#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২১.
সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত দু’জন। তনয়া যতই বলুক সে অনেক কিছু গুছিয়ে রেখেছে, আদতে সে কী গুছিয়েছে স্বরূপ বুঝতে পারল না। তার মনে হলো মেয়েটা গোছানোর নামে অনেক বেশি এলোমেলো করে রেখেছে। ঘন্টা দুয়েক চেষ্টা করে একসময় স্বরূপ হাঁপিয়ে উঠে বলল, “মাফ চাই! এবার তুমি আমাকে একা কাজ করতে দাও। কাজ তো বাড়িয়ে দিচ্ছো। আচ্ছা তুমি ওখানে ওয়াটার হিটার নিয়ে কী করবে?”
“যদি হঠাৎ কফি খেতে ইচ্ছে করে…”
“কোনো দরকার নাই এসব। কফি ওখানে কিনতেই পাওয়া যায়। আর চায়ের দেশে গিয়ে কফি খেতে যাবে কোন দুঃখে?”
“চা খেতেও তো গরম পানি লাগে…”
“চা কিনে খাওয়া যাবে৷ এসব কেন নেব? আর তুমি এই ব্লাউজগুলি এলোমেলো করে রেখেছ কেন?”
“এর মধ্যে থেকে কোনগুলো নেব বেছে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শাড়ি অলরেডি প্যাক করে ফেলেছ।”
“আর ওইযে ইনার…ওসবও কি তুমি ম্যাচিং ম্যাচিং নিতে চাও নাকি?”
তনয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল। মনে মনে বলল, “তা তো অবশ্যই। কিন্তু সেটা সরাসরি বললে তুমি কী প্রশ্ন করবে জানা আছে।”
স্বরূপ বলল, “আচ্ছা, প্যাকিংয়ের বিষয়টা আমি দেখছি। তুমি যেটা ভালো পারো সেটা করো। প্লিজ কিছু বানিয়ে আনো, ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি।”
“কী খেতে চাও?”
“এনিথিং ইউ মেক।”
তনয়া চলে গেল। শর্টকাটে কী বানানো যায়? আচ্ছা প্রেশার কুকারে খিচুড়ি বসিয়ে দিলে তো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। সাথে ডিমভাজি করে ফেলা যায়। তনয়া কাজে লেগে গেল।
আকাশ আজ মেঘলা। অনেকদিন বৃষ্টি হয় না। আজ তারা চলে যাবে, আজই বৃষ্টি নামবে? রাতে নামলে আর দেখা হবে না। আচ্ছা, ওরা যদি আর না ফিরতে পারে? যদি পথেই কিছু হয়ে যায়?
দার্জিলিংয়ে তো অনেক বৃষ্টি হয় শুনেছে। ওখানে গিয়ে রেইনি ওয়েদার পেলে দারুণ হবে! তনয়া শুধু কক্সবাজারের পাহাড় দেখেছে। আকাশ ছোঁয়া উঁচু পাহাড় বাস্তবে দেখলে কেমন লাগে? তারা দেখতে পারবে তো? সাবধানে যাওয়া হবে তো?
প্রেশার কুকারের সিটি তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। কী সব আবোল তাবোল ভাবনা! আচ্ছা এই ভাবনাগুলো কি শুধু তারই আসে? অন্যরা কি সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই ভাবে?
সে এক ফাঁকে গিয়ে শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে এলো। স্বরূপ আপনমনে কাজ করছে। চোখমুখ খুব সিরিয়াস। ভাব দেখে লোকে ভাববে পাশের দেশের আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার মতো বিরাট কাজ করছে! তনয়ার হাসি পেল, কিন্তু সে শব্দ করল না। স্বরূপ আদতেই কতটা সুন্দর সেটা সে হিসেব করতে পারে না। তবে তার চোখে এখন ওকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বলে মনে হয়। ওর মুখের প্রতিটা ভাজ, হাসি, হাত পা নাড়া, কাজ করা, খাবার মুখে তোলা প্রতিটা ক্ষেত্রে তনয়ার মনে হয়, ও এত সুন্দর কেন? নাকি তার চোখ গেছে? কালো জাদু করে ফেলেছে কি না কে জানে! আচ্ছা কালো জাদুতেই মানুষ বশ হয়? সাদা জাদুতে হয় না? সাদা জাদুটা কি? ভালোবাসা? ‘ভালোবাসা কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর কি তবে হবে ভালোবাসা এক প্রকার জাদু। Highly powerful magic!
