#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ৯)
—————
সে রাতের পর থেকে নিঝুম বেশ দোটানায় ভুগছে। শত হোক নিজের ভালবাসার মানুষ, নিজের স্বামীর মুখ থেকে অমন আকুতি,অনুরোধ শুনে কোনো স্ত্রী কী আর ভালো থাকতে পারে। তার মন প্রতি মুহূর্তে চাইছে ইহানের কাছে ছুটে চলে যেতে কিন্তু বিবেক বাঁধা দিচ্ছে। অভিমান বাঁধ সাধছে। তবুও ক্ষীণ ইচ্ছে নিয়ে বেঁচে আছে। ইহান যদি একবার নিজেকে প্রমাণ করতে পারে তাহলে আর নিঝুম পিছু ফিরে তাকাবে না। অতীত ভুলে ইহানকে মেনে নেবে। কিন্তু তুশী? তুশীর কী হবে তখন? আর সে ই বা তুশীকে ছেড়ে কীভাবে থাকবে? সমর্পণ কী তুশীকে দিতে রাজি হবে? নাহহ আর ভাবতে পারছে না নিঝুম। নিজের ভাবনায় নিজেই হতবাক। এতকিছু সে কী করে ভেবে নিল? পরমুহূর্তেই নিজেকে নিজেই ধিক্কার টেনে বলল,”ছিহ নিঝুম ছিহ এতটা স্বার্থপর তুই কী করে হতে পারিস। যারা তোকে নতুন করে বাঁচতে শেখালো এখন তুই তাদেরকেই ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিস? নাহ নাহ এটা ভুল এটা অন্যায়।”
সোনালী বুঝতে পারে নিঝুমের হয়তো মন ভালো নেই। সবকিছুতেই কেমন উদাসীন ভাব।সারাদিনের বেশিরভাগ সময় তাকে আনমনা থাকতে দেখা যায়। এমন মনমরা নিঝুমকে দেখতে একদমই ভালো লাগছে না সোনালির। তাই দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সে চলে যায় নিঝুমের ঘরে। একান্তে কিছু কথা বলতে।
“ভাবিমনি আসবো?”
নিঝুম তখন ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে কিছু একটা করছিলো। সোনালীর ডাকে মৃদু হেসে প্রতুত্তরে বলল,
“হুম এসো এসো।”
সোনালী ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়ল৷ নিঝুম তার কাজ অব্যাহত রেখেই প্রশ্ন করল,
“কিছু বলবে?”
“হুম”
“কী বলবে বলো।”
“তোমার কী মন খারাপ? তুমি কী কোনো ভাবে ডিস্টার্ব?”
নিঝুম চমকে ওঠে। হাতের কাজ ফেলে সোজা হয়ে দাড়িয়ে যায়। একদম সোনালীর কাছ বরাবর এসে দাড়ায়। সোনালী তখনও উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রয়েছে। নিঝুম গলা ঝেড়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“এমন কেনো মনে হচ্ছে?”
“তোমার প্রতিটি কাজে,তোমার মুখভঙ্গিতে, তোমার উদাসীনতায় প্রতি মুহূর্তে প্রমাণিত তুমি ভালো নেই।”
নিঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও যেন ব্যর্থ সে। প্রতিটি পদে পদে তাকে হেরে যেতে হচ্ছে। কেবল এক ব্যক্তির কারণে। সোনালী নিঝুমকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়। নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তুমি এতো চিন্তা কেন করছ ভাবিমনি। আল্লাহ আমাদের যার কপালে যা লিখেছেন তা অবশ্যই কোনো না কোনো ভাবে প্রতিফলিত হবেই। সুতরাং এতো চিন্তা ভাবনা করে কী হবে। তারচেয়ে যেমন চলছে তেমন চলতে দাও সবকিছু। জানি যতটা সহজে আমি কথা গুলো বলতে পারছি তোমার কাছে সেগুলো হজম করা এতটা সহজ সাধ্য নয়। তবুও বলছি চেষ্টা করো। তুমি পারবে। আমার মনে হয় তোমার এই মুহুর্তে মাইন্ড টা ফ্রেশ করা প্রয়োজন। তুমি বরং আজ বিকেলে তুশীকে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে এসো দেখবে ভালো লাগবে।”
নিঝুম এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সোনালীর পানে। সোনালীর সাবলীল ভাবে তাকে ম্যানেজ করাটা বেশ উপভোগ করছে সে। মেয়েটা সত্যিই অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। কত সহজে কত ভারী ভারী কথা বলতে পারছে। নিঝুম সোনালীর চিবুকে হাত রাখে। রসিকতার ছলে বলে,
“খুব বড় হয়ে গেছ দেখছি। বিয়ে দিতে হবে তো।”
বিয়ের কথা শুনতেই কিঞ্চিৎ দমে যায় সোনালী। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়। আচ্ছা তার কপালে কী আদৌ বিয়ে নামক শব্দটির কোনো ভ্যালু আছে? তার মন প্রাণ যার জন্য উদাসীন সে তো তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। ইশানের সঙ্গে তার কোনো দিনও মিলবে না এটা সে খুব ভালো ভাবেই জানে। তার ওপর ইশানের পরিচয় পাওয়ার পর থেকে তো সে একেবারেই মস্তকে গেঁথে নিয়েছে যে, “ইশান তার জন্য নিষিদ্ধ,একেবারেই নিষিদ্ধ।” নিঝুম কষ্ট পায় এমন কাজ সে কখনো করবে না। তাই তো সেদিন কফিশপ থেকে ফেরার পর ইশানের নম্বর থেকে অগণিত ফোন কল আসার পরেও সে একটি কলও রিসিভ করে নি। এমন কী নিজের মনের কোণে সদ্য জন্ম নেওয়া লুকায়িত অনুভূতি গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় আছে।
সোনালীকে আনমনা থাকতে দেখে নিঝুম বলে,
“কী হলো মেয়ের বিয়ের কথা বলতেই এখনই ভাবতে বসলে নাকি নিজের প্রেমিক পুরুষকে নিয়ে?”
