সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৫)

0
114

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৫)

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। ঠিক সে সময় মৌনতার ফোনে কলটা এলো। মেয়েটির সবে তন্দ্রা ভাব এসেছে। রিং পেয়ে হুরমুরিয়ে উঠে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝিলের কণ্ঠ,
“ডিস্টার্ব করলাম মৌন?”

“আরে ধ্যাত। কি যে বলিস তুই। আমি তো তোর কলের অপেক্ষাতেই ছিলাম। কেমন আছিস তুই?”

“ভালো। তোর কি খবর?”

“ঠিক ঠাক।”

তারপরই নীরবতা এসে জেঁকে ধরে। কে কি দিয়ে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। ঝিল কিছু বলতে চাইছিল ওমন সময় মৌনতা বলল, “জানিস ঝিলি, অভিনব ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে। চোখ মুখ শুকিয়ে এসেছে। একদমই ভালো নেই মানুষটা।”

কথাটা ঝিলের হৃদয়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। হু হু করে উঠল মন। মানুষটার চোখ মুখ যেন ভেসে উঠেছে।
“বিকেলে কল করেছিলাম। তখন ভাইয়া পাশে ছিল। উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কথা হলো না।”

ঝিল কথা বলতে পারছে না। মৌনতা ফের বলল, “জানিস ভাইয়া তোর মামা বাড়িতেও গিয়েছিল। ভেতরে ও ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু তোর রুম কোনটা সেটা বুঝতে পারে নি। ফিরে এসেছে খালি হাতে। একবার নয় পরপর দুবার গিয়ে ফিরে এসেছে।”

মেয়েটির চোখ থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে এবার। শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে শীতল ঘামের স্রোত। মনে হয় সব এলোমেলো। অস্বস্তিতে হৃদপিন্ড ধক ধক করেছে। মৌনতা সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল, “ঠিক আছিস ঝিলি?”

অনেক কষ্টে মেয়েটি উত্তর দিল, “হু।”

মৌনতার দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠেছে চারপাশ। এদিকে ঝিলের চোখ দুটি বাঁধন হারিয়েছে।
“ওনার নাম্বার আছে মৌন?”

“নাম্বার,ইস ভাইয়ার নাম্বার টা তো নেই।”

ঝিলের মনে হচ্ছে এবার দম বন্ধ হয়ে মা রা যাবে। আয়ুষ ফোন ঠিক করে এনে দিয়েছে। তবে সীম কার্ড লোড করার পর সমস্যা দেখা দিয়েছে। সীম কার্ডটা কাজ করছে না। আর না আছে কোনো নাম্বার। হাতের ফোনটা রজনীর। আয়ুষের ফোন থেকে কথা বলতে হলে কাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ঝিলের তড় সইছে না। খানিক বাদে মৌনতা বলল, “ওয়েট আমি তরুণ ভাইয়ার নাম্বার দিচ্ছি। ওনার থেকে চেয়ে নে।”

আশার আলো পেয়ে ঝিল কথা হারালো। মৌনতা নাম্বারটা ম্যাসেজ করে পাঠায়। এখন প্রায় মধ্য রাত্রি। এ সময় কাউকে ফোন করা একদমই উচিত নয়। তবু ঝিল কল করল। কিন্তু কল রিসিভ হলো না। কয়েকবার চেষ্টা করে মেয়েটি আশাহত হলো। কান্নায় ভেঙে পড়ল। মৌনতা পুনরায় কল করেছে।
“তরুণ ভাইয়া কল রিসিভ করছে না।”

“দাঁড়া আমি চেষ্টা করি। হয়ত অচেনা নাম্বার দেখে রিসিভ করে নি।”

মৌনতা কল করল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এবার ঝিল ফোনের এপ্রান্ত থেকেই ডুকরে উঠল। মৌনতার ইচ্ছে করছে তরুণের সব গুলো চুল ছিঁড়ে ফেলতে। মেয়েটির কান্না ওর সহ্য হচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড থমকে থেকেই মনে পড়ল ওর ফোনে ব্যালেন্স শেষ হয়েছিল বিধায় অভিনবর ফোন থেকে রুদ্রমকে কল করেছিল। এখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। কে জানে রুদ্রম জেগে আছে কি না। তবু চেষ্টা করল মৌনতা। কল রিসিভ হলো।
“এত রাতে কল করেছিস ক্যান?”

