#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১০)
বাড়ির সামনে বিশাল এক মাঠ। সেখানে বাচ্চারা নিয়মিত খেলে। মির্জারা বরাবরই খুব বিনয়ী। পাঁচ বছরে এই বিনয়ী ভাবটা কিছুটা কমেছে। তবু এদের প্রশংসা চার পাশে। হয়ত এই প্রশংসা ধরে রাখতে গিয়েই বাড়ির একমাত্র মেয়েটিকে একা করে দিয়েছে। আসলেই কি একা করেছে? এই যে বাড়িতে কোনো মেয়ে সদস্য নেই আট জন পুরুষ মানুষ! সর্বদাই তো কেউ না কেউ ঝিলের খেয়াল রেখেছে। যত্নের অন্ত ছিল কি? তবে শূন্যতা যে কখনো ফুরোয় না। মায়ের অভাবে মেয়েটি যেন একটু বেশিই কাতর হয়ে যেত। কিন্তু সেসব তো গোপনে। পাপা কিংবা ভাইদের কখনো বুঝতে দেয় নি। সেই জন্যেই হয়ত মেয়েটির জীবন আরেকটু মশ্রিণ হতে পারে নি। তবু ঝিলের জীবন দেখে অনেকেরই হিংসে হয়। এত পরিপূর্ণ এক জীবন সবারই স্বপ্ন। অথচ ঝিল জানে, এই পরিপূর্ণতার আড়ালে কত খানি দুঃখ মিশে। কত রাত ঘুমহীন গত হয়েছে। অশ্রু ভেজা নয়ন মেলল ঝিল। বাবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, “তুমি এমন করলে আমার খারাপ লাগে পাপা। আম্মু বলত বুড়ো বয়সেও নাকি বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করবে। তোমরা তো স্ট্রাগল করে একে অপরকে জয় করেছ। সব ভুলে গেলে চলবে?”
“স্যরি মামুনি। আসলে তোমার আম্মু কে আমি ভীষণ মিস করছি।”
“জানি তো।”
মেয়েটির মুখে লুকানো বেদনাটা ফুটে উঠল। জাফর মির্জা নিজেকে সামাল দিলেন। রোহন এসে নিয়ে গেল ওকে। খাবারের বিশাল আয়োজন। গরীব বাচ্চাদের জন্য রয়েছে চকলেট বক্স। সেসব নিজ হাতে দিবে ঝিল। গত চার বছর এমনটাই হয়ে এসেছে। দুঃখ ভুলে সবাই এই দিনটিকে উদযাপন করেছে। অথচ এর পরপরই রয়েছে এক বিষাদ যন্ত্রণা! সকলের নির্ঘুম রাত্রি।
অভিনব জানে মির্জাদের সাথে শিকদারদের পুরনো রেষারেষিটা সহজ নয়। কতবার এই নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। কত চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে ফলাফল শূন্য। তবু সে চাইছে সম্পর্কে মলিনতাটা দূর করার। সেই জন্যই উপহার গুলো পাঠালো। এ উপহার দেখে শিকদারদের সম্পর্কে সুন্দর ধারণা জন্মাবে বলেই ওর ধারণা। এখান থেকে মির্জা বাড়ি স্পষ্ট। এর থেকেও বেশি স্পষ্ট ঝিলের মুখখানি। এক বিষাদ বেদনা মেয়েটির মুখে গভীর ভাবে লেপে আছে। চোখের মনি স্থির। এসব যে অভিনবর পছন্দ নয়। ও চায় মেয়েটি হাসুক। নিজেকে মেলে ধরুক। প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়ে বেড়াক। সেসবের জন্যেই তো এত কিছু। এত কষ্ট এত পাঁয়তারা।
“অভিনব, ফোন অফ কেন?”
চোখ নামায় ছেলেটা। তরুণের গলা শুকিয়ে এসেছে। হাপাচ্ছে রীতিমতো।
“তুই, আমি এখানে তুই জানলি কি করে?”
