#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্বঃ১১)
—————
ইমার্জেন্সিতে ট্রিটমেন্ট চলছে সমর্পণের। আঘাত বেশ গুরুতর। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পরেও মারিয়া ছল ছাতুরি করে যাওয়ার আগে নিঝুমের দিকে শেষ টার্গেট করেছিল কিন্তু সমর্পণ সেটা লক্ষ্য করে নিঝুমকে আগলে নিজে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে যায়। ফলস্বরূপ ছু’রির আঘাতে ততক্ষণাৎ ক্ষতবিক্ষত হয় তার পৃষ্ঠদেশ। সেই মুহূর্তে ইহান আর নিঝুম তাকে নিয়ে হসপিটালে এডমিট করে।
খান বাড়ির সকলে উপস্থিত হসপিটালে সেই সঙ্গে তুশী,সোনালীও আছে। তুশী তেমন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে শুধু নিঝুমের বুকে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। নিঝুমকে বেঁধে রাখার সেই দৃশ্য তার ছোট্ট মনটিতে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করেছে। যার দরুন সে কোনো মতেই তার মা’কে ছাড়তে চাইছে না। কিন্তু সকলের থমথমে মুখ, থেকে থেকে কান্নার আওয়াজে ভয় পাচ্ছে তার ছোট্ট মস্তিষ্ক। সোনালী অঝরে কেঁদে চলেছে। যেটা ইশানের পক্ষে মেনে নেওয়া একদমই সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সব কথার বড় কথা হলো অনিলা খান অস্বাভাবিক ভাবে কাঁদছে। এটা নিয়ে ইরা,ইশান,ইহান সকলেই বেশ চিন্তিত। তবে সমর্পণের সঙ্গে যে তার কোনো যোগ সূত্র আছে এটা তার ব্যবহারে সুস্পষ্ট। নিহানও আছে ওদের সঙ্গে। ভাই,বোনের কর্মকাণ্ডে সে ভীষণ ভাবে লজ্জিত।
——————
পিটপিট চোখ মেলে তাকিয়ে সর্ব প্রথম যে নামটি সমর্পণ উচ্চারণ করে তা হলো “নিঝুম।” চোখ মেলে তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “নিঝুম ঠিক আছে তো?” নিঝুমকে ঘিরে তার এতো উদ্বীগ্নতা পছন্দ হলো না ইহানের। ইহান ততক্ষণাৎ কেবিন থেকে বেড়িয়ে যেতে নিচ্ছিল ঠিক তখনই তার পা থেমে যায় নিঝুমের কন্ঠস্বরে। নিঝুম আকুতি মাখা কন্ঠে সমর্পণকে ভাইয়া বলে ডাকছে। তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। উপস্থিত সবাই কিছুটা হতবাক। ইরা,ইশান, নিহান আর ইহান হতবাক কারণ তারা এতদিন যা ভেবে এসেছে তা হয়তো সম্পূর্ণ ভুল এটা ভেবে। আর অনিলা খান আর সোনালী হতবাক কারণ এই চার বছরে নিঝুমকে দিয়ে কখনো সমর্পণকে ভাইয়া বলাতে পারে নি। নিঝুম সর্বদা স্যার বলেই সম্মোধন করতো। কিন্তু আজ যখন নিজের কাছের মানুষটির এমন করুণ পরিণতি দেখল তখন সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এই চার বছরে নিঝুম সমর্পণকে নুহাশের থেকে আলাদা চোখে দেখে নি। নুহাশ যেমন তার ভাই সমর্পণও ঠিক তেমনই তার ভাই। তবে দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক। নুহাশ তার ছোট ছোট আবদার গুলোকে সবসময় পূরণ করতো। তাকে ভালবাসত কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তাদের পথ ভিন্নগামী পথে