“শোন রুদ্রম এখন কথা বলার সময় নেই। চটপট বিকেলে যে নাম্বার থেকে কল করেছিলাম সেটা ম্যাসেজ কর।”

“কি বললি?”

“ধুর, বিকেলে যে নাম্বার থেকে আমি কল করলাম সেটা দে।”

“কেন, কি হয়েছে? এমন উন্মাদের মতো করছিস কেন?”

“কু ত্তা, হা রা মি যা বলি তাই কর।”

রুদ্রম আর কিছু বলল না। যা বুঝলো, মৌনতার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কল রেখে নাম্বারটা ম্যাসেজ করে দিল। মৌনতা সীন করেই চলে গেছে। রুদ্রম অবাকই হয়েছে। এত রাতে ফোন করে নাম্বার নিল কিন্তু থ্যাংকস অবধি বলল না!

ঝিল কান্না করছিল। ফের কল আসতেই রিসিভ করল। নাক টানা কণ্ঠে বলল, “হু।”

“দোস্ত ভাইয়ার নাম্বার পেয়েছি।”

ঝিলের ঠোঁটে হাসি এলো। চোখ দুটো মুছে বলল,
“দ্রুত ম্যাসেজ কর মৌন। আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।”

“হু দোস্ত একটু ওয়েট কর। এখনি দিচ্ছি।”

ঝিলের কল রাখতে না রাখতেই তরুণের কলটা এলো। মৌনতা রেগেমেগে আগুন।
“এত বার কল করার পর ও কল রিসিভ করেন না কেন হ্যাঁ?”

“ঘুমিয়ে ছিলাম। কি হয়েছে, এত রাতে কল দিলে যে?”

“ঝিল, কল করেছিল।”

“বাহ, অভিনবর সাথে কথা হয়েছে?”

“হবে কি করে? ওনার নাম্বারই তো নেই। আর এদিকে আপনি ঘুমাচ্ছেন। কত বার কল করেছি আমরা।”

“ইস। খুব খুব স্যরি।”

“আচ্ছা রাখুন এখন।”

তরুণ কল রেখে তখুনি অভিনবকে কল করে বিষয়টা জানালো। অভিনবর হাত পা যেন শক্তি হারিয়েছে। ছেলেটার আর সহ্য হচ্ছিল না। ঝিলের কাজিনের নাম্বারে কল করল। কিন্তু ওপাশ থেকে জানালো ব্যস্ত আছে। অন্যদিকে ঝিল ও কল করছে অভিনবকে। একই ভাবে ব্যস্ততার সুর শুনতে পেল। রাগে দুঃখে মেয়েটির চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো। কল কেটে মৌনতাকে বিষয়টা জানালো। মৌনতার ভ্রু কুঁচকে গেছে। এত রাতে অভিনব কার সাথে কথা বলতে পারে? ঝিলের কল রেখে তরুণকে কল করল মৌনতা। তরুণ জানায় অভিনব তাকে কল করে জানিয়েছে ঝিলের কাজিনের নাম্বার নাকি ব্যস্ত শোনায়। মৌনতা আর তরুণ দুজনেই ভ্যবলার মতো থেমে রইল কিছু সময়। অন্য দিকে ঝিল আর অভিনব দুজনেই একে অপর কে কল করে যাচ্ছে। তাই নাম্বার ব্যস্ত শোনাচ্ছে। মৌনতা আর তরুণ দুজনেই বুঝতে পারল বিষয়টা। কল রেখে মৌনতা বলল অভিনব ওকে কল করে যাচ্ছে তাই নাম্বার ব্যস্ত দেখায়। ও যেন এখন কল না করে। একইভাবে তরুণ ও অভিনবকে বলল ঝিল ওকে কল করছে। এরপর দুজনেই কল দেওয়া বন্ধ কলে দিল। ফোনের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে দুটি মানব। কিন্তু কোনো কল আসছে না। ঝিল আর অভিনব দুজনেই ভীষণ বিরক্ত। কি হচ্ছে কি এসব? ঝিল মৌনতাকে কল করে জানালো অভিনব তো কল করছে না। মৌনতা এবার রেগে আগুন। তরুণ তো ওকে বলল অভিনব কল করছে। মৌনতা আবার তরুণকে কল করল। এবার ওদের দুজনের ঝগড়া লেগে গেল। দুজনেই গাঁধার মতো কাজ করেছে। অভিনবর প্রহর যেন কাঁটে না। সে ঝিলের ফোনের অপেক্ষা না করে কল টা করেই ফেলল। এবার কল গেল। ঝিল বসে ছিল সিলিং এর দিকে তাকিয়ে। রিং হতেই বুকের ভেতর নাড়া দিল। অভিনবর নাম্বারটা স্ক্রিনে ঝলমল করছে। চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করেছে,হাত কাঁপছে রীতিমতো। প্রথম বার কল রিসিভ করতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু দ্বিতীয় বার রিং হতেই রিসিভ করে ফেলল। কিন্তু কি বলবে সেটা বুঝতে পারছে না। দুজনেই চুপ। নিশ্বাসের ভারী শব্দ গুলো কেবল শুনে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কত জনম পর এই নিশ্বাস শুনতে পেল। অভিনবই শুরু করল, “শুনছেন প্রজাপতি।”

