সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৩)

0
114

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৩)

একপ্রকার স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে অধৈর্য হয়ে পড়ল অভিনব। মস্তিষ্কে এক আকাশসম চিন্তা। গত কয়েকদিন ধরে ঝিলের ফোন সুইচঅফ। সোশ্যাল মিডিয়া ডিএকটিভেট। সব মিলিয়ে ছেলেটা পাগল হয়ে উঠেছে। মেয়েটি কে ভীষণ ভালোবাসে কি না। ওর এই অধৈর্য, উদ্বিগ্নতায় সান্ত্বনা দিচ্ছে তরুণ। ছেলেটা বড্ড ভালো। সর্বদা পাশে থাকে। সে মনে মনে ঠিক করল ঝিলের সব থেকে কাছের বান্ধবী মৌনতার সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে। মেয়েটির নাম্বার থাকাতে চটজলদি কলটা করে ফেলল। সেদিন বিকেলেই দেখা করল ওরা। মৌনতা আয়েশি ভঙ্গিতে কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে। তরুণ অধৈর্য হলো না। খুব শান্ত ভাবে কুশলাদি করে এক পর্যায়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার বান্ধবী কোথায়?”

কথাটি বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর। তারপরই পাল্টা প্রশ্ন করল, “কেন কি করবেন?”

“দরকার আছে। প্লিজ বলো, ঝিল কোথায়।”

এবার মৌনতা সিরিয়াস হলো। তরুণের মুখটা শুকিয়ে এসেছে। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “আমি তো গত এক সপ্তাহ গ্রামে ছিলাম। কাল রাতে ফিরেছি। গ্রামে নেট নেই একদম। তাই যোগাযোগ ও হয় নি। ওয়েট কল করে দেখি।”

মৌনতা তখনি কল করল। কল যাচ্ছে না। মেয়েটা ঈষৎ চিন্তিত স্বরে বলল, “কোনো সমস্যা? ঝিলির বিষয়ে কিছু জেনেছেন কি?”

“তেমন কিছু না। তবে ও বাসায় নেই। অভিনব পাগল হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছো ওদের ইস্যুটা।”

মৌনতার খারাপ লাগল। অভিনবর সাথে কয়েকবার দেখা হলো। ছেলেটা অদ্ভুত সুন্দর। ব্যবহারটাও দারুণ। সেবার ওরা যখন ঘুরতে গেল তখন অভিনবর আরেকটি রূপ ধরা দেয়। সেই থেকে মৌনতার মনে অভিনব নামটি দারুণভাবে লিপিবদ্ধ। মেয়েটি একটু ভেবে বলল, “আমি দেখছি কি করা যায়। ওর ফ্যামেলি আমার প্রতি খুব লয়াল। আমি নিশ্চয়ই কোনো খবর আনতে পারব।”

পরদিনই খবর দিল মৌনতা। ঝিল তাঁর মামা বাড়িতে আছে। অভিনব এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিল না। কিন্তু পথিমধ্যে বাঁধা দিলেন ইববান শিকদার। ওনার মুখাশ্রী কঠিন হয়ে এসেছে। ঝিলের মামাদের সম্পর্কে অবগত নয় ছেলেটি।
“ব্যস্ত হইয়ো না ইহান।”

“আমি আসলেই সহ্য করতে পারছি না মামা। ওরা সর্বদা আমার বিপরীতে গিয়েছে। এটা খুবই অন্যায়।”

“সেটাই সমস্যা। কিন্তু তোমার মা বুঝে নি এসব। আমাদের নাক কেটে যাই হোক এখন পরিস্থিতি অন্য পর্যায়ে। মির্জারা ভুলে গেছে তাদের সীমা।”

“এখুনি বের হতে চাচ্ছি আমি।”

“বারবার ভুল করো না ইহান। মাথা নুইয়ে কেন দিচ্ছ? সময় নাও,আর বুঝতে দিও না প্রতিপক্ষ তোমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে।”