সোনালী নিঝুমের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে। মনের কষ্ট মনে লুকিয়ে রেখেই ওপরে লজ্জা পাওয়ার ভাব ধরে বলে,
“আরেহ ভাবিমনি কী যে বলো না। আচ্ছা আমি আসছি এখন।”
সোনালী দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তার ধারণা সোনালী হয়তো লজ্জা পেয়েছে কিন্তু সে তো আর জানে না মেয়েটা নিজের মনে এত বড় কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে ঘুরছে।
—————-
তুশীকে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে আজকের বিকেলটি নিঝুমের। এই তুশীকে সে একদম পিচ্চি বয়স থেকে অনুভব করেছে। মাতৃস্নেহে বড় করে তুলেছে। তুশী নিঝুমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। কে বলেছে জন্ম না দিলে মা হওয়া যায় না? একদম ভুল বলেছে। জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়। নিঝুম তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তুশী যখন আধো আধো বুলিতে প্রথম নিঝুমকে ‘আম্মা’ বলে ডেকেছিল সেদিন নিঝুমের মনে হয়েছিল এই মেয়েই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। মারিয়ার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে চার বছর আগে যখন সে বেঁচে থাকার নূন্যতম ইচ্ছে টুকুও খুঁজে পাচ্ছিলো না ঠিক তখনই সমর্পণ তার কোলে তুলে দেয় মাস খানেকের জন্ম নেওয়া পিচ্চি তুশীকে। ধীরে ধীরে সমর্পণ নিঝুমকে উপহার দেয় নতুন একটা জীবন, সুন্দর একটা পরিবার। সেই সঙ্গে শেখায় নিজের পায়ে দাড়াতে। নিজের ক্ষমতা দ্বারা দেশকে রক্ষা করতে।
“আম্মা আইসক্রিম খাবো।”- তুশীর ডাকে ধ্যান ভাঙে নিঝুমের। অতীত থেকে বেড়িয়ে সে মিষ্টি হেসে চুমু খায় মেয়ের কপালে। আদুরে কন্ঠে বলে,
“মামনি আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে। বাবা বকবে খুব।”
তুশী জেদ ধরে বসে, “নাহ নাহ নাহ আমি আইসক্রিম খাবো মানে খাবোই।”
নিঝুম অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হয় না। তুশী নাছোড়বান্দা। অবশেষে নিঝুম রাজি হতে বাধ্য হয়। যেহেতু তারও আইসক্রিম ফেবারিট সেহেতু একটু তো দুর্বলতা থাকবেই। নিঝুম আশেপাশে চোখ বুলায় রাস্তার অপজিটে একটা আইসক্রিম পার্লার চোখে পড়ছে। তুশীকে বলে তার সঙ্গে যেতে কিন্তু তুশী যায় না অনেকক্ষণ যাবৎ ঘোরাঘুরির ফলে ছোট্ট পা দুটোয় ব্যথা উঠেছে। নিঝুমও আর জোর করে না। ড্রাইভারের সঙ্গে তুশীকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে সে যায় আইসক্রিম আনতে।
দোকানে ভিড় থাকায় বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় নিঝুমের ফিরতে। দু হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে বেশ হাসোজ্জল মুখে ফিরে আসলো সে। কিন্তু কে জানতো তার সেই হাসির স্থায়িত্ব ছিল ক্ষণকালের। নিঝুম গাড়ির দরজা খুলে সীটে বসতে বসতে বলল,”এই নাও মামুনি তোমার আইসক্রিম।” আইসক্রিম টি এগিয়ে সামনে তাকাতেই সে বেশ চমকে উঠলো, তুশী নেই। কোথাও নেই। নিঝুমের গলা শুকিয়ে এলো অজানা আশঙ্কায়। সে দ্রুত ড্রাইভারের সিটে নজর বুলালো। মুহূর্তেই নিঝুম হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ল। ড্রাইভার অস্বাভাবিক ভাবে সিটে ঝুলে আছে। গলা দিয়ে ফিকনি ধরে রক্ত ঝড়ছে। চোখ উল্টে আছে। চেহারা ফ্যাকাশে। নিঝুমের হাত থেকে আপনাআপনি আইসক্রিম দুটো পড়ে গেল। সে দ্রুত সামনের সিটে ড্রাইভারের কাছে গেল। ড্রাইভারের বাম হাত ধরে পালস রেট চেক করে দেখল সে আর বেঁচে নেই। নিঝুম এখন কী করবে? কোথায় খুঁজবে তুশীকে? তুশীকে কারা নিতে পারে এটা অজানা নয় তার কিন্তু কী করে উদ্ধার করবে সে তার মেয়েকে? কী জবাব দেবে সমর্পণকে? বাচ্চা মেয়েটার কোনো ক্ষতি করবে না তো ওরা? আঁতকে ওঠে নিঝুম। এমন অসহায় সে আগে কখনো হয়নি। এমনকি নিজে যখন মৃ’ত্যু শয্যায় ছিল তখনো এমন লাগে নি। দু-হাতে চুলের মুঠি খামচে ধরে তীব্র চিৎকার করে ওঠে সে। সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার। নয়তো নিজে শেষ হতে ইচ্ছে হচ্ছে।
——————-
চলবে,
নামিহা নিশি