কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ) –(পর্ব – ৮)

0
298

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ৮)

—————
এতক্ষণের হাসোজ্জল পরিবেশ, আনন্দের উচ্ছ্বাস সবকিছু যেন এক নিমেষেই রুপান্তরিত হয়েছে থমথমে পরিবেশে। সকলের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। কতশত কথা মনের কোণে চাপা পড়ে আছে কিন্তু বলার অবকাশ নেই। নিরবতা ভেঙে সমর্পণ বলল,

“তো নিঝুম এভাবে বসে থাকলে চলবে। ইন্ট্রডিউস করাও ওনাদের সঙ্গে।”

নিঝুম ঢোক গিলে। পরক্ষনেই স্মিত হেসে ইরা আর ইশানের দিকে ইশারা করে বলে,

“ও ইরা মি.ইহানের বোন আর ও ইশান ওনার ভাই।”

নিঝুম কথা শেষ করে চুপ মে’রে গেল। সমর্পণ বিরক্তি মাখা মুখ করে বলল,

“আহ নিঝুম শুধু ওনাদের পরিচয় দিলে আমাদের পরিচয়ও ওনাদের দাও।”

সমর্পণের এই একটি কথায় ইহান, ইরা, ইশান তিনজনই উৎসুক হয়ে উঠল। তারা তো এ সময়েরই অপেক্ষায় ছিল। নিঝুম হাত মোচড়াচ্ছে। তা দেখে সমর্পণ ফের বলল,

“ওকে আমিই দিচ্ছি আমাদের পরিচয়।”

সমর্পণ সোনালীর দিকে ইঙ্গিত করে বলল,”ও আমার একমাত্র বোন সোনালী চৌধুরী।” তারপর তুশীকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,”এ হলো আমার প্রিন্সেস তুশী চৌধুরী”। সমর্পণ এবার নিঝুমের দিকে ইঙ্গিত করে যখনই মুখ খুলতে নিবে ঠিক তখনই ওয়েটার মেনু-কার্ড নিয়ে হাজির। ওয়েটারকে দেখে সমর্পণ সেদিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে নেয়। নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইহান,ইরা,ইশান হতাশ হয়। এবারেও জানা হলো না নিঝুমের সঙ্গে সমর্পণের সম্পর্কের পরিসীমা।

অনেক চাপা কষ্ট, প্রশ্ন, অনুভূতি, দুঃখ সবকিছুর মধ্যদিয়ে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। এবার নিঝুম বলল তারা এখন উঠতে চায়। ইরা বাঁধ সাধে। কেঁদে দেয় অস্বাভাবিক ভাবে। নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলে,

“তুমি আমাদের সঙ্গে আমাদের বাসায় যাবে। তোমাকে আর আমি ছাড়ছি না।”

দেখা যায় এ কথা শুনে তুশী স্বশব্দে কেঁদে দেয়। কফিশপের অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা একটু অসহ্যকর। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইশান জোরপূর্বক ইরাকে নিঝুমের থেকে ছাড়িয়ে নিল। ইহান তখনও নিরব দর্শক। অবশেষে ইহান দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। তারপক্ষে আর একদন্ড দাড়ানো সম্ভব হলো না। যাবার আগে ইশানকে কড়া আদেশ দিয়ে গেল ইরাকে নিয়ে দ্রুত গাড়িতে ফিরতে। সে অপেক্ষা করছে। ইশান অনেক কষ্টে ইরাকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। নিঝুম মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। সোনালী, সমর্পণ এগিয়ে যায় তার নিকট। তুশী নিঝুমের কোল ঘেষে দাড়িয়ে নাক টানছে। সোনালী নিঝুমের জড়িয়ে ধরে। কাতর কন্ঠে বলে,

“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবিমনি। তুমি কষ্ট পেও না।”

সমর্পণ নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিঝুম সোনালীকে জড়িয়ে ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠে। মায়ের কান্না দেখে তুশীও আবার কাঁদতে শুরু করে।

—————–
রেস্টুরেন্টে সোনালী বেশকিছু বার নিঝুমকে ভাবিমনি বলে ডেকেছে এই ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি ইহানের। শুধু ইহান নয় ইশান, ইরার নজরেও পড়েছে। সকলের মনেই অজানা আশঙ্কা ডানা মেলেছে। ইহানের মনটা সহসা অস্থির হয়ে উঠেছে। দিকবিদিকশুন্য মনে হচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্র যন্ত্রণার সঞ্চার হচ্ছে। নিঝুমের কন্ঠ শোনার তীব্র বাসনা জাগছে অন্তরে। ঘড়ির কাটায় এখন রাত বারোটা বেজে উনিশ মিনিট। এতরাতে কী নিঝুমকে বিরক্ত করা ঠিক হবে? ও হয়তো এখন ঘুমিয়ে আছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ইহান নিঝুমের নম্বরে ডায়াল করে ফেলল। কাজের সূত্রে নিঝুমের নম্বর ইহানের কাছে থাকলেও এই কয়েকদিনে কখনো দরকার ছাড়া ফোন করে নি ইহান। কিন্তু আজ আর নিজের বেহায়া মনকে সামলাতে অক্ষম হলো।

এতরাতে ইহানের ফোন পেয়ে নিঝুম কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল, এতো রাতে কেন ফোন দিল? কোনো বিপদ হয়নি তো? নিঝুম চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে নিল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“কী হয়েছে? খারাপ কিছু কী? আপনি ঠিক আছেন তো?”