মামার হাজারো নির্দেশের তোয়াক্কা না করে সে রাতেই ছুটলো অভিনব। এমন নয় সে ঝিলকে দেখার জন্য ম রে যাচ্ছে। তবে মেয়েটি যে ভীষণ অভিমানী। গত ছয় বছরে করে আসা ভুলের পাহাড় ফের জমাতে চায় না ছেলেটি।

ঝিলের মামারা বিশাল ক্ষমতাবান। ওদের এই ক্ষমতার কারণে ভয়ে মাথা নুইয়ে চলছে দু চার এলাকার লোকজন। বাড়ির চারপাশ জুড়ে বিশাল প্রাচীর। এগুলো বেয়ে উঠা অসম্ভব। দেয়াল গুলোতে লাগানো কাঁচের টুকরোতে র ক্তা ক্ত হতে হবে। তবে অভিনব জানে তাকে কি করতে হবে। পকেট থেকে এক প্রকার ভেষজ সুগন্ধির বোতল বের করে হেসে ফেলল সে। এই ভেষজ ব্যবহার করেই তো ঝিলের সাথে দেখা করতো। অথচ ঝিল ভেবেছে ছেলেটা অতো গুলো গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে উঁচু দেয়াল টপকে বারান্দা বেয়ে কত কষ্ট করে এসেছে। অভিনব বরাবরের মতোই মাক্স পড়ে নিয়ে ভেষজটা ছড়িয়ে দিল। মেইন ফটকে থাকা গার্ডরা ঘুমিয়ে পড়ল কিছু সময়েই। অতি সহজেই ভেতরে প্রবেশ করল ছেলেটি। তবে সমস্যা দেখা দিল সি সি ক্যামেরা নিয়ে। ঝিলদের বাড়ির সি সি ক্যামেরা ওর আয়ত্তে থাকলেও এখানে তো সে উপায় নেই। একটু চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু তখনি দেখতে পেল বাড়ির পেছনের দিকটার একটা ক্যামেরা ভাঙা। এক চিলতে হাসি ফুটলো অধরে। সৃষ্টিকর্তা যেন ওর বিজয়ের সব পথই খুলে দিয়েছেন। অতি সাবধানে উঠে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ছেলেটা। ফের সমস্যায় পড়ে যায়। ঝিল রয়েছে কোন ঘরে? এধার ওধার তাকিয়ে ছেলেটা যখন ভীষণ চিন্তায় ডুবে ঠিক তখনি দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে ঝিলের বড় মামার ছেলে আয়ুষ। অভিনব চটপট লুকিয়ে পড়ে। ছেলেটা ড্রয়িং রুমে এসে আরাম করে বসে গেমস খেলছিল। অভিনবর ইচ্ছে হলো ছেলেটাকে ঠাটিয়ে কান বরাবর থা প্প ড় বসাতে। তবে সেরকম কিছুই করতে পারল না। অনেকটা আশাহত হয়েই ফিরতে হলো ওকে। সারারাত এধার ওধার ঘুরেছে। চোখের নিচটায় কালি জমে গেছে। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার কারণে সেসব বেশ চোখে পড়ছে। অভিনব বাড়ি ফিরতেই তামীম ব্যগ্র কণ্ঠে বলল, “সারারাত কোথায় ছিলে ইহান ভাইয়া? আব্বু আর চাচ্চু কত টেনশন করছিল জানো।”

অভিনব উত্তর করে নি। ওর মনে ভীষণ তৃষ্ণা জেগেছে। মেয়েটির এত নিকটে গিয়েও দেখা হলো না। কাল রাতের ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। গত ছয় বছরের জন্য ভীষণ আপসোস হতে লাগল। সেদিন জোর খাটালে গল্পটা আসলেই ভিন্ন হতে পারত।
.

