#সুখ_একটি_প্রজাপতি(২)
তিন বছর পূর্বে অভিনব যখন বাংলাদেশে এসেছিল তখন তাঁর বয়স ছিলো প্রায় ছাব্বিশ এর আশে পাশে। আর তিন বছর পর এখন তার বয়স হলো উনত্রিশ। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছেলেটা আমেরিকার স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটির লেকচারার পদে ছিল দু বছর। বরং যদি বলা হয় অভিনব সবে অনার্স শেষ করেছে তাহলে সেটা হবে বিশ্বাসযোগ্য। সবে বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। এর ই মাঝে আকাশ কালো ঘন মেঘে আবৃত। ঠান্ডা শীতল মিহি এক বাতাসে অভিনবর টনক নড়ে। আনমনেই হেসে উঠে ছেলেটি। দোতলার ছাদ থেকে নেমে পড়ে দ্রুত পায়ে। মাথাটা সামান্য উঁচু করতেই বৃষ্টির বৃত্তাকার ফোটা পড়ল নাক বরাবর। তারপর পড়ে চোখ,কান, গালে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় সর্বাঙ্গে। অভিনবকে ভিজতে দেখে ছুটে আসে তরুণ। এতে বিন্দু মাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না অভিনবর। সে আপনমনে বৃষ্টি অনুভবে ব্যস্ত। প্রকৃতি তার ভীষণ প্রিয়। এর সাথে মিশ্রিত ওর আবেগ। তরুণ ব্যগ্র কণ্ঠে বলে
“এই অভিনব! কি করছিসটা কি? বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিস তো।”
“ভেজার জন্য ই তো এসেছি।”
“বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। সর্দি জ্বর লেগে যাবে।”
“উহু কিছু হবে না।”
“এটা কিন্তু আমেরিকা নয় যে সর্দি জ্বর লাগলে ডজন খানেক ডাক্তার এসে হাজির হবে। ভেতরে আয় বলছি।”
“বাংলার হাওয়া আমায় কাবু করতে পারবে না। এ দেশ, দেশের মাটি, মানুষ সব কিছুকে নিশ্চয়ই আপন করে নিব আমি।”
কথা শেষ করেই বৃষ্টিতে নেমে গেল অভিনব। তরুণ তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। যখন বিষয়টা খেয়াল হলো তখনি ধপ ধপ পা ফেলে ঘরে চলে গেল। আর ফিরে এলো ছাতা নিয়ে। অভিনব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। র ক্তে জেগেছে মাতাল করা প্রেম। পা খিচে চলতে চলতে তরুণ ওর কাছে এলো। অভিনব উপস্থিতি অনুভব করতে পারল ঠিক, তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তরুণের শ্বাস ভারী। ছেলেটা বিদেশ থেকে এসেছে। এই আবহওয়া কিছুতেই নিতে পারবে না। নিশ্চিত ভাবে জ্বর লাগাবে। আর তখন হবে আরেক বিপদ! তাছাড়া এই বৃষ্টিতে ছেলেটা যাচ্ছেই বা কোথায়?
“এই অভিনব। এই বৃষ্টিতে যাচ্ছিস কোথায়? আর তুই এখানে চিনিস নাকি। হারিয়ে গেলে তো আরেক ঝামেলা।”
“কে বলল আমি চিনি না? আর আমি দু বছরের বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাব। বোকার মতো কথা বলিস না।”
“তুই চিনিস!”
তরুণের কণ্ঠে বিস্ময়। অভিনব একটু হাসল। তবে মুখে বলল “বাসায় যা। আমার ঠান্ডা জ্বর না এলে ও তোর ঠান্ডা লাগবে নিশ্চিত।”
“অভিনব তুই…”
তরুণের মুখের কথা মুখে রইল তার পূর্বেই মুখ চেপে হাঁচি বের হয়ে এলো। ফিক করে হেসে উঠে অভিনব। ভেজা হাতটা তরুণের বাহুতে রেখে বলে ফিরে যেতে। ছেলেটার ঠান্ডার ধাঁচ রয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই কাবু!
হাঁচি দিতে দিতে ঘরে এলো তরুণ। তুহিন সোফায় বসে কাজ করছিল। তরুণকে দেখে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে শুধায়।
“বৃষ্টি সহ্য হয় না তো যাস কেন?”
“আরে ভাই অভিনব কোথায় যেন চলে গেল।”
“কোথায় গেল? এখানে তো নতুন। কুল হারিয়ে ফেলবে। কি একটা অবস্থা!”
“সে নাকি চিনে।”
তুহিন এবার চোখ ছোট করে তাকায়। অভিনব ছেলেটা কে বোঝা সত্যিই দুষ্কর! এ যেন অসীম কোনো রহস্যের জাল।
অভিনব এখন যে স্থানে দাড়িয়ে আছে সে স্থানটা মির্জা বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে। একটু দূরেই সাদা রঙের এক তলা বাড়ি। সেই বাড়ির দিকে বুকে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনেকটা সময়। আচানাক ঘটল বিষয়টা। অপেক্ষার অবসান হলো। এতক্ষণ পর ঝিল বেরিয়ে এসেছে। সাথে মৌনতা ও। দুজনের মাঝে টানা হেঁচকা চলছে। নির্লিপ্ত তাকিয়ে আছে অভিনব। ঝিল মৌনতাকে টেনে বাইরের করিডোরে দাঁড় করায়।
“ঝিলি প্লিজ আমি যাব না। আই হেইট সর্দি।”
“কিছু হবে না রে। একটু ভিজে দেখ।”
“নো ওয়ে। এক সপ্তাহ ভোগা সম্ভব না।”
“মৌন দেখ….”
ঝিলের কথা অগ্রাহ্য করে মৌনতা ঘরে ছুট লাগিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে দুজনে এসেছে এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। আর তারপর ই শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। বছরের প্রথম বৃষ্টি। এই লোভ সামলাতে পারবে না ঝিল। আজ এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা গায়ে মেখেই ছাড়বে। ত্রস্ত পায়ে এগোয় ঝিল। শীর শীর হাওয়ায় কেঁপে উঠে শরীর। মুখে ফুটে লাজুক হাসি। হঠাৎ করে এক ভেজা হাত পেছন থেকে ওকে আকড়ে ধরল। এক রাশ ভয় নিয়ে চমকে তাকায় ঝিল। অভিনবর মুখে লেগে আছে পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা। ছেলেটার হাত মেয়েটির বাহুতে। ঝিলের কণ্ঠ কাঁপে।
“আপনি!”
“আপনার জন্য চলে এসেছি। খুশি হোন নি?”
“ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”
“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি প্রজাপতি।”
ঝিলের চোখে এবার বিস্ফোরণ। অভিনব সামান্য ঝুকে দুজনের হাইট ব্যালেঞ্ছ করে নিল। ঝিলের চোখ বড় হয়ে গেছে। হাত পা ছুড়োছুড়ি করছে রিতিমতো। বিরক্ত হয়ে আরেকটু আগলে নিল অভিনব।
“ছাড়ুন প্লিজ।”
“আচ্ছা ছাড়ছি তবে এক মুহূর্তের জন্য।”
হাত আলগা করতেই ঝিল সেটার সুযোগ নিতে চাইল। তবে লাভের লাভ কিছুই হয় নি। অভিনবর লম্বা হাত ওকে চেপে ধরল আরও একবার। অভিযোগের কণ্ঠে বলল
“এর জন্যই প্রজাপতিকে খাঁচায় রাখতে হয়। যতক্ষণ না অবধি নিশ্চিত হওয়া যায় ছেড়ে দিলেও গোল চক্রের মতো ফিরে আসবে।”
ঝিল শান্ত হতে পারছে না। অস্বস্তিতে নুইয়ে যাচ্ছে। বার বার চারপাশে চোখ বুলায়। ছুটোছুটি করার চেষ্টা করে।
“আপনি এমন কেন প্রজাপতি। আমায় ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন কেন?”
নিরুত্তর ঝিল। সে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালানো বন্ধ করল না। অভিনব আগেই লক্ষ্য করেছে এ দিকে মানুষ জন নেই। তবু ও হুটহাট চলে আসতেই পারে। তাছাড়া ঝিলের বান্ধবীর বাসার ছাদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রিক্স নিতে চাইল না। সেই কারনে মেয়েটি কে টেনে অন্য দিকে নিয়ে এলো। এখানটা নিরাপদ। ঝিলের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হয়। অভিনব মেয়েটিকে পেছন ঘুরিয়ে নেয়। বৃষ্টির ফোটাতে ঝিলের শরীর ভিজে একাকার। দৃশ্যমান হয়েছে মশ্রিন পাতলা কোমর। একবার চোখ চলে যায় অভিনবর। শুরুতেই নিজেকে শাসন করে। ঝিলের কানের কাছে এসে বলে
“প্রজাপতি আপনার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস আছে?”
বৃষ্টি ভালো লাগলে ও ঝিল অভ্যস্ত না এতে। তাই চুপ করে রইল। অভ্যস্ত হলেও উত্তর দিত না। মৌনতাকেই সম্মতি মেনে নেয় অভিনব।
“অভ্যেস করে নিন প্রজিপতি। আপনাকে ভিজতে হবে। কখনো প্রকৃতির মায়াতে, কখনো বা প্রাপ্তি তে কখনো বা আমার ভালোবাসা তে।”
ঝিল কেঁদে দেয় প্রায়। হাতে ব্যথা লাগছে ঈষৎ।
“ব্যথা পাই।”
“আলগা করে দিচ্ছি।”
হাত আলগা করে রাখল অভিনব। ঝিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে ছেলেটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর নিকট। ভেজা চুল গুলো ঘাড়ের এক পাশে দিয়ে দেয়। কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড়ের দিকে অগ্রসর হয়। গরম নিশ্বাসে জামা চেপে ধরে ঝিল। ভেজা শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠে। অভিনবর উষ্ণ অধর ঘাড় ছুই ছুই। তখনি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় ঝিল। অভিনব তাকিয় থাকে কেবল। মেয়েটা চালাকি করেছে। হাত আলগা না থাকলে কোনো ভাবেই ছাড়াতে পারত না। অনেকটা চলে গেছে ঝিল। সে জন্য আর পিছু নেয় নি অভিনব। ঠোঁট কামড়ে হাসে। আজকের জন্য এই টুকুই এনাফ।
ঝিল হাঁপিয়ে গেছে। মৌনতা বসে বসে চিপস খাচ্ছিল। মেয়েটি কে দেখে মৌন ব্যস্ত হলো।
“কি রে ঝিল। হাপাচ্ছিস কেন? একটু আগেই তো ঠিক ছিলি।”
“শাওয়ার নিব। তুলি কে বল জামা বের করতে।”
“কিন্তু.. ”
মৌনতার কথা পরিপূর্ণ হলো না। তার পূর্বেই ঝিল চলে গেছে। মেয়েটিকে বুঝতে পারে না মৌনতা। এই যে জরুরি তলবে ওকে তুলে নিয়ে এসেছে। অথচ কারণ হিসেবে এখন অবধি কিছুই বলে নি।
কাক ভেজা হয়ে সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে এলো অভিনব। পুরো ঘর ময় পায়চারি করছিল তরুণ। অভিনবর জন্য বেশ চিন্তিত ছিল। ছেলেটার ফোন ও বন্ধ। ঘরে ঢুকতেই তরুণ চেপে ধরল এক প্রকার।
“এই তুই তো ভেজা কাক হয়ে গেছিস। কি করি এখন! নিশ্চিত আজ জ্বরে ভুগবি।”
অভিনব স্বচ্ছ চোখে তাকায়। মনে মনে কাউন্ট করল ১,২,৩ সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি দিয়ে উঠল তরুণ। অভিনব হেসে কুটি কুটি। নাক মুছে তরুণ কিছু বলবে আবার সেই হাঁচি! অভিনব নিজ থেকে সহজ করে দিল।
“তোয়ালে দে। মাথা মুছতে হবে।”
তরুণের প্রয়োজন পরে নি। তুহিন ই তোয়ালে নিয়ে হাজির হয়েছে। বিন্দু মাত্র রিক্স নিতে চায় না এই ছেলেটার বিষয়ে। এই অর্ধ বিদেশী ছেলের শরীর খুব নাজুক না হলে ও ওর মনের ভয়টা নাজুক। অভিনবর মতো আদরের দুলালের এক চিলতে সমস্যা হতে দিবে না। কিছুতেই না।
অভিনব শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে মাত্র। তুহিনকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে বলল
“আমি ঠিক আছি তুহিন ভাই। আপনি শুধুই ব্যস্ত হচ্ছেন।”
“মেডিসিন খেয়ে নাও। রিক্স নেওয়ার কি দরকার?”
বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ এখন লাল আভাতে পরিপূর্ণ। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে মম করছে পরিবেশ। লালটে গগন অপূর্ব দেখাচ্ছে। যেন সাদা ক্যানভাসে সবে রঙের ঝড় উঠেছে। বৃষ্টির পর মূহুর্তটা খুব প্রিয় ঝিলের। নরম পাতাতে কেমন যেন আলোকরশ্মি খেলা করে। দারুণ লাগে তখন। মৌনতা অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ। গলা চুলকোচ্ছে কথা বলার জন্য। তবে ঝিল গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরের পরিবেশে মত্ত। এই ধরা, এই বৃষ্টি, আর অপরূপ সৃষ্টি সব কিছুই ওকে মুগ্ধ করে। চারপাশ টা কে স্থির নয়নে অবলেকন করছে। মৌনতা এই মৌন সহ্য করতে পারছে না। পেটের ভেতর সুরসুরি লাগে। মেয়েটি নীরবতা ভেঙে বলল
“কি হয়েছে বল না।”
“কই কি হয়েছে?”
“তোকে কেমন যেন চিন্তিত ঠেকছে।”
“উহু আমি চিন্তিত নই। ভুল ভাবিস তুই।”
“সে না হয় বুঝলাম। তবে আমাকে এই জরুরি তলব করে নিয়ে এলি সেটার কারণ তো বললি না।”
“এমনিই নিয়ে এলাম। এখন চুপ কর তো। দেখ পরিবেশ টা কি সুন্দর।”
ঝিলের কণ্ঠে দৃঢ়তা। মৌনতা কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই ঝিল চোখে শাসালো। নুইয়ে পরল মৌনতা। ঠোঁটে আঙুল চেপে নিয়েছে।
“যা কথাই বলব না।”
বাসায় এসে সারপ্রাইজ পেল ঝিল। পাঁচ ভাই এসে হাজির। কিছু কাজের জন্য মেঝো পাপা আসেন নি। ভাইয়েরা আগলে নিচ্ছে বোনকে। এ দৃশ্যে যেন মৌনতার চোখ জুড়িয়ে যায়। রোহনের সাথে চোখাচোখি হলো একবার। ছেলেটা ভোতা মুখ করে আছে। চেহারায় রাগ স্পষ্ট। ছেলেটা এত রেগে আছে কেন? ফোন রিসিভ করে নি বিধায়? মৌনতার ভেতর ডিঙিয়ে বের হয় তপ্ত শ্বাস। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। ঝিল ভাইদের থেকে সরে এসে বলল
“আমি খুব টায়ার্ড।”
“ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”
হু। তোমরা ও যাও। এতটা জার্নি করে এলে। আর এসেই আমার যত্নের পেছনে নেমে এসেছ!”
“আগে তুই যা।”
“ওকে।”
মৃদু হেসে চলে যায় ঝিল। মাঝ রাত্রিতে ঝিলের কাঁচা ঘুমে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে আননোন ফোন কল। বিরক্তিতে কুচকে যাচ্ছে চোখ মুখ। ফোনের স্ক্রিন দেখে রেখে দিল ঝিল। কোন মানব তার ঘুমে আ ঘা ত করে! ব্যক্তিটির ধৈর্য্য পরীক্ষা শেষে মায়া হয় ওর। একটা মানুষ এই রাত্রিতে এত করে কল কেন করছে? টুলুটুল চোখে কল রিসিভ করল। এক হাতে চোখ কচলে নিচ্ছে।
“হ্যালো। কে বলছেন।”
“আমি বলছি প্রজাপতি।”
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
ছবি : Tufan’s Artbin