ইহান অধরে স্মিত হাসি টেনে বলল,

“এখনো তবে আমাকে নিয়ে চিন্তা হয়।”

নিঝুম অকস্মাৎ হতভম্ব হয়ে পড়ল। নিজের কর্মে নিজেই হতবাক সে। কোনো রকমে আমতা আমতা করে বলল,

“এক..একদমই নাহহ।”

ইহান তখনো হেসে চলেছে। যেখানে নিঝুমের কন্ঠেই স্পষ্ট চিন্তার ছাপ সেখানে মুখের কথায় কীই বা আসে যায়। ইহান দমে গেল না। রসিকতার ছলে বলল,

“তাহলে এতো প্রশ্ন করা কেনো?”

নিঝুম ঠোঁট কামড়ে বলল,

“এতরাতে ফোন দিলে এসব বলা স্বাভাবিক নয় কী?”

ইহান আনমনে উত্তর দিল,
“হয়তো স্বাভাবিক নয়তো নয়।”

“মানে?”- নিঝুমের কন্ঠে কৌতুহল।

ইহান বেলকনির গ্রিল ধরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সুদূর আকাশে। ওপাশে নিঝুম অপেক্ষায়। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কাতর কন্ঠে বলল,

“ফিরে এসো না ঝুম। শেষ বারের মতো ক্ষমা চাইছি। চারটা বছর অনেক সহ্য করেছি। তুমিই বলো এখনো কী শেষ হয়নি আমার পাপের বোঝা? তিলে তিলে মরছি আমি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে বিন্দু মাত্র ভালো নেই। ফিরে এসো প্রেয়সী।”

নিঝুম স্তব্ধ। চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে শব্দ আটকে রেখেছে। ইহানের কাছে সে কিছুতেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চায় না। নিঝুম নিজেকে যথা সম্ভব শক্ত করে কাঠিন্য স্বরে বলল,

“আর কখনো এসব বাজে টপিক নিয়ে ফোন করবেন না। মনে রাখবেন কাজ ব্যতিত আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

ইহান হতাশ হয়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে রিনরিনিয়ে হটাৎ প্রশ্ন করে বসে,

“তোমার সঙ্গে ওই বাচ্চা মেয়েটার কীসের সম্পর্ক? ও কেন তোমায় আম্মা বলে? মি.সমর্পণের বোন কেন তোমায় ভাবিমনি বলে ডাকে? মি.সমর্পণ কে হয় তোমার ঝুম?”

নিঝুম এসব প্রশ্নে ধাক্কা খায়। বিচলিত হয়ে পড়ে। কী বলবে না বলবে ভেবে না পেয়ে খট করে কল টা কেটে দেয়। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। চোখের পানি মুছে নিয়ে আপনমনে বলে,

“একদিন আমিও এমন কষ্ট সহ্য করেছি মি.খান। কাছে থেকেও ছুঁতে না পারার কষ্ট। আজ আপনার মনে কী চলছে আমি তা বুঝতে পারছি শত হলেও আপনি আমার একমাত্র ভালবাসার মানুষ, আমার তিন কবুল বলে বিয়ে করা স্বামী। তবুও দেখুন না ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আপনার করা কয়েকটি ভুলের জন্য আজ আমরা একে অপরের থেকে কতটা দুরে অবস্থান করছি। আপনাকে আমি ভালবাসি আর সারাজীবন বাসব কিন্তু কখনো ধরা দিবো না। আপনি আমাকে সেই দিনই ফিরে পাবেন যেদিন প্রকৃত অর্থে প্রমাণ দিতে পারবেন আমি আপনার কে সেদিন। ভালবাসার পরীক্ষা। যেদিন আমি মনে করবো আপনি জীবনের এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করতে পেরেছেন ঠিক সেদিনই আমি আবার আপনার ঘরে আপনার সঙ্গে আপনার বধূ রুপে ফিরে যাবো। তার আগে নয়।”

——————–
“তারমানে ওই লোকটাই ভাবিমনির হাসবেন্ড। আর ওনারাই ভাবিমনির পরিবার?”

“হুম”- সমর্পণ মাথা ঝাকায়।

“কিন্তু ওনাকে দেখে তো এমন মনে হয় না। তাকে তো খুব বিচক্ষণ পুরুষ বলেই মনে হয়।”

“সবাইকে কী আর বাহিরে থেকে দেখে বোঝা যায়।”

“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু তবুও।”

“হুম এখন অবশ্য আগের মতো নেই। নিঝুমকে হারিয়ে বেশ বুঝতে পেরেছে ভুলটা তার ছিল। আসলে আমরা মানুষেরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না। আশা করছি খুব শীঘ্রই ওদের কষ্টের দিন শেষ হবে৷”

সমর্পণ কিছু একটা ভাবতে বসে। অকস্মাৎ সোনালী বলে ওঠে,

“আচ্ছা ভাইয়া সবকিছু যদি ঠিক হয়ে যায় তবে কী ভাবিমনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?”

সমর্পণ বোনের মুখের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। বোনের কথার মর্মার্থ খুব ভালো ভাবে তার কাছে প্রকাশ্য। কিন্তু সে তো নিরুপায়। নিঝুম যেতে চাইলে সে তো তাকে বাঁধা দিতে পারবে না। আচ্ছা নিঝুম চলে গেলে তুশীর কী হবে? তুশী কী করে মা ছাড়া বাঁচবে? সমর্পণের শঙ্কিত দৃষ্টিতে চোখ মিলিয়ে কান্নারত কন্ঠে সোনালী বলে,

“একজনকে হারিয়ে আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি আমরা। এবার সে ও যদি চলে যায় তাহলে তো বাঁচা দুষ্কর।”

সোনালী এক ছুটে চলে যায়। চোখের অবাধ্য পানি গুলো লুকাতে হবে তো। সমর্পণ নিরব দর্শকের ন্যায় চেয়ে চেয়ে দেখে বোনের চলে যাওয়া। তার যে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

——————–

চলবে,
নামিহা নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here