কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ) পর্ব সংখ্যা – ৯

0
317

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
পর্ব সংখ্যা – ৯

——————–
ইহান ড্রাইভ করছে। এটা তার পারসোনাল গাড়ি। সচরাচর ড্রাইভার ইউজ করে না প্রয়োজনে করে। নিঝুমের দৃষ্টি জানালা থেকে বাহিরে। ব্যস্ত শহরের কর্মজীবী মানুষদের রোজকার পরিশ্রম, যাতায়াত, কর্মকাণ্ড দেখছে আপন মনে। হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে কিছুটা ভড়কে ওঠে নিঝুম।

-‘এরপর থেকে যেন এমন নায়িকা সেজে কলেজ যেতে না দেখি৷ বোরকা, হিজাব পড়ে সুন্দর, সৌজন্যমূলক আদবে বাহিরে পা রাখবে। খান বাড়ির বউদের এমন ঊশ্রীঙ্খল বেমানান।’

নিঝুম হতবাক। কী এমন ঊশ্রীঙ্খল সেজেছে সে। হালকা-পাতলা একটা থ্রি-পিস, চোখে সামান্য কাগজ,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুলগুলো নিচু করে ঝুটি করা। ব্যস!এটুকুই তো। এতে বেমানান লাগার কী আছে? লোকটার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। মনে মনে নানারকম উদ্ভট কিছু কথা শুনিয়ে দিল ইহানকে কিন্তু মুখে বলার সাহস হলো না। কোনো রকমে মাথা দুলিয়ে ফের বাহিরে দৃষ্টি দিল। ইহান দেখল কিনা কে জানে কারণ তার দৃষ্টি তো শুরু থেকেই সামনে গাড়ির কাঁচ ভেদ করে বাহিরে। নিঝুম বাহিরে তাকিয়ে আবার ইহানের কথা গুলো মনে করতে লাগল। একটা কথা মনে পড়তেই তাচ্ছিল্য হাসল। ‘খান বাড়ির বউ’। তার খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,’আপনি কী তা মানেন?’ কিন্তু বলা আর হলো না। মনের কথা মনেই রয়ে গেল।

——————-
ইরার অভিভাবক হিসেবে এই কলেজে ইহানের প্রায়শই যাতায়াত। সেই মাধ্যমে প্রায় স্টুডেন্ট’স তাকে চেনে। শুধু চেনে বললে ভুল হবে প্রায়শই মেয়ে মানুষ তার ওপরে চরম লেভেল ক্রাশ’ড। বেশিরভাগই ইরার ব্যাচমেট। এছাড়াও সিনিয়ররা তো আছেই। এরা ইহানের খোঁজ খবর নিতে মাঝে মধ্যেই নানান অজুহাতে ইরাদের বাড়িতে গিয়েও হাজির হয়। তখন ইরার সঙ্গে কথা বলে কম কিন্তু ইহানের খোঁজে মশগুল থাকে বেশি। কলেজেও ইরাকে দেখলেই তোমার ভাইয়া কই,কেমন আছে, আসে না কেন, কবে আসবে, আসতে বলিও ইত্যাদি নানানরকম প্রশ্নে তার মাথা ঝালাপালা করে তেলে। ইরা এদের হাবভাব দেখে আর মনে মনে প্রচুর বিরক্ত হয় কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারে না।

নিঝুমকে আগের দিন ইরার সঙ্গে দেখে সেভাবে কেউ খেয়াল না করলেও আজ ইহানের সঙ্গে দেখে সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে। মেয়েগুলোতো ইতোমধ্যে কানাঘুষো শুরু করে দিয়েছে। ইহানের সেদিকে ধ্যান নেই। সে তো আরাম ছে ফোন টিপছে আর হাঁটছে। কিন্তু নিঝুম? সে ভীষণ গিল্টি ফিল করছে। এভাবে কেন সকলে দেখছে? তাকে তো মনে হচ্ছে এখনই দৃষ্টি দ্বারা ভস্ম করে দেবে। ঠিক তখনই একটি মেয়ে এগিয়ে এলো ওদের সম্মুখে। নিঝুমের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে ইহানের উদ্দেশ্যে মিষ্টি করে হেসে বলল,
-‘কেমন আছেন, ভাইয়া?’