অগ্রসর হয়েছে। এদিকে সমর্পণ তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে শিখিয়েছে। নিজের প্রয়োজন নিজে পূরণ করার রাস্তা দেখিয়েছে। স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পদে পদে আগলে রেখেছে। রক্তের সম্পর্ক সবসময় বড় হয় না কিছু কিছু সময় রক্তের সম্পর্ককে ছাপিয়ে তৈরি হয় আরও একটি সম্পর্ক। আর সেটি হলো আত্নীক সম্পর্ক। সমর্পণের সঙ্গে তার আত্নীক সম্পর্ক। যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।
সমর্পণ খুব সন্তপর্ণে নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এক বাহুতে নিঝুমকে আকরে ধরে অন্য বাহুতে সোনালীকে আসতে ইশারা করল। সোনালী যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল। ভাইয়ের অনুমতি পেয়ে ঝাপিয়ে পড়ল তার বাহুডোরে। তুশীকে তখন অনিলা খান আগলে নিয়েছে। দু’বোনকে স্নেহ করার পর সমর্পণ অনিলা খানের দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
“এত সহজে তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না ফুপিমনি। আর কেঁদো না প্লিজ।”
অনিলা খান শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলে,
“যেতে দিচ্ছে কে তোকে। আমাদের সকলের এতো এতো ভালবাসা ফেলে কীভাবে যেতে পারতি তুই।”
নিঝুম হাসোজ্জল মুখে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বলেছ কে যেতে দিচ্ছে ভাইয়াকে। ভাইয়ার চলে গেলে আমাকে কে দেখবে শুনি?”
সমর্পণ মৃদু হেসে বলে,
“তোর একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করবো পাগলী। যাতে করে আর তোকে একা একা কষ্ট পেতে না হয়।”
সোনালী মিটমিটিয়ে হাসল। নিহান,ইরা,ইশান, ইহান সকলেই সমর্পণের সঙ্গে টুকটাক কথা বার্তা বলল। শেষমেশ সমর্পণ তুশীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমের দেশে পারি দিল। তুশী ভেতর থেকে নার্ভাস হওয়ায় খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল। ওদের এখন রেস্টের প্রয়োজন।
——————
অনিলা খানের অনুরোধে চৌধুরী পরিবার খান মঞ্জিলে আতিথেয়তা রক্ষা করতে গেল। সমর্পণকে রিলিজ দেওয়া মাত্রই তারা ও বাড়িতে গিয়ে উঠল। ইহান এই কয়েকদিনে নিঝুমের সঙ্গে অনেক বার কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু নিঝুম তা হতে দেয় নি। সে খুব সন্তপর্ণে এড়িয়ে চলেছে ইহানকে। কিন্তু আজ আর তা পারল না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে সকলে যখন নিজ নিজ ঘরে রেস্ট নিতে ব্যস্ত ঠিক সেটারই ফায়দা লুটে ইহান৷ চুপিচুপি নিঝুমের ঘরে চলে যায়। কিন্তু নিঝুম একা নয় তার সঙ্গে তুশীও আছে। তবে তুশী ঘুম। ইহান বড় করে শ্বাস ফেলে ভেতরে অগ্রসর হলো। নিঝুম তখন ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। ইহান ধীরে সুস্থে গিয়ে নিঝুমের পাশে বসে পড়ল। নিঝুম এক পল তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। ইহানকে না দেখার ভ্যান ধরে নিজের কাজে মন দিল। ইহান নিঝুমের এহেন কান্ডে বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপ-টা বন্ধ করে দেয়। নিঝুম চরম রেগে গিয়ে ইহানের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কিন্তু ইহান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এক ঝটকায় নিঝুমকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। নিঝুম ছোটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল কিন্তু ইহান ছাড়ার পাত্র নয়। সে ঠোঁটের কোণে শয়তানির লেস লাগিয়ে বলল,
“একবার ভুল করেছে তবে বার বার একই ভুল করছি না।”
“ছাড়ুন বলছি আমাকে।”
“রাগলে তোমায় আরও বেশি মায়াবী লাগে বউ।”
বউ শব্দটি যেন নিঝুমের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হলো। হৃদপিন্ডে দুরুম দুরুম শব্দে অস্থির হয়ে উঠল সে। এই মুহুর্তে তাকে মুক্তি পেতে হবে ইহানের থেকে নয়তো দম আটকে ম’র’তে হবে। ইহান নিঝুমের অস্থিরতা দ্বিগুণ করতে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এভাবেই সারাজীবন মরতে হবে তোমায়। প্রতিনিয়ত আমাকে তিলে তিলে মেরেছ এবার আমার পালা। ভালোবাসায় বন্দিনী করে মারবো তোমায়। দম ফেলার জায়গা পাবে না। লজ্জায় মরতে মরতে মুখ লুকবে আমার বক্ষপিঞ্জরে।”
নিঝুম এক ধাক্কায় ইহানকে দুরে ঠেলে দিল। ইহান বোধহয় জানত এমন টাই হবে। সে বিছানায় হেলে পড়ল কিছুটা। নিঝুম রেগেমেগে তার দিকে তাকিয়ে আছে তবে চেহারায় লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। ইহান তা দেখে ঈষৎ হাসল। নিঝুম তেজস্বী কন্ঠে বলল,
“বেড়িয়ে যান। মা বলেছে তাই এখানে আসা নয়তো এই দৃষ্টে পা ফেলার ইচ্ছে এই নিঝুমের ছিল না।”
ইহান এবার সোজা হয়ে দাড়ালো। একদম নিঝুমের কাছাকাছি গিয়ে চোখে চোখ মিলিয়ে বলল,
“আর কতো ঝুম? আমি যে আর পারছি না। এবার একটা বিহিত তো হতেই হবে। হয় তুমি আমার হবে নয়তো তোমার হাতেই আমাকে শেষ করে দেবে।”
“কী সব যা তা বলছেন? দেখুন আমার এসব ভালো লাগছে না। আমি আমার পরিবার নিয়ে বেশ ভালো আছি আপনার সঙ্গে নতুন করে মায়ায় জড়াতে চাই না।”
“প্লিজ ঝুম ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। এমন চলতে থাকলে আমরা কেউ ভালো থাকবো না। অনেক তো হলো এবার না হয় অতীত ভুলে নিজেদের মতো করে গুছিয়ে সবটা শুরু করা যাক।”
ওদের কথার মধ্যে ঘরে প্রবেশ করে সমর্পণ আর অনিলা খান। নিঝুম কিছু বলতে নিয়ে আবার ওদের দেখে চুপ হয়ে যায়। সমর্পণ এসে নিঝুমের কাঁধে হাত রাখে। বলে,
“দেখ বোন এতদিন যা হয়েছে যেভাবে হয়েছে আমি মেনে নিয়েছি কিন্তু এখন আমারও মনে হচ্ছে তোর অতীত ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করা উচিত। ইহান তোকে সত্যিই ভালবাসে। ও ওর ভুলের যথাযথ শাস্তিও পেয়েছে তবে এখনো কেন এতো দুরত্ব থাকবে?”
