সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৯)

0
127

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৯)

মোহ,মুগ্ধতা, প্রেম, ভালোবাসা এসব কেবল কাব্যিক শব্দ নয় বরং এক একটা লুকানো অনুভূতি। সব কিছু মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে যায় আর ভাগ্য সহায় থাকে তখনি হয় পরিনয়। তবে এই পরিনয় সর্বদা সুখের হয় না। রজনীর বিয়ের আয়োজন তাক লেগে যাওয়ার মতোই। এই মুহূর্তে যে গানটা চলছে সেটা বেশ বিখ্যাত। সকলেই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। অভিনব ড্রাম বাজাতে পারে ভালো। তাই সে নিজেও বসেছে গানের আসরে। ঝিল ওকেই দেখছিল। ভালোবাসার মানুষটির সমস্ত কিছু ভালো লাগতে হবে এমন নয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে অভিনবর সব কিছুই ভীষণ আর্কষণ করে মেয়েটিকে। এই ছেলেটা ওর কিশোরী বয়সের আবেগ। যে বয়সটায় মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে থাকে। ঠিক সে বয়সেই অভিনব ওর জীবনে এসেছে। শুধু তাই নয় ওর জীবনের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। সম্পর্কটা একদিক থেকে বেশ সুন্দর লাগলেও কোথাও একটা টানাপোড়ন রয়েছে। পরিবারের দ্বন্দ্বেই মেয়েটির দীপশিখার মতো জীবন নিভে গেছে। হয়ত অভিযোগ নেই তবে অভিমান আছে। এই অভিমানের আবার প্রকাশ নেই। থাকবেই বা কেমন করে? পরিবারের প্রতিটি মানুষ এতটা আদরে রেখেছিল যে মেয়েটি একটা সময় স্বীয় ভালোবাসাকে ভুলতে বসেছিল। তবে ভুলে নি। আসলে ভালোবাসাকে ভোলা যায় না। কোনো না কোনো ভাবে ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে ঠিকই উৎপাত করতে থাকে। গানটি সবে শেষ হয়েছে। চারপাশ থেকে হৈ হৈ আওয়াজ আসছে। অভিনব সুযোগ বুঝে নেমে এলো। ঝিলের থেকে কিছুটা দূরে ওমন সময় ঝিলের বড় মামা এলেন, “রজনীর সাথে গিয়ে বসো।”

“জী মামা।”

অভিনবর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেল ঝিল। মন খারাপ হলো ছেলেটার। আয়ুষ এলো একটু বাদে। অভিনব চলে যেতে নিচ্ছিল সে সময়টাতেই ডাক পড়ে। কিছুটা এগিয়ে এসে বলে, “ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাইন্ডলি গিয়ে বসুন।”

অভিনব ডিনারে জন্য যায়। ঝিল রজনীর পাশে বসে অনেকগুলো ছবি তুলে। খানিক বাদে অভিনবর ম্যাসেজ আসে, “সময় করে একটু বাহিরে আসবেন প্রজাপতি।”

রজনীর বান্ধবীরা ঝিলকে ছাড়ছিলই না। ওরা নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। অনেকটা সময় লাগল বের হতে। অভিনব বাহিরের গেটে দাড়ানো ছিল। ঝিলকে দেখেই এগিয়ে এলো, “সুন্দর লাগছে।”

লজ্জা লাগল মেয়েটির। সাধারণত প্রশংসা শুনতে মেয়েরা অধিক পছন্দ করে থাকে। কিন্তু সে প্রশংসাটাই যখন প্রিয় মানুষটা করে তখন একটা অদ্ভুত ভালো লাগার সাথে সাথে লজ্জাও লাগে। বাইরে অনেকদূর অবধি লাইটিং করা হয়েছে। নিরলস ভাবে চলছে দুজনেই। আজকের আকাশে চাঁদ অতো সুন্দর নয়। অর্ধেক উঠেছে। তবে পরিবেশটা স্নিগ্ধ। বাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে। এপথে মানুষ কম। নেই বললেই চলে। প্রায় মধ্যরাত। সমস্ত আর্কষণ তো হলুদের অনুষ্ঠানে।
“চা খাবেন?”