ঝিলের ইচ্ছে করল ম রে যেতে। এভাবে কেউ ডাকে? মন প্রাণ কেমন উতলা হয়ে উঠল। উত্তেজনায় মেয়েটি কথা বলতে পারছে না। অভিনব মিটিমিটি হাসছে। যেন স্পষ্ট সবটা বুঝতে পারছে মেয়েটির অবস্থা। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত তিনটে বাজে। চারপাশ শুনশান। ঝিলের মনের ভেতর কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে।
“কথা বলবেন না প্রজাপতি?”

“জী।”

অভিনবর হৃদয় যেন জুড়িয়ে এলো। এই সামান্য শব্দটি যেন ওকে পাগল করে দিল। ঝিল কিছুটা স্বাভাবিক হলো। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “কেমন আছেন আপনি?”

“আপনাকে ছাড়া যতটা ভালো থাকা যায় ঠিক ততটাই ভালো আছি প্রজাপতি।”

ছেলেটা এভাবে কেন বলছে? ঝিলের যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে ইচ্ছে করছে সব রেখে ছুটে পালিয়ে যেতে। মানুষটার বুকে মাথা রেখে বলতে আপনাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু সেসব যে মুখ দিয়ে আসে না। এই অনুভূতি কেবল নৈঃশব্দে আলোড়ন ফেলে। ওভাবেই অনেক সময় চলে গেছে। দুজনের খুব বেশি শব্দের কথা হয় নি। তবে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফজরের আজান পড়তেই দুজনেই মনে হলো বুকের ভেতর শান্তি নেমে এসেছে। দুজন দুজনের অনুভূতি গুলো বুঝতে পারছিল ঠিকই তবে সেভাবে প্রকাশ করতে পারে নি। একে অপর কে বিদায় জানিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। এই মুহূর্তটা যে কতখানি মধুমাখা তা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব।

নামাজ পড়ার জন্য অজু করতে যাবে ঝিল। ওমন সময় রাতের শেষ আঁধারে দেখতে পেল এক জোড়া কপোত কপোতি। ওরা কথা বলছে। একে অপরের হাত ধরে রাখা। কিন্তু আঁধারের কারণে দেখা যাচ্ছে না মুখগুলো। পাখির কলতান আর হাল্কা আলো ফোঁটার পূর্বেই কপোত কপোতি আলাদা হয়ে গেল। ঝিল নামাজ শেষ করে আর ঘুমাতে পারল না। আজকে আর ঘুম হবে না। সমস্ত ঘুম, ক্লান্তি হারিয়ে হৃদয়ে কেবল ভালোবাসার অনুভূতি ডানা মেলেছে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

ছবি: ইন্টারনেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here