#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ২)
————–
এক সপ্তাহ কেমন চোখের পলকেই পার হয়ে গেল। সমর্পণ সোনালী, তুশী আর নিঝুমকে নিয়ে ঢাকায় শিফট হয়ে এসেছে। চেনা শহর, চেনা পথঘাট আজ বড্ড অচেনা নিঝুমের কাছে। হবে নাই বা কেন এই চার বছরে সে তো নিজেই নিজের কাছে অচেনা। সেক্ষেত্রে তো এই ইট, কাঠ,পাথরের দালানে আবৃত শহরের বদলে যাওয়াটা নিছকই তুচ্ছ।
ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে নিয়ে তৈরি হতে লেগে পড়ল নিঝুম। একে তো নতুন ক্যাম্প তারওপর তার কাঁধে চাপানো বড়সড় দ্বায়িত্বের বোঝা। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। সমর্পণ অনেক আগেই বেড়িয়ে গেছে। নিঝুম তৈরি হয়ে তুশী, সোনালী থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বাইকে চেপে সোজা ক্যাম্পের পথ ধরে।
—————-
– ভাইয়া চলো। আজ তো আশ্রমে যাওয়ার ডেট। বাচ্চাগুলোকে দেখে আসতে হবে। ওরা প্রতি মাসের এই দিনটিতে তোমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করে থাকে। তুমি না গেলে তো ওরাও কিছু মুখে তুলবে না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
ইরার কথায় ইহান ছোট্ট করে, “হু” বলল শুধু। পরপরই উঠে চলে গেল ফ্রেশ হতে। আশ্রমের কথা শুনলে ইহান না করতে পারে না। প্রতি মাসের এক তারিখে আশ্রমে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায় সে। এই আশ্রমটা তার বাবার নামে করা। সকল অনাথ,অবহেলিত শিশুদের জন্য। আশ্রমের শিশুদের কাছে ইহান খুবই প্রিয় পাত্র। সেখানকার সকল বাচ্চারা তাকে ভালো ভাইয়া বলে ডাকে। ইরাকে বলে ভালো আপু। আর ইশানকে বলে দুষ্টু ভাইয়া। কারণ ইশান ওদের সঙ্গে প্রচুর দুষ্টুমি করে, বিরক্ত করে তোলে খুব।
ইরা,ইশান, ইহান তিনজন গাড়ি করে রওনা হয়ে গেল আশ্রমের পথে। অনিলা খান বাসায় আছেন। শারীরিক সমস্যার দরুন তিনি তেমন একটা যেতে পারেন না।
—————-
ঢাকা শহরের সবথেকে বড় প্রবলেম হলো এই ট্রাফিক জ্যাম। একবার জ্যাম বাঁধলে ছাড়াছাড়ির আর কোনো ওয়ে নেই। এটা অবশ্য নিত্যদিনের রুটিন। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বাইকের ওপর দু-হাত টান টান করে রেখে সামনে তাকিয়ে আছে নিঝুম।
জ্যামে আটকে দাড়িয়ে পড়েছে ইহান-দের গাড়িটাও। ইরা, ইশান বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল। ইহানের সেদিকে কোনো পরয়া নেই। সে তো আপনমনে জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। ইরা ইহানের এক কাঁধে হাত রেখে আলতো কন্ঠে ডাক দিল। ইহান চমকে উঠে পাশ ফিরে বলল, “কিছু না।” ইরা চুপ করে রইল। কিয়ৎক্ষণ বাদেই ইহান কেমন জানি দিশেহারা হয়ে পড়ল। বেশ অস্থিরতা নিয়ে জানালার বাহিরে মাথা বের করে দিল। ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে গেছে। ইরা, ইশান ইহানের এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ওকে টেনে ভেতরে ঢোকায়। ইরা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কী হয়েছে ভাইয়া এমন করছ কেন? খারাপ লাগছে বেশি?
ইশানও ইরার সঙ্গে তাল মেলায়,
– হ্যাঁ ভাইয়া কী হয়েছে বলো না?