“আরে ব্যাটা, আমি তো এখানেই ছিলাম। হঠাৎ ই তোকে দেখতে পেলাম। কল করলাম দেখি অফ বলে। তাই ছুটে এলাম।”
ছেলেটা কিছু বলল না। নজর ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল দোতলায়। ঝিল বসে, ধ্যান কোনো কল্পতে। তরুণ সবটা লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি? একটুপর ওরা বের হবে। দেখলে রক্ষে নেই।”
“দেখানোর জন্যেই তো এসেছি।”
“তুই কি করতে চাচ্ছিস বল তো।”
“সময় হোক বুঝবি সব।”
“ভাই আমি সত্যিই বুঝি না তোকে। এটা তো স্পষ্ট তোর মামাদের সাথে মির্জাদের সম্পর্ক ভালো নয়। পুরনো রেষারেষি। এ দিকে তোর পাগলামো। না জানি কোন ইতিহাসের জন্ম দিবে।”
অভিনব হাসল। তরুণের পিঠ হাত রেখে বলল, “চল ভেতরে যাওয়া যাক।”
কিছু বলার পূর্বেই ছেলেটা চলতে লাগল। তরুণ পিছু ডাকে, “আর ভাই শোন, মা রা পড়বি। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা কর। এত সাহস দেখানো ভালো না। আমি কিন্তু আঙ্কেল আন্টির কাছে সবটা বলব।”
কোনো রকম পাত্তা না দিয়েই চলছে ছেলেটা। বরাবরেই মত জেদি আর বিনয়ী মানুষটা নিজের আলাদা রূপে সেজে উঠছে। তরুণ বুঝতে পারল না কি হবে। তবু মনে প্রাণে চাইল অভিনবর যেন কিছু না হয়।
.
সমস্ত আয়োজন শেষ। খাবার দেওয়া হচ্ছে। মানুষগুলোর পাশে বসল অভিনব। মানুষ হিসেবে মির্জারা আসলেই ভালো। তবে সমস্ত রোষানলে শিকদারদের উপরে। বিষয়টা আসলেই ভাবণার। কিন্তু অভিনব জান প্রাণ দিয়ে চাইছে সবটা সুন্দর হোক। ওর প্রজাপতির ঠোঁটে থাকুক চিরস্থায়ী হাসির রেখা। এসব তো সহজ নয়। সময় নিয়েই সবটা সামলাতে হবে। মনিরুল মির্জা খাবারের তদারকি করছিলেন। অভিনব কে দেখে অবাক ই হলো। এমন সুন্দর ছেলেটি এখানে কি করছে! তাছাড়া পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা কোনো ভালো পরিবারের।
“তুমি বাবা এখানে কেন?”
“দাওয়াতে এসেছি আঙ্কেল।”
“সেটা না হয় ঠিক আছে, তবে এখানে তো নিম্ন আয়ের মানুষদের আয়োজন।”
“আমি তো নিম্ন আয়ের মানুষই।”
মনিরুল মির্জা ভরকালেন। ছেলেটা বলে কি? তিনি একজনকে ডেকে অভিনবর প্লেটে খাবার দিলেন। ছেলেটার চোখে মুখে তৃপ্তি। দরিদ্র মানুষদের পাশে বসে কতটা সহজ ভাবে খাচ্ছে!
অভিনবর খাওয়া প্রায় শেষ। ওমন সময় এলো ঝিল। ওর হাত কাঁপছে। অথচ অভিনব হাসছে। মেয়েটির পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে তরল। ছেলেটা উঠে এসে বলল, “অবাক হলেন প্রজাপতি?”
“এখানে কেন এসেছেন! মেঝো পাপার সাথে কি কথা হলো আপনার?”
“তেমন কিছু না। আপনি এভাবে ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?”