একে একে ওই ঘরে তখন ইরা,ইশান,সোনালী সকলে প্রবেশ করে। অনিলা খান সহ সকলে নিঝুমকে অসম্ভব বোঝায়। ইহান ততক্ষণে সে স্থান ত্যাগ করেছে। নিঝুম খেয়াল করে ইহান কেমন নিস্তেজ হয়ে চলে গেছে। নিঝুম এবার নিজেকে নরম করে। সকলের জোরাজুরিতে আলতো হেসে সম্মতি জানায় তাদের পক্ষে। সকলে ভীষণ খুশি হয় কিন্তু এই খুশির খবর শোনা হয় না কেবল ইহানের। তুশী এখনো বেঘোরে ঘুমচ্ছে। বাবার মতো ঘুম কাতুরে মেয়ে সে।
—————–
রাতে ইহান বাড়ি ফিরে খুব লেট করে। সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। অনিলা খান জেগে থাকলেও বাহিরে আসলেন না কারণ তিনি চাইছিলেন নিঝুম আসুক। নিঝুমও যে নির্ঘুম এখনো সে তা ভালো করেই জানে। ওনার ধারণা ঠিক প্রমাণ করে নিঝুম ঠিক বেড়িয়ে এলো। ইহান তখন সিড়ি বেয়ে টাল-মাতাল পায়ে ওপরে উঠছিল। কেমন উশকো খুশকো লাগছিল তাকে। নিঝুমের বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। সে ধীরে পায়ে এসে ইহানের সামনে দাড়ায়। ইহান ততক্ষণে শেষ সিঁড়ি টা অতিক্রম করে নিঝুমের মুখোমুখি পৌঁছে গেছে। দুজনেই দুজনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়। ইহান ভেবেছে নিঝুম হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইহানের অপলক দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিঝুম বলে উঠে,
“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”
ইহান ধ্যান থেকে বেড়িয়ে ফের সুধায়, “হ্যাঁ।”
নিঝুম বিরক্তি নিয়ে বলে,”খেতে আসতে বলেছি। ওয়েট করছি।”
নিঝুম ইহানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ডাইনিং চলে যায়। ইহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না নিঝুম নিজে থেকে এসব করছে। ইহান রুমে গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। নিঝুম ততক্ষণে খাবার গরম করে সার্ভ করে দিয়েছে। ইহান গুটি গুটি পায়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। নিঝুমও বসে। ইহান দেখে নিঝুম নিজের জন্যও খাবার নিচ্ছে। তারমানে নিঝুম এত রাত অব্দি না খেয়ে ছিল কিন্তু কেনো? ইহানকে বসে থাকতে দেখে নিঝুম বলে,
“কী হলো খাচ্ছেন না যে?”
“হু হুম খাচ্ছি তো।”
অতঃপর দু’জনে খেতে আরম্ভ করে। ইহান খাওয়ার মাঝে নিঝুমকে বারংবার পরখ করছে কিন্তু নিঝুম একমনে খেয়েই চলেছে। খাওয়া শেষ করে নিঝুম টেবিলটা গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে নেয়। ইহান তখন সোফায় বসে ছিল। নিঝুমকে যেতে দেখে সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করে,
“এত রাত অব্দি না খেয়ে ছিলে কেনো?”
নিঝুম দাড়িয়ে পড়ে। পেছন না ঘুরেই উত্তর দেয়,
“আমার কিউট,হ্যান্ডসাম,পাগলাটে বর টার জন্য ওয়েট করছিলাম।”
কথাটা বলেই নিঝুম দৌড়ে চলে যায়। পেছনে ফেলে যায় একরাশ কৌতুহলী, উচ্ছ্বসিত মুখশ্রী। ইহান নিঝুমের এমন উত্তর আশা করে নি৷ তবে এমন উত্তর পেয়ে তারচেয়ে খুশি আর কেউ হয় নি।
——————-
পরদিন সকালে ইহান বাড়িতে একজন অতিথি নিয়ে হাজির হয়। সকলকে লিভিং রুমে আসতে বলে। সকলে প্রথমে না চিনলেও পড়ে জানতে পারে এটা নিঝুমের মা। দীর্ঘ সময় পরে মায়ের সান্নিধ্যে পেয়ে উচ্ছ্বসিত নিঝুম বাচ্চামো করতে থাকে। স্বামী এবং ছেলের কুকর্মে তিনি ভীষণ ভাবে লজ্জিত। সকলের কাছে তাদের হয়ে কতবার যে ক্ষমা চাইল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সে এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবে। ও বাড়িতে একা একা থেকে কষ্ট পাবে অযথাই।