ইহান হাতের ইশারায় বাহিরের দিকে দেখায়। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। ওর শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা বুলি আওড়ে বলল,
– নি… নি.. ঝু..ঝুম
ইরা, ইশান দুজনেই অবাক। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অতঃপর ইরা বলল,
– এসব তুমি কী বলছ ভাইয়া বউমনি কোত্থেকে আসবে? বউমনি তো আরও চার বছর আগেই….
কথা শেষ করতে পারে না ইরা। চোখজোড়া জলে চিকচিক করে ওঠে। ইশান ইরার কাঁধে হাত রাখে। ইরা নিজেকে সংযত করে নেয়। ইহান গাড়ির সিটে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে বলে,
– স..সত্যি বল..ছি আমি।
অতঃপর ইহান চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকে। ইরা,ইশান বুঝতে পারছে না এটা কী করে সম্ভব? তবে এই চার বছরে এমন কথা ইহান কখনো বলেনি। এটাই প্রথম। কিছু যদি না দেখে থাকে তবে এমন অদ্ভুত প্রসঙ্গ তোলার মতো মানুষ ইহান নয়। তবে কিছু তো একটা ঘটেছেই যা ইরা আর ইশান দেখি নি। তবে সেটা কী?
—————-
নিঝুমকে সঙ্গে নিয়ে সমর্পণ ডিরেক্ট এখানকার থানায় চলে গেল। থানার সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলে ইহানের বাবার মৃ’ত্যু এবং তার রেখে যাওয়া সেই অসমাপ্ত কাজ যেটা চার বছর আগে শেষ করতে করতেও শেষ করতে পারে নি ইহান। সেই অসমাপ্ত কাজের দ্বায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো নিঝুমের কাঁধে। সিনিয়র অফিসারের কাজ থেকে সবরকম দ্বায়িত্ব বুঝে নিয়ে নিঝুম আজকের মতো বাড়িতে চলে গেল। সমর্পণ সেখানে আরও কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করল। তার মতে এই কেস সালুয়েশনের জন্য নিঝুম’ই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।
সমর্পণ পেশায় একজন আর্মি অফিসার। নিঝুমকে সে নিজের হাতে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে তার জুনিয়র অফিসার পদে। চার বছর ধরে নিঝুমকে গড়ে পিঠে তৈরি করেছে একজন দক্ষ দেশসেবিকা হিসেবে। প্রথম প্রথম নিঝুম খুব ভয় পেত। তার রক্তে ফোবিয়া জনিত সমস্যার কারণে অচেতন হয়ে পড়া জিনিসটা নিয়ে অনেক বার সমর্পণকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। তবুও সে হাল ছাড়ে নি। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তুলেছে নিঝুমের সেই উইকনেস। নিঝুমের অতীত জানার পর থেকেই সমর্পণের তীব্র ইচ্ছে নিঝুম নিজ হাতে তার অপরাধীদের শাস্তি দিক। দেশের বুকে নিজের নাম লেখাক। সেই জন্যই সে এই কেসের ভারটা নিঝুমের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। মূলত নিঝুম বা সমর্পণ কারোরই পুলিশি কেস হ্যান্ডেল করার কথা নয় তবুও এটা পারসোনাললি সমর্পণ এ্যারেন্জ করেছে।
—————
আশ্রমে আজ আর যাওয়া হলো না ইহানদের। ইহানের শরীরের অবগতির জন্য গাড়ি ব্যাক করে বাড়িতে চলে এলো ওরা। অনিলা খান এসব কথা শুনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। ইরার বেশ খটকা লাগলো। এমন অদ্ভুত কথা শুনেও তার মা কীভাবে চুপ আছে? তিনি কী আগে থেকে কিছু জানেন?