“সরে যান প্লিজ। পাপারা এখনি আসবে। দেখলে রক্ষে নেই।”
“কিচ্ছু হবে না প্রজাপতি। মিছে ভয় পাচ্ছেন।”
“চুপ,কোনো কথা না।”
হঠাৎ মেয়েটির এমন আচরণে অভিনব বিস্মিয় হয়ে পড়ল। বলিষ্ঠ দেহের ছেলেটি কে টেনে সরিয়ে নিল। ছেলেটার দু চোখ নেচে উঠে। একটু খানি ছোঁয়া ওকে নিয়ে যায় মনের মধ্যভাগে। লিখে দেয় নতুন কিছু।
“পেছনের রাস্তা দিয়ে চলে যাবেন। এ পথে কেউ নেই। যান দ্রুত।”
“বউ সেজেছেন প্রজাপতি! ভীষণ ভালো লাগছে।”
“কেউ চলে আসার আগে প্লিজ চলে যান।”
“যাওয়ার জন্য তো আসি নি প্রজাপতি।”
“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না।”
“বুঝতে পারি প্রজাপতি। আপনি মিছে মিছে টেনশন করছেন।”
কথাটা বলেই ঝিলের কপালে থাকা চুল কানের পিঠে লুকিয়ে দিল অভিনব। এ ছোঁয়ায় মেয়েটির পুরো শরীর কেঁপে উঠে। হৃদস্পন্দন গুলো অসম্ভব ভাবে বেড়ে যায়। ছেলেটা এমন কেন? কেন বার বার ওকে এলোমেলো করে দেয়!
“ঝিল, ঝিল, কোথায় তুই।”
আহনাফের কণ্ঠ! কল্প থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটি। অভিনব কিছুতেই যাবে না। উপায় না পেয়ে শর্ত জুড়ে দেয় মেয়েটি।
“আমার কসম রইল,আপনি এখনি চলে যাবেন। ভাইয়া এসে পড়লে ঝামেলা হয়ে যাবে।”
অসহায় হয়ে পড়ল অভিনব। চোখ দুটো মেয়েটির মুখের দিকে তাক করা। আহনাফের কণ্ঠটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ঝিল আর থাকতে পারল না। অভিনব কে বের হতে বলে ছুট লাগায়। যাওয়ার পূর্বে ফের তাকায় ছেলেটির পানে। ওর চোখে থাকা ভয় অভিনবর হৃদয়ে প্রশান্তি হয়ে নামে।
বাড়িতে এসে অভিনবর মনে হলো ঝিলের এই অতি ভয়ের পেছনে কোনো অনুভূতি জড়িয়ে। এসবে তো ওর খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু কেন যেন পারছে না খুশি হতে। একটা গুমোট অশান্তি ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। মা বাবাকে ও ভীষণ মনে পড়ছে।
কত দিন হয় কথা হয় না। কিন্তু কথা হলেই বা কি শুনাবে?এখন অবধি কোনো ভালো নিউজ তো নেই ওর নিকটে। এই নিয়ে মন খারাপ হয়েছিল অভিনবর। সে সময়টায় আরেকটি খবর এলো। সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো সে। বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, “ভাবি সবাই কি বলেছে আমি জানি না। তবে আমার মতামত থাকবে নিজেকে গুরুত্ব দিন।”
চোখে জল মুনতাহার। আরফান একদমই মৌন। ওর ভেতর থেকে একটুও খারাপ লাগছে না। অন্যদিকে মুনতাহার অবচেতন মন চাইছে ছেলেটা বলুক ‘তুমি থেকে যাও। আমি ট্রাই করব তোমাকে ভালোবাসার।’ যদি এইটুকু ও বলত তবু থেকে যেত মেয়েটি। অন্তত এইটুকু শান্তি নিয়ে থাকত, ওর প্রিয় মানুষটা চেষ্টা তো করেছে। কিন্তু কথায় আছে মানুষ যা চায় তা পায় না। ওর ব্যপারেও এমনটা ঘটল। একরাশ হা হা কার নিয়ে চলে গেল মেয়েটি। বাড়ির সবাই চুপ। কেউ কিছুতে বলতে পারছে না। আরফান ও চলে গেল নিজের ঘরে। সে পথে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে অভিনব। বোকা মানুষ বোধহয় একেই বলে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
ছবি: Tufan’s Artbin