#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা 💦(প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-১২)
————–
ইরা এক পলক নিঝুমের দিকে তাকালো। নিঝুমের কৌতুহলী দৃষ্টি উপেক্ষা করে সে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি স্টার্ট দিতে। ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি টান দিলো। নিঝুম ঝটপট জানালা থেকে মুখ বের করে দিয়ে বলল,
– ‘ইরা কী করছ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো? দ্রুত গাড়িতে এসো।’
ইরা নিঝুমকে হাতের ইশারায় আস্বস্ত করে। অগত্যা নিঝুমকে বাধ্য হয়েই ইরাকে ফেলে চলে যেতে হয়। কিন্তু ইরার জন্য তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। একে তো এই প্রখর বৃষ্টি তার ওপর ওই ছেলেটা। ইরার যদি কোনো বিপদ হয়?
————-
ইহান আজ দুপুরেই বাড়িতে চলে এসেছে। নিঝুম বাড়িতে আসার পরপরই। মূলত এসময়ে ইহানকে বাড়িতে দেখা যায় না তবে কাজের চাপ কম থাকায় চলে এসেছে। তাছাড়া শরীর টাও বেশ খারাপ লাগছে। রুমে ঢুকেই তার চোখ সর্বপ্রথম নিঝুমের ওপরে পড়ে। নিঝুম তখন আনমনেই পায়চারি করছে সারা ঘরে। ওকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গভীর চিন্তায় মগ্ন। নয়তো ইহান এসেছে নিঝুম টের পায়নি এমনটা হতেই পারে না। নিঝুম যে ইহানের প্রতি এই অল্প কয়েকদিনেই বেশ ভালোই দুর্বল হয়ে পড়েছে এটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি ইহানের। বিচক্ষণ চক্ষু বলে কথা। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে টাই- এর বাঁধন খুলতে খুলতে তার প্রশ্ন,
— এতো গভীর চিন্তার কারণ?
হঠাৎ প্রশ্নে নিঝুম আঁতকে উঠল। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশঙ্কা তাকে ভেতর থেকে ভীষণ নাড়িয়ে দিচ্ছে। ইহানকে দেখে ভয়টা যেন আরও তীব্রতর হয়েছে। সে আলগোছে ঘড়ির কাঁটায় চোখ বুলালো। নাহ! এত তাড়াতাড়ি লোকটা বাড়িতে কী করছে? মনের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে নিঝুম বলেই বসল,
–এত তাড়াতাড়ি ফিরলেন যে?
ইহান তখন গায়ের পোশাক খুলে টাওয়াল জড়িয়ে নিয়েছে। আপাততঃ তার এখন শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। কী আশ্চর্য! ইহানের এই অর্ধনগ্ন অবস্থায়ও এখন পর্যন্ত নিঝুমের চোখে পড়ে নি নয়তো কখন ছুট্টে পালিয়ে যেত। তারমানে ঘটনা টা বেশ গুরুতর, ভাবলো ইহান। অতঃপর নিঝুমের প্রশ্নের জবাবে বলল,
— কেন খুব কী অসুবিধে করে ফেললাম?
নিঝুম অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল,
— ছি ছি! কী বলছেন? আপনার বাড়ি আপনি এসেছেন তাতে আমার কী? এ সময়ে সচরাচর আসতে দেখিনি তাই বলে ফেলেছি।
— আমার উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি?
“কীসের উত্তর?”– বলতে বলতেই নিঝুম এবার ইহানের দিকে দৃষ্টি দিল। খানিকটা ভড়কে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে দাড়ালো। আলগোছে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” মা ডাকছিলো আমায়, আমি আসছি।”
নিঝুম দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরতেই গম্ভীর কণ্ঠে তার চলাচল থেকে গেল,
— আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।
নিঝুম পেছন ফেরে না। সেভাবে দাড়িয়েই হাত কচলাতে থাকে। ইহান বারকয়েক একই প্রশ্ন করে। কিন্তু নিঝুমের কোনো হেলদোল নেই। সে তো ভয়েই কুপকাত। সত্যি টা জানলে ইহানের রিয়েক্ট কী হয় কে জানে আবার মিথ্যেও তো বলতে পারছে না।
নিঝুমের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ইহানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে জোর কদমে এগিয়ে এসে নিঝুমের নিকটে দাড়ায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,
— বলবে নাকি?