মাথা দুলায় মেয়েটি। অভিনব বাজারে গিয়ে টং এর দোকান থেকে চা নিয়ে আসে। পুরো বাজারটা জনমানবহীন। এই একটা দোকানই খোলা। রাতের আঁধারে টিম টিম করে জ্বলছে একটা বাতি। হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া। দু একটা কুকুরের ডাক। কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ। ঝিলের শরীরে কম্পন ধরে গেল। অভিনব আলগা হাতে মেয়েটির ত্বক স্পর্শ করেছে। এই শিহরণে মেয়েটির যে ম রে যেতে ইচ্ছে করছে। কাকে বোঝাবে এসব?
“প্রজাপতি।”

“হু।”

“কেমন লাগছে?”

“ভীষণ ভালো।”

“আপনার শখ ছিল মধ্য রাতের আঁধারে কোনো এক গ্রামের কাঁচা সড়কে পথ চলতে চলতে চা পান করবেন।”

মেয়েটির মনে পড়ল এবার। খুব ছোট বেলায় এই শখটাও জেগেছিল ওর। সিনেমা দেখতে দেখতে নিজের জীবন নিয়ে কত কল্পনাই করত। সে সব জানে অভিনব। ডায়েরিতে সব কিছুই তো লিখা আছে। চা শেষ করে অভিনবর বাহুতে মাথা রাখল ঝিল।
“থ্যাংকস।”

“শুধু থ্যাংকস?”

মেয়েটি ভেবে পেল না আর কি দেওয়া যায়। অভিনব নিজ থেকেই জানালো কথাটি। সে সময় ঝিলের মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। ছেলেটা নিজ থেকেই টেনে নিল। ঈষৎ ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিল অধর যুগল। একে অপরের শুধা পান করে যেন তৃপ্ত হলো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা অন্তর অনল। মেয়েটি এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়।
“প্রজাপতি, আপনি প্লিজ কাছে আসবেন না। আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাই। আমার যুবক হৃদয়ের এই হাহাকার আপনি বুঝতে পারছেন না।”

এমন একটি কথা শোনার জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না মেয়েটি। প্রতিটা ভালোবাসার কোনো না কোনো পর্যায়ে শারীরিক আর্কষণ থাকে। সে দিক থেকে ভাবতে গেল ওদের দুজনের বয়সটাই মারাত্মক। ওরা যখন ফিরে এলো তখন আবার গান শুরু হয়েছে। ভীড়ের কারণে সেভাবে লক্ষ্য করেনি কেউ। ঝিল সরাসরি নিজের ঘরে চলে এলো। আজ সারারাত ই গান চলবে। আরশির সামনে দাড়িয়ে মেয়েটি হাসল। গালের এক পাশে কিছুটা হলুদ লাগানো। অভিনব লাগিয়ে দিয়েছে। ওর ইচ্ছে করছে এই হলুদ আজন্ম অবধি রেখে দিতে। কিন্তু তেমনটা সম্ভব নয়।

ভোর রাতের চিল্লাচিল্লিতে ঝিলের ঘুম ছুটে গেল। বাড়ির প্রতিটা মানুষ ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে চিন্তার ছাপ। কান্নার শব্দ ও শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কি থেকে কি হয়ে গেল। সবটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ঝিল কেবল খুঁজে যাচ্ছে। একটা শান্ত, পরিপক্ব মানুষ চাচ্ছে সে। যাকে ধরে জানা যাবে সবটা। কিন্তু তেমন কাউকেই পেল না। এই মুহূর্তে কাউকেই শান্ত দেখাচ্ছে না। একটু বাদে নজর এলো সুমাকে। বাচ্চা মেয়েটি নিজেও হয়ত বুঝতে পারছে না।
“সুমা, এদিকে এসো তো।”

“হ্যাঁ আপু।”

“আমায় একটা কথা বলো তো। সবাই এত চিন্তিত কেন! কি হয়েছে, তুমি কি জানো?”

“রজনী আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“পাওয়া যাচ্ছে না! কেন, কোথায় গিয়েছে আপু?”