ইহানের দৃষ্টি ফোন থেকে মেয়েটির ওপর পরল। সে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলল,
-‘ ইতি না? আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছো?’
ইতি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-‘আপনার আমার নাম মনে আছে। ভালো ছিলাম না তবে এখন অনেক বেশি ভালো আছি।’
ইহান কিছু বলার আগেই আরও কিছু মেয়ে ছুট্টে এলো। একেক জনের একেক প্রশ্ন। ইতিকে দেখে যেন সকলেই সাহস পেল। কেমন মৌমাছির মতো ছুটে চলে এসেছে মধু খেতে। মূলত ইহানের গম্ভীর স্বভাব সম্পর্কে সকলেই একটু আধটু অবগত তাই ভয়ে ভয়ে ছিল। ইতিকে কথা বলতে দেখে সকলের ভয় নিমেষেই উধাও। সকলের সঙ্গে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে ইহান। নিঝুম যেন জনতার ভীড়ে চাপা পড়া এক বস্তু। কেউ যেন তাকে দেখছেই না। এসব কান্ড কারখানা নিঝুমের একদম সহ্য হচ্ছে না। মনে মনে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে ইহানের।

-‘আরেব্বাস!এ তো দেখছি কলির কেষ্ট। শালা লুইচ্চা পুরুষ মানুষ। এমনিতে তো সবসময় মুখে করলা গুজে থাকে কিন্তু এখন দেখো মনে হচ্ছে কোনো মধুর স্রোত বইছে। পাশে বউ রেখে মেয়েদের সঙ্গে রঙ্গলীলা চলছে। নেহাৎ আমি ভালো মেয়ে তাই নয়তো তোকে বুঝিয়ে দিতাম ব্যাটা খচ্চর। পোলা তো নয় যেন বহুরুপী শয়তান। এমন মিষ্টি করে হাসি মাখিয়ে কথা তো কখনো বাড়িতে বসেও বলে না। হনুমান একটা জীবনে বউ পাবি না।’

শেষোক্ত কথায় নিজেই জিভে কামড় কাটে নিঝুম। বউ পাবে না মানে। অলরেডি তার মতো সুন্দরী বউ গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। নিঝুম অভিশাপের ল্যাঙ্গুয়েজ চেঞ্জ করে নিল সামান্য। ক্রদ্ধ ভাবনায় ভাবল,’বউ তো পেয়ে গেছিস তাই আর কী বলি কিন্তু তুই তোর বউয়ের হাতে রোজ অত্যাচারিত হবি। তোর বউ তোকে রোজ ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দু বেলা ধৌত করবে। ক্লিপ দিয়ে আটকে আটকে দড়িতে ঝুলিয়ে শুকাতে দিবে। ঠ্যাং ধরে আঁচড়ে আঁচড়ে……. ‘

আরও কিছু ভাবতে নিবে তার আগেই নিঝুম তার হাতের মধ্যে ইহানের আঙুলের উপস্থিত টের পায়। ধ্যান ভঙ্গ নিঝুম তখন হতবাক। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ইহান স্বেচ্ছায় তার হাত ধরেছে। ইহান নিঝুমকে নিয়ে মেয়েগুলোকে ঠেলাঠেলি করতে করতে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। মেয়েগুলো বারকয়েক পেছন থেকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মেয়েটি কে?’
ইহানের গম্ভীর উত্তর, ‘ইরার থেকে জেনে নিও।’

নিঝুমের হঠাৎ অভিমানে গোটা দুনিয়া ছেঁয়ে এলো। ইরা’র থেকে কেন শুনতে হবে? নিজে বললে কী হতো? না কী চলতে রুচিতে বাঁধছে?

———————
ইশান ক্লাসে পা রাখতে না রাখতেই মৌমাছির দল মৌ মৌ করতে করতে তাকে ঘিরে ফেলেছে মধু আহরনের জন্য। সব সুন্দরী মৌমাছি। গুড লুকিং আর হ্যান্ডসাম হওয়ায় ক্লাসের প্রায় মেয়েরাই তার ভক্ত। ইশান এগিয়ে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিট করছে। ইশান এসব বেশ এনজয় করে। সুন্দরীদের হিরো হয়ে থাকাই তার একমাত্র কাজ। আগে অবশ্য এমন ছিল না তবে কিছু বাস্তবতা তাকে এমন করতে বাধ্য করেছে। ভালবাসার ওপরে তার একদম বিশ্বাস নেই। তার মতে, ভালবাসা মানেই ছলনা,প্রতারণা, যন্ত্রণা। তার থেকে বরং মেয়েদের সঙ্গে টাইমপাস করাই বেটার। ওসব মন দেওয়া নেওয়ার কেচ্ছা না করাই শ্রেয়। এক কথায় ক্লাসের রোমিও সে।