কুকারের সিটির শব্দ শুনে রান্নঘরে ঢুকল তনয়া। খিচুড়ি হয়ে গেছে। এবার সেটা কিছুক্ষণ এমনি রেখে দিতে হবে। ততক্ষণে ডিমভাজি হয়ে যাবে।
কাজের মধ্যে দিয়ে আবারও তার মাথায় এলোমেলো চিন্তা আসতে থাকল। মা বাবা আসার সময় যদি বৃষ্টি হয়, ওরা আসতে পারবে তো? মা বাবাকে একবার না দেখে গেলে ওর শান্তি লাগবে না। স্বরূপের কথা ভাবে সে। ওর তো বাবাও নেই, আছে এক মা। কেমন করে মা ছেড়ে একা থাকে? অবশ্য গ্রামে গিয়ে ও করবেই বা কী! শাশুড়ী মায়ের স্কুলটা না থাকলে সে নিজেই তাকে নিয়ে আসত। বাড়িতে একজন অভিভাবক থাকলে ভরসা লাগে। তাদের আর কতটুকুই যত্ন করতে হয়? বরং তারাই আরও বেশি খেয়াল রাখে ছেলেমেয়ের। অনেকের শাশুড়ী নিয়ে নানা অভিযোগ শুনে তনয়ার ভয় হতো। তার শাশুড়ীও অমন দজ্জাল হলে? কিন্তু স্বরূপের মায়ের মতো ভালো মানুষ দজ্জাল হতে পারবে কি?
ব্যথার অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছুনোর পর তনয়ার এবার হুশ ফিরল। হাত কেটে গেছে। কুঁচি কুঁচি মরিচের সাথে মিশে যাচ্ছে রক্ত!
হাত নাড়তে নাড়তে দ্রুত উঠে পড়ল সে। বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে হাত রাখল প্রবাহিত পানিতে। হাত ভীষণ জ্বলছে। মরিচ লেগে ছিল হাতে। চোখে পানি চলে এসেছে তার। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
সে শোবার ঘরে গেল। “ফার্স্ট এইড বক্স আছে?”
“কেন?” বলতে বলতে স্বরূপ পেছনে তাকাতেই তনয়ার হাতের রক্ত চোখে পড়ল।
“কী হয়েছে?” এগিয়ে এলো সে।
“কেটে গেছে।”
স্বরূপ দেখল অনেকখানি কেটেছে। তনয়া ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকাবার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটা এত নরম! কী করে যে এই কঠিন পৃথিবীতে সারভাইভ করবে কে জানে!
সে দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স বের করে আনল। রক্ত বন্ধ হলে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল, “তো হাতটা কাটলেন কেমন করে?”
“একা একাই কেটেছে?”
“একা একা কেমন করে কাটে? নিশ্চয়ই কিছুতে লেগে কেটেছে!”
“ছুরি।”
“কী কাটছিলে?”
“মরিচ।”
“চলো দেখি।”
রান্নাঘরে গিয়ে প্রথমেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল স্বরূপ। আরে! খিচুড়ি তো আমার প্রিয় খাবার! কিন্তু তনয়া, তুমি পেঁয়াজ মরিচ কাটছিলে কেন?”
“ডিম ভাজতে।”
“তো ডিম ভাজি কি তোমার রক্তমাখা মরিচ দিয়ে করব নাকি নতুন করে কেটে নেব?”
“ধুর! তুমি রক্ত খাবে কেন?”
“কারন আমি ভ্যাম্পায়ার, ভুলে গেলে নাকি?”
“তাহলে ব্যান্ডেজ না করে আমার রক্তগুলো খেয়ে নিলেই পারতে।”
“আরে তা কী করে হয়? তুমি হলে আমার রিজার্ভ করা ব্লাড ব্যাংক। যখন খাদ্যের অভাব পড়বে তখন তোমাকে খাব।”
“ফালতু কথা বন্ধ করবে?”
“না, আমি যে ক’টা কথা জানি তার অধিকাংশই ফালতু। আমি কী করব?”
কথা বলতে বলতে স্বরূপ নতুন করে মরিচ কেটে ফেলল। ডিম ভাজা শেষ হলে জিজ্ঞেস করল, “তনয়া, তোমার কাছে দুটো অপশন৷ এক. চামচ দিয়ে খাবে, সেক্ষেত্রে ডিমটা আমি ভেঙে ছড়িয়ে দেব। আর দুই…..”
স্বরূপ বলছে না দেখে তনয়া অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর দুই কী?”
“আমার হাতে খাবে।”
তময়া সবকটা দাঁত বের করে বলল, “দুই।”
“দেখো তোমাকে আমি কত যত্ন করি। সব কাজ করে দেই। তোমার বাবা মা জানলে তোমার বদলে তাদের সব প্রোপার্টি আমার নামে লিখে দেবেন।”
তনয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “একদিন খাইয়ে দিয়ে প্রোপার্টি চেয়ে ফেলছ?”
“না না, ওসব আমার দরকার নেই। উল্টে তাদের প্রোপার্টি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও আপত্তি নেই।”
তনয়া মুখ কালো করে বলল, “আমি চলে গেলে তুমি খুশি হবে?”
“আমি মজা করছি তনয়া। তুমি সিরিয়াস হচ্ছো কেন?”