মারিয়া, মায়ানের অজস্র খু’নে’র রেকর্ড আছে সেই সঙ্গে সকল অপকর্ম তারা করে থাকে। সবদিক বিবেচনা করে আদালত তাদের যাবৎ জীবন কারাদণ্ড দেয়। আর আহসান সাহেবকে ১৪ বছর এবং নুহাশকে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
——————–
লিভিং রুমে বৈঠক বসেছে। সমর্পণের সঙ্গে তাদের মায়ের কী সম্পর্ক এবং নিঝুমকে সমর্পণ কীভাবে পেল এটা জানতে। অবশেষে অনিলা খান মুখ খুললেন। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি বলতে শুরু করলেন,
“সমর্পণ হলো আমার একমাত্র ভাইয়ের ছেলে। ভাই অনেক বছর আগেই মারা যায়। আর ভাবি লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে মারা যায়। সমর্পণ পড়াশোনা শেষ করে আর্মি পদে জয়েন করে সেদিনই দেশে ফিরছিলো যেদিন নিঝুমের দুর্দশার শুরু হয়। নিঝুমকে ওরা একটা ইনজেকশন পুস করে রাস্তার সাইডে ফেলে রেখে গিয়েছিল। ওই ইনজেকশনটা একবার শরীরে পুশ করলে সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট না হলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। ওরা ভেবেছিল এই রাতের বেলা কেউ নিঝুমকে বাঁচাতে আসবে না এজন্য ফাঁকা রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সমর্পণ ওই রাস্তা ধরেই সিলেট যাচ্ছিল। তারপর মাঝপথে সে নিঝুমকে পায়। সমর্পণের সঙ্গে সোনালী, তুশীও ছিল। তুশী তখন এক মাসের নবজাতক শিশু। তুশীর মা তুশীকে জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত ব্লিডিং এর ফলে লন্ডনের হসপিটালে মা’রা যায়। সমর্পণ সেই শোক সহ্য করতে না পেরে সোনালী আর তুশীকে নিয়ে এদেশে চলে আসে। কারণ ওদেশে ওর বউয়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। নিঝুমকে ওরা তখন হসপিটালে নিয়ে যায়। তারপর আমাকে সমর্পণ ফোন করে। আমি তোদের সমর্পণের বিষয়ে আগে জানাই নি। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। তারপর আমি ইহানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিঝুমকে আর বাড়িতে আনি নি। সমর্পণের কাছে রেখে দেই। সমর্পণ নিঝুমের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা শুনে ওকে আগলে রাখতে শুরু করে। নিজের পায়ে দাড়াতে সাহায্য করে। ব্যস পরেরটুকু তো তোমাদের জানাই আছে।”
সমর্পণের চোখে পানি। মৃ’ত স্ত্রীর কথা মনে পড়লে সকলেরই চোখে পানি থাকা স্বাভাবিক। নিঝুম গিয়ে সমর্পণকে আশ্বস্ত করে।
এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিঝুম বলে সে কিছু বলতে চায়। সকলে তার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত। নিঝুম গলা ঝেড়ে নিয়ে বলে,
“আসলে ইরা আর নিহান ওরাও তো কম কষ্ট পায়নি। আমার মনে হয় ওদেরকেও এবার একই সুতোয় বেঁধে দেওয়া উচিত।”
সকলেই নিঝুমের এই কথায় সম্মতি দেয়। এদিকে ইরা লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে ফেলে। নিঝুম আবার বলে,
“আরও একটি কথা। এখানে আরও একটি লাভ বার্ড রয়েছে যারা নিজেদের কথা এখনো নিজেরাই বলে উঠতে পারে নি। ”
সকলেই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে কারা সেটা জানার জন্য। নিঝুম তখন এক নিশ্বাসে বলে দেয়।