“জানি না। মা বলছিল আপু নাকি পালিয়ে গেছে।”

বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল। ঝিলের দুটি চোখ একদম বিচলিত হয়ে পড়েছে। চারপাশের গন্ডগোল বেড়ে যাচ্ছে। ভোরের আলো যত বৃদ্ধি পাচ্ছে শব্দের বেগও তত ব্যকুল হচ্ছে। এসব ওর মন মস্তিষ্ককে দিশেহারা করে দেয়।
ঘটনাটা খুব দ্রুতই ঘটে গেল। ঝিলের মাথা ঘুরে গেল হঠাৎ। মেয়েটিকে ধরে বসালো একজন সার্ভেন্ট। পানি এগিয়ে দিল। সবটা শেষ করে ঝিল উঠে আসে। ঝিলের ছোট মামা রকিবুল চৌধুরী বলছেন,”পুলিশে ইনফর্ম করেছি। খোঁজ চলছে। তোমরা কি কেউ কিছু বুঝতে পারো নি?”

“তোমাদের আগেই বলেছি আমি। মেয়েটার মনে কিছু চলছিল। কোথাও একটা সমস্যা। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেসব কেউ আমলেই নিচ্ছিল না। দেখ এখন কি থেকে কি হয়ে গেল।”

রজনীর মা ডালিয়ে বেগম এবার কেঁদে ফেললেন, “আমি কি করে বুঝব? মেয়ের মা আমি। আমার সাথে তো বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়।”

“কিন্তু আপা আমি তোকে বলেছিলাম রজনীর মতামত নে। বার বার বলেছিলাম। কি বলেছিলাম তো?”

সুমতি বেগমের প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না। মেয়ে তার শিক্ষিত। স্পষ্ট করেই কথা বলে। যদি কাউকে পছন্দ করেই থাকে তবে লুকানোর কথা নয়। কি এমন ঘটে গেল যে লুকাতে হলো। আয়ুষ আর রাশিদ চৌধুরী কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা সামলে নিলেন। সব কিছু যেন ঘরের মধ্যেই থাকে এর জন্য দেওয়া হলো কড়াকড়ি নির্দেশ। রাশিদ চৌধুরী শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ। মেয়ের এই ভাবনা আগেই ধরে ছিলেন। এই নিয়ে খোলামেলা কথাও বলেছেন। যদিও এই বিষয়টা তাদের বাবা মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মেয়েটা তখন খুব বুঝদারের মতো করে কথা বলেছিল। তাই অনেকটা নিশ্চিন্তেই বিয়ের আয়োজন করেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু শেষে এমন কিছু করে বসবে ধারণাও ছিল না। রকিবুল চৌধুরী সি সি টিভি ফুটেজ দেখতে বসলেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। গত এক মাসের বাড়ির সামনের সবগুলো সি সি টিভি ফুটেজ ডিলেট করা! সবাই খুব ভালো করেই বুঝতে পারল জল খুব ভালোই ঘোলা হয়েছে। ওমন সময় একটা ভিডিও পাওয়া গেল। কাল রাতে ছেলেরা যখন নাচানাচি করছিল সেই ভিডিওতেই উঠেছে। তবে বিশেষ কিছু স্পষ্ট নয়। শুধু দেখা যাচ্ছে একটা ছেলের হাত ধরে চলে যাচ্ছে রজনী। ঝিল উপর থেকে নেমে এলো। লোকটার থেকে ফোন নিয়ে ভিডিওটা অন করল। এতে করে মেয়েটির হৃদয়ে গর্জন নেমে আসে। তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে বাহিরে। গেস্ট হাউজে কেউ নেই। সম্ভবত কাল রাতেই পোগ্রাম শেষ করে চলে গেছে সবাই। ভীষণ অসহায় লাগছে। অভিনবর নাম্বারে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ! এবার ঝিলের দুটি চোখে বর্ষণ নামে। আর্তনাদ গুলো গলায় এসে ঠেকেছে। বার বার ভাসছে ভিডিওটা। যেখানে হলুদের কাপড় পরা রজনীর মেহেদী রাঙা হাত ধরে চলে যাওয়া ছেলেটিকে চিনতে একটুও সমস্যা হয় নি ওর। ছেলেটা যে আর কেউ নয় ওর নিজের ভালোবাসা অভিনব!

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here