গত কয়েকদিনে ঝিল এইটুকু বুঝেছে তাকে মামা বাড়ি পাঠানোর পিছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য। রজনীপুর বিয়ের কোনো ইয়াত্তা নেই। এদিকে ফোন নষ্ট হয়ে গেল হুট করেই। কারো সাথে যোগাযোগ ও হচ্ছে না। এ বাড়িতে এমন কেউ নেই যার সাথে নিজের মনের অশান্তি টুকু শেয়ার করা যায়। রজনীপু ও খুব একটা আসে না। সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থেকে ঝিলের মনে হয় অসুখে ধরে যাবে। ওর এই অস্বস্তি লক্ষ্য করতে পারলেন বড় মামা। ভদ্রলোক আয়ুষকে ডেকে পাঠালেন। ছেলেটা একটু অন্য ধাঁচের। মিশুক নয় একদমই। একা থাকতে পছন্দ করে। তবু তিনি বললেন মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরে আসতে। বেশি দূর নয় কেবল আশপাশটায়। ঝিলের যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবে মুখের উপর বারণ ও করতে পারছে না। আয়ুষের সাথে চলছে মুখে কুলুপ এঁটে। ছেলেটা যেন কোনো যন্ত্র থেকে জন্মেছে। এর সঙ্গ ওকে বিরক্তই করছিল। অন্যমনস্ক থাকাতে হঠাৎ ই পড়ে যেতে নিচ্ছিল। নিজেকে সামাল দিতে সামনে থাকা আয়ুষের শার্ট খামচে ধরে মেয়েটি। আয়ুষ ও চটজলদি ধরে ফেলে মেয়েটির হাত। প্রথম বারের মতো কথা বলে, “তুই কি চোখের মাথা খেয়েছিস। এভাবে কেউ হাঁটে। একটুর জন্য কোমর ভা ঙা থেকে বেঁচে গেলি।”

আয়ুষ ঝিলের থেকে কম হলেও পাঁচ বছরের বড় হবে। ছেলেটার সাথে আগে কখনোই কথা হয় নি। একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। আয়ুষ নিজ থেকেই এগিয়ে এলো। ঝিলের পা মচকেছে। হাঁটতে পারছে না একদমই। আয়ুষ সাহায্য করল। কিছুদূর যাওয়ার পর বলল,
“ভ্যান গাড়িতে উঠেছিস কখনো?”

“উহু।”

তখুনি একটা ভ্যান ডেকে আনে আয়ুষ। ঝিলকে উঠিয়ে নিজেও পাশে বসে। গ্রামের হাওয়া, আর পাখিদের কলতান মেয়েটির ভালোই লাগছে। ঝিল নিজ থেকে কথা বলল না বিধায় আয়ুষ ও আর কিছু বলছিল না। হঠাৎ করেই টক পানি দেখে মেয়েটির লোভ জাগল।
“মামা থামান।”

“কেন? কি হলো আবার!”

“টক পানি, টক পানি খাব।”

“ছি, এটা কেউ খায়? জানিস তো আমাদের এখানে এটাকে পাগলা পানি বলে। এটা খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।”

ঝিলের ভ্রু বেঁকে গেছে। ওর মুখের অবস্থা দেখে গগন কাঁপিয়ে হাসতে লাগল আয়ুষ। ঝিল ও হেসে উঠে। আয়ুষ দুটো টক পানি কিনে আনে। ঝিল চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে,
“এখন? নিজে খাচ্ছে দোষ নেই। অথচ আমি খেতে চাইলেই ফালতু লজিক।”

স্মিত হাসল আয়ুষ। পুরোটা বিকেল বেশ ভালো গেল ঝিলের। প্রথমবারের মতো ঝিল স্বস্তির দম ফেলল। আয়ুষের সাথে কাটানো গত দু ঘন্টা সত্যিই দারুণ ছিল। ছেলেটা হুট হাট লজিকের দোকান নিয়ে আসে। যার বেশির ভাগই রসিকতায় ঠাসা। বাড়ি ফিরে এসে ঝিলের মনে হলো চোখ দুটো ভীষণ ক্লান্ত। ঘুমে টলে যাচ্ছে সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহ।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

রিচ তলানিতে। সাধ্যমতো রেসপন্স করার অনুরোধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here