শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে কানে আসার আগেই। মেঘের ওপাড় থেকে কে যেন চিৎকার করে বলছে, “তোমার কি আইকিউ কম? সামান্য মেঘ কেটে বেরিয়ে আসতে পারছ না?”

**********

তিনদিন পর তনয়া নিউমার্কেটে গেল জামাকাপড় কিনতে৷ এবার শীতে তাদের প্ল্যান আছে একবার গ্রামের দিকে যাবে। গ্রামে শীত তুলনামূলকভাবে বেশি। এদিকে ঢাকায় শীত কম পড়ে বলে তার শীতের জামাকাপড় কেনা হয় না অনেকদিন। ফুটপাত থেকেই একটা ডেনিম জ্যাকেট বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছে তার। সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার সময় চোখ গেল একটা লোকের দিকে। ঠিক চিনল সে। স্বরূপ! গায়ে হালকা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, চোখে সানগ্লাস! কী দারুণ লাগছে তাকে! দেখতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷ কাকে যেন ফোনে ট্রাই করেও পাচ্ছে না।

তাকে অন্যমনষ্ক দেখে দোকানদার জিজ্ঞেস করল, “আপা নিবেন না?”

তনয়া চোখ ফিরিয়ে জ্যাকেটে মন দিল। ওই লোককে নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার কোনো অর্থ হয় না। জ্যাকেটটা কেনার পর আবার সেদিকে তাকিয়ে দেখল স্বরূপ চলে গেছে৷

তনয়া আরও কিছু শপিং করল। কয়েকটা ফ্লোরাল প্রিন্টের ওড়না পেয়ে কিনে ফেলল, একটা ঘড়ি কিনল, দুটো লিপস্টিকও কিনে ফেলল। শেষে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে খেতে খেতে পা বাড়াল বাইরে। রিকশা খোঁজার দিকে মন তার।

রাস্তার ওপাশে নীলক্ষেতের ফুটপাতে চোখ গেল বোধহয় হলুদ রঙটা দেখেই। কোথায় যেন শুনেছিল হলুদ রঙ দূর থেকেও ফোকাসে চলে আসে?

ছেলেটা বসে আছে ফুটপাতে। ওকে ঘিরে কয়েকটা পথশিশু। কোনো মজার গল্প বলছে কি? বাচ্চাগুলো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তনয়ার একবার ইচ্ছে হলো গিয়ে দেখে। আবার ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল সে। লোকটাকে পাত্তা দেবার কোনো মানে নেই। অবশ্য সে কাছে গেলে লোকটা নিজেই তাকে পাত্তা দেবে না এই সম্ভাবনা প্রবল।

তনয়া রিকশা খুঁজতে লাগল। আজ কোনো রিকশাই যাত্রাবাড়ী যেতে রাজি হচ্ছে না। কী সমস্যা?

হঠাৎ কে যেন ওর ওড়না ধরে মৃদু টান দিল। কোনো বদ ছেলের কাজ ভেবে ঝট করে ফিরে তাকিয়ে তনয়া দেখল একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা ঠিক ভিক্ষা চাইতে আসেনি। ওর মুখে হাসি। হাসি হাসি গলায় সে বলল, “আপা, আপনারে বাঈয়ে ডাকে।”

“কোন ভাই?”

বাচ্চাটা আঙুল দিয়ে সোজা দেখাল। সেখানে সানগ্লাস পরা হলুদ পাঞ্জাবি দাঁড়িয়ে আছে। তনয়াকে তাকাতে দেখে এগিয়ে এলো সে। বাচ্চাটাকে বিদায় করে দিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে তোমাকে পেয়ে গেলাম। রূপা জ্বালিয়ে মারছে। তোমার সাথে আরেকবার কথা বলতে বলছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়িতে না করে দেবে। কিন্তু তা করোনি৷ ঝুলিয়ে রেখেছ। তোমার নাকি দুটো কোশ্চেন আছে, সেগুলোর উত্তর দিতে পারলে আমার ছুটি। ফোন করতে চেয়েছিলাম, নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি। প্রশ্নগুলো ঝটপট করে ফেলো তো।”

রূপা তনয়াকেও বলেছিল ও যে প্রশ্নগুলো সব পাত্রকেই করে থাকে সেগুলো স্বরূপকে করতে। স্বরূপ নিজেই নাকি যোগাযোগ করবে। করেনি বলে কথাটা ভুলেই গিয়েছিল তনয়া। এখন মনে পড়ল৷ সামনে যখন পড়েছে, করে ফেলতে আর দোষ কী?

সে বলল, “একটু নির্জন জায়গায় যাওয়া যাবে? এখানে এত ভিড়ের মধ্যে সিরিয়াস আলাপ করা যায় না।”

স্বরূপ চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক কতটা নির্জন চাও?”

তনয়ার ইচ্ছে করল লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে। সে নেহায়েতই ভদ্র বলে কাজটা করতে পারল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কোনো প্রশ্ন নাই। চলে যান আপনি।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here