নিঝুম তখনও আমতা আমতা করছে। এবার আর ইহান রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। শক্ত হাতে চেপে ধরে নিঝুমের বাহু। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি।
নিঝুম ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। ইহানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো তার উত্তর শোনার জন্য উদগ্রীব। নিঝুমের চোখ থেকে অঝোরে জল গড়াচ্ছে। শঙ্কিত হৃদয়ে কম্পিত কন্ঠে সে এবার ইরার ব্যাপারটা বলেই দিল ইহানকে। সব শুনে ইহান স্তব্ধ। চরম মাত্রায় রেগে গেল সে নিঝুমের ওপর। নিঝুমের বাহুজোড়া আরও দ্বিগুণ শক্ত করে চেপে ধরে গর্জে উঠে বলল,
— কী করে তুমি ইরাকে ওই ছেলের হাতে ফেলে চলে আসতে পারলে তাও আবার এই ঝড়,বৃষ্টির মধ্যে? এখন যদি ইরার কিছু হয়ে যায় তার দ্বায় ভার কে নেবে তুমি? তাও যদি এতক্ষণ আমায় বলতে। তা না করে সমানে কেটে পড়তে চাইছিলে? আমার বোনের যদি কিছু হয় তোমাকে আমি ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।
ইহান নিঝুমকে ছিটকে দুরে সরিয়ে দেয়। নিঝুম কিছুটা দুরে গিয়ে পড়ে। নিচে পড়তে নিলে দরজা ধরে সামলে নেয় নিজেকে। ইহান দ্রুত শার্ট, প্যান্ট পড়ে এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে যায়।
নিঝুম দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার কী ভুল ছিল এখানে? সে তো আসতে চায়নি ইরা’ই তো পাঠিয়ে দিল তাকে। আর ওই ছেলেটাকে তো চেনেও না। তাহলে কী করে বুঝবে কীসে ইরা’র ক্ষতি। ওই ছেলেটার মধ্যে কী এমন রহস্য আছে যা সে জানে না? মুহূর্তেই সবকিছু কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। হঠাৎ করে নিজেকেই অপরাধী লাগছে নিঝুমের। আজ যদি ইরা’র কিছু হয় তবে ইহান কী করবে জানে না তবে নিজের বিরুদ্ধে নিজেই চরম স্টেপ নিতে ভুলবে না সে।
—————
–এভাবে হাত ধরার অধিকার কে দিলো আপনাকে?
— অধিকার দিতে হয় না তৈরি করে নিতে হয় আর সেভাবে বলতে গেলে আমার অধিকারের মাপকাঠি আমার চেয়ে ভালো তোমার জানা আছে। তাই নয় কী?
— এসব লেইম এক্সকিউজ বন্ধ করে আসল কথা বলুন। কে এভাবে পথ আটকালেন?
— আর কত ভাবে বলতে হবে?
— আমি তো জেঁচে শুনতে আসিনি।
নিহান এবার করুণ দৃষ্টি ফেলল। যা দেখে ইরার ভেতরটা ধক করে উঠল। কিছু সময় এভাবেই কেটে গেল। মেঘলা আকাশের বুক চিড়ে প্রবল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি সিক্ত করে তুলছে দু’জন তরুণ-তরুণীর শরীর,অন্তর। নিষ্পলক চেয়ে আছে দু’জন দু’জনাতে। সময় টা যেন এভাবেই থমকে যায়। আচ্ছা!খুব কী ক্ষতি হতো যদি সবকিছু পাঁচ বছর আগেকার নিয়মে চলতো? খুব কী ক্ষতি হতো যদি বিষাক্ত সত্যি সকলের সম্মুখে না আসত? আনমনেই ভাবে ইরা। আনমনেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। হঠাৎ চেতনা ফিরতেই ছিটকে সরে যায় সে নিহানের থেকে। বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। নাহ নাহ বলে পেছতেই থাকে। নিহান এক হাত বাড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে। অসহায় কন্ঠে বলে,
— ইরা…. প্লিজ একবার সুযোগ দাও। এই যন্ত্রণা সহ্য করা যে খুব কঠিনতর। প্লিজ মুক্তি দাও আমায় এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে। আমি একটু শান্তি চাই ইরা। দেবে কী একটু শান্তি?
ইরার দৌড়ে গিয়ে নিহানের হাতটি আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করল। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,
“নিহান! আমিও চাই একটু শান্তি। সবকিছু ভুলে তোমার বুকে ঠাঁই নিতে চাই। এই মুক্ত পৃথিবীর বুকে তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই বহুদূর। প্রাণ খুলে শান্তির নিশ্বাস ফেলতে চাই।” কিন্তু মনের কথা মনেই থেকে গেল। মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো কিছু অপ্রিয় মিথ্যে,
— চলে যান আমার সামনে থেকে। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। ঘৃণা করি আপনার পরিবার এবং আপনাকে। ওই কুৎসিত পরিবারে জন্ম নিয়ে আপনি নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে চাইবেন আর আমি সেটা বিশ্বাস করে নেবো সেরকম ভেবে থাকলে চরম ভুল ভাবছেন। আর কখনো আমাকে এভাবে ডিস্টার্ব করতে আসবেন না। তাহলে কিন্তু আমি……
— কিচ্ছু করতে পারবে না তুমি। তা সেটা জানি। কারণ তুমি যে এখনো আমাকে……
— ও কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না সেটা না হয় পড়ে জানবি কিন্তু আমি কী করতে পারি সেটা তোকে আজ ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দেবো।
নিহান, ইরা দু’জনেই চমকে যায়। ইরার পেছনে ইহান চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছে। চোখ থেকে যেন তার রক্ত ঝরছে। হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ। ইরা অন্তর কেঁপে ওঠে। এবার নিহানের দিক তো একবার ইহানের দিকে তাকায়। বার কয়েক ঢোক গিলে নেয়। কী হতে চলেছে ভেবেই আঁতকে ওঠে।
——————
চলবে,
®নামিহা নিশি
(প্রবল অসুস্থতা মাথায় নিয়ে লিখলাম। কেমন হয়েছে জানিনা)