মৌমাছির দলেরা মধু আহরনে সক্ষম হওয়ার আগেই ক্লাসে স্যারের উপস্থিতি। অতঃপর ভাঙা মন নিয়ে সকলে নিজেদের আসনে বসে পরল।
সকলের মুখের অবস্থা স্যাড। ইশানও ওদের দিকে তাকিয়ে স্যাড হওয়ার ভান করল।

নিঝুম, ইশান দুজনেই সেম ইয়ার। ইশানের সঙ্গে এখনো নিঝুমের তেমন একটা সখ্যতা হয়নি। ওই টুকটাক সৌজন্য মূলক কথা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। ইশান আর ইরা এক কলেজেই পড়ে তবে ডিপার্টমেন্ট আলাদা হওয়ায় একজনের ডান সাইডের বিল্ডিংয়ে আর একজনের বাম সাইডের বিল্ডিংয়ে ক্লাস। ওপাশের ব্যাচের স্টুডেন্স’রা সাধারণত এপাশে আসে না আবার এপাশের স্টুডেন্সরা ওপাশে আসে না। কলেজের বৃহত্তর অনেক দীর্ঘ এজন্যই আসার প্রয়োজন পড়ে না আরকি। তবে ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে অনেকেই আসা যাওয়া করে।

——————-
ইহান নিঝুমকে কজেলে ভর্তির সকল কার্যক্রম শেষ করে সবে মাত্র বাহিরে বেড়িয়েছে তখনই তার ফোনে একটা ইম্পরট্যান্ট কল আসে। ইরাও তখন বাহিরে বেড়িয়ে গেছে দু’টো ক্লাস শেষ করে। ইহান নিঝুমকে ইরার সঙ্গে দিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পড়ে ওখান থেকে। নিঝুম গাল ফোলায়। নিন্ম স্বরে বলে, ‘পাষাণ একটা, নিষ্ঠুর।’

নিঝুমের অভিমানী মুখশ্রী পড়ে নিতে ইরার বেশি সময় লাগেনি। সে মজার ছলে বলে,
-‘ কী হলো আমার বউমনি টার। ভাইয়ের সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না কী? এখনই চোখে হারাচ্ছো দেখছি।’

নিঝুম লজ্জা পেয়ে যায়। থতমত কন্ঠে বলে,
-‘একদম না। লোকটা ভীষণ খারাপ। তার সঙ্গে এমনিতেই থাকা যায় নাকি।’

ইরা শব্দ করে হেসে ওঠে। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে দেখে। মনে মনে বিড়বিড় করে,
-‘হাসছ হাসো বেশি করে হাসো কিন্তু তুমি তো আর জানো না তোমার ভাইটা ঠিক কত বড় মাপের শয়তান।’

———————
ইরা, নিঝুম গেট থেকে বেড়তে নেয় ঠিক তখনই নিহানের আগমন। রোজকার মতো সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দাড়িয়ে। ইরা চরম বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল। কাঠামো শক্ত করে বলল,
-‘পথ ছাড়ুন।’

নিহানের ধীর উত্তর,
-‘যদি না ছাড়ি?’

ইরা’র রাগ হলো ভীষণ,
-‘কত বড় মাপের ছ্যাচড়া হলে এমন করতে পারে।’

নিহান হাসে নির্বিকারে,
-‘তাও যদি বুঝতে।’
-‘ বুঝতে চাই না কখনোই।’

নিঝুম এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছিল সবকিছু। হঠাৎ নিহানের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

-‘ইনি কে?’

নিহানের এই প্রশ্নে ইরা মনে হচ্ছে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। সে ঠোঁটে বাঁকা হাসির দেখা ফুটিয়ে বলল,
-‘আমার বউমনি। আবরার খান ইহানের বউ নিঝুম খান। বলে দিও তোমার……’

ইরা কথা শেষ না করেই নিঝুমকে নিয়ে চলে এলো। বেড়নোর আগে ফের এক তাচ্ছিল্য হাসি উপহার দিয়ে গেল নিহানকে। নিহান স্তব্ধ। তারমানে বড়সড় ঝড় আসতে চলেছে।

——————–

চলবে,
নামিহা নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here