“তারা হলো ইশান আর সোনালী।”
নিঝুমের এহেন কথায় সকলে চমকে ওঠে। সেই সঙ্গে ইশান, সোনালীও। কারণ নিঝুম কেন এখনো এই কথা তো তারা নিজেরাও খোলাখুলি ভাবে কেউ কাউকে বলেনি। তাহলে নিঝুম কী করে জানলো? নিঝুম তখন ওদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,
“আমি সোনালীর ডায়েরি পড়েছি। জানি এটা অন্যায় তবুও কৌতুহল দমাতে পারি নি। অগোচরে পড়ে ফেলেছি৷ ভাগ্যিস পড়েছি নয়তো এত বড় খবর তো জানতেই পারতাম না।”
সকলে অবাক হলেও পড়ে বেশ খুশি হয়। ইরা আর সোনালীর মাস্টার্স কম্পিলিট হয়ে গেলেই ঘুমধাম করে দুই জুটির বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হবে। সমর্পণ চেয়েছিল তার সিলেটের বাড়িতে ফিরে যেতে কিন্তু নিঝুমের জন্য তা সম্ভব হয়নি। নিঝুমের এক কথা সে তার ভাইকে কিছুতেই একা থাকতে দেবে না। সকলে মিলেমিশে এক ছাদের নিচে থাকবে।
——————-
গাড়ি করে পুরো শহর ঘুরছে নিঝুম আর ইহান। তুশীকেও আনতে চেয়েছিল কিন্তু বাড়ির কেউ আনতে দেয় নি। সকলে মনে করছে ওদের এখন প্রাইভেসি দরকার। গাড়ি এসে থাকে সেই লেকের পাড়ে। চার বছর আগে যেখানে বেড়াতে এসে তাদের চরম বিপদের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই জায়গা দেখে নিঝুম বেশ অবাক হয় কিন্তু কিছু বলে না। চুপচাপ ইহানের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ নিঝুমের পায়ের সঙ্গে কিছু একটা লেগে সে পড়ে যেতে নেয়। ইহান সেই মুহূর্তে তার কোমড় জড়িয়ে নেয়। ততক্ষণাৎ চারপাশ থেকে অজস্র ফুলের পাপড়ি তাদের মাথার ওপর দিয়ে পড়তে থাকে। নিঝুম চোখ বন্ধ করে নেয়। এ কেমন অনুভূতি, এ কেমন পরিবেশ। সবকিছুই স্বপ্নের মতো। ইহান নিঝুমকে সোজা করে নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। সামনেই ফুলের পাপড়ি দিয়ে বড় লাভ শেড তৈরি করা। তার মধ্যে লেখা ঝুম + ইহান। তারপর কিছুদূরে একটা সজ্জিত টেবিলে কেকের আয়োজন করা। নিঝুমকে কেকের কাছে নিয়ে যায় ইহান৷ কেকের ওপর ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, “নতুন জীবনে স্বাগতম বিবিজান।” লেখাটা দেখে নিঝুমের চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তবে এই জল আনন্দের। ইহান নিঝুমের চিবুক তুলে ধরে খুব সন্তপর্ণে সেই জল টুকু মুছে দিল। মাথা নেড়ে ইশারা করল আর যাতে না কাঁদে। অতঃপর দুজনে কেকটা কাঁটল। কেক কাটার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে রংবেরঙের আতশবাজি স্বশব্দে ভেসে ওঠে। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে আরও অবাক হয়ে যায়। আতশবাজির রঙের মধ্যে লেখা ভাসছে, “ভালবাসি বিবিজান।” নিঝুম খুশিতে ইহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে আবার। ইহানও নিঝুমকে জড়িয়ে নেয়। উপভোগ করে দু’জনে কিছু ভালোবাসার মুহূর্ত।
আজ যেন সব আঁধার কেটে গিয়ে আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল ওদের জীবন। শত প্রতিক্ষার পর এ এক অন্তিম আনন্দের ছটাক। লেকের পানিতে পা ভিজিয়ে ইহানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিঝুম। সহসা সে চোখ বন্ধাবস্থায় ছন্দ কেটে উঠল।
……….কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা……….
শূন্যতা আর আসবে না
পূর্ণতার রঙিন খামে
……….. তুমি আমি দু’জনা……….
————সমাপ্ত———
®নামিহা নিশি….