“কিছু মজা শুনতে ভালো লাগে না।”
তনয়া রান্নাঘর থেকে চলে গেল।
স্বরূপ একটু পর একটা প্লেটে খাবার নিয়ে তার কাছে এলো। তনয়া চুপচাপ বিছানায় বসে আছে।
স্বরূপ ডাকল, “খাবার টেবিলে এসো।”
“খাব না।”
“প্লিজ!”
“খাব না।”
“একবার খাও, দুপুরে না খেয়ে থেকো।”
“কোনোবারই খাব না।”
“বেড়াতে যাবে না?”
“না।”
“কী করবে?”
“বাড়ি চলে যাব।”
“আচ্ছা দিয়ে আসব। আগে খাও।”
“খাব না।”
স্বরূপ প্লেট নিয়ে তার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে বলল, “খাইয়ে দিচ্ছি তো! আর তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসব না। এটা তো তোমারও বাসা। আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার কে বলো? নাও হা করো।”
তনয়া হা করল। খাবার মুখে নিয়ে মনে হলো, সে একটু বেশিই আহ্লাদ দিয়ে লোকটাকে মাথায় তুলেছে! কি দরকার ছিল খেয়ে নেয়ার? আরেকটু রাগ করে থাকলে আরেকটু শিক্ষা হতো!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে তনয়া ঘর গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ রান্নাঘর গোছাতে গেল। তৈরি হওয়া বাদে আর কোনো কাজ নেই এখন। মা বাবা চলে আসবেন।
ফোনটা বাজল। কার ফোন? তনয়া দেখল স্বরূপের ফোন বাজছে। মা কল করেছেন।
তনয়া রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ আছি আম্মা। তোমরা কেমন আছ?”
“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
মা এবার আর কোনো কথা না বলে বেশ উদ্বিগ্ন স্বরেই বললেন, “স্বরূপ কই? ওকে দাও তো। অনেক জরুরি দরকার।”
“কী হয়েছে মা?”
মা ওর কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললেন, “স্বরূপকে দাও।”
তনয়া ছুটে গিয়ে স্বরূপকে ফোন ধরিয়ে দিল।
স্বরূপ হ্যালো বলতেই মা বললেন, “স্বরূপ তুই গ্রামে চলে আয়। আজই রওনা দে।”
“মানে? কেন? কী হয়েছে?”
“ঝামেলা হয়েছে। এত বলতে পারব না। এলে জানতে পারবি।”
“কিন্তু আজ তো…”
মা কঠিন স্বরে বললেন, “বেড়াতে পরে যাস। এখন এখানে তোকে প্রয়োজন।”
স্বরূপ বলল, “আসছি।”
সে ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা এরকম করে বলছেন মানে ভয়াবহ কিছু হয়েছে। সেটা কী?
তনয়া ওকে ঠেলা দিল, “কী হয়েছে?”
স্বরূপের খুব খারাপ লাগছিল তনয়াকে কথাটা বলতে। বেচারি এত আশা করে আছে। কবে থেকে এই হানিমুন প্ল্যান করা! অথচ…
তনয়া ওর মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “কী হয়েছে? কোনো খারাপ খবর?”
স্বরূপ শেষ পর্যন্ত বলল, “সম্ভবত। কিন্তু কী খবর বলেনি। গ্রামে যেতে বলেছে শুধু।”
“আজই?”
“হ্যাঁ।”
তনয়ার খুব কান্না পেতে লাগল। কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করল না। নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কখন রওনা দিচ্ছি?”
“তুমিও যাবে?”
“তোমাকে একা যেতে বলেছে?”
“তা না। কিন্তু তুমি তো ঘুরে এলে সেদিনও।”
“এবার তো ঘুরতে নয়, কাজে যাচ্ছি। তুমি কি আমাকে নিতে চাও না?”
“তুমি যেতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”
স্বরূপ একটু পরে কী একটা কাজে বাইরে গেলে তনয়া নিজের মাকে ফোন করে আসতে নিষেধ করে দিল। মা কারন জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে কাঁদল সে। মা সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন। অনেক কথা বুঝিয়ে বললেন। একটা সময় তনয়ার মন খারাপ কমে এলো। মায়ের সাথে কথা বললে সত্যিই দুঃখ কমে যায়।
এবার তার দুশ্চিন্তা হতে শুরু করল। কী হয়েছে ওখানে যে এত জরুরি তলব?
*
ট্রেনে যেতে যেতে তনয়া নির্নিমেষ চেয়েছিল অন্ধকারের দিকে। স্বরূপ ঘুমিয়ে পড়েছে। বলা চলে মাঝরাতে পুরো ট্রেন ঘুমিয়ে আছে। শুধু সে একা নির্ঘুম।
স্বরূপের হঠাৎ ঘুম ভাঙল। সে তনয়ার বিষন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তনয়া, আমি তোমাকে খুব দ্রুত বেড়াতে নিয়ে যাব। প্রমিজ!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু