#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১২)
মির্জা আর শিকদারদের পুরনো রোষের কথা কারো অজানা নয়। তবে এই শত্রুতা বেশ কিছুটা দমে গিয়েছিল গত ছয় বছরে। সেই শত্রুতা পুনরায় জাগ্রত হওয়ার একটি আভাস ইতোমধ্যেই চলে এসেছে। অভিনবর বড় মামা এতদিন চুপ থাকলেও আজ চুপ থাকলেন না। ভাগ্নের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য আসর সাজিয়েছেন। সে আসরে থাকার কথা বাড়ির সব ছেলেদের। এমনকি গত কিছুদিন পরিবারের চোখে সব থেকে নিকৃষ্ট হওয়া আরফান ও উপস্থিত। ইববান শিকদার ছেলের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললেন,
“একা কেন? দানেশ কোথায়!”
“জানি না বাবা। বেশ কিছুদিন ধরেই আমার সাথে কথা হচ্ছে না।”
তিনি আর কিছু বললেন না। লিটন শিকদার ভাইয়ের মুখের ভঙ্গিমা বুঝতে পেরে বললেন,
“ভাইয়া আপনি শান্ত হোন। আমি ডেকে নিয়ে আসছি।”
“না যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তামীম,সাদাদ যা ওকে নিয়ে আয়।”
ওরা চলে যেতেই ইববান শিকদার কাউচে বসেন। অভিনব সবটা বোঝার চেষ্টা করছে। একটা সরু চিন্তা ওকে পাগল করে দিচ্ছে। তবু বাইরেটা ভীষণ শান্ত। ওর এই অভ্যাসের কারণেই মামারা অধিক ভালোবেসে থাকেন। দশ মিনিটের মাথায় দানেশ এলো। ছেলেটা একটু অন্যরকম। এসব ঝামেলা একদম ই পছন্দ করে না। অথচ বাবা, চাচারা, ভাইয়েরা সব এক একজন ঝামেলার পাহাড়। ইববান শিকদার কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লিটন শিকদার বললেন, “বেয়াদব ছেলে। ভাইয়া আলোচনায় ডাকার পর ও কেন আসছ নাই?”
“বাবা আমি আগেও বলেছি এসব আমার ভালো লাগে না। সব থেকে বড় কথা তোমাদের যে কোনো আলোচনার মানে তো সেই মা রা মা রি, ধরাধরি।”
ছেলের মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে হবে তা কোনো কালেই ভাবেন নি লিটন শিকদার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে গেলেন। বাঁধ সাজলেন মুজাহীদ শিকদার।
“কি করছেন কি ভাইয়া! ও কি ছোট? ওকে মে রে ধরে কোনো লাভ হবে।”
“মে রে লাভ না হলে কে টে ফেলব। কোন বংশে ওর জন্ম সেটা বুঝতে হবে। ভয়ে দমে থাকার জন্য শিকদারদের জন্ম হয় নি।”
“থাম, তোরা।”
“বড় ভাইয়া আপনি বুঝতে পারছেন না কতটা বেয়াদব হয়ে গেছে ও।”
“বলেছি তো চুপ করতে।”
পুনরায় কিছু বললেন না লিটন শিকদার। ভয় আর লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আছে দানেশের। ছেলেটা কিছুতেই বোঝাতে পারে না এসবের কারণে কত মানুষের জীবন হুমকিতে। কি দরকার পুরনো কাসুন্দী ঘাটার!
দানেশ কে ছাড়াই আলোচনা শুরু হলো। এত সময়ে অভিনব টু শব্দটি করে নি। তবে এবার বলল, “আমি আসলে বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে।”
“একটু অপেক্ষা কর ইহান। সবটা বলা হবে। এসবের আগে একটা বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার।”
“জী মামা।”
“তুই মির্জা বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করিস?”
অভিনব তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারে না। একটু ভেবে বলে, “নিয়মিত নয় মামা।”
“আহা গিয়েছিস কি না সেটা বল।”
“গিয়েছিলাম মামা।”
“কেন?”
ছেলেটা এবার চুপ হয়ে গেল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইববান শিকদার নিশ্বাস ফেললেন। ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে নির্ভরতা হয়ে বললেন, “নিষেধ করা সত্ত্বেও কেন গিয়েছিস? তুই জানিস এর জন্য কতটা পোহাতে হবে আমাদের।”
“দুঃখিত মামা।”
“কথাগুলো সিরিয়াস ভাবে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তুমি সেখানে যাওয়া আসা করছো, এসব আমি আরও আগেই খবর পেয়েছি। তাই নিষেধ করেছিলাম। তবু গত রাতে কেন গিয়েছিলে?”
“মামা, আমি ওকে ছাড়তে পারি না।”
ভদ্রলোক পুনরায় কিছু বললেন না। অভিনবর ছোট মামা মুজাহীদ শিকদার বললেন, “ছয় বছর আগের ঘটনা ভুলে গেলি অভিনব?”
“ভুলি নি ছোট মামা। তবে সব অস্বীকার করা তো যায় না।”
“ধৈর্যহীন হয়ে যাচ্ছিস। অথচ ভুলে গেছিস পুরনো ঘটনা।”
“মেঝো মামা আমি ভুলি নি কিছু। তোমাদের সম্মান করি বিধায় আমি ছয় বছর ধরে চুপ করে আছি।”
সকলেই এবার চুপ। ইববান শিকদারের মুখের পানে তাকিয়ে অভিনব বলল, “ছয় বছর আগেও আমি ভদ্র ছেলে ছিলাম আর ছয় বছর পরেও ভদ্র ছেলে আছি। তোমরা যদি সত্যিই না চাও তবে আমি পিছিয়ে আসব।”
“পিছিয়ে আসবে? বোকার মতো কথা বলবে না। মির্জাদের গুমোট ভাঙতে হবে। শুধু বলো মেয়েটা তোমায় ভালোবাসে কি না।”
অভিনবর মুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো। হাসি হাসি ঠোঁটে বলল, “ভালোবাসে, ও আমার ভীষণ ভালোবাসে।”
.
বিরস ভঙ্গিতে বসে আছে ঝিল। ছাদের এ পাশটায় রোদ উঠেছে। মিষ্টি সোনালী রোদ। দেখতে ভালো লাগছে। অন্য পাশে গাছের সমাহার। একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। অন্য সময় হলে এই স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেই বসে থাকত। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না। মনের ভেতর সুখ নেই। একটা যন্ত্রণা সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। রজনী আপুর কথাটা বার বার মস্তিষ্কে হানা দেয়। সবটা এলোমেলো হয়ে আসে।
“অসময়ে রোদে বসে আছো কেন?”
আচমকা কথাটা শুনে ধরমরিয়ে উঠে ঝিল। রজনী হেসে ফেলে। হাতে আচারের বাটি। এগিয়ে দিয়ে বলে, “কড়া রোদ, আর গোসল ও করলে না। খাবে কখন? কাল রাতে ও তো খাও নি। ঘুম থেকে উঠলে মাত্র। এখন তো লাঞ্চ টাইম চলে এসেছে।”
“ভালো লাগছে না রজনীপু।”
“তা বললে চলে?”
“একটা সত্যি কথা বলবে?”
“হুম। কেন বলব না। আগে চলো গোসল করে নিবে।”
“উহু। আগে শোনো আমার কথা।”
“ঠিক আছে। বলো কি জানতে চাও।”
“সত্যিই তোমার বিয়ে?”
“হ্যাঁ। মিথ্যে কেন হতে যাবে। এখন এসো না।”
রজনী ওকে টেনে নিয়ে গেল। কিন্তু ঝিলের মস্তিষ্কে একটি কথাই দ্বন্দ্ব জুড়েছে। রজনীপু তখন কেন বলল আমি আবার কোথায় যাব।
ঝিলের দুই মামী। বড় মামী ডালিয়া বেগম আর ছোট মামী সুমতি বেগম। এরা একই সংসার থেকে এসেছে। অর্থাৎ দুজন একই মায়ের সন্তান। আর দুজনেই বেশ স্নেহশীল স্বভাবের। কথিত মামীদের মতো বি ষা ক্ত নয়। তবু ঝিল এদের সঙ্গ পছন্দ করে না। এর অবশ্য একটি কারণ ও রয়েছে। ঝিলের মা বাবার প্রণয়ের বিয়ে। অথচ ওর মামারা চেয়েছিল নিজেদের শ্যালকের সাথে বোনের বিয়ে দিতে। জাফর মির্জার সাথে জেহেনাজ চৌধুরীর বিয়ে নিয়ে বেশ দ্বিমত করেছিলেন ওনারা। এমনকি শুরুর দিকে বোনের সাথে সম্পর্কচ্যুত ও করেছিলেন। সেসব গল্প জানে ঝিল। মায়ের আর্তনাদ গুলো আজও স্মরণে আছে। তাই মামা বাড়ির প্রতি এত বিতৃষ্ণা। একটা শ্বাস ফেলল মেয়েটি। বড় মামী খাবার দিয়ে বললেন, “মন খারাপ মামুনি?”
“ঠিক আছি আমি।”
“খাবার খাও, কিছু লাগলে জানিও।”
খাবারের রকমারির দেখে ঝিলের বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। ইলিশ মাছের পাতুরি! মা খুব ভালোবাসতেন খেতে। ডালিয়া বেগম খুব ভালো বানাতে পারেন। অথচ বিয়ের পর একবার আবদার করেছিলেন। রাগের চোটে জেহেনাজ বেগমকে সরাসরি না করে দেওয়া হয়। সেই গল্প বলতে বলতে মা কাঁদতেন। ঝিলের চোখে জল নামে। খাবারের পাত থেকে ইলিশ মাছ উঠিয়ে রাখতেই সুমতি বেগম বলেন, “একি ইলিশ মাছ উঠিয়ে রাখলে কেন?”
“এ খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না ছোট মামী।”
অদ্ভুত শোনায় কথাটা। কেউ কিছু না বুঝলেও ডালিয়া বেগম বুঝতে পারলেন। ঘটনা মনে পড়তেই লজ্জায় ওনার মাথাটা নিচু হয়ে আসে। সাদা ভাত আর ঘন ডাল মেখে ভাত খায় মেয়েটি। এ বাড়িতে মায়ের কত স্মৃতি। সব যেন চোখে ভাসে।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
ছোটো বলে অভিযোগ করবেন না। ফোনটা ঠিক হয় নি এখনো। নতুন করে লিখতে হলো। পরশু থেকে আমার প্রি-টেস্ট। আর গল্পটায় ভ্রমণের সাথে পারিবারিক একটি কাহিনীও রয়েছে। তাই একটু এলোমেলো লাগতে পারে। জটলা খোলার অপেক্ষা করুন।