বাড়িতে এসে থেকেই নিঝুমকে দেখার ব্যাপারটা ইহানকে বেশ ভাবাচ্ছে। সে সময় সাময়িক অসুস্থতা ফিল করলেও এখন সে দিব্বি ফিট আছে। নিঝুমের শূন্যতায় সে একগুয়ে জীবন কাটালেও তার মস্তিষ্ক পুরোপুরিই সতেজ আছে। শুরু মাত্র একটু ঝিমিয়ে গেছে। নিঝুমকে এক ঝলক দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা যেন আবার তাজা হয়ে উঠেছে। কিছু একটা ভেবে ইহান তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে পুলিশ স্টেশনে। সাময়িক ছুটি কাটাচ্ছিল এতদিন সে। তবে আজ থেকে আবার কাজে জয়েন করবে এবং সেই সাথে নিঝুমকে খুঁজবে। তার বিশ্বাস নিঝুম আছে। এই শহরেই আছে। একদিন সে ঠিক তার দেখা পাবে। দেখা পাবেই।
– কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া?
ইশানের প্রশ্নে দাড়িয়ে পরে ইহান। হ্যান্ড ঘড়িটির বেল্ট আটকাতে আটকাতে তার উত্তর,
– থানায় যাচ্ছি
– কেনো? কোনো প্রবলেম হয়েছে কী?
– নাহ! অনেক দিন কাজে অবহেলা করেছি আর নয় এখন সময় হয়েছে ব্যাক করার।
– ওহ আচ্ছা। বেস্ট অফ লাক।
– থ্যাংকিউ
ইহান চলে যায়। ইশান কৌতুহলী মনে ভাবতে থাকে,
– ভাইয়ার হলো টা কী? মনে হচ্ছে এই সেই চার বছর আগের ইহান। এতদিনের পাগলাটে ইহান আর নেই।
—————-
বাড়িতে কেউ নেই। মেইন ডোর লক করা দেখেই নিঝুম বুঝে গেছে সোনালী হয়তো তুশীকে নিয়ে বেড়িয়েছে। ডুপ্লিকেট চাবি দ্বারা ডোর ওপেন করে সে ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ নেয়। তারপর কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি করে আবার রুমে চলে যায়। অতঃপর থানা থেকে সংগ্রহকৃত ডকুমেন্টস গুলো চেক করতে বসে পড়ে। সব তথ্য খুব নিখুঁত ভাবে দেখে নেয়। সব তথ্যের ভিত্তিতে একটি কথাই নিঝুমের মাথায় ঘোর পাক খেতে থাকে। পেনড্রাইভ টা এখন কার কাছে আছে? নাকি নষ্ট করে দিয়েছে? কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই বেলকনিতে চলে যায় সে। কিছুক্ষণ ভাবনা – চিন্তার পরপরই তার মস্তিষ্কে প্রবল ভাবে একটি কথা হানা দেয়। হ্যাঁ! সে পেয়ে গেছে উত্তর। পেন ড্রাইভের খোঁজ হয়তো তার নাগালে। পেন ড্রাইভ টা যে এখনো পর্যন্ত নষ্ট করা হয়নি এটাও সে সিওর। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির দেখা মেলে তার। নিঝুম কফির মগটা পাশের টি-টেবিলে রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। দুপুরের আকাশটা রোদে ঝলমল করছে। আকাশের দিকে তাকানো দ্বায়। রোদের উত্তাপে চোখ যেন ঝলসে পড়ে। নিঝুম চোখ বন্ধ করে নেয় ততক্ষণাৎ। মনের মধ্যে কিছু স্মৃতি স্মরণ করে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ায়,
কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা
জীবন স্রোতে ভাসছি একা
জমানো অনেক মনের কথা
অভিমানে পড়ছে চাপা
—————-
চলবে,
লেখিকা – নামিহা নিশি
(প্রিয় পাঠকমহল,,, সকলে এত অধৈর্য্য কেন হচ্ছেন? গল্পে কোনো গড়মিল হয়নি। সময় মতো সব মিলে যাবে। একটু ধৈর্য সহকারে পড়ে নিন সকলের উত্তর পেয়ে যাবেন। এই পরিচ্ছদ বেশি বড় করার ইচ্ছে নেই। খুব তাড়াতাড়ি ক্লিয়ার